
বর্তমানে নানামুখী সমস্যায় বৈশ্বিক আর্থসামাজিক অবস্থা সংকটজনক। এ সংকট খুব শিগগির দূরীভূত হওয়ার নয়। দেশে ডলারসংকটের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সুদের হার, পণ্য আমদানি-রপ্তানি, রাজস্বসহ কোনো সূচকেই সন্তোষজনক অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মুদ্রাবাজারেও অস্থিরতা বিদ্যমান। এমতাবস্থায় বিরাজমান বিশ্বমন্দা ও সংকট কেটে যাওয়ার আশা থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। অধিকন্তু বিশ্বরাজনীতি জটিল থেকে জটিলতর রূপ নিচ্ছে।
নানা কারণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে খুব দুর্বল অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বৃদ্ধির সঙ্গে শেয়ারবাজারের সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে শেয়ারবাজার নিম্নমুখী এবং কেনাবেচা ঠিকমতো হচ্ছে না। বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারের অবস্থা তুলনামূলক ভালো একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত নাজুক এবং মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো যাচ্ছে না।
বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে না পারলে রিজার্ভ-রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় ছাড়াও রাজস্ব ও ব্যাংক খাত নিয়ে যে ভয়াবহ উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন হবে। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসাই হবে নতুন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ব্যাংক বা অন্য কোনো খাতে যেন কাঠামোগত সংকট দেখা না দেয়। বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রেও যেন কোনো সমস্যা তৈরি না হয়।
বর্তমানে রীতিমতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক চলছে। কিছু ব্যাংক অনেক আগেই তাদের পুরোপুরি সক্ষমতা হারিয়েছে। অনেক ব্যাংককে অন্যদের সঙ্গে একীভূত কিংবা গুটিয়ে ফেলতে হচ্ছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বিগত সরকার আইএমএফ ও অন্য দাতাদের কাছ থেকে যেসব সংস্কারের শর্তে ঋণ নিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে শঙ্কা তৈরি হতে পারে।
কাজেই বড় ধরনের কোনো সংস্কার ছাড়া অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে। অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে নির্বাচনের পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে, তার ওপর অর্থনীতির সংকট উত্তরণ নির্ভর করবে। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। সংকট দূর করে উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে অনুকূল পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ও সহিষ্ণুতা না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনো টেকসই হয় না।
দেশের শেয়ারবাজার মূলত আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত। অর্থনীতির সঙ্গে এর একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। ব্যাংকের সুদহারের সঙ্গে শেয়ারবাজারের আরও বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্যাংকের সুদহার বেড়ে গেলে শেয়ারবাজারে তারল্য কমে যায়। ব্যাংকের সুদহার কমতির দিকে থাকলে বুঝতে হবে শেয়ারবাজারে তারল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কায়দায় দেশ থেকে প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। দেশের প্রতি আস্থাহীনতা ও নিরাপত্তাজনিত দুশ্চিন্তা থেকেই মানুষ বিদেশে এসব অর্থ পাচার করেছে।
দেশের বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎ কারিগর। বিনিয়োগকারীদের হাতেই শেয়ারবাজারের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ ও ভালো-মন্দ নির্ভর করে। শেয়ার কেনার আগে সেই কোম্পানি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়াটা খুবই জরুরি। বিনিয়োগকারীরা না বুঝে কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করে থাকে। সে কারণে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সঠিক হয় না। পরবর্তী সময় দেখা যায়, বিনিয়োগকারী লোকসান গুনছেন। মনে রাখতে হবে, ভালো ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ একটি খারাপ কোম্পানিকেও অনেক সময় ভালো কোম্পানিতে রূপ দিতে পারে।
আবার ব্যবস্থাপনা দক্ষ না হলে ভালো কোম্পানিও অনেক সময় খারাপ হয়ে যায়। সঠিক পরিকল্পনার অভাবে আজকে তার নেতিবাচক ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি। মূল্যস্ফীতি, দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস, ডলারসংকট, টাকার অবমূল্যায়নসহ নানাবিধ অসংগতি রয়েছে। অন্যদিকে দেশের রপ্তানি সূচকও আশাব্যঞ্জক নয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কাঙ্ক্ষিতভাবে অর্জিত হয়নি। বলা বাহুল্য, এই সংকট এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। বছরব্যাপী ধাপে ধাপে এই সংকট ঘনীভূত হয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়লেও বাড়েনি মানুষের আয়। চাল, ডাল, তেল, ডিম, আটা থেকে শুরু করে সব পণ্যের দাম বেড়েছে।
সীমিত আয়ের মানুষ পড়েছে বিপাকে। ফলে অনেকেই ব্যয় কাটছাঁট করছে। দ্রব্যমূল্য প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে জনজীবনে মানুষ দুঃখ-কষ্ট ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। শুধু চাল নয়; ডাল, আটা, ভোজ্যতেল, শুকনা মরিচ, পেঁয়াজ, চিনিসহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামই এখনো বাড়তির দিকে। এভাবে ক্রমাগত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠেছে মধ্যবিত্তসহ স্বল্প আয়ের মানুষের। বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় বাজারে পণ্যের দাম লাগামহীন হয়ে পড়েছে। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও পরিবহনের মতো সেবা সার্ভিসের মূল্য দফায় দফায় বেড়ে যাওয়ায় দেশের ক্রেতা-ভোক্তা সাধারণ মানুষ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে।
নানা ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখতে হলে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সুশাসন দরকার। যেকোনো সমস্যা সমাধানে যৌক্তিক আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতায় দল-মতনির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিককে নিজের অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতার পাশাপাশি জনমত গঠন জরুরি। সব অপতৎপরতা বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দেশ গঠনে মনোযোগ দিতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ