ঢাকা ১৩ চৈত্র ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ ২০২৫, ১৩ চৈত্র ১৪৩১

ভারত কেন তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী?

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:৩৮ পিএম
ভারত কেন তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী?
তালমিজ আহমাদ

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি, যিনি দেশটির সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক, এই মাসে দুবাইয়ে তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে দেখা করেছেন। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার পর থেকে এটি ছিল তালেবানদের সঙ্গে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ।

প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতীয় এই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারত আফগানিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ, দেশটির স্বাস্থ্য খাত এবং শরণার্থীদের পুনর্বাসনে যথেষ্ট সহায়তা দেবে। ইরানের চাবাহার বন্দরের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ও মানবিক সংযোগ সম্প্রসারণের কথা বিবেচনা করবেন তারা। 

এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পৃক্ততার প্রশংসা করে আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতকে ‘গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তারা ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আফগানিস্তানের কাছ থেকে কোনো ধরনের হুমকি নেই বলে তারা আশ্বস্ত করেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ী, রোগী এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ভারতীয় ভিসা সুবিধা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে আফগানিস্তান। এখন পর্যন্ত কোনো দেশ তালেবান সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। 

ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব এবং আফগান ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে এই আলাপচারিতা ছিল তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের একটি বড় বিবর্তনের অংশ। ৯/১১-এর হামলার পর মার্কিন বাহিনী কর্তৃক কান্দাহারে তালেবান আমিরত ধ্বংসের পর ভারত আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির নেতত্বে কাবুল সরকারকে সহযোগিতা করেছিল। তাদের অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রকল্পের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের উন্নয়ন সহায়তাও দিয়েছিল ভারত। এর ফলে আফগানিস্তানের জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি অগাধ বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।

এই সময়কালে তালেবান এবং কাবুল সরকারের মধ্যে তীব্র সংগ্রাম চলছিল, যা মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল। ভারত তালেবানকে চরমপন্থি হিসেবে দেখত। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রত্যাহার এবং কাবুলে তালেবানের ক্ষমতায় আসার পর ভারত তার কূটনৈতিক উপস্থিতি এবং উন্নয়ন-সহায়তা বন্ধ করে দেয়।

ভারত আফগান জনগণের সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক বন্ধনের প্রতি সব সময় গুরুত্ব দেয়। সে কারণেই ২০২১ সালের শেষের দিকে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে খাদ্য ও চিকিৎসা-সহায়তা দিয়েছিল। ২০২২ সালের জুনে ভারত কাবুলে তার দূতাবাস পুনরায় চালু করে। তারা তালেবানকে ‘প্রযুক্তিগত দল’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
দুবাইয়ে সাম্প্রতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়। মূলত পাকিস্তানের প্রভাবের জন্যই এমনটা হয়েছে। 

ইসলামাবাদ লক্ষ্য করেছে, তালেবানরা পাকিস্তানের জঙ্গি তেহরিক-ই-তালেবানদের আশ্রয় দিয়ে চলেছে, যারা নিয়মিতভাবে পাকিস্তানে সশস্ত্র হামলা চালায়। একই সঙ্গে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে বিভক্তকারী ২ হাজার ৬৪০ কিলোমিটারজুড়ে ডুরান্ড লাইন নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছে। পাকিস্তানে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে তাদের বিমানগুলো গত বছরের মার্চ এবং ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে তেহরিক-ই-তালেবানের অবস্থানগুলোতে বোমাবর্ষণ করে। 

পাকিস্তান এবং তালেবান সরকারের মধ্যে বিভাজন ভারতকে তালেবানের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্কের দিকে নিয়ে গেছে। এতে আফগান জনগণের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভারতের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে তালেবানরা পুনর্ব্যক্ত করেছে যে, তারা তাদের ভূখণ্ড ভারতের বিপক্ষ শত্রুদের ব্যবহার করতে দেবে না।

স্বাস্থ্য ও কল্যাণ-সহায়তার মাধ্যমে আফগান জনগণের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। তালেবানের সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক ভারতের দীর্ঘমেয়াদি ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থেও অবদান রাখবে। এতে চাবাহার বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন জোরদার হবে। লজিস্টিক সংযোগের এই দৃষ্টিভঙ্গি কমপক্ষে দুই দশক ধরে চালু ছিল। কিন্তু আফগানিস্তানের সংঘাতের কারণে তা অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। শক্তি, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনার জন্য এই সংযোগগুলো এখন ভারত যথেষ্ট কৌশলগতভাবে অনুসরণ ও ব্যবহার করতে পারে। 

যদিও তালেবানদের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে তার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। তবে চলমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা এবং চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, তালেবানরা এখনো ভারত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশকে বোঝাতে পারেনি যে, তারা তাদের চরমপন্থি বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ করেছে। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনটি কোনো ঐক্যবদ্ধ দল নয়, এটি বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এদের মধ্যে কিছু গোষ্ঠী ভারতের সঙ্গে উন্নত সম্পর্কের বিরোধিতা করতে পারে। তৃতীয়ত, তালেবানরা পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণ করে না। বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠী রয়েছে, যা তালেবানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত পুনরুজ্জীবিত করতে পারে এবং দেশকে নতুন করে যুদ্ধে প্ররোচিত করতে পারে।

বর্তমানে তালেবান সরকারের আদর্শিক প্রতিশ্রুতি একটু ভিন্ন। তাদের সমমনা চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই এবং তাদের উন্নয়নের চাহিদা পূরণের জন্য বহিরাগত সহায়তা থেকে দূরে অবস্থান নিয়েছে। সন্ত্রাসবাদ ইস্যু নিয়ে তালেবানরা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে। তারা এখন অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং কার্যকর শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় সক্ষম। সবকিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক: ভারতীয় সাবেক কূটনীতিক।
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

একাত্তরের যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের পরীক্ষা

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৫, ০২:২৬ পিএম
একাত্তরের যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের পরীক্ষা
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ের মতো সমষ্টিগত দুঃসময় আমাদের জীবনে আর কখনো আসেনি। যুদ্ধটা ছিল রাজনৈতিক এবং তাতে জাতীয়তাবাদ নানাভাবে ও বিভিন্ন দিক দিয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তি সে সময়ে বিশেষভাবে প্রকাশ পায়, তার দুর্বলতাও যে ধরা পড়েনি এমনও নয়। বাঙালির জাতীয়তাবাদের শক্তি ছিল ঐক্যে, দুর্বলতা ছিল নেতৃত্বের পেটি বুর্জোয়া চরিত্রে। বিপরীত পক্ষে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদও পরীক্ষা দিয়েছিল। তার দুর্বলতা ছিল অনৈতিকতায় ও অনৈকের। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের কৃত্রিমতা তখন উন্মোচিত হয়ে যায়। ৫৬ জনের ওপর ৪৪ জন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল; আক্রমণের চরিত্রটা ছিল গণহত্যার। 

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের রক্ষকরা পরিণত হয়েছিল হানাদার ঘাতক ও দস্যুতে; তাদের অন্য কোনো জোর ছিল না, অস্ত্রের জোর ছাড়া। নৈতিক জোর তো নয়ই। ওই যুদ্ধে ভারত যুক্ত হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই, তাদের তাগিদটাও জাতীয়তাবাদেরই ছিল। আমেরিকা, চীন, রাশিয়া- এদের সংযোগটাও যে জাতীয় স্বার্থের বিবেচনার দ্বারা নির্ধারিত হয়েছিল সে বিষয়েও সন্দেহ নেই।
আসলে বাংলাদেশের মানুষ তো এক সময়ে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদকেই নিজেদের মধ্যে ধারণ করত। এমনকি একাত্তরের প্রথম দিকেও। পয়লা মার্চ ঢাকার স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা চলছিল পাকিস্তানি টিমের সঙ্গে ইংল্যান্ডের এমসিসি টিমের; পরিবেশটা ছিল রীতিমতো উৎসবমুখর। স্টেডিয়াম ভর্তি বাঙালি দর্শক সবাই প্রবলভাবে পাকিস্তানি দলকে সমর্থন করছিল; কিন্তু ভরদুপুরে যে মুহূর্তে শোনা গেল গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে অমনি দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে গেল। স্টেডিয়াম মুখরিত হলো ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে। আসন তছনছ করা, আগুন জ্বালানো, সবকিছু ঘটল।

 পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা আক্রান্ত হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাহারায় তাদের জান বাঁচিয়ে আশ্রয় নিতে হলো এমপি হোস্টেলে, মাস ঘুরতে না ঘুরতেই যে আবাসটি পরিণত হয়েছিল বাঙালি নির্যাতনের কেন্দ্রে। পরিবর্তনটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। কিছুটা পরিবর্তিত জাতীয়তাবাদের প্রতি অবিশ্বাস গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল এবং আক্রমণের মুখে তা প্রতিরোধে পরিণত হয়েছিল। আক্রমণটা পাকিস্তানিরাই করেছে এবং কাজটা শুরু হয়ে গিয়েছিল সেই সাতচল্লিশ সালেই। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই। 

সত্য তো এটাও যে, একদা বাঙালি মুসলমানই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। তারা একই সঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান ছিল। বাঙালিত্বটাই ছিল প্রধান, সেটিই ছিল স্বাভাবিক, তবে তারা নিজেদের মুসলমান পরিচয়টিকে সামনে নিয়ে এসেছিল রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আশায়। নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল তাদের স্বপ্ন আক্রান্ত হয়েছে। ওই আক্রমণের মুখেই তারা তাদের বাঙালি পরিচয়ের কাছে ফিরে গেছে, ওই পরিচয়টিকেই প্রধান করে তুলেছে। আক্রমণটি চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল পঁচিশে মার্চের মধ্য রাতে। অখণ্ড পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার কাজটা বাঙালিদের হস্তক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করেনি, পাকিস্তানি হানাদাররাই সেটা শুরু ও শেষ করেছে। 

বাঙালি মুসলমান কেন পাকিস্তানপন্থি হয়েছিল তার ব্যাখ্যা অস্পষ্ট নয়। ড. খান সারওয়ার মুরশিদের পত্রিকা ‘নিউ ভ্যালুজ’-এ অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, তাতেও ব্যাখ্যাটির দেখা পাওয়া যাবে। রাজ্জাক স্যার লেখার চেয়ে বলতেই পছন্দ করতেন বেশি, ওই প্রবন্ধটি ড. মুরশিদ যে প্রকাশ করতে পেরেছেন তাতে সম্পাদক হিসেবে তার অনেক দক্ষতার একটির পরিচয় পাই। ‘দ্য মাইন্ড অব দ্য এডুকেটেড মিডল ক্লাস ইন দ্য নাইনটিনথ সেঞ্চুরি’ নামের ওই প্রবন্ধটিতে অধ্যাপক রাজ্জাক দেখাচ্ছেন যে, শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত যেভাবে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠছিল তাতে বিলম্বে উত্থিত শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্তের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সূত্রপাত ওই ঊনবিংশ শতাব্দীতেই, বিংশ শতাব্দীতে এসে দুই পক্ষের দূরত্ব বেড়েছে এবং মুসলিম মধ্যবিত্ত পাকিস্তানপন্থি হওয়া ছাড়া দৃষ্টিগ্রাহ্য গত্যন্তর দেখেনি। 

নিউ ভ্যালুজ থেকে বাছাই করা কিছু প্রবন্ধের একটি সংকলন ড. মুরশিদ তৈরি করেছিলেন, এর ভূমিকায় তিনি তার সহকর্মী ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের উৎসাহ-দানের কথা উল্লেখ করেছেন। আমার এই দুই শিক্ষক এক সময়ে পরস্পরের খুব কাছাকাছি ছিলেন। শুরুতে উভয়েই পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বলয়ের ভেতরেই ছিলেন, যেমন ছিলেন বয়সে তাদের অগ্রবর্তী অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক; কিন্তু ড. মুরশিদ ও অধ্যাপক রাজ্জাক যা করেছেন ড. হোসায়েন তা করতে পারেননি। তিনি পাকিস্তানিই রয়ে গেছেন এবং ভয়ংকর বিপদ-আপদের মধ্যেও সেই বিশ্বাসেই অবিচল ছিলেন। একাত্তরের পরে তিনি তার আত্মজৈবনিক রচনায় বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ত্যাগ করছে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। বিস্ময়ের প্রধান কারণ তাদের অকৃতজ্ঞতা। তারা কি ভুলে গেল যে, বৈষয়িক ব্যাপারে পাকিস্তান রাষ্ট্র তাদের কতটা সাহায্য করেছিল? বিস্ময়ের সঙ্গে ব্যথা মিশিয়ে তিনি প্রশ্নটি করেছেন। বোঝাই যায় যে, সংকীর্ণ শ্রেণিস্বার্থের কথাই ভাবছিলেন এবং বাঙালির জাতীয় মুক্তির প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেননি। দিলে তাকেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী হতে হতো। সে ক্ষেত্রে অধ্যাপক রাজ্জাক এবং ড. মুরশিদের মতো তিনিও বিপদে পড়তেন; তবে তাদের সঙ্গে নয়, কয়েক মাস পরে। ওই কৃত্রিম রাষ্ট্র যে কেমন অমানবিক ছিল, কেমনভাবে তছনছ করে দিয়েছিল মানুষের জীবন, সেটা ভুলবার নয়। উল্লেখ্য, অধ্যাপক রাজ্জাক দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে ছিলেন, সামরিক আদালত তার চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড ঘোষণা করেছিল; ড. মুর্শিদ সপরিবারে দেশত্যাগ করেছিলেন। 

সত্য এই যে, জাতীয় মুক্তির জরুরি প্রশ্নটিকে সবাই সমান গুরুত্ব দিতে পারেননি। পাকিস্তান রাষ্ট্রে বসবাসকারী বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের প্রভাব ছিল; ছিল আচরণগত অভ্যাস, এমনকি ওই জাতীয়তাবাদে আস্থা যে ছিল না তাও নয়। যে জন্য দেখা যায়, একাত্তরের আগে তো বটেই, পরেও স্থানে স্থানে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের চিহ্ন রয়ে গেছে, বন্যার স্রোত নেমে গেলেও যেমন পানি আটকে থাকে, এখানে সেখানে। যেকোনো বিশ্বাসের পক্ষেই মানসিক সম্পত্তি ও আশ্রয়ে পরিণত হওয়াটা কোনো অসম্ভব ঘটনা নয়। দক্ষিণপন্থিরা পাকিস্তানি ভ্রান্তিতে পতিত হয়েছেন, বামপন্থিদের একটি অংশকেও দেখা গেছে শ্রেণি প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে জাতি প্রশ্নকে পেছনে ঠেলে দিয়েছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধে তাদের যেভাবে অংশগ্রহণ প্রত্যাশিত ছিল সেভাবে তারা অংশগ্রহণ করতে পারেননি। সেই সঙ্গে এটাও তো জানি আমরা যে, মার্চ মাসের শেষ দিনগুলোতে বাঙালিদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাকিস্তানিদের হর্তাকর্তা ইয়াহিয়া খান যে দরকষাকষি করছিলেন সেটা পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য ছিল না, ছিল তাকে বাঁচানোর জন্যই। সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বলয় থেকে বাঙালির পক্ষে বের হয়ে যাওয়াটা সহজ ছিল না; মতাদর্শিক নিষেধটা নষ্ট হয়ে যায়নি, তার চেয়েও প্রবল ছিল রাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। মুজিবের পেছনে ছিল জনমতের অকুণ্ঠ সমর্থন, ইয়াহিয়ার হাতে ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। জনমতের জন্য জায়গা করে দেওয়াটা হতো ন্যায়সঙ্গত, সেটা ঘটেনি; অস্ত্র দমন করতে চেয়েছে জনমতকে। শেষ রক্ষা অবশ্য হয়নি; জনমতেরই জয় হয়েছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীরা হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণের যে মহোৎসব বসিয়েছিল তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। 

মানসিক আনুগত্যের ব্যাপারটা সামান্য ছিল না। ১৯৪৮-এর মার্চে জিন্নাহ ঢাকায় এসে উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, এই ঘোষণা দিয়ে বাঙালির ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। বিশেষ করে ছাত্রদের। তার পরও দেখা যাবে যে, তিনি জাতির পিতা ও কায়েদে আজম রয়ে গেছেন, এমনকি ছাত্রদের একাংশের মধ্যেও। ফারুক আজিজ খান তখন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র। একাত্তরের অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে ‘স্প্রিং ১৯৭১’ নামে তিনি একটি বই লিখেছেন। তাতে তিনি স্মরণ করেছেন যে, জিন্নাহ মারা গেছেন, বিবিসিতে এই খবর শুনে মুসলিম লীগপন্থি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্যরা বামপন্থি হিসেবে পরিচিত ছাত্রদের ওপর এমনভাবে চড়াও হয় যেন জিন্নাহর মৃত্যুর জন্য বামপন্থিরাই দায়ী। মুনীর চৌধুরী তখন ওই আবাসিক হলে থাকতেন, তিনিও আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। 

পাকিস্তানপন্থিরা একাত্তরে কী করবে তার পূর্বাভাস ঊনপঞ্চাশেই পাওয়া গিয়েছিল। ফারুক আজিজ লিখছেন যে, আক্রমণকারীরা এমনকি তার ওপরও ক্রুদ্ধ ছিল, যদিও বামপন্থি বলে তিনি পরিচিত ছিলেন না। কারণ? কারণ তিনি জিন্নাহর মৃত্যুতে যথোপযুক্ত পরিমাণে শোক প্রকাশে ব্যর্থ হয়েছিলেন। পাকিস্তানের আদত শত্রু বামপন্থিরাই, এই রকমের একটা বোধ পাকিস্তানপন্থিদের চেতনায় সানন্দে খেলাধুলা করত- এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সামরিক এবং বেসামরিকদের ভেতর খুব যে একটা পার্থক্য দেখা গেছে তা নয়। তবে তাদের এই বোধ একেবারে যে অযৌক্তিক ছিল তাও নয়। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ছিল ধর্ম, আর বামপন্থিরা ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ, তাদের ‘নাস্তিক’ বলারও রেওয়াজ ছিল। তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের আওয়াজ যে বামপন্থিরাই প্রথমে তোলেন এটাও তো ঐতিহাসিকভাবে সত্য। পাকিস্তানের নিপীড়নকারী ও অবৈজ্ঞানিক সত্তাটি তাদের কাছে স্পষ্ট না হয়ে পারেনি। 

পাকিস্তান যে রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট শক্তসমর্থ হবে না, এই বোধটা যাদের মধ্যে ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্বয়ং তাদের একজন। যে জন্য তিনি ভরসা করতে চেয়েছিলেন সেনাবাহিনী ও অভিন্ন রাষ্ট্রভাষার ওপর। দেশভাগের সময় তার বিশেষ উদ্বেগ ছিল সেনাবাহিনীর যথোপযুক্ত ভাগ পাওয়ার বিষয়ে। উপযুক্ত একটি সেনাবাহিনী তিনি পেয়েছিলেনও বৈকি। অফিসার ও সৈন্য উভয় গণনাতেই সেখানে ছিল পাঞ্জাবিদের একক আধিপত্য। রাষ্ট্রের রক্ষক হিসেবে অস্ত্রধারী সেনাবাহিনীই আবির্ভূত হয়েছিল। তবে রাষ্ট্রের ধ্বংসও মাশাল্লাহ তাদের হাতেই সম্পন্ন হয়েছে। তার দ্বিতীয় ভরসা ছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ওপর, বাঙালিরা সেটা মেনে নেয়নি; বাঙালি জাতীয়তাবাদের অপ্রতিহত বিকাশ ওই না-মানা থেকেই শুরু। তার পর রাষ্ট্র চলে গেছে সেনাবাহিনীর হাতে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

স্বাধীনতার সূর্য চিরদীপ্যমান থাকুক

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৫, ০২:২২ পিএম
স্বাধীনতার সূর্য চিরদীপ্যমান থাকুক
ড. রকিবুল হাসান

ভারতের দ্বিখণ্ডিতা ও বাংলা ভাগ- এই উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় এবং তার করুণ মৃত্যুর ভেতর দিয়েই ভারতবর্ষ পরাধীনতার শেকলে বন্দি হয়ে পড়ে। এই শেকল ছিঁড়তে বহু রক্তক্ষয়ী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। বহু তাজা প্রাণের বলি হয়েছে। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে। ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটলেও ভারত ও বাংলা ভাগের মধ্য দিয়ে এখানে চিরকালের জন্য বিয়োগান্তক এক অধ্যায় রচিত হয়। পাকিস্তান দুটো অংশে বিভক্ত হয় পশ্চিম পকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান। ট্র্যাজেডিটা এখানেই। পূর্ব বাংলা যেটাকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ অভিধা দেওয়া হলো এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হলো, তা বাংলার জন্য সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের মহাকাব্য হয়ে থাকল। যার চূড়ান্ত পরিণতিও ঘটে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। 

ভারতকে দ্বিখণ্ডিতকরণ এবং বাংলার বুকে শাণিত ছুরি চালিয়ে দুভাগ করার কথা বিপ্লবী ও রাজনীতিকরা কখনো ভাবেননি। কিন্তু ইংরেজদের চতুরতার ফাঁদে রাজনীতিকরা আটকে যান- তাদের অদূরদর্শিতার কারণে, কিছু রাজনীতিকের ব্যক্তিগত সুবিধার কারণে ভারত ও বাংলা বিভাগ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পূর্ব বাংলার ললাটে লেখা হয়ে যায় আর এক খণ্ডণের ইতিহাস। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব বাংলার দূরত্ব ছিল বহু, ভাষা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতেও কোনো মিল ছিল না। শুধু ধর্মের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব বাংলাকে যুক্ত করে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করা হয়। পূর্ব বাংলার নতুন নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য আর নিপীড়নের অনিবার্য জায়গা হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় ভারসাম্যোর ব্যাপক অভাব ছিল। 

বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি না দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন বাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানিরা আলাদা জাতি। অথচ সে সময় পাকিস্তানের শতকরা ৫৬.৪০ ভাগ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। পাঞ্জাবি ছিল শতকরা ২৮.৫৫ ভাগ, পশতু ছিল ৩.৪৮ ভাগ, সিন্ধি ছিল ৫.৪৭ ভাগ, উর্দু ছিল ৩.২৭ ভাগ এবং অন্যান্যা ভাষাভুক্ত ছিলেন শতকরা ২.৮৩ ভাগ। অথচ মাত্র ৩.২৭ ভাগ মানুষের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ঔদ্ধত্য দেখান তিনি। এর ভেতর দিয়েই তার প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ পায়। পূর্ব পাকিস্তানিরা প্রতি পদে পদে বঞ্চনা-বৈষম্যের শিকার হয়েছে। এর বড় কারণ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একনায়কতান্ত্রিকতা। তার উত্তরসূরিরাও তার দেখানো পথেই হেঁটেছিল। ফলে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়। অথচ পাকিস্তান ছিল বহু ভাষাভাষী মানুষের আবাস। সংস্কৃতিও ছিল আলাদা। ভৌগোলিকভাবেও নাগরিকরা ছিল বিচ্ছিন্ন। ফলে জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুদৃঢ় করার জন্য যে ‘একজাতি একরাষ্ট্র’- এই চেতনাবোধ সৃষ্টি করা যে অপরিহার্য ছিল, তা করা হয়নি। ফলে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পারস্পরিক মমত্ববোধ ও সহানুভূতির ব্যাপারটিও তৈরি হয়নি। বরং পাকিস্তান তৈরির পর থেকেই বহুভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত ও নির্যাতন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে ব্যাপকভাবে বৈষম্য সৃষ্টি হয়। 

১৯৬৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিকল্পনা কমিশনের চেয়ারম্যান ও ডেপুটি চেয়ারম্যান, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান ও প্রশাসক, ১৯৬২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের গভর্নর কখনোই বাঙালি ছিলেন না। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বৈষম্য আরও বেড়ে যায়। সামরিক শাসনের ৪৪ মাসে ৭৯০ জন জুনিয়র গ্রেড কর্মচারী নিয়োগ করা হয়, যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছিল মাত্র ১২০ জন (১৫.২ শতাংশ)। ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১৯৬০ সালের মে মাস পর্যন্ত ৯ মাসে ৭৩৪ জন সেকশন অফিসার নিয়োগ করা হয়, যার মাত্র ৭৪ জন (১০ শতাংশ) পূর্ব পাকিস্তানের। ১৯৫৯-১৯৬৩ সময়কালে রাওয়ালপিন্ডির কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে ৩১৫ জন কেরানি নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানি ছিল মাত্র ৩৬ জন (১১ শতাংশ)। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সালেল মধ্যে ১৪ জন সামরিক কর্মকর্তাকে বেসামরিক প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। 

এভাবে দেখা যায় পাকিস্তানের সব ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য ছিল অবিশ্বাস্যরকমের। শিল্পকারখানা, চাকরি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব ক্ষেত্রে এই বৈষম্য বিরাজ করেছিল। দেশভাগের অভিশাপ থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি ঘটেনি এবং এই মুক্তি যখন ঘটেছে, তখন পেরিয়ে গেছে ২৩ বছর। পাকিস্তানি সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করেছিল। 

করাচিকে রাজধানী শহর হিসেবে গড়ে তুলতেই ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ব্যয় ৫ হাজার ৭০০ মিলিয়ন টাকা। এই অর্থ ছিল সে সময়ে পাকিস্তান সরকারের মোট ব্যয়ের ৫৬.৪ শতাংশ। আর পূর্ব পাকিস্তানে সে সময় ব্যয় ছিল ৫.১০ শতাংশ। আর একটা চিত্র দিলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয় পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে কতভাবে শোষণ করেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত সময়কাল পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত ছিল ৪৯২৪.১ মিলিয়ন টাকা। সেখানে পশ্চিম পাকিস্তানে ঘাটতি ছিল ১৬,৬৩৪.৬ মিলিয়ন টাকা। খুব সহজেই বোঝা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের ঘাটতি পূরণে ব্যবহার করা হতো। ২৩ বছর শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছে পূর্ব বাংলা। 

১৯৪৭ সালে দেশভাগ হওয়ার পরে পাকিস্তানের জনগণের যে মনোভাব ছিল, স্বাধীনতা লাভের পরেই তা ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। পাকিস্তান সব ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তাননির্ভর হয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হতে হয়। উন্নয়নের সব ধারা থেকে ছিটকে ফেলানো হয়। পাকিস্তান নিজেই নিজেদের বিভক্ত করে ফেলে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হতে থাকে যে, পাকিস্তান নামক দেশটা ও দেশের সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য নয়। নিজেদের স্বাধীন হওয়ার শক্তিটা সেই হতাশা থেকেই অগ্নিবারুদের মতো জন্ম নেয়। পুরো পূর্ব পাকিস্তান যখন ক্ষোভে বিস্ফোরিত হতে থাকে, পরিণত হতে থাকে উত্তাল তরঙ্গে- স্বাধীনতার প্রশ্নে, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী তখন বাঙালি-নিধনে ২৬ মার্চ গভীর রাতে অতর্কিত আক্রমণ শুরু করে। বাঙালির জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ কালরাত্রি। বাঙালিরা মৃত্যুকে তখন বুকে পেতে নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যে যুদ্ধ দীর্ঘ নয় মাস চলে। 

ভারত স্বাধীনতার মাধ্যমে যে খণ্ডিত হলো, পূর্ব বাংলাকে জোর করে ভাগ করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করে দিল, তা ছিল ঐতিহাসিকভাবে চরম ভুল এবং হঠকারী এক সিদ্ধান্ত। এর ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি- পাকিস্তানের সম্পদ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সম্পদ হয়ে ওঠেনি। বৈষম্যের অগ্নিশিখা সব ক্ষেত্রে তখন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল- তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। সেই স্বাধীনতার সূর্য চিরকাল থাকুক অক্ষয়।

লেখক: অধ্যাপক-কবি-কথাসাহিত্যিক-গবেষক
[email protected]

ভয়াল কালরাতের দুঃসহ সেই স্মৃতি!

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২:৪২ পিএম
ভয়াল কালরাতের দুঃসহ সেই স্মৃতি!

২৫ মার্চ শুধু গণহত্যার দিন নয়, পাশাপাশি চলেছিল অবাধে টাকা লুটপাট, যার সঙ্গে অনেক বাঙালি অফিসারও যুক্ত ছিলেন। বাঙালির রক্তে বাঙালির স্নান, বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও হয়নি। কিন্তু আজও যেসব কাণ্ড বাংলাদেশে ঘটে চলেছে, তা বড়ই বেদনার। অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয় ঢাকায়। কিন্তু ৫৪ বছর পর আজও সেই স্মৃতি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।...

আজ ২৫ মার্চ। বিগত শতকের ৭১ সালে পাকিস্তান শুরু করেছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে বাঙালি-নিধন যজ্ঞ। এই যজ্ঞের নেতৃত্বে ছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ কে নিয়াজি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল রাও ফরমান আলী এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর টিক্কা খান। ঢাকা শহরজুড়ে যেখানেই বাঙালি পেয়েছে, সেখানেই খুন করেছে এই তিন মূর্তি। তাদের এই অপারেশন সফল করতে তারা সহযোগী হিসেবে পেয়েছিল রাজাকার, আলবদর ও আলশামস নামের তিনটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে। এই তিন মূর্তিকে ষোলো আনা থেকে আঠারো আনা সাহায্য করেছিল এই তিনটি গোষ্ঠী। ঢাকার পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে এমন কোনো এলাকা ছিল না, যেখানে বাঙালিকে হত্যা করা হয়নি।

ওদিকে ইসলামাবাদে বসে এই বাঙালি খুনের যাবতীয় নির্দেশ দেন ইয়াহিয়া খান ও ভুট্ট। বাংলায় একটা কথা আছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ভাগ্যের এমনই পরিহাস, পাক গোয়েন্দা সংস্থা সেই আইএসআইয়ের হাতেই ভুট্টকে ফাঁসি দেওয়া হয়। দুর্ঘটনায় মারা যান জিয়া উল্ হক।

২৫ তারিখ রাত থেকেই জেলায় জেলায় বাঙালি হত্যার নির্দেশ চলে যায়। সঠিক তথ্য যখন বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের হাতে আসে, তখন দেখা যায় প্রায় ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছে। এই বাঙালি হত্যার কলকাঠি পাকিস্তান থেকে নাড়া হলেও বাঙালিরাই বাঙালিদের হত্যা করেছে। উপরন্তু সেই তিনটি সন্ত্রাসবাদী দল এখনো হাসিনার অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে নারকীয় ঘটনা চালাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা সন্ধ্যার মধ্যে ফাঁকা হয়ে যায়, মানুষ পালিয়ে বাঁচার জন্য সীমান্তের পথে রওনা দেন। শুধু হত্যা নয়, দেশজুড়ে চলে লুটপাট। জেলার পর জেলায় আওয়ামী লীগের নেতারা রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অস্ত্রের অভাবে তারা প্রথম দফায় মোকাবিলা করতে পারেননি। ৫৪ বছর পরেও এই সন্ত্রাসবাদীরা পাকিস্তানের হাত শক্ত করার জন্য নিজের ভাইবোনের ওপর গুলি চালিয়েছে, নির্বিচারে হত্যা করেছে।

২৫ মার্চ দিনটি গোটা বাঙালি জাতির পক্ষেই একটি শোকাহত দিন। আমি তখন খবরের সন্ধানে সীমান্ত এলাকায় ঘুরছি। খবর আসতে থাকল আর বিশ্ব স্তভিত হয়ে গেল ঘটনার আকস্মিকতায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে এলে দেখা যেত ঢাকার রাজপথ জনমানবশূন্য। সন্ত্রাসবাদীরা ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়েদের ওপর অত্যাচার করেছে ও ধরে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর হাতে নির্বিচারে তুলে দিয়েছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ও ওই তিন জেনারেল মনে করেছিলেন বাঙালিদের দাবিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিলেন ৭ মার্চ জনসভায় দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমাগো দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ তার ওই উক্তির বিরোধিতা করে পাকিস্তান বাঙালি হত্যাকে গণহত্যার পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাইল। নিয়াজি বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে শুধু গণহত্যা বা লুটপাটই করেনি, সাধারণ মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে। পল্টন থেকে শাহবাগ, শাহবাগ থেকে রমনা সর্বত্র একই দৃশ্য। ছোট ছোট শিশুকেও সামরিক বাহিনী বুটের আঘাতে পিষে মেরেছে। এই জঘন্য হত্যালীলা নিয়ে কলকাতার প্রথম শ্রেণির দৈনিকে গণহত্যা হিসেবে খবর দেওয়া হয়। তারপর নিউজ উইকে এই জঘন্য ঘটনাকে ‘The Genocide’ হেডলাইন দিয়ে খবর করা হয়।

ঢাকা যখন জনমানবশূন্য হয়ে গেল, তখন আওয়ামী লীগের প্রথম সারির চার-পাঁচজন নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, নজরুল ইসলাম, আবু হেনা কামারুজ্জামান ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম- এই কয়েকজন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন, কীভাবে পাকিস্তানকে মোকাবিলা করা হবে। ঘরের শত্রু বিভীষণ খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী, তাকে ডাকাও হয়নি, তিনি আসেনওনি। তোফায়েল আহমেদ ও আব্দুর রাজ্জাককে বঙ্গবন্ধু ফোনে কিছু নির্দেশ দেন। সেই বৈঠকেই স্বাধীনতা ঘোষণার খসড়া তৈরি করা হয়, যেটি করেছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। সই করলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুকে যখন ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিমানবন্দরের দিকে যাচ্ছেন, সাধারণ মানুষ টেরও পেলেন না। তবে এই খবর দুপুরের মধ্যেই বেরিয়ে যায়। যদিও পাকিস্তান রেডিও ও টেলিভশন খবরটি চেপে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ঢাকায় উপস্থিত বিদেশি সাংবাদিকরা গোটা বিশ্বে খবর ছড়িয়ে দেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।

২৬ মার্চ সকালে এই ঘোষণাপত্র একমাত্র চট্টগ্রাম টেলিভিশনে পৌঁছে যায়। সেখানে তখন উপস্থিত ছিলেন জিয়াউর রহমান, যিনি বিএনপি পার্টির জন্মদাতা। তিনি নিজের নামে ঘোষণাটি করে দেন। তখন আওয়ামী লীগের যুব নেতারা, যারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন, তারা জোর করে জিয়াকে রেডিওতে টেনে আনেন এবং পিস্তল ধরে স্বীকার করান যে এটা আসলে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা। তার পরই সেখানে চলে আসেন চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতা জাহুরুদ্দিন সাহেব। তিনি নতুন করে ঘোষণা করেন যে বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং তার অনুপস্থিতিতে তিনি তার ঘোষণাপত্র পড়ে শোনাচ্ছেন। তার ঘোষণা শুনেই সাধারণ মানুষ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উল্লসিত হয়ে যান এবং জেলায় জেলায় মুক্তিবাহিনী গঠন করে রাস্তায় নেমে পাকবাহিনীর মোকাবিলা শুরু করেন। ৫৪ বছর আগের এই ঘটনা আজও বাঙালিদের চোখের সামনে ভাসছে। এ ধরনের গণহত্যা আগে কেউ দেখেছে কি না সন্দেহ। কিন্তু বাঙালিরাও অস্ত্র ধরে রাস্তায় নেমে দেখিয়ে দেন যে তারা অত্যাচারী পাকবাহিনীর যথাযথ মোকাবিলা করতে পিছপা নন।

ওই ঘটনার পর সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। সন্ত্রাসবাদীরা নিজের দেশের মানুষকে নিজেরাই খুন করতে পারে, এই ঘটনা অনেকের মনেই বিস্ময় সৃষ্টি করে। সেই বাঙালি হত্যাকারীরা বাঙালিদের লাশ পদ্মা-মেঘনার জলে ভাসিয়ে দেয়, রক্তে লাল হয় নদীর বুক।

ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ায় ইন্দিরা গান্ধী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হোয়াইট হাউসে ১৫ মিনিট কথা হয়। ইন্দিরাজির বক্তব্য ছিল, নিক্সন যেন বাংলাদেশে অস্ত্র পাঠিয়ে বাঙালি নিধনযজ্ঞে ইন্ধন না দেন। বাংলাদেশের সব নদী ইতোমধ্যেই বাঙালির রক্তে লালে লাল হয়ে গেছে। নিক্সন ইন্দিরাজির কথার কোনো জবাব দেননি, বরং পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য চালিয়ে যেতে লাগলেন। ইন্দিরা গান্ধী সেদিন বিকেলের দিকেই জাতিসংঘে ভাষণ দেন, যেখানে তিনি নিক্সনের সঙ্গে তার কথার উল্লেখ করে বলেন, অন্যান্য দেশ যেন নিক্সনের ওপরে চাপ দেন, আমেরিকা যেন পাকিস্তানের ওপরে চাপ দেন বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার জন্য।

এর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশজুড়ে সন্ত্রাস চলে। এর ফলে প্রায় এক কোটি মানুষ সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যেতে থাকেন। ইন্দিরা গান্ধী তাদের আশ্রয় দেন, অন্ন দেন, বস্ত্র দেন। ভারতের ৮৫ কোটি মানুষ দুই হাত তুলে তাকে সমর্থন জানান।

পাকিস্তানিরা শপথ নেন পূর্ব পাকিস্তান পুরোপুরি ধ্বংস করার। তারা ৯ মাস ধরে সেই অনুযায়ী কাজও করে যাচ্ছিল। কিন্তু অবশেষে ডিসেম্বর মাসে সেই ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে নিয়াজিকে ৯১ হাজার সৈন্য নিয়ে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়। এটা ইতিহাস। ভারতের রাঁচি শহরে তাদের প্রায় তিন বছর থাকতে হয়। ৯ মাস ধরে তারা ভেবেছিলেন বাঙালিকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলবে। কিন্তু তাদের সেই কুচিন্তা সফল হয়নি। কারণ জনগণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের জয় ছিনিয়ে আনেন। ২৫ মার্চ শুধু গণহত্যার দিন নয়, পাশাপাশি চলেছিল অবাধে টাকা লুটপাট, যার সঙ্গে অনেক বাঙালি অফিসারও যুক্ত ছিলেন।

 বাঙালির রক্তে বাঙালির স্নান, বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও হয়নি। ৭১ সালের সেই গণহত্যার সময় পাকিস্তানকে আরও শক্তিশালী করার জন্য চীন ও আমেরিকা একসঙ্গে কাজ করে, কেউ এই গণহত্যার প্রতিবাদ করেনি। উল্টো দিকে ১৭ ডিসেম্বর ওয়াশিংটন থেকে নিক্সনের বিদেশমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বিবৃতি জারি করে বলেন, we’ll take the revenge against the Indian lady. তারা প্রতিশোধ নিয়েছে ইন্দিরা গান্ধী, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। কিন্তু আজও যেসব কাণ্ড বাংলাদেশে ঘটে চলেছে, তা বড়ই বেদনার। অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয় ঢাকায়। কিন্তু ৫৪ বছর পর আজও সেই স্মৃতি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

অতিক্রান্ত কালরাত ও বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম
অতিক্রান্ত কালরাত ও বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা
সোহেল আমিন বাবু

স্বাধীনতার এত বছর পরও এর কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চলেছে চরম এক ন্যক্কারজনক বৈষম্য। জনগণের না ছিল কথা বলার স্বাধীনতা, না ছিল শান্তিমতো বেঁচে থাকার অধিকার। সংবিধানের মূলনীতির সবগুলোই ছিল পুস্তকে আর বক্তৃতায়।...


১৯৪৬ সালের শুরুর দিকে দিল্লিতে মুসলিম লীগের একটি কনভেনশন হয়েছিল। আর এই কনভেনশনে জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের অবাঙালি নেতারা লাহোর প্রস্তাবকে পাশ কাটিয়ে দুই রাষ্ট্রের পরিবর্তে এক রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পাকিস্তানি নেতাদের ষড়যন্ত্রে দুই পাকিস্তানের জায়গায় এক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পায়। অথচ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাবে দুই রাষ্ট্র গঠনেরই উল্লেখ ছিল। লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিলে বলা হয়েছিল- ‘ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে দুই অঞ্চলে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।’ শেষে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা পাকিস্তানের পক্ষ নেয় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে যুক্ত হয়। শেরেবাংলার প্রস্তাবমতো যদি দুটি আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র হতো, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলার) আকাশে কারও শ্যোন দৃষ্টি পড়তে পারত না। সম্রাজ্যবাদের কালো থাবাও পড়তে পারত না।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। এর পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে নানাভাবে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা বৈষম্যহীন পাকিস্তান গড়ার প্রত্যয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার বাংলার মানুষের দাবি-দাওয়াকে উপেক্ষা করে বরং তাদের ওপর নানা রকম অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন শুরু করে। শোষণের মাত্রা দিনকে দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। পাকিস্তানি সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র করে। বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু হবে বাংলার মানুষের ভাষা। এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। এর বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। শুরু হয় মিছিল-মিটিং। বাংলার মানুষ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য লড়াই করে। রাজপথে রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত বুকের রক্ত ঢেলে সেই ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা পায়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে উত্থাপিত হতে থাকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন দাবি।

 ভাষা আন্দোলনের গতিকে সামাল দিতে না পেরে নূরুল আমিন সরকার ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ’৫৪-এর প্রাদেশিক নির্বাচন সামনে রেখে পূর্ব বাংলায় শেরেবাংলার সহযোগিতায় একাধিক রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। এ ফ্রন্টে যুক্ত ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের পতন ঘটে। এ নির্বাচনে জয়লাভের পর শেরেবাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা সহজে মেনে নিতে পারেনি। নানা ছলছুঁতোয় পাকিস্তানি সরকার ১৯৫৪-এর ৩০ মে পূর্ব বাংলার যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। শুরু হয় অপশাসন। একপর্যায়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উঠতে থাকে। সোচ্চার হতে থাকে বাংলার জনগণ। বাংলার মানুষের সঙ্গে কোনোভাবেই পেরে উঠতে পারছিল না শাসকেরা। জনগণ ও ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। এর পর থেকে ঢাকার রাজপথ দখলে নেয় বাংলার মানুষ। ২৪ মার্চ মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় ঢাকা।
কী ঘটেছিল ভয়াল ২৫ মার্চে? জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ’৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের ঘুমন্ত, নিরস্ত্র মানুষের ওপর। 

রাজধানী ঢাকায় প্রথমে তারা হামলা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসে এবং পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী ইপিআরের সদর দপ্তরে। এরপর তারা ধ্বংস করেছে ঢাকার বস্তি, বাজার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের ঘরে ঢুকে কিংবা ঘর থেকে বের করে এনে হত্যা করেছে তারা। বাজার ও বস্তিগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আগুনের আতঙ্কে হাজার হাজার মানুষ যখন ঘর থেকে দলে দলে বেরিয়ে এসেছে, তখন ওদের ওপর মেশিনগানের গুলিবর্ষিত হয়েছে একটানা, যতক্ষণ না প্রতিটি মানুষ নিহত হয়। বহু মানুষ নিহত হয়েছে ঘুমন্ত অবস্থায়। এসব মানুষ জানতেও পারেনি কেন তাদের হত্যা করা হচ্ছে কিংবা কারা হত্যা করছে। 

ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় প্রতিরোধ গড়ে তুললেও ভারী অস্ত্রের মুখে প্রতিরোধকারীরা টিকতে পারেনি। হত্যাকাণ্ড ছাড়াও তারা ঘরবাড়ি পেট্রল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে দেয় ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান। অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২৫ মার্চ রাত দেড়টায় শেখ মুজিবুর রহমানকে তার ধানমন্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি বাহিনী। তারা চেয়েছিল বাঙালি সামরিক অফিসারদের নিরস্ত্র করে পুরো দেশকে নিজেদেরে কবজায় নিতে। কিন্তু বাঙালি সামরিক অফিসার এবং জানবাজ জনতার জনরোষে সেটা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

‘২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পরিচালিত অপারেশন সার্চলাইটের পর রাজনৈতিক সংকট ও নেতৃত্বশূন্য অবস্থা চলছিল। এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার এই ঘোষণা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড আশা ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। সবাই স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। যুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হলেও ক্রমান্বয়ে এটি জনযুদ্ধে রূপ নেয়। এ দেশের সর্বস্তরের মানুষ- কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবকদের সঙ্গে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসারে কর্মরত বাঙালিরা এই যুদ্ধে অংশ নেয়। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।’

স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা আরও কঠিন। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের নিবেদিতপ্রাণ হওয়া উচিত। কারও চোখ রাঙানিতে ভয় না পেয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর সাহস এ দেশের মানুষের আছে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানো যেমন জরুরি, তেমনি নাগরিকদের নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কেও সচেতন হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্তব্যবোধ, ন্যায়নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের মাধ্যমে বাংলাদেশের যথার্থ অগ্রগতি নিশ্চিত করা সম্ভব। স্বাধীনতা মানেই সার্বিক মুক্তি নয়। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের চাওয়া ছিল ব্যাপক। আমাদের স্বপ্ন ছিল স্বাধীন দেশে কোনো বৈষম্য থাকবে না, দারিদ্র্য থাকবে না। মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারবে, অবাধে চলাফেরা করতে পারবে। মানবাধিকারসহ নাগরিকদের বিভিন্ন অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। থাকবে কথা বলার অবাধ স্বাধীনতা।

 কিন্তু সব অধিকার হরণ করেছিল পতিত স্বৈরাচারী সরকার। একটা সময় পর এসব চাওয়া-পাওয়াও হয়তো আমাদের পূর্ণ হবে। তবে এ জন্য সিস্টেম বা পদ্ধতির পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধন করতে হবে। গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বড়াতে হবে। বিভিন্ন জাতীয় ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি এর অধিকতর বিকশিত ও শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে পিসফুল ট্রান্সফার অব পাওয়ার তথা ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর নিশ্চিত করতে হবে। সব দ্বন্দ্ব ও মতপার্থক্য দূর করে আমাদের জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীনতা অর্জনকে কেন্দ্র করে বিদ্যমান বিতর্কের অবসান না হলে জাতি হিসেবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। এতে আমাদের উন্নতি ও সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিও থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রত্যাশা ছিল বৈষম্য এবং শোষণহীন একটি স্বাধীন দেশ, যেখানে সবার গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার থাকবে। মৌলিক অধিকারে থাকবে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান। হবে শুভচিন্তার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ- বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতির আলোকে এক নন্দিত সমাজ।

স্বাধীনতার এত বছর পরও এর কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চলেছে চরম এক ন্যক্কারজনক বৈষম্য। জনগণের না ছিল কথা বলার স্বাধীনতা, না ছিল শান্তিমতো বেঁচে থাকার অধিকার। সংবিধানের মূলনীতির সবগুলোই ছিল পুস্তকে আর বক্তৃতায়। কাজের কাজ কিছু হয়নি। যেহেতু ওই সব নীতি বাস্তবায়ন করা এখনো সম্ভব হয়নি, তাই মূলনীতিগুলোর সংস্কার করতে হবে। জনগণ ও নতুন প্রজন্ম আলোকিত বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যাশায় সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে। জনতা ও নতুন প্রজন্ম কী চায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশে আমাদের সবার প্রত্যাশা অনেক। বিশেষত গণ-অভ্যুত্থানকারী নতুন প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অধিক। তারা চাকরিক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন চেয়েছিল।

 মোটাদাগে বৈষম্য মুক্তির লক্ষ্যে গণতন্ত্র, মানবিকতা, সমাজের প্রতি দায় ও দরদ, ভোটের অধিকার ও ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের কথা তারা বলেছে। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা বৈষম্যহীন একটি আলোকিত বাংলাদেশ প্রত্যাশা করতেই পারি। প্রত্যাশা করতে পারি, যতদ্রুত সম্ভব সংস্কারকাজ সমাধা করে একটি সুন্দর নির্বাচনের। কার্যকরী গণতান্ত্রিক, আদর্শিক, মানবিক ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যাশায় পুরো প্রজন্ম এখন অপেক্ষমাণ।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
[email protected]

যক্ষ্মা থেকে রক্ষার উপায় কী!

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৫, ০২:১৬ পিএম
যক্ষ্মা থেকে রক্ষার উপায় কী!
ডা. মুশতাক হোসেন

আগামী ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। বাংলাদেশে যক্ষ্মা এখনো একটি বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যক্ষ্মা রোগী রয়েছে এমন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। যক্ষ্মা একটি প্রতিরোধযোগ্য এবং সহজে সারিয়ে তোলা যায় এমন একটি রোগ। তবুও ২০২২ সালে করোনাভাইরাসের পরে দ্বিতীয় রোগ যার দ্বারা সর্বাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, সেটা হচ্ছে যক্ষ্মা। যক্ষ্মায় বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা এইচআইভি/এইডস-এ মৃত্যুর সংখ্যার দ্বিগুণ। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১ কোটির বেশি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়। জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব সদস্য রাষ্ট্র ২০৩০ সাল নাগাদ যক্ষ্মার মহামারি শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে, যার জন্য জরুরিভাবে কাজে নেমে পড়া দরকার।

যক্ষ্মা একটি বায়ুবাহিত রোগ। জীবাণুর নাম মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারক্যুলোসিস। যক্ষ্মায় আক্রান্ত মানুষের কাশি থেকে বায়ুতে যক্ষ্মা ছড়ায়। যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশের পরে দুই বছরের মধ্যে যক্ষ্মায় ভোগার সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে (মোটামুটি ৫ ভাগ)। এর পরে ঝুঁকি অনেক কমে যায়। যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশের পরও কেউ কেউ সংক্রমণকে পরাজিত করতে পারেন। যত মানুষ যক্ষ্মায় ভোগেন, তাদের ৯০ ভাগ পূর্ণ বয়স্ক। নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে যক্ষ্মা রোগী বেশি পাওয়া যায়। পৃথিবীর আনুমানিক এক-চতুর্থাংশ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। 

যক্ষ্মার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অবিরাম কাশি, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা, জ্বর, রাতের বেলা ঘেমে যাওয়া। যদি চিকিৎসা না হয়, তবে এতে মৃত্যুও হতে পারে। যক্ষ্মা সাধারণতঃ ফুসফুসকে আক্রান্ত করে, তবে শরীরের অন্যান্য অংশও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যক্ষ্মা শনাক্তে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার ভালো উন্নতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যক্ষ্মা শনাক্তের জন্য কতকগুলো রেপিড মলিকিউলার পরীক্ষা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন করেছে। এসব পরীক্ষা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মাকেও একই সঙ্গে শনাক্ত করতে পারে। এ ধরনের পরীক্ষা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে করা যেতে পারে। রোগী যখন চিকিৎসাকেন্দ্রে আসেন তখনই তার প্রশ্রাব নিয়ে লেটারাল ফ্লো পরীক্ষা করে যক্ষ্মা শনাক্ত করা যেতে পারে। এ পরীক্ষাটিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন করে। এ পরীক্ষার প্রধান ব্যবহার হচ্ছে গুরুতর এইচআইভি রোগীর যক্ষ্মা শনাক্তে। রেপিড মলিকিউলার পরীক্ষার সঙ্গে এটিও পরীক্ষা করা হয়। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এখনো মাইক্রোস্কোপে থুতু পরীক্ষা করে যক্ষ্মা শনাক্ত করা হয়। এ পরীক্ষাটি ১০০ বছরেরও আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে দ্রুত হারে এ পরীক্ষার বদলে এখন রেপিড পরীক্ষা চালু হচ্ছে। যক্ষ্মা শনাক্তের জন্য কালচার পরীক্ষা হচ্ছে আদর্শ পদ্ধতি। তবে যক্ষ্মা শনাক্তের পর তার চিকিৎসায় অগ্রগতি হচ্ছে কি না তা জানার জন্য কালচার বা থুতু পরীক্ষা করা যেতে পারে। 

বাংলাদেশে যক্ষ্মার প্রকোপ কতটুকু সেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর আগে বৈজ্ঞানিক অনুমান করে বের করত। এ দেশে যক্ষ্মার প্রথম জাতীয়ভিত্তিক জরিপ হয় ২০১৫-১৬ সালে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি সহায়তায় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এ জরিপ পরিচালনা করে। আমি এ জরিপ কর্মের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলাম। প্রধান অনুসন্ধানকারী ছিলেন আইইডিসিআর-এর তৎকালীন পরিচালক প্রফেসর ডা. মাহমুদুর রহমান।

এ জরিপের লক্ষ্য ছিল মাইকোব্যাকটেরিয়ম টিউবারকুলোসিস (যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া) দ্বারা সংক্রমিত রোগের বিস্তার ভালোভাবে বোঝা এবং বাংলাদেশে যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও উন্নত করার উপায় বের করা। উদ্দেশ্য ছিল: (ক) ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী মানুষের মাঝে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় (কালচার জিনএক্সপার্ট অথবা রিফামপিসিন সংবেনশীল) নিশ্চিত হওয়া ফুসফুসের যক্ষ্মা রোগীর ব্যাপকতা (প্রিভ্যালেন্স) পরিমাপ করা; (খ) ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী মানুষের মাঝে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া রোগীদের মাঝে থুতু পরীক্ষায় শনাক্ত যক্ষ্মা রোগীদের ব্যাপকতা পরিমাপ করা; (গ) লক্ষণ দেখে অনুমান করা যক্ষ্মা রোগীদের ব্যাপকতা পরিমাপ করা।

জরিপটি প্রস্থচ্ছেদ নকশা (ক্রসসেকশনাল ডিজাইন) অনুসরণ করেছে। নমুনার আকার হিসাব করা হয়েছিল ১ লাখ মানুষ। আকারের সমানুপাতিক সম্ভাবনা (প্রোব্যাবিলিটি প্রোপোরশনালিটি টু সাইজ) সূত্র ব্যবহার করে ১২৫টি গুচ্ছকে শহর অঞ্চলে ৪৬টি এবং গ্রামাঞ্চলে ৭৯টি গুচ্ছ (ক্লাস্টার) বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গুচ্ছে ৮০০ জন মানুষকে জরিপের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়। গ্রামাঞ্চলে একটা ইউনিয়নকে প্রাথমিক নমুনা একক (প্রাইমারি স্যাম্পল ইউনিট) হিসেবে ধরা হয়, অনুরূপভাবে শহরাঞ্চলে একটা ওয়ার্ডকে প্রাথমিক নমুনা একক ধরা হয়। গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রতিজনকে যক্ষ্মার লক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় ও তার বুকের এক্স-রে করা হয়। যাদের লক্ষণ অথবা অস্বাভাবিক এক্স-রে দ্বারা যক্ষ্মা সন্দেহ করা হয়েছে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে থুতু দিতে বলা হয়েছে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার জন্য। তাদের পরদিন সকালেও থুতু দিতে বলা হয়েছে। এ থুতু জাতীয় যক্ষ্মা রেফারেন্স ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা, কালচার ও জিনএক্সপার্ট/ রিপামপিসিন সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করা হয়েছে। বুকের এক্স-রে কেন্দ্রীয় রেডিওলজিস্টরাও পর্যালোচনা করেছেন। 

একটি কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞ দল যক্ষ্মার লক্ষণ বাছাই ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষার ফলাফল, কালচার ও জিনএক্সপার্ট/ রিফামপিসিন পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে জরিপে অংশ নেওয়া মানুষের জরিপের সংজ্ঞা অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করেছেন।

অংশগ্রহণকারীদের মাঝে ১৯,০৫৮ (১৯.৩ ভাগ) ছিলেন ধূমপায়ী। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে যক্ষ্মায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি পাওয়া গেছে। যত বয়স বেশি তত বেশি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দেখা গেছে। যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি তাদের মধ্যে যক্ষ্মার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। গ্রামাঞ্চলের চাইতে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে যক্ষ্মার ঝুঁকি বেশি পাওয়া গেছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তার বেশি বয়সী প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ২৬০ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত। সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে অনুমিত হয় যে, প্রতি বছর প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ২২১ জন নতুন করে (ইনসিডেন্স) যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। আরও হিসাব করে দেখা গেছে যে, যতজন মানুষ যক্ষ্মা রোগী বলে স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে প্রজ্ঞাপিত (নোটিফিকেশন) হয়েছেন, যক্ষ্মা রোগীর ব্যাপকতা (প্রিভ্যালেন্স) তার চেয়ে ২.৮ গুণ। অর্থাৎ সব বয়সী যক্ষ্মা রোগীর অর্ধেকেরও বেশি শনাক্তের বাইরে থাকেন। পঁয়ষট্টি বছর বা তার বেশি বয়সী রোগীদের মাঝে এ হার অনেক বেশি, ৪.৩ গুণ। এ জরিপ হয়েছে প্রায় ১০ বছর হয়ে গেছে। নতুন আর একটি জাতীয়ভিত্তিক জরিপের সময় হয়েছে। গত জরিপের ফলাফল এবং অভিজ্ঞতা নতুন জরিপের সময় বিবেচনায় নিতে হবে।

বাংলাদেশে যক্ষ্মার উচ্চ হারের জন্য কতকগুলো কারণকে দায়ী করা যেতে পারে। (১) দেরি করে চিকিৎসা নেওয়া; (২) হাতুড়ে চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া: (৩) সচেতনতার ঘাটতি। সরকার বিনামূল্যে ডটস কর্মসূচির মাধ্যমে যক্ষ্মার ওষুধ দিয়ে থাকে, এটা অনেক মানুষ জানেন না; (৪) দারিদ্র্য।

যক্ষ্মার জন্য যে বিসিজি টিকা আছে, সেটা আবিষ্কার হয়েছিল ১৯২১ সালে। এটা নবজাতক শিশুকে দেওয়া হয়। এরপ আর কোনো নতুন উন্নত টিকা আবিষ্কৃত হয়নি, যদিও যক্ষ্মা পৃথিবীর অন্যতম একটি মরণব্যাধি। এ টিকা শিশুদের মাঝে টিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোগায়, কিন্তু বয়স যত বাড়ে তত এর প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। তাই নতুন আরও উন্নত টিকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। 

একটি নতুন যক্ষ্মার টিকা এম৭২/এএস০১ই-এর তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। জিএসকে বায়োফার্মা কোম্পানি প্রথম এ টিকা প্রস্তুত করেছিল। বয়োসন্ধি ও পূর্ণ বয়স্ক মানুষ যারা সুপ্ত যক্ষ্মায় (ল্যাটেন্ট টিবি) আক্রান্ত তারা এ টিকা থেকে যক্ষ্মা প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করবেন। বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে যক্ষ্মা সংক্রমণের উচ্চহার, সেখানে প্রচুর মানুষের মধ্যে সুপ্ত যক্ষ্মা রয়েছে। যাদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে, দেহে সুপ্ত যক্ষ্মা থাকলেও তারা সাধারণতঃ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন না। 

যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে নিজের দেশকে প্রত্যাহার করে সব চাঁদা বন্ধ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া ইউএসএআইডির সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন, এবং এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যক্ষ্মা, এইচআইভ/এইডসসহ বিভিন্ন জরুরি স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের কার্যকলাপে। এর ফলে যক্ষ্মাজনিত মৃতুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যেতে পারে।
তবে বাংলাদেশ এত দরিদ্র নয়। আমরা কয়েক বছরের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছি। দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করা দেশের সম্পদ দিয়েই সম্ভব। দরকার শুধু অগ্রাধিকার নির্ণয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর কার্যকরী পরিষদ সদস্য
[email protected]