
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি, যিনি দেশটির সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক, এই মাসে দুবাইয়ে তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে দেখা করেছেন। ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার পর থেকে এটি ছিল তালেবানদের সঙ্গে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ।
প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতীয় এই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারত আফগানিস্তানের উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণ, দেশটির স্বাস্থ্য খাত এবং শরণার্থীদের পুনর্বাসনে যথেষ্ট সহায়তা দেবে। ইরানের চাবাহার বন্দরের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ও মানবিক সংযোগ সম্প্রসারণের কথা বিবেচনা করবেন তারা।
এই গুরুত্বপূর্ণ সম্পৃক্ততার প্রশংসা করে আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতকে ‘গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক অংশীদার’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তারা ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আফগানিস্তানের কাছ থেকে কোনো ধরনের হুমকি নেই বলে তারা আশ্বস্ত করেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ী, রোগী এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ভারতীয় ভিসা সুবিধা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছে আফগানিস্তান। এখন পর্যন্ত কোনো দেশ তালেবান সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি।
ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব এবং আফগান ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে এই আলাপচারিতা ছিল তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের একটি বড় বিবর্তনের অংশ। ৯/১১-এর হামলার পর মার্কিন বাহিনী কর্তৃক কান্দাহারে তালেবান আমিরত ধ্বংসের পর ভারত আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির নেতত্বে কাবুল সরকারকে সহযোগিতা করেছিল। তাদের অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রকল্পের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের উন্নয়ন সহায়তাও দিয়েছিল ভারত। এর ফলে আফগানিস্তানের জনগণের মধ্যে ভারতের প্রতি অগাধ বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।
এই সময়কালে তালেবান এবং কাবুল সরকারের মধ্যে তীব্র সংগ্রাম চলছিল, যা মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক জোটের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছিল। ভারত তালেবানকে চরমপন্থি হিসেবে দেখত। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন প্রত্যাহার এবং কাবুলে তালেবানের ক্ষমতায় আসার পর ভারত তার কূটনৈতিক উপস্থিতি এবং উন্নয়ন-সহায়তা বন্ধ করে দেয়।
ভারত আফগান জনগণের সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক বন্ধনের প্রতি সব সময় গুরুত্ব দেয়। সে কারণেই ২০২১ সালের শেষের দিকে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে খাদ্য ও চিকিৎসা-সহায়তা দিয়েছিল। ২০২২ সালের জুনে ভারত কাবুলে তার দূতাবাস পুনরায় চালু করে। তারা তালেবানকে ‘প্রযুক্তিগত দল’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
দুবাইয়ে সাম্প্রতিক দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ভারত-আফগানিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতির ইঙ্গিত দেয়। মূলত পাকিস্তানের প্রভাবের জন্যই এমনটা হয়েছে।
ইসলামাবাদ লক্ষ্য করেছে, তালেবানরা পাকিস্তানের জঙ্গি তেহরিক-ই-তালেবানদের আশ্রয় দিয়ে চলেছে, যারা নিয়মিতভাবে পাকিস্তানে সশস্ত্র হামলা চালায়। একই সঙ্গে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে বিভক্তকারী ২ হাজার ৬৪০ কিলোমিটারজুড়ে ডুরান্ড লাইন নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছে। পাকিস্তানে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে তাদের বিমানগুলো গত বছরের মার্চ এবং ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে তেহরিক-ই-তালেবানের অবস্থানগুলোতে বোমাবর্ষণ করে।
পাকিস্তান এবং তালেবান সরকারের মধ্যে বিভাজন ভারতকে তালেবানের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পর্কের দিকে নিয়ে গেছে। এতে আফগান জনগণের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভারতের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে তালেবানরা পুনর্ব্যক্ত করেছে যে, তারা তাদের ভূখণ্ড ভারতের বিপক্ষ শত্রুদের ব্যবহার করতে দেবে না।
স্বাস্থ্য ও কল্যাণ-সহায়তার মাধ্যমে আফগান জনগণের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন হয়েছে। তালেবানের সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক ভারতের দীর্ঘমেয়াদি ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থেও অবদান রাখবে। এতে চাবাহার বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন জোরদার হবে। লজিস্টিক সংযোগের এই দৃষ্টিভঙ্গি কমপক্ষে দুই দশক ধরে চালু ছিল। কিন্তু আফগানিস্তানের সংঘাতের কারণে তা অনেকটা পিছিয়ে পড়ে। শক্তি, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনার জন্য এই সংযোগগুলো এখন ভারত যথেষ্ট কৌশলগতভাবে অনুসরণ ও ব্যবহার করতে পারে।
যদিও তালেবানদের সঙ্গে যে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে তার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। তবে চলমান পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তা এবং চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, তালেবানরা এখনো ভারত এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশকে বোঝাতে পারেনি যে, তারা তাদের চরমপন্থি বৈশিষ্ট্য পরিত্যাগ করেছে। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনটি কোনো ঐক্যবদ্ধ দল নয়, এটি বিভিন্ন গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত। এদের মধ্যে কিছু গোষ্ঠী ভারতের সঙ্গে উন্নত সম্পর্কের বিরোধিতা করতে পারে। তৃতীয়ত, তালেবানরা পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণ করে না। বিভিন্ন বিরোধী গোষ্ঠী রয়েছে, যা তালেবানদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাত পুনরুজ্জীবিত করতে পারে এবং দেশকে নতুন করে যুদ্ধে প্ররোচিত করতে পারে।
বর্তমানে তালেবান সরকারের আদর্শিক প্রতিশ্রুতি একটু ভিন্ন। তাদের সমমনা চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই এবং তাদের উন্নয়নের চাহিদা পূরণের জন্য বহিরাগত সহায়তা থেকে দূরে অবস্থান নিয়েছে। সন্ত্রাসবাদ ইস্যু নিয়ে তালেবানরা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে। তারা এখন অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং কার্যকর শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় সক্ষম। সবকিছুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক: ভারতীয় সাবেক কূটনীতিক।
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল