
চাঁদমারীর চাঁদ ব্যাপারীর বারো সন্তান (চার মেয়ে আর আট ছেলে)। এসব ছেলেমেয়ের জন্ম ১৯৬৫ সালের আগে। ১৯৬৫ সালের কথা। পাকিস্তানের সমকালীন সামরিক সরকারপ্রধান; যিনি ’৬৪-এর ভোটে অভিনয় করে বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। শোনা কথা, নিজের নাক কেটে বাঁধানো যুদ্ধ জয়ে হয়েছেন ফিল্ড মার্শাল, মৌলিক গণতন্ত্র তার এক বিশেষ প্রিয় শব্দ। গণতন্ত্রের বিশ্ব মডেলে রূপান্তরের জন্য তার খয়েরখাঁদের কাজে লাগিয়েছেন- জাতিসংঘ যদি এটি মডেল হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার তিনি পেতেও পারেন- এমন সম্ভাবনা তার চাটুকাররা হরহামেশা জানাচ্ছেন। দেশের মেধাবী আমলারা প্রেসিডেন্টকে বললেন, ‘স্যার মাথায় এক জবর বুদ্ধি আইছে, পুবের লোকেরা সব সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ, গোঁ ধরে- সব কাজে ভাগ বসাতে চায়, ভাগাভাগিতে হরহামেশা বেশিটা চায়। কারণ, তারা জনসংখ্যায় বেশি। এখন পশ্চিমের জায়গা-জমি বেশি অথচ জনসংখ্যা অনুপাতে কম। আর পুবের লোক বেশি অথচ জায়গা-জমি কম। তাই গলার জোর তাদের বেশি। এটা কমানো-থামানোর একটা ভালো উপায় আছে।’
প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন- কী?
‘পরিবার পরিকল্পনা’।
এ আবার কী? গণতন্ত্রের আগে ‘মৌলিক’ জুড়ে দিয়ে গণতন্ত্ররে যেমন নতুন সুখ ও সুরে সাধতে চাইছি, তেমনি পরিকল্পনার আগে ‘পরিবার’ জুড়ে দিয়ে পরিকল্পনারে কল্পনার বাড়িছাড়া করতে চাওয়া হচ্ছে নাকি- প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন রাখেন।
বিজ্ঞ আমলারা, যারা মেকলের ভাষায় রক্তে-মাংসে শক্তিশালী, জ্ঞান-গরিমায় চৌকস আর চালাক, চতুরতায় সুন্দরবনের বনেদি মামা সম্প্রদায়ের স্বগোত্রীয় নাম-পরিচয়ে সুশীল সেবক, কাজ-কামে প্রভু প্রভু ভাব। প্রেসিডেন্টকে বোঝালেন- মহোদয়, এটি পরিকল্পনাকে লম্বা-খাটো কিংবা বিশেষায়িত করার জন্য নয়, এটি একটি ‘পরিবার’কে সাইজ করার জন্য। পুবের দেশে পরিবার সাইজ করতে পারলে ৩০-৪০ বছরের মাথায় দেখা যাবে তারা সংখ্যায় পশ্চিমের চাইতে কমে গেছে, সংখ্যাগুরু হয়েছে সংখ্যালঘু। পশ্চিমের পরিবার সাইজ করার দরকার হবে না। কেননা, এখানে জমি-জায়গা বেশি, লোকসংখ্যা কম। তখন পুবের লোকেরা ভাগ চাওয়া-চাওয়িতে আর পেরে উঠছে না। চোখ ট্যারা আরেক কূটনৈতিক আমলা বলল, স্যার আর একটা মজার ব্যাপার ঘটবে পুবের সংসারে। প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন সেটা কী? এই আমলা সমাজতত্ত্বে বড় ডিগ্রিধারী। সে বিজ্ঞের মতো বলল, স্যার পরিবার সাইজ করার যেসব ব্যবস্থা দেওয়া হবে তা পুবের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী সংসারের লোকেরাই ব্যবহার করবে। অশিক্ষিত, বেকার ও বুদ্ধুরা ব্যবহার করবে না। কেননা, তারা ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ জাতীয় সাইনবোর্ড পড়তে পারবে না। ফলে তারা পরিবার সাইজ করবে না। অন্যদিকে শিক্ষিত পরিবারের লোকেরা পরিবার সাইজ মন্ত্র মেনে নিয়ে ছেলেমেয়ের সংখ্যা কমাবে। ফলে তাদের পরিবার থেকে সমাজে আসবে স্বল্প পরিমাণ সদস্য আর অশিক্ষিত পরিবার থেকে আসবে বেশি সদস্য। একপর্যায়ে সমাজে একটা ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির উদ্ভব হবে। সম্পন্নরা তাদের স্বল্পসংখ্যক সদস্যদের ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখবে। নইলে বিদেশে পাঠিয়ে দেবে। কেননা, বাইরের হানাহানিতে নিজেদের সন্তানদের নিরাপত্তার প্রশ্নে শঙ্কিত হয়ে উঠবে। এ রূপ পরিবেশে একসময় পুবের সংসার মেধাশূন্য হয়ে পড়বে। তখন দেখা যাবে পুবের লোকেরা রাজনীতি, শিক্ষাদীক্ষা, চাকরিবাকরিতে পশ্চিমের সঙ্গে আর পেরে উঠছে না। তখন আমরা হব আরও লাভবান, বলীয়ান ও কামিয়াব।
প্রেসিডেন্ট বললেন, আর বলতে হবে না। সাচ্চা প্রস্তাব।
ব্যাপারীর বারো সন্তানের ঘরে নাতিপুতি মিলে শ খানেক হবে। সেই সব নাতিপুতির আবার পোলাপান হয়েছে, তার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে মোটামুটি শ তিনেক। যারা আপন চাচাতো মামাতো ফুফাতো খালাতো ভাইবোন বা এক কথায় ইংরেজিতে ফার্স্ট কাজিন নামে পরিচিত। বাঙালির হাতে অনেক সময় তাই তাদের শব্দমালায় চাচাতো মামাতো ফুফাতো খালাতো কত-শত শব্দ আছে। ইংরেজের হাতে সময় কম- ‘ফার্স্ট কাজিন’ বলেই খালাসের ভেতর ওরা সবাই। ইংরেজরা যেমন ‘ইউ’ শব্দের মধ্যে তুমি, তোমরা সবাইকে ভরিয়েছে।
চাঁদ ব্যাপারী অবস্থাপন্ন মানুষ। এবারের শীতে তার শখ হলো নাতিপুতিসহ সবাইকে নিয়ে তার বিরাট বাড়িতে মাহফিল বা সম্মেলন বা মেজবান করবেন। মেয়েদের নাইওরি আনবেন। তারাও তাদের ছেলেমেয়েদের তস্য-তস্যদের নিয়ে আসবে। ব্যাপারীর বড় ছেলের বড় মেয়ের বড় ছেলে মহিবুলকে দায়িত্ব দিলেন তালিকা তৈরিতে দুই জেনারেশন পর্যন্ত কত সদস্য হয়। মহিবুল চৌকস ছেলে। পরিসংখ্যানে পড়াশোনা করছে। সে তার দাদুকে বারবার এটা-সেটা প্রশ্ন করছে। ব্যাপারী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রিকুলেট। আজকালকার নাতিপুতিদের ফেসবুক, ওয়াটসআপ, ভাইবার- এসব অত বোঝেন না। গুগল নামে কী এক সবজান্তা আছে কম্পিউটারে, তার কাছে যা কিছুই জানতে চাওয়া হোক না কেন, নিমেষের মধ্যে ওনার তথ্যভান্ডার নিয়ে হাজির। মহিবুলের প্রথম সমস্যা ফার্স্ট কাজিনদের শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে। তার চাচা-ফুফুরা সিনিয়র ফার্স্ট কাজিন আর তার নিজের মামাতো ফুফাতোরা জুনিয়র কাজিন। সে তার নানাভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে সিনিয়রদের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ এবং জুনিয়রদের নিম্নকক্ষ এমন ধরনের দুটি শ্রেণিতে ভাগ করে ফেলল। সিনিয়রদের বয়স বেশি। অনেকেরই স্বাস্থ্যগত সমস্যা। ডায়াবেটিস আছে কারও কারও। কারও কারও চোখে ছানির অপারেশন হয়েছে। খাওয়া-দাওয়ার রেস্ট্রিকশন- এসব দেখতে হবে। এরা রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, মান্না দে, আঙুর বালা, হেমন্তর গান, বড়জোর সাবিনা পর্যন্ত এদের চলে। কিন্তু জুনিয়রদের কাছে ব্যান্ড সংগীত ছাড়া চলবে না। খেতে হবে টাইগার জাতীয় এনার্জি ড্রিংস, ওয়াইফাই, ফেসবুক দেখার সুবিধা চাই- এন্তার দাবি সবার। দুই জেনারেশনের ফার্স্ট কাজিনদের এক জায়গায় করার বিস্তর ঝামেলা। মহিবুল প্রমাদ গোনে। কিন্তু তার নানাভাই যত সমস্যা দেখেন তাতে আনন্দ পান, উৎফুল্ল বোধ করেন। তিনি দেখতে চান সমাজ কীভাবে বদলাচ্ছে। কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে রুচিতে। চিন্তাচেতনার স্তরে কী কী পরিবর্তন। বোঝাপড়ায় কী বিস্তর ফাঁক।
২৭ পৌষ ঠিক হয়েছে ফার্স্ট কাজিন কনফারেন্সের। পৌষমেলার মতো, পিঠা উৎসবের মতো ব্যাপারীবাড়িতে মিলবে সবাই। ‘আগের কাজ আগে’- এই প্রতিপাদ্যের ওপর সেমিনার এবং থিম সং ঠিক করা হয়েছে ‘পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা দুপুরে সেই দিন ফিরে আর আসবে কি’- মান্না দের এই গানটি ব্যাপারীর বড় ছেলের বড় মেয়ে ময়নার খুব পছন্দ। মহিবুল এই মুহূর্তে যদিও জুনিয়র ফার্স্ট কাজিন গ্রুপ (জেএফসিজে)-এর আহ্বায়ক। তার পছন্দ একটু আধুনিক, একটু পপ, একটু বিটলস, একটু দলছুট, একটু ডিফারেন্ট টাস-জাতীয় কোনো গান।
মেলবোর্ন থেকে মল্লিকা আর তার তিন ছেলে তমাল, কামাল ও জামাল মন খারাপ করে ই-মেইল পাঠিয়েছে। স্কাইপে কথা বলেছে তারা। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া পেশের মতো। ব্যাপারী বলেছেন, সবার কথা একসঙ্গে শোনা সম্ভব নয়। আগের কাজ আগে। এ ধরনের হরেক রকম দাবি-দাওয়া লন্ডন, টরন্টো, সৌদি আরব আর কাতার-কুয়েত থেকে। চাঁদ ব্যাপারী ভাবেন- সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে তার রক্তের সম্পর্কের সবাই। বাঙালি ঘরে বসে নেই। এই বাংলাদেশের ভেতরেও জেলা-উপজেলা বাছবিচার নেই। ছাগলনাইয়া, ডোমার কিংবা গাংনী, জকিগঞ্জ, শ্যামনগর- সবখানে ব্যাপারীর কেউ না কেউ আছে।
এবার কুয়াশা বড্ড বেশি মনে হচ্ছে। লঞ্চ রাতে চলতে পারে না, স্টিমার চরে আটকে যায়। প্লেন ল্যান্ড করতে না পেরে উড়াল দিয়ে যায়, রাস্তায় ফগ লাইট জ্বালিয়েও চলতে পারে না ময়নার ড্রাইভার। সে আসছে ঢাকা থেকে। খালা-ফুফুদের শোরগোলে এলাহি কারবার। রংপুর থেকে আসছে নাসি খালার পরিবার। তার মেয়েরা বিদেশে। খালা-খালু একা আসছেন। রংপুরে শীত একটু বেশি, ওনাদের বয়সও বেশি।
কনফারেন্সে খাবার-দাবারে বৈচিত্র্য প্রত্যাশা করছেন অনেকেই। নতুনরা জাংক ফুড খেতে চাইছে, কোকাকোলা ড্রিংকস- এসব জম্পেশ জমবে। পুরাতনরা অধিকাংশই নানান রোগবাতিকগ্রস্ত। তারা ডায়েট ড্রিংক, ভেজিটেবলস খেতে এবং রেড মিট-জাতীয় খাবার না খাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। খাবার-দাবার আয়োজনকারী কমিটির প্রধান সরকারের সমাজকল্যাণ দপ্তরের পরিচালক এবং সিএফসিজির সদস্য রোমিও হক সংবাদ বন্ধুদের জানালেন- আমরা ডেলিগেটদের কাছ থেকে যেসব ফরমায়েশ পেয়েছি তাতে নানা বৈচিত্র্য লক্ষ করেছি। কেউ চেয়েছে চ্যাপা শুঁটকি আবার হ্যামবার্গার পেতে চেয়েছেন অনেকে। খেজুরের রস পেতে চেয়েছেন ২৬ শতাংশ ডেলিগেট। চিকিৎসকবন্ধুরা জানিয়েছেন নিপাহ ভাইরাসের ভয় আছে তাতে।
আমরা দুটো উপায় বিবেচনায় রেখেছি এ ব্যাপারে- (১) এই শহরের সব বাদুড়কে দুই দিনের জন্য ‘গৃহবন্দি’ (যেমন শহরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের পরিবেষ্টন করে রাখা হয়) রাখা অথবা (২) প্রতিটি রসের পাত্রের কাছে একজন করে দারোয়ান দাঁড় করিয়ে রাখা বাদুর তাড়াবার জন্য (এটিএম বুথে যেমন একজন পাহারাদার সব সময় বসিয়ে রাখা হয়)। দৈনিক টাকা-পয়সা প্রতিদিন-এর প্রতিনিধি মুখের ওপরই মন্তব্য করলেন- এতে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে যাবে না? রোমিও হক বললেন, সদস্যদের সুস্থতা আমাদের আছে অন্য অনেক কিছুর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কনফারেন্সে কোনো নাশকতামূলক কিছু ঘটা বা ঘটানোর আশঙ্কা তারা করছেন কি না- এমন প্রশ্ন রাখলেন সাপ্তাহিক সুনীতি সম্ভারের প্রতিনিধি। ব্যাপারী বললেন, এটা আপন রক্তসম্পর্কীয় স্বজনদের সম্মেলন। এখানে রাগারাগি মান-অভিমান পর্যন্ত ব্যারোমিটার উঠতে পারে, তার পর কিছু নয়। তা ছাড়া এক কারণের জন্য অন্য সব কারণকে টেনে আনার কোনো পরিকল্পনা এখানে থাকবে না। এখানে কোনো হাইব্রিড নেতৃত্ব, সংস্কারবাদী কিংবা ফরমালিনযুক্ত মনোভাবের কারও সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্ভাবনা দেখছি না। সেহেতু আমার মনে হয় না এখানে নাশকতার কোনো আশঙ্কা থাকবে।
লেখক: সাবেক সচিব এবং
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান