
ভারতজুড়ে নিম্ন আদালতের রায়ে রাজ্যশাসকের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠছে। উত্তরপ্রদেশে নতুন করে উঠে আসা মন্দির-মসজিদ বিতর্কে সেখানকার নিম্ন আদালতগুলোর ভূমিকা, আরএসএস-বিজেপির মুসলমান বিদ্বেষকেই সিলমোহর দেওয়া। কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় গত আগস্টে ধর্ষিতা হওয়ার পর খুন হওয়া চিকিৎসককে ঘিরেও নিম্ন আদালতের রায় কী হতে পারে, সে সম্পর্কে রায় ঘোষণার অনেক আগে থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে আগত রায় সম্পর্কে একটা অনাস্থার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
আর জি করের ঘটনা কেবল পশ্চিমবঙ্গে নয়। গোটা ভারতে, এমনকি বহির্বিশ্বেও বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। গোটা ঘটনায় যে ধরনের খবর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ভেতর দিয়ে সাধারণ মানুষ জানতে পারছিল, তাতে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল- এটা নিছক কোনো ধর্ষণ বা খুনের ব্যাপার ছিল না। গোটা অপরাধের সঙ্গে একটা বৃহত্তর ঘটনার সংযোগের সংকেত সব রকমভাবে উঠে এসেছিল। সাধারণ মানুষ নানান কার্যকারণ সূত্রে এটা মনে করেছিল যে, ওই ছাত্রী চিকিৎসক হয়তো এমন অনেক দুর্নীতির বিষয়ে জেনে ফেলেছিলেন, যার জন্য তাকে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হয়।
আর জি কর-পর্ব ঘিরে এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ পশ্চিমবঙ্গে দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে নারীরা যেভাবে রাত জেগে আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান করেছেন, জমায়েত হয়েছেন, জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা অনশন করেছেন। সেসব কিছুর ভেতর দিয়েই পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভয়াবহ দুর্নীতির ব্যাপারটা প্রায় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আর এই দুর্নীতির সঙ্গে আপস করতে না পারাই যে ওই নারী ডাক্তারের প্রাণ দেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ, সেটাও সাধারণ মানুষ বুঝে নিতে দেরি করেনি।
এ রকম একটা অবস্থায় দ্রুত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে ফাস্ট ট্রাক কোর্টে বিচার করে, তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বিচারক ঘোষণা করেছেন। আর জি কর-পর্বে সাধারণ মানুষের ভয়াবহ ক্ষোভ তৈরি হয়েছে রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের ওপর। ওই ঘটনা ঘিরে রাজ্যের শাসক দলের ভূমিকা এতটাই সন্দেহজনক যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ঘটনার সঙ্গে শাসক দলের সংযোগ আছে কি না, তা ঘিরেও প্রশ্নটা ক্রমশ জোরালো হতে থাকে। এটি যদি একটি সাধারণ অপরাধের ঘটনা হয়েই থাকে, একজন সিভিক ভলান্টিয়ার যদি এই ধর্ষণ ও খুনের সঙ্গে একমাত্র যুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার এবং শাসক দল গোটা ঘটনাকে এভাবে ধামাচাপা দিতে চাইল?
ওই ছাত্রী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার সঙ্গে যদি কোনো রকম বৃহত্তর ষড়যন্ত্র না-ই থাকে, এটি যদি কেবল একজন সিভিক ভলান্টিয়ারের দ্বারা সংঘটিত একটি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে কেন শাসক দল, বিশেষ তৎপরতায় শবদাহের ঘটনাটি ঘটাল? শবদাহের সময় যাতে কোনো অবস্থাতেই কোনো সমস্যা তৈরি না হয়, তার জন্য শাসক দলের একজন বিধায়ক পর্যন্ত উপস্থিত রইলেন। ঘটনাগুলো কি শাসক দলের সংযোগই হোক বা অন্য কোনো বৃহত্তর ষড়যন্ত্রই হোক, সেই সব সন্দেহের দিকে আঙুল দেখাচ্ছে না?
আর জি কর-পর্ব ঘিরে যখন আন্দোলন তুঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি ঘিরে প্রথম অবস্থায় সেভাবে কোনো মন্তব্য করেননি। অথচ ভারতীয় রাজনীতিতে প্রগলভ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যথেষ্ট পরিচিতি আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ থেকে প্রথমে মৃতের পরিবারকে একটা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। মৃতের পরিবার এক কথায় সেই টাকা প্রত্যাখ্যান করে। ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন তারা। দল-মতনির্বিশেষে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা, এমনকি তার মধ্যে বহু ক্ষেত্রে শাসক তৃণমূল শিবিরের মানুষও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারা যেভাবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে রাজপথ দখল করেছিলেন, লড়াইয়ের সংকল্পে দৃঢ় ছিলেন, এমনটা সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গে আগে কখনো ঘটেনি।
আন্দোলনের রেশ ঘিরেই জুনিয়র ডাক্তারদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার নানা অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি এবং তাদের সহকর্মীর এই হত্যাকাণ্ড, সব নিয়ে কলকাতার রাজপথে আমরণ অনশন করেছেন। সেই অনশন ঘিরে মুখ্যমন্ত্রী বাধ্য হয়েছিলেন আন্দোলনরত ডাক্তারবাবুদের রাজ্য সরকারের প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয় নবান্নে ডেকে পাঠিয়ে আলোচনা করতে। সেখানে উভয়ের মধ্যে মতবিনিময় হয়। আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা যেভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে ডাক্তারি পরীক্ষা থেকে শুরু করে গোটা চিকিৎসাব্যবস্থার দুর্নীতির বিষয়টি সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীর সামনে তুলে ধরেন, আর তার লাইফ স্ক্রিনিং হয় সংবাদমাধ্যমে, তাতে বেআব্রু হয়ে পড়ে গোটা রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্য দপ্তরের দায়িত্বে রয়েছেন ২০১১ সাল থেকে।
আদালতের নির্দেশে তদন্তভার যায় সিবিআইয়ের হাতে। সিবিআই আর জি কর হাসপাতালে ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সময় যিনি অধ্যক্ষ ছিলেন সেই সন্দীপ ঘোষকে গ্রেপ্তার করে এবং টালা থানার তৎকালীন আইসিকে গ্রেপ্তার করে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করে। আইনি জটিলতার জালে মামলার দীর্ঘসূত্রতা সত্ত্বেও মামলাটি এখনো ভারতের সুপ্রিম কোর্টে চলছে।
আর জি কর ঘিরে সিবিআই তদন্তভার গ্রহণ করে কতখানি সাফল্যের মুখ দেখানোর চেষ্টা করেছে, তা নিয়ে কিন্তু নিম্ন আদালতের রায়ে সিভিক ভলান্টিয়ারের শাস্তি ঘোষণার আগে থেকেই সাধারণ মানুষ সন্দিহান হতে শুরু করে। কারণ, আর জি করের সাবেক অধ্যক্ষ এবং টালা থানার সাবেক আইসি আদালত কর্তৃক জামিন পেয়ে যায় সিবিআই সময়মতো চার্জশিট না দেওয়ায়। সন্দীপ ঘোষ যে আর জি কর-কাণ্ডে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অন্যতম অংশীদার, এটা আদালতের নানান তথ্য-প্রমাণের দ্বারা এখন পর্যন্ত প্রমাণিত না হলেও সাধারণ মানুষ, সংবাদমাধ্যম- সব মিলিয়ে যা খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সন্দীপ ঘোষের সম্পৃক্ত না থাকার বিষয়টি বিশ্বাস করাই এখন কার্যত অবিশ্বাস্য।
আর জি করের ছাত্রী চিকিৎসকের ধর্ষণ, খুনের ঘটনাটিকে প্রথম পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল এবং মুখ্যমন্ত্রী খুব মামুলি একটা বিষয় হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। এ ঘটনার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, তাকে নানা ধরনের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের চেষ্টা করেছে গোটা শাসকশিবির। কিন্তু নিম্ন আদালতের রায় প্রকাশিত হওয়ার পর, স্বভাবসুলভ রাজনৈতিক ক্ষিপ্রতায়, সাধারণ মানুষের ক্ষোভের ফসলটিকে নিজের ঝুলিতে ভরতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই সিভিক ভলান্টিয়ারের ফাঁসি দাবি করেছেন। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, তারা নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাবেন।
বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড ঘিরে এখন একটা ভিন্ন মতামত তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সঞ্জয় রায়ের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে যে ধরনের কথাবার্তা সংবাদমাধ্যমে বলছেন, সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মমতা চাইছেন গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঘিরে যে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগ, তার থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে। মমতা চাইছেন- মৃত ছাত্রীর প্রতি সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা এবং তার হত্যার বিচারের দাবিতে গণমানুষের মধ্যে যে চেতনা, তাকে কীভাবে রাজ্যের শাসক তৃণমূলের দিকে স্থানান্তরিত করা যায়।
সে কারণেই তিনি সন্দীপ ঘোষ সম্বন্ধে একটাও শব্দ উচ্চারণ না করে, সিবিআই সম্বন্ধেও সেভাবে কোনো কথাবার্তা না বলে, সঞ্জয় রায়ের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন। বিষয়টির মধ্য দিয়ে মমতা বোঝাতে চাইছেন, এই হত্যাকাণ্ড কোনো বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ নয়। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঞ্জয় ছাড়া আর কারও কোনো যোগাযোগ ছিল না। মমতা বোঝাতে চাইছেন, এই হত্যাকাণ্ড একটা সম্মিলিত উদ্যোগে হয়েছে বলে সাধারণ মানুষের মধ্যে সংবাদ মাধ্যমের ভেতর দিয়েই যে ধারণা তৈরি হয়েছে সেই ধারণা ভুল। বৃহত্তর সব রকমের ষড়যন্ত্রের সম্পর্কে সংবাদমাধ্যম যেসব খবর পরিবেশন করেছে তা ভুল, এটাই বোঝাতে চান মমতা। নিজের বিরুদ্ধে, তার সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ এভাবেই রাজনৈতিক স্তরে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে সঞ্জয় রায়ের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন মমতা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
[email protected]