
বিপ্লবী ছাত্র-জনতা কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে নিজেদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারসম্পন্ন রাষ্ট্র পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হইলাম।...
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সব রাজনৈতিক দলসহ জনগণের একটি প্রত্যাশা ছিল রাষ্ট্র সংস্কারের রোডম্যাপ ঘোষণার। কিন্তু সেটি ঘোষিত হয়নি। যে রোডম্যাপটি ঘোষিত হওয়া অত্যাবশ্যক ছিল সেটি আমার প্রস্তাবনায় নিম্নরূপ হতে পারত:
জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ও অন্তর্বর্তী সরকারকে সাংবিধানিক ভিত্তি প্রদান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের রোডম্যাপের রূপরেখা:
১. ‘প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশন’ বা ‘বিপ্লবের ফরমান’ জারি করে অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা।
২. প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশনে হাসিনা সরকারের পতন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকে ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান’ তথা ‘বিপ্লব’-এ রূপান্তরিত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া।
৩. ‘সফল বিপ্লব’-এর ফলে বিদ্যমান সংবিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে অবলুপ্তি হওয়া বিবেচনা করা।
৪. প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশনের ক্ষমতায় একজন নতুন রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন করা।
৫. স্বৈরাচার সরকার কর্তৃক সৃষ্ট রাষ্ট্রীয়, বিচারিক ও আর্থিক সব প্রতিষ্ঠানের বিশৃঙ্খলার সংস্কার সাধন করা।
৬. প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশনের অধীনে সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করা।
৭. নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যদের দ্বারা নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা।
৮. নতুন সংবিধানের অধীনে সংসদের নির্বাচন করা।
৯. রাষ্ট্রপতির আহ্বানে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দ্বারা সরকার গঠন করা।
১০. নতুন সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ও অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার বিলুপ্ত করা।
এই রোডম্যাপের ভিত্তিতে যে ‘প্রোক্লামেশন অব রেভ্যুলিউশন’ ঘোষিত হতে পারত সেটি নিম্নরূপ-
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
যেহেতু ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে শুরু হওয়া একটি ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করিয়াছে এবং উহার গণপরিষদ গঠন করিয়া ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসের ৪ তারিখে রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নপূর্বক উহা ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর হইতে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে গ্রহণ করিয়াছে;
যেহেতু সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং ১১ অনুচ্ছেদের বিধানে এই মর্মে অঙ্গীকার ও নিশ্চয়তা বিধান করা হইয়াছিল যে, রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে;
যেহেতু রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সভাপতিরূপে শেখ হাসিনা নবম সংসদে নির্বাচিত হইয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকার গঠন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীরূপে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার মানসিকতায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সহায়তায় নির্বাচনব্যবস্থা কলুষিত করিয়া ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন এবং সরকারের সর্বময় ক্ষমতা নিজ হস্তে কুক্ষিগত করেন;
যেহেতু শেখ হাসিনা ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি হইতে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়কালে সরকার পরিচালনাকালীন সর্বগ্রাসী দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অবকাঠামোয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিয়া গণতন্ত্রহীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচারব্যবস্থা অকার্যকরক্রমে নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রকে অকার্যকর করিয়া এক অমানবিক ও নীতি-নৈতিকতাবিহীন স্বৈরাচারী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন; যেহেতু সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সংবিধানে ত্রয়োদশ, চতুর্দশ, পঞ্চদশ ও ষষ্ঠদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশ অসংশোধনযোগ্য রূপে কঠোর বিধান করিয়া ভবিষ্যতের সকল সংসদকে অকার্যকর করিয়া রাখিয়াছিলেন; যেহেতু বাংলাদেশের সকল কার্যকরী বিরোধী দলের সদস্যরা চরম অমানবিক নিষ্পেষণের শিকার হইয়া শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিতে অস্বীকৃত হওয়ায় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট প্রদানে বিরত থাকে, যাহার ফলে নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সরকার পরিবর্তন অসম্ভব হইয়া পরে;
যেহেতু বিগত পনেরো বছর এক অমানবিক, অনৈতিক, বিচারহীন অগণতান্ত্রিক সমাজে জনগণ মতপ্রকাশে বিপদাপন্ন ছিলেন ও শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় বসবাস করিতেছিলেন; যেহেতু জুলাই-আগস্ট ২০২৪ মাসে ছাত্র-জনতা এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের মাধ্যমে যে সফল বিপ্লব ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান সংঘটন করেন এবং যাহার দমনে শেখ হাসিনার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচারে প্রাণঘাতী গুলিবর্ষণে সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার জীবনহানি করিয়াছে; যেহেতু এই সফল বিপ্লবের ফলে ৫ আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি বরাবরে পদত্যাগ করিয়া পলায়ন-প্রক্রিয়ায় দেশত্যাগ করিলে দেশ সরকারবিহীনতায় পতিত হয় এবং সংসদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয় এবং যেহেতু বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের সর্বময় ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং সেই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণের পক্ষে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে বিপ্লবী ছাত্র-জনতার দ্বারা আমরা মনোনীত হইয়া বিপ্লবী পরিষদ গঠন করিয়াছি; সেহেতু বিপ্লবী ছাত্র-জনতা কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে নিজেদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি অন্তর্বর্তী বিপ্লবী সরকার গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারসম্পন্ন রাষ্ট্র পরিচালনায় অঙ্গীকারবদ্ধ হইলাম। আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, জুলাই-আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আন্দোলনটি একটি সফল বিপ্লব হিসেবে পরিসমাপ্ত হইয়াছে।
আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, ঘোষিত সফল বিপ্লবের ফলে ১৯৭১ সালে গঠিত গণপরিষদ কর্তৃক ৪ নভেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রবর্তিত ও ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে গৃহীত বাংলাদেশের সংবিধান, উহার ষোলোটি সংশোধনীসহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হইয়া যাওয়ায় বর্তমানে উক্ত সংবিধানের কোনো আইনগত কার্যকারিতা ও অস্তিত্ব নাই। আমরা ঘোষণা করিতেছি যে, আমরা বাংলাদেশের জন্য একজন রাষ্ট্রপতি মনোনীত করিব এবং ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি প্রয়োগ করিবেন এবং তিনি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হইবেন।
আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, স্বৈরাচার সরকার কর্তৃক রাষ্ট্রীয়, বিচারিক ও আর্থিক সকল প্রতিষ্ঠানে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হইয়াছে আমরা তাহার সংস্কার সাধন করিব। আমরা আরও ঘোষণা করিতেছি যে, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য আমরা সুবিধাজনক সময়ে গণপরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিব এবং উক্ত গণপরিষদ দ্বারা প্রণীত সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করিব। আমরা দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করিতেছি যে, নির্বাচিত সংসদ দ্বারা গঠিত সরকারের নিকট আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর করিব ও তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের বিপ্লবী পরিষদের অবলুপ্তি ঘটিবে।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, এই ঘোষণাপত্র ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট দুপুর ২টা ৩১ মিনিট হইতে কার্যকর হইয়াছে মর্মে বিবেচিত হইবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস
(উপদেষ্টা পরিষদের অনন্য সদস্য)
বিপ্লবী ছাত্র-জনতার মনোনয়নে ক্ষমতাপ্রাপ্ত বিপ্লবী পরিষদ।
বঙ্গভবন, ৮ আগস্ট ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ।
ইতোমধ্যে অনেকটা সময় চলে গেলেও সময় একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। বর্তমান সরকারের বৈধতাসংক্রান্ত বিষয় হওয়ায় ভবিষ্যতের সব জটিলতা এড়ানোর জন্য এখনই এই ‘বিপ্লবের ফরমান’ জারি করা আবশ্যক। নতুবা সমগ্র জাতিকে পস্তাতে হতে পারে।
লেখক: বিচারপতি
(বি. দ্র.: ভাষারীতি ও মতামত লেখকের নিজস্ব।)