
নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার পাশাপাশি সব অংশীজনকে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনার লক্ষ্যে প্রায় ১৮টি উল্লেখযোগ্য জায়গায় ১৫০টির মতো সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। পাশাপাশি নির্বাচনব্যবস্থায় সংস্কার আনতে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে সংবিধানসংক্রান্ত সুপারিশও করা হয়েছে। এরই মধ্যে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের অন্তত তিন সুপারিশ নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে বিদায় নেওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিষয়ে তদন্তভার সংসদীয় স্থায়ী কমিটির হাতে দিলে এবং সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা নিয়ে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ করার সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে তা ইসির স্বাধীনতা ‘খর্ব করবে’ বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমাদের অনেক দিনের দাবি যে, দেশে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী ইসি গঠিত হবে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে যদি সেই স্বাধীনতা আগের চেয়ে খর্ব হয় অথবা নতুনভাবে খর্ব হওয়ার কোনো সুযোগ তৈরি হয়- সেটি কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত হবে না। একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানকে তাদের স্বাধীন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আরেকটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করার বিষয়টি স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। ভবিষ্যতে সীমানা পুনর্নির্ধারণে আলাদা স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন সংস্থা নামে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থা গঠন করার কথা বলা হয়েছে সুপারিশে। ভোটার তালিকা ও সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা ইসির কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশে ক্ষোভ প্রকাশ করে গত ২৬ জানুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে সিইসি বলেন, ‘সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা ইসির কাছ থেকে সরিয়ে নিলে বা এমন কোনো শর্ত আরোপ করলে যাতে কমিশন অভিযোগগুলোর সুরাহা করতে না পারে বা বিবেচনার সময় বাধার সৃষ্টি হয়, তাহলে বিশাল একটা সমস্যা দেখা দেবে।’
তাছাড়া এ কথাও সত্য, নির্বাচন কমিশন একটি ভোটার তালিকা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পুনর্নির্ধারণে নিজেরাই যথেষ্ট জনবল কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু ইসিকে যদি আরেকটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে উল্লিখিত প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়, সেটি নিশ্চয়ই যথাসময়ে নির্বাচন পরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। সীমানা পুনর্নির্ধারণ ইসির সাংবিধানিক ম্যান্ডেট। এটার ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। এ কারণে এ বিষয়ে স্পষ্ট মনে হচ্ছে যে, ভোটার নিবন্ধন অন্যের কাছে দিয়ে দেওয়া অথবা সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেওয়ার ঘটনা ইসির সাংবিধানিক ম্যান্ডের বিরুদ্ধে যেতে পারে। সংবিধান সংশোধন হয়, এমন সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারলে সেটি ভিন্ন চিন্তার সুযোগ তৈরি করবে।
আরেকটি সুপারিশ করা হয়েছে যে, ইসির মেয়াদকাল পূর্ণ হওয়ার অসঙ্গতিপূর্ণ কার্যক্রমের তদারকির দায়িত্ব সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ওপর বর্তাবে। আর এমন অবস্থা বাস্তবায়ন হলে পরবর্তী সময়ে কোনো সংক্ষুব্ধ সংসদ সদস্য উদ্দেশ্যমূলক ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়ে নতুনভাবে ইসির ওপর কোনো তদারকি প্রতিষ্ঠান তৈরি হওয়ার সুযোগ কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হবে কি না, তা ভেবে দেখা দরকার। এ কথা সত্য যে, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নই। কিন্তু বিদ্যমান আইনে ইসির মেয়াদকাল পূর্ণ হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট তদারকি যথাযথভাবে সম্পন্ন হতে পারে।
এমনকি ইসির জনবল, বাজেট ইত্যাদির দায়িত্বও সংসদীয় কমিটির হাতে দেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। আমাদের দেশে সংসদীয় কমিটিগুলো সাধারণত সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের দ্বারা গঠিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। আর এই প্রবণতা রোধ করা না গেলে জনবল এবং বাজেটসংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়তে পারে। যা পরবর্তী সময়ে যেকোনো নির্বাচন, বিশেষ করে উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন (স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুরোধক্রমে) প্রভৃতির বিষয়ে ইসির স্বাধীনতা বাড়বে নাকি কমবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে আমাদের সামনে আসবে। আমরা মনে করি ইসির কার্যক্রমকে আরও বেশি স্বাধীন করতে হলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। এমন পরিস্থিতি যদি যথাযথভাবে সুরাহা না করা যায়, সে ক্ষেত্রে একটি ভালো ও সত্যিকার অর্থে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করা ইসির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে মাথায় রেখে সংস্কার কমিশনকে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ইসির জন্য এমন স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে কোনো বিশেষ মহলের আনুগত্যে নয়, বরং সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে তারা কাজ করতে পারে। একটি ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ইসিকে আগে থেকেই সংবিধানে একেবারে কম ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এ পর্যন্ত দেশে যতগুলো ইসি গঠন করা হয়েছে, তার খুব কমই তাদের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেটার পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পেরেছে। সম্ভবত, সে জন্যই অধিকাংশ কমিশনের কার্যক্রমই বেশির ভাগ মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়নি। নির্বাচনের সময় যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের মন জুগিয়ে চলার কারণেই মূলত ইসি বিতর্কমুক্ত থাকতে পারেনি। আবারও যদি এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, ইসিকে সরকারের মন জুগিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, তাহলে শঙ্কা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাছাড়া যদি কোনো বড় রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজ নির্বাচন আয়োজনের পক্ষে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে ইসিকে প্রভাবিত করে, সেটি নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে শুভ লক্ষণ হবে না। বাংলাদেশ সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীদের প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’
কাজেই নির্বাচন কমিশনই প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। মূলত ইসি এবং প্রশাসনের ভূমিকার ওপরই সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্পর্ক রয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থাকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সংস্কার কমিশনের ন্যায্য সুপারিশগুলো তখনই যথাযথভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব যখন ইসি, প্রশাসন এবং দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ ও ভূমিকা ন্যায্য এবং যৌক্তিক হবে। এমন কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা ভুল হবে, যেগুলো ইসির স্বাধীনতা আরও খর্ব করতে পারে। বরং সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য মাপকাঠির একটি নির্বাচন পরিচালনার জন্য ইসিকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার নিমিত্তে বাজেট, সীমানা পুনর্নির্ধারণ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোয় অধিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]