
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের রাখাইন রাজ্য এখন আরাকান আর্মির দখলে। মায়ানমার সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে আরাকান আর্মি সেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। আরাকান আর্মি রাখাইন জনগণের স্বার্থ রক্ষা নিশ্চিতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় ক্ষমতা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বিকল্প প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করেছে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, প্রশাসন, শিক্ষা ও পুনর্গঠন ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রাখাইনের আপাত দখল নেওয়ার পর আরাকান আর্মি বর্তমান পরিস্থিতি রাজনৈতিকভাবে সমাধানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং সে জন্য তারা রাজনৈতিক সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার নীতি মেনে আলোচনার দরজা খোলা রেখেছে। মায়ানমার জান্তা রাজনৈতিকভাবে এই সংকট সমাধান না করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সামরিকভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চাইলে রাখাইনে আরও ধ্বংস ও মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাও রয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। রাখাইনের পরিস্থিতির অবনতি হলে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও রাখাইনে মানবিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
রাখাইন রাজ্য ভূকৌশলগত ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে মায়ানমার জান্তা রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মির কাছ থেকে পুনরায় দখলের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন, স্থলভাগে সৈন্য সমাবেশ এবং বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান দিয়েও ব্যাপক আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। রাজনৈতিকভাবে এই সংকটের সমাধান না করে জান্তা আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তা ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বহু প্রাণহানি ও মানবিক সংকট সৃষ্টি হবে।
মায়ানমারের বিমানবাহিনীতে ১০ জানুয়ারি রাশিয়ার কাছ থেকে ছয়টি সুখোই বিমানের উন্নত সংস্করণ এসইউ-৩০ এসএমই যুদ্ধবিমান যুক্ত হয়েছে। মায়ানমার জান্তা বিদ্রোহীদের মোকাবিলা করতে তাদের বিমান সক্ষমতা জোরদার করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জান্তা তাদের যুদ্ধকৌশলেও পরিবর্তন এনেছে এবং বিদ্রোহীদের ওপর আক্রমণে চীন ও রাশিয়ার সহায়তায় নির্মিত ড্রোন আর জ্যামার ব্যবহার শুরু করেছে। আরাকান আর্মিকে দুর্বল করতে মায়ানমার জান্তা এই যুদ্ধবিমানগুলো ব্যবহার করতে পারে। এর পাশাপাশি আরাকান আর্মির ক্যাম্পগুলো ধ্বংস করতে তারা ড্রোন হামলাও চালাতে পারে। রাখাইনে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে এগুলো ব্যবহার করা হলে সংঘর্ষের তীব্রতা বাড়বে এবং তা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে পরিণত হবে।
রাখাইনে যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবে। মায়ানমার সেনাবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পারলে এবার আরাকান আর্মির সদস্যরাও বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে। এর আগেও আরাকান আর্মির আক্রমণে টিকতে না পেরে মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে তাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। মায়ানমার আর্মির পাল্টা আক্রমণে আরাকান আর্মির সদস্যরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়লে তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে জটিলতার সৃষ্টি হবে।
আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে গেলে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশেরও আশঙ্কা রয়েছে। সামনের দিনগুলোর পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও সেনা মোতায়েনের বিষয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে বাংলাদেশ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য কূটনৈতিক উপায়ে মায়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। এ ছাড়া রেডক্রসসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে হবে, যাতে পরিস্থিতি বিবেচনায় তারা রাখাইনে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে।
বাংলাদেশও মায়ানমারের চলমান সংকটের কারণে নিরাপত্তা ও অন্যান্য ধরনের চাপে রয়েছে। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ কীভাবে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। চলমান অপারেশন ১০২৭-এ রোহিঙ্গা এলাকাগুলোতে আরাকান আর্মি চাঁদাবাজি ও লুটপাট চালিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। সামরিক জান্তা কিছু রোহিঙ্গাকে সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। রোহিঙ্গা রাখাইন সম্পর্ক উন্নয়নে এর প্রভাব পড়েছে ও পড়বে।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ে পরিপূর্ণ সমাধান খুঁজতে গেলে বাংলাদেশকে আরাকান আর্মির সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশ মায়ানমার সীমান্ত নিরাপত্তা, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ও মাদক-চোরাচালান ঠেকানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখন আরাকান আর্মিই প্রভাবশালী শক্তি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আরাকান আর্মি এখনো তাদের অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। তারা স্পষ্ট বলছে, এটি সামরিক নয়, রাজনৈতিক বিষয়। রাখাইনে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরই তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে মায়ানমার সেনাবাহিনীকে সমর্থন করা সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীদের শনাক্ত করে তাদের নির্মূল বা বিচারের আওতায় আনা হবে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে রোহিঙ্গাদেরও এক হতে হবে। বাংলাদেশের ভেতরে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা নানা মত ও দলে বিভক্ত। আরাকান আর্মি মিডিয়ায় রোহিঙ্গারা তাদের বিরুদ্ধে মায়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করছে বলে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে বাস্তব পরিস্থিতি কি তা জানিয়ে দিতে কোনো প্রচারণা নেই। এর ফলে সাধারণ রাখাইন জনগণের মনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ বাড়ছে। এতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যেতে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। ১৬ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলিসংক্রান্ত হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং তাদের সংঘবদ্ধ থাকার পরামর্শ দেন। মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে এখনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছে এবং গত দেড় থেকে দুই বছরে প্রায় ৬০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
মায়ানমার সরকার ২০২৫ সালে মায়ানমারে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং এই নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে মায়ানমারে জনশুমারির কাজ শুরু হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক শাসকদের ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল হিসেবে ২০২৫ সালে এই নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে। আসিয়ান ১৯ জানুয়ারি মায়ানমারের জান্তা সরকারকে চলমান গৃহযুদ্ধের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করার আগে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা জরুরি এবং বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নির্বাচণের পরিকল্পনা অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নয় বলে জানায়। রাখাইনে নির্বাচন হলে আরাকান আর্মি বিজয়ী হবে এবং তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে।
বাংলাদেশ গত ৪ জানুয়ারি, মায়ানমারের ৭৭তম স্বাধীনতা দিবসে নিয়মিত কূটনীতি চর্চার অংশ হিসেবে জান্তা সরকারের কাছে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠায়। বাংলাদেশ জান্তা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখলেও এনইউজি কিংবা আরাকান আর্মির সঙ্গে এখনো যোগাযোগ স্থাপন করেনি। আরাকান আর্মিকে বাদ দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং রোহিঙ্গ সংকট সমাধান করা যাবে না। প্রতিবেশী চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড এবার জান্তাকে শুভেচ্ছা না জানালেও এই দেশগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষায় মায়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।
বর্তমানে আরাকান আর্মি রাখাইন অঞ্চলের বিদেশি বিনিয়োগ, ব্যবসা ও প্রকল্পের সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে রাজনৈতিক উপায়ে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের চলমান সংঘাত নিরসনে আরাকান আর্মি প্রস্তুত। আরাকান আর্মি তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চীন, ভারত ও অন্যান্য বিদেশি বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রগুলোকে তাদের বিনিয়োগের সর্বোত্তম সুরক্ষা এবং সহযোগিতা করবে বলে জানায়। তারা রাখাইন অঞ্চলের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে সহায়তাকারী সব বিদেশি বিনিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছে।
আরাকান আর্মি ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু বাংলাদেশ সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারেনি। সে সময় আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছিল। আরাকান আর্মি প্রধান জেনারেল তোয়াই ম্রা নাইং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যেকোনো ধরনের সহযোগিতায় আরাকান আর্মি প্রস্তুত বলে জানায়। নানা কারণে ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট ও আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপন না করায় নিজস্ব স্বার্থ নিশ্চিতে পিছিয়ে পড়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চলমান পরিস্থিতিতে এই ভুলগুলো শুধরে নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
ভারত ও চীন তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য আরাকান আর্মির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এমন কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়নি। বাংলাদেশকে আরাকান আর্মির সঙ্গে এ ধরনের যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। কূটনৈতিক চ্যানেলের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ নানাভাবে তাদের প্রয়োজনে এ ধরনের যোগাযোগ করে থাকে। বাংলাদেশকেও নিজস্ব স্বার্থ রক্ষায় আরাকান আর্মির সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে এবং একই সঙ্গে জান্তার সঙ্গেও সম্পর্ক চলমান রাখতে হবে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে মায়ানমার জান্তা ও আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। সামনের দিনগুলোতে মায়ানমার জান্তা, আরাকান আর্মি এবং রাখাইনের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় কী তা দ্রুত নির্ধারণ করতে হবে এবং এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতি থাকতে হবে। বাংলাদেশকে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে রাখাইন পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নতুন নীতি প্রণয়নের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রণীত নীতির ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মায়ানমার সম্পর্ক, রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ এবং রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এমফিল (অব.)
মায়ানমার ও রোহিঙ্গাবিষয়ক গবেষক