
গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর পর তা বাস্তবায়নের জন্য এক চূড়ান্ত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। এখন গাজা যুদ্ধবিরতি বহাল থাকবে কি না, সে সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিধাগ্রস্ত মন্তব্য খুবই উদ্বেগজনক বলে মনে হচ্ছে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেছিলেন, এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে বলে তিনি আত্মবিশ্বাসী নন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘এটি আমাদের যুদ্ধ নয়। এটি তাদের যুদ্ধ’। তার এমন অবস্থান নেওয়াটা বিভ্রান্তিকর, যিনি ১৫ মাস যুদ্ধের পর যুদ্ধবিরতির কৃতিত্ব দাবি করেছেন। তিনি বলেছেন, তার শপথ গ্রহণের আগে জিম্মিদের মুক্তি না দিলে ‘সব নরক ভেঙে পড়বে’।
একই সময়ে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফ ঘোষণা করেছেন, তিনি শিগগিরই ‘একটি পরিদর্শন দলের’ অংশ হতে এই অঞ্চলে ভ্রমণ করবেন- যারা যুদ্ধবিরতি মেনে চলা নিশ্চিত করবে।
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার পদক্ষেপের ফলে ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের মিশ্র সংকেত আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। গত বছর ফিলিস্তিনি গ্রামবাসীদের ওপর সহিংস বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণের জন্য বাইডেন প্রশাসন এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের নির্বাহী আদেশ এমন একসময়ে এসেছিল যখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ করছিল এবং তাদের সম্পত্তিতে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল।
জেনিন শরণার্থী শিবিরে প্রাণঘাতী অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে তাদের আক্রমণ আরও তীব্র করে তোলে। জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের মতে, এই শিবিরে যেখানে ইতোমধ্যেই ২ হাজার পরিবারকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। সেখানে ক্রমাগত অভিযানের ফলে ‘প্রায় বসবাসের অযোগ্য’ হয়ে পড়েছিল। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের এক দিন পর ইসরায়েল পশ্চিম তীরে আয়রন ওয়াল নামে ‘বিস্তৃত’ সামরিক অভিযান শুরু করে, যা স্পষ্টতই ওয়াশিংটনের পদক্ষেপের কারণেই উৎসাহিত হয়েছিল। এদিকে ট্রাম্প প্রশাসনের জাতিসংঘে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এলিস স্টেফানিক তার কংগ্রেসনাল নিশ্চিতকরণ শুনানিতে বলেছেন, অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের দখল করার অধিকার রয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের কিছু বিশেষজ্ঞ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডকে গাজা যুদ্ধবিরতি থেকে বিভ্রান্ত করার একটি উপায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার ডানপন্থি সদস্যরা তীব্রভাবে বিরোধিতা করেছিল, যারা যুদ্ধবিরতিকে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখেছিল। এটা সত্য, যুদ্ধবিরতির আগে ইসরায়েল আক্রমণ এবং ড্রোন হামলা করেছিল।
এটি কেবল একটি বিমুখী কৌশল নয় বরং এটি একটি কৌশলগত লক্ষ্যকে প্রতিফলিত করে। শেষ পর্যন্ত তাদের ইচ্ছা পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করা। তেল আবিব এখন অনুভব করে ট্রাম্পের ইসরায়েলপন্থি প্রশাসনের কাছ থেকে এর অনুমোদন পেতে পারে। ইসরায়েলের পরবর্তী রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবিসহ তার প্রশাসনের কয়েকজন ট্রাম্প বাছাই করেছেন, যারা পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের ‘দাবি’র পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন।
ইসরায়েল যদি পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করে, তবে এটি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করবে এবং দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের সমাপ্তি ঘটাবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলোতেও দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের বিষয়টি প্রতিফলিত করতে আন্তর্জাতিক ঐকমত্য রয়েছে। দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। নেতানিয়াহু বারবার তা প্রত্যাখ্যান করলেও ট্রাম্প তা পুনর্নিশ্চিত করা থেকে বিরত থাকেন। গত সপ্তাহে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস সময়োপযোগী সতর্কতা জারি করেছিলেন যখন তিনি দাভোসে বলেছিলেন, সংযুক্তিকরণ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হবে।
এদিকে গাজায় বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা তাদের ধ্বংস হওয়া বাড়িতে ফিরে যেতে শুরু করেছে। গাজা ধ্বংসের পুরো মাত্রা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গাজায় বোমায় বিধ্বস্ত ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও লাশ পাওয়া গেছে। এসব লাশ পাওয়ায় ১৫ মাসের যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজারের বেশি। জীবন ধীরে ধীরে আবার শুরু করলেও গাজা ধসে পড়া অবস্থায় পর্যাপ্ত পরিষেবা পেতে সময় লাগবে। এখনো গাজা ধ্বংসস্তূপে পড়ে আছে। জরুরি প্রয়োজন মেটাতে মানবিক সহায়তা ঢেলে দেওয়া হয়েছে। গাজা পুনর্গঠনের জন্য ব্যাপক মানবিক ও পুনর্গঠন প্রচেষ্টা এবং সম্পদের পাশাপাশি স্থায়ী শান্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
যুদ্ধবিরতি থাকা অবস্থাতেও গাজার সামনে ভয়ংকর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে তিনটি ধাপের কথা বলা হয়েছে। প্রথমটি ছয় সপ্তাহ ধরে চলবে; যার মধ্যে ইসরায়েলি জিম্মি এবং ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময় হবে, যা এখন চলছে। ইসরায়েলি বাহিনীকে জনবহুল এলাকা থেকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং গাজায় মানবিক সহায়তার অনুমতি দিতে হবে।
প্রথম পর্বের ১৬ দিনের মধ্যে আলোচনা শুরু হবে, যা দ্বিতীয় পর্বের জন্য আরও চ্যালেঞ্জিং হবে। দ্বিতীয় পর্বে এই বন্দিবিনিময় অব্যাহত রাখতে হবে। ইসরায়েলি সৈন্যদের গাজা থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার করতে হবে এবং যুদ্ধের স্থায়ী সমাপ্তিতে সম্মত হতে হবে। তৃতীয় ধাপে গাজার পুনর্গঠন হতে হবে। প্রথম পর্বে যুদ্ধবিরতি বহাল রাখার পাশাপাশি দ্বিতীয় পর্বে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি মেনে চলার উভয় পক্ষের সক্ষমতা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি এবং এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য হবে। ওয়াশিংটনের পাশাপাশি কাতার এবং মিসরের থাকবে অন্যতম গ্যারান্টার। ইসরায়েলের ওপর মার্কিন চাপ অব্যাহত না থাকলে চুক্তির ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ট্রাম্পের অভিষেক-পরবর্তী মন্তব্য এ ক্ষেত্রে উৎসাহব্যঞ্জক নয়।
অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, তিনি প্রথম মেয়াদের স্বাক্ষরিত মধ্যপ্রাচ্যের উদ্যোগে ২০২০ সালের আব্রাহাম অ্যাকর্ডস- যা আরব রাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের বিষয় জড়িত ছিল তা প্রসারিত করতে আরও আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। ট্রাম্প এখন সৌদি আরবকে আব্রাহাম চুক্তিতে আনার দিকে নজর দিয়েছেন। তার অভিষেকের পর তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, এটি নিশ্চিত ঘটবে। কারণ গাজায় যুদ্ধ শুরু হলে রিয়াদ এ বিষয়ে আলোচনায় বিরতি নেয়।
পরবর্তীকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়, ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণের জন্য ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সমাধান তখনই সম্ভব হবে, যখন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের একটি বিশ্বাসযোগ্য পথ পাওয়া যাবে। ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানের জন্য ট্রাম্পের পক্ষে এটি কী যথেষ্ট নয়, যার জন্য তিনি কখনো কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই স্থিতিশীলতা আসতে পারে না।
এখনো মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ভারসাম্যের মধ্যে ঝুলে আছে। এমনকি পশ্চিম তীরের কিছু অংশ সংযুক্ত করার ইসরায়েলি যেকোনো প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক চুক্তির লঙ্ঘন হবে। তাই যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্তে ইসরায়েল পিছু হটতে পারে। ফলে আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
ডন থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদুল ইসলাম সকাল