একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ের মতো সমষ্টিগত দুঃসময় আমাদের জীবনে আর কখনো আসেনি। যুদ্ধটা ছিল রাজনৈতিক এবং তাতে জাতীয়তাবাদ নানাভাবে ও বিভিন্ন দিক দিয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তি সে সময়ে বিশেষভাবে প্রকাশ পায়, তার দুর্বলতাও যে ধরা পড়েনি এমনও নয়। বাঙালির জাতীয়তাবাদের শক্তি ছিল ঐক্যে, দুর্বলতা ছিল নেতৃত্বের পেটি বুর্জোয়া চরিত্রে। বিপরীত পক্ষে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদও পরীক্ষা দিয়েছিল। তার দুর্বলতা ছিল অনৈতিকতায় ও অনৈকের। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের কৃত্রিমতা তখন উন্মোচিত হয়ে যায়। ৫৬ জনের ওপর ৪৪ জন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; আক্রমণের চরিত্রটা ছিল গণহত্যার।
পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের রক্ষকরা পরিণত হয়েছিল হানাদার ঘাতক ও দস্যুতে; তাদের অন্য কোনো জোর ছিল না, অস্ত্রের জোর ছাড়া। নৈতিক জোর তো নয়ই। ওই যুদ্ধে ভারত যুক্ত হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই, তাদের তাগিদটাও জাতীয়তাবাদেরই ছিল। আমেরিকা, চীন, রাশিয়া- এদের সংযোগটাও যে জাতীয় স্বার্থের বিবেচনার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল সে বিষয়েও সন্দেহ নেই।
আসলে বাংলাদেশের মানুষ তো এক সময়ে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকেই নিজেদের মধ্যে ধারণ করত। এমনকি একাত্তরের প্রথম দিকেও। পয়লা মার্চ ঢাকার স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা চলছিল পাকিস্তানি টিমের সঙ্গে ইংল্যান্ডের এমসিসি টিমের; পরিবেশটা ছিল রীতিমতো উৎসবমুখর। স্টেডিয়াম ভর্তি বাঙালি দর্শক সবাই প্রবলভাবে পাকিস্তানি দলকে সমর্থন করছিল; কিন্তু ভরদুপুরে যে মুহূর্তে শোনা গেল গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে অমনি দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে গেল। স্টেডিয়াম মুখরিত হলো ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে। আসন তছনছ করা, আগুন জ্বালানো, সবকিছু ঘটল।
পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা আক্রান্ত হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারায় তাদের জান বাঁচিয়ে আশ্রয় নিতে হলো এমপি হোস্টেলে, মাস ঘুরতে না ঘুরতেই যে আবাসটি পরিণত হয়েছিল বাঙালি নির্যাতনের কেন্দ্রে। পরিবর্তনটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। কিছুটা পরিবর্তিত জাতীয়তাবাদের প্রতি অবিশ্বাস গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল এবং আক্রমণের মুখে তা প্রতিরোধে পরিণত হয়েছিল। আক্রমণটা পাকিস্তানিরাই করেছে এবং কাজটা শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই সাতচল্লিশ সালেই। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই।
সত্য তো এটাও যে, একদা বাঙালি মুসলমানই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। তারা একই সঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান ছিল। বাঙালিত্বটাই ছিল প্রধান, সেটিই ছিল স্বাভাবিক, তবে তারা নিজেদের মুসলমান পরিচয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছিল রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আশায়। নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল তাদের স্বপ্ন আক্রান্ত হয়েছে। ওই আক্রমণের মুখেই তারা তাদের বাঙালি পরিচয়ের কাছে ফিরে গেছে, ওই পরিচয়টিকেই প্রধান করে তুলেছে। আক্রমণটি চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল পঁচিশে মার্চের মধ্য রাতে। অখণ্ড পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার কাজটা বাঙালিদের হস্তক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করেনি, পাকিস্তানি হানাদাররাই সেটা শুরু ও শেষ করেছে।
বাঙালি মুসলমান কেন পাকিস্তানপন্থি হয়েছিল তার ব্যাখ্যা অস্পষ্ট নয়। ড. খান সারওয়ার মুরশিদের পত্রিকা ‘নিউ ভ্যালুজ’-এ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, তাতেও ব্যাখ্যাটির দেখা পাওয়া যাবে। রাজ্জাক স্যার লেখার চেয়ে বলতেই পছন্দ করতেন বেশি, ওই প্রবন্ধটি ড. মুরশিদ যে প্রকাশ করতে পেরেছেন তাতে সম্পাদক হিসেবে তার অনেক দক্ষতার একটির পরিচয় পাই। ‘দ্য মাইন্ড অব দ্য এডুকেটেড মিডল ক্লাস ইন দ্য নাইনটিনথ সেঞ্চুরি’ নামের ওই প্রবন্ধটিতে অধ্যাপক রাজ্জাক দেখাচ্ছেন যে, শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত যেভাবে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছিল তাতে বিলম্বে উত্থিত শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্তের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সূত্রপাত ওই ঊনবিংশ শতাব্দীতেই, বিংশ শতাব্দীতে এসে দুই পক্ষের দূরত্ব বেড়েছে এবং মুসলিম মধ্যবিত্ত পাকিস্তানপন্থি হওয়া ছাড়া দৃষ্টিগ্রাহ্য গত্যন্তর দেখেনি।
নিউ ভ্যালুজ থেকে বাছাই করা কিছু প্রবন্ধের একটি সংকলন ড. মুরশিদ তৈরি করেছিলেন, এর ভূমিকায় তিনি তার সহকর্মী ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের উৎসাহ-দানের কথা উল্লেখ করেছেন। আমার এই দুই শিক্ষক এক সময়ে পরস্পরের খুব কাছাকাছি ছিলেন। শুরুতে উভয়েই পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ের ভেতরেই ছিলেন, যেমন ছিলেন বয়সে তাদের অগ্রবর্তী অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক; কিন্তু ড. মুরশিদ ও অধ্যাপক রাজ্জাক যা করেছেন ড. হোসায়েন তা করতে পারেননি। তিনি পাকিস্তানিই রয়ে গেছেন এবং ভয়ংকর বিপদ-আপদের মধ্যেও সেই বিশ্বাসেই অবিচল ছিলেন। একাত্তরের পরে তিনি তার আত্মজৈবনিক রচনায় বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ত্যাগ করছে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিস্ময়ের প্রধান কারণ তাদের অকৃতজ্ঞতা। তারা কি ভুলে গেল যে, বৈষয়িক ব্যাপারে পাকিস্তান রাষ্ট্র তাদের কতটা সাহায্য করেছিল? বিস্ময়ের সঙ্গে ব্যথা মিশিয়ে তিনি প্রশ্নটি করেছেন। বোঝাই যায় যে, সংকীর্ণ শ্রেণিস্বার্থের কথাই ভাবছিলেন এবং বাঙালির জাতীয় মুক্তির প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেননি। দিলে তাকেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী হতে হতো। সে ক্ষেত্রে অধ্যাপক রাজ্জাক এবং ড. মুরশিদের মতো তিনিও বিপদে পড়তেন; তবে তাদের সঙ্গে নয়, কয়েক মাস পরে। ওই কৃত্রিম রাষ্ট্র যে কেমন অমানবিক ছিল, কেমনভাবে তছনছ করে দিয়েছিল মানুষের জীবন, সেটা ভুলবার নয়। উল্লেখ্য, অধ্যাপক রাজ্জাক দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে ছিলেন, সামরিক আদালত তার চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করেছিল; ড. মুর্শিদ সপরিবারে দেশত্যাগ করেছিলেন।
সত্য এই যে, জাতীয় মুক্তির জরুরি প্রশ্নটিকে সবাই সমান গুরুত্ব দিতে পারেননি। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বসবাসকারী বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের প্রভাব ছিল; ছিল আচরণগত অভ্যাস, এমনকি ওই জাতীয়তাবাদে আস্থা যে ছিল না তাও নয়। যে জন্য দেখা যায়, একাত্তরের আগে তো বটেই, পরেও স্থানে স্থানে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের চিহ্ন রয়ে গেছে, বন্যার স্রোত নেমে গেলেও যেমন পানি আটকে থাকে, এখানে সেখানে। যেকোনো বিশ্বাসের পক্ষেই মানসিক সম্পত্তি ও আশ্রয়ে পরিণত হওয়াটা কোনো অসম্ভব ঘটনা নয়। দক্ষিণপন্থিরা পাকিস্তানি ভ্রান্তিতে পতিত হয়েছেন, বামপন্থিদের একটি অংশকেও দেখা গেছে শ্রেণি প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে জাতি প্রশ্নকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধে তাদের যেভাবে অংশগ্রহণ প্রত্যাশিত ছিল সেভাবে তারা অংশগ্রহণ করতে পারেননি। সেই সঙ্গে এটাও তো জানি আমরা যে, মার্চ মাসের শেষ দিনগুলোতে বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাকিস্তানিদের হর্তাকর্তা ইয়াহিয়া খান যে দরকষাকষি করছিলেন সেটা পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য ছিল না, ছিল তাকে বাঁচানোর জন্যই। সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বলয় থেকে বাঙালির পক্ষে বের হয়ে যাওয়াটা সহজ ছিল না; মতাদর্শিক নিষেধটা নষ্ট হয়ে যায়নি, তার চেয়েও প্রবল ছিল রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। মুজিবের পেছনে ছিল জনমতের অকুণ্ঠ সমর্থন, ইয়াহিয়ার হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। জনমতের জন্য জায়গা করে দেওয়াটা হতো ন্যায়সঙ্গত, সেটা ঘটেনি; অস্ত্র দমন করতে চেয়েছে জনমতকে। শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি; জনমতেরই জয় হয়েছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীরা হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের যে মহোৎসব বসিয়েছিল তার তুলনা ইতিহাসে বিরল।
মানসিক আনুগত্যের ব্যাপারটা সামান্য ছিল না। ১৯৪৮-এর মার্চে জিন্নাহ ঢাকায় এসে উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, এই ঘোষণা দিয়ে বাঙালির ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। বিশেষ করে ছাত্রদের। তার পরও দেখা যাবে যে, তিনি জাতির পিতা ও কায়েদে আজম রয়ে গেছেন, এমনকি ছাত্রদের একাংশের মধ্যেও। ফারুক আজিজ খান তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র। একাত্তরের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে ‘স্প্রিং ১৯৭১’ নামে তিনি একটি বই লিখেছেন। তাতে তিনি স্মরণ করেছেন যে, জিন্নাহ মারা গেছেন, বিবিসিতে এই খবর শুনে মুসলিম লীগপন্থি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্যরা বামপন্থি হিসেবে পরিচিত ছাত্রদের ওপর এমনভাবে চড়াও হয় যেন জিন্নাহর মৃত্যুর জন্য বামপন্থিরাই দায়ী। মুনীর চৌধুরী তখন ওই আবাসিক হলে থাকতেন, তিনিও আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।
পাকিস্তানপন্থিরা একাত্তরে কী করবে তার পূর্বাভাস ঊনপঞ্চাশেই পাওয়া গিয়েছিল। ফারুক আজিজ লিখছেন যে, আক্রমণকারীরা এমনকি তার ওপরও ক্রুদ্ধ ছিল, যদিও বামপন্থি বলে তিনি পরিচিত ছিলেন না। কারণ? কারণ তিনি জিন্নাহর মৃত্যুতে যথোপযুক্ত পরিমাণে শোক প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পাকিস্তানের আদত শত্রু বামপন্থিরাই, এই রকমের একটা বোধ পাকিস্তানপন্থিদের চেতনায় সানন্দে খেলাধুলা করত- এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সামরিক এবং বেসামরিকদের ভেতর খুব যে একটা পার্থক্য দেখা গেছে তা নয়। তবে তাদের এই বোধ একেবারে যে অযৌক্তিক ছিল তাও নয়। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ছিল ধর্ম, আর বামপন্থিরা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ, তাদের ‘নাস্তিক’ বলারও রেওয়াজ ছিল। তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের আওয়াজ যে বামপন্থিরাই প্রথমে তোলেন এটাও তো ঐতিহাসিকভাবে সত্য। পাকিস্তানের নিপীড়নকারী ও অবৈজ্ঞানিক সত্তাটি তাদের কাছে স্পষ্ট না হয়ে পারেনি।
পাকিস্তান যে রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট শক্তসমর্থ হবে না, এই বোধটা যাদের মধ্যে ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বয়ং তাদের একজন। যে জন্য তিনি ভরসা করতে চেয়েছিলেন সেনাবাহিনী ও অভিন্ন রাষ্ট্রভাষার ওপর। দেশভাগের সময় তার বিশেষ উদ্বেগ ছিল সেনাবাহিনীর যথোপযুক্ত ভাগ পাওয়ার বিষয়ে। উপযুক্ত একটি সেনাবাহিনী তিনি পেয়েছিলেনও বৈকি। অফিসার ও সৈন্য উভয় গণনাতেই সেখানে ছিল পাঞ্জাবিদের একক আধিপত্য। রাষ্ট্রের রক্ষক হিসেবে অস্ত্রধারী সেনাবাহিনীই আবির্ভূত হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রের ধ্বংসও মাশাল্লাহ তাদের হাতেই সম্পন্ন হয়েছে। তার দ্বিতীয় ভরসা ছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ওপর, বাঙালিরা সেটা মেনে নেয়নি; বাঙালি জাতীয়তাবাদের অপ্রতিহত বিকাশ ওই না-মানা থেকেই শুরু। তার পর রাষ্ট্র চলে গেছে সেনাবাহিনীর হাতে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়