
রাজনৈতিক আমলনির্বিশেষে যদি গত তিন দশকের ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাতে দেখা যাবে যে, প্রাসঙ্গিক এবং অপ্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ একস্বরে একটি কথা বলে এসেছেন, পাশ্চাত্য বাংলাদেশের মেধাবী তরুণ-তরুণীদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দেশে পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে। এই পাশ্চাত্য বলতে পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা, যথাক্রমে- যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, জামার্নি এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকে বোঝানো হয়ে থাকে। এই বক্তব্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও বিভিন্ন শীর্ষ ব্যক্তিদের কণ্ঠে ও লেখনিতে একই গতিতে শুনতে পাচ্ছি। বছরে গড়ে ৫২ হাজার তরুণ-তরুণী উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ওইসব দেশে গমন করছে।
শিক্ষা শেষে শতকরা ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী আর দেশে না ফিরে সেখানেই চাকরি/পেশা গ্রহণ করে উন্নত জীবনযাপনের লক্ষ্যে এবং কালক্রমে ইমিগ্রেশনের সুবিধা নিয়ে ওইসব দেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ দিচ্ছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারা এমফিল, পিএইচডি বা আরও উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের স্কলারশিপ নিয়ে ওইসব দেশে গমন করে সেখানেই থেকে যাচ্ছেন। দেশের বক্তাদের মতে, এটার নাম মেধা পাচার। এতে নাকি আমাদের দেশ এই মেধাবীদের অভাবের কারণে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ছে আর এতে লাভবান হচ্ছে পাশ্চাত্যের ওইসব দেশ। এই মেধাবীরা স্বদেশে থাকা অবস্থায় বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কী কী আবিষ্কার করেছেন, এই প্রশ্নের উত্তর প্রায় শূন্যের কোঠায়ই থাকবে। তা নিয়ে কোনো মূল্যয়ন না করেও বলা যায় যে, পাশ্চাত্যে উন্নত সমাজে নিজেদের অধিষ্ঠিত করার পর এই লাখ লাখ বাংলাদেশি কোনো মৌলিক আবিষ্কার ওইসব দেশেও করতে পারেননি, সেখানে গবেষণার অবাধ সুযোগ এবং অপরিমিত সম্পদ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও। আর স্বদেশে থাকা অবস্থায়ও তারা আজ পর্যন্ত এমন কিছু উদ্ভাবন করতে পারেননি, যা দিয়ে লাখো কোটি মানুষের কোনো উপকার হয়েছে।
যখন ইংল্যান্ডে জনসংখ্যা ছিল ১ কোটিরও নিচে তখন সেখানে মধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব, টেলিভিশন, বাষ্পীয় জাহাজ ও রেলওয়ে লোকোমোটিভ আবিষ্কার হয়েছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পরম পরিশীলতা লাভ করেছে প্রফিট অ্যান্ড লস অ্যাকাউন্ট, ব্যালেন্স শিট এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বাণিজ্য হিসাব, হিসাব নিরীক্ষা, লাভ-ক্ষতি এবং সেগুলোর পরিচালনপদ্ধতি। কলার ক্ষেত্রে সহস্রাব্দ স্থায়ী উৎকর্ষ অমরাবতী কাব্য, নাটক, উপন্যাস, ব্যঙ্গ এবং অংকনশিল্প। উড়োজাহাজ, চশমা, মোটরগাড়ি, গ্রামোফোন, টেলিফোন, পরিবার পরিকল্পনাপদ্ধতি কিংবা হৃদযন্ত্রের শল্য চিকিৎসা আবিষ্কারে পাশ্চাতের উদ্ভাবকদের কোনো প্রয়োজন পড়েনি আমাদের মেধাবী মানুষ পাচার করে তাদের সঙ্গে শামিল করার। আবিষ্কারগুলো তারাই করেছেন। আমাদের শীর্ষ ব্যক্তিদের কথা হচ্ছে একটি যে, পাশ্চাত্য আমাদের মেধাবীদের পাচার করে নিয়ে গিয়ে নানা প্রলোভন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের সমাজের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে।
ঢাকায় যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য উন্নত দেশের শিক্ষামেলা অনুষ্ঠিত হয় তার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের শোষণ করে ওইসব দেশের উন্নতি সাধন করা। কিন্তু ওসব দেশের ভিসা সেন্টারগুলো ভিন্ন দেশে থাকার ফলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসাপ্রাপ্তীতে অসুবিধা হচ্ছে বলে বিষয়টিতে অতি সম্প্রতি সরকারপ্রধানও বিদেশি সরকারগুলোর প্রতি একটি আহ্বান জানিয়েছেন। তাতে তিনি দিল্লিতে অবস্থিত এই দূতাবাসগুলোকে স্থানান্তর করে ঢাকায় প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, নিশ্চয় আমাদের কর্তব্য তরুণ শিক্ষার্থীরা যেন বিদেশে যেতে না পারে এমন কাজ করা। এবং যারা চলে গেছে ও ফিরে আসছে না, তাদের দেশে ফিরে আসতে আমাদের দূতাবাসগুলো এবং ওই দেশের সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তার বদলে দেখি অভিভাবক, শিক্ষক এবং কিছু রাজনৈতিক দল এই মর্মে অভিযোগ করছেন যে, এই শিক্ষার্থীরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি পরীক্ষায় সফল, বৃত্তি লাভ ও অ্যাসিসট্যান্টশিপ পাওয়া সত্ত্বেও বিদেশি সরকারগুলোর অসহযোগিতার ফলে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন-ইচ্ছুক নবীন শিক্ষার্থীদের ঝামেলা হচ্ছে।
এই অসুবিধার কারণ হলো- ওইসব বিদেশি সরকারের ভিসা সেন্টার ঢাকায় নেই। এখানে তাহলে বিষয় দাঁড়াচ্ছে দুটি। প্রথমত, বিদেশিরা যদি প্রলোভন দেখিয়ে তাদের স্বার্থে মেধা পাচার করতেই চান তাহলে তারা ভিসা প্রদানে বর্তমান জটিলতা সৃষ্টি করছেন কেন? দ্বিতীয়ত, মেধা পাচারে আমাদের দেশ মেধা ও নেতৃত্বশূন্যই যদি হয় তো সেই কাজে কোনো কর্তৃপক্ষ কি মদত দেবে? নাকি বিরত করবে? দূতাবাসগুলোকে ঢাকায় আনার প্রস্তাব তো মেধা পাচারকে উৎসাহিত করারই নামান্তর। এই শিক্ষার্থীরা নিজেরাই মেধাবী অথচ তারা কেন বুঝচ্ছে না যে, পাচার করে তাদের মেধাকে শোষণ করছে পশ্চিমের দেশগুলো। তাদের অভিভাবকরাও এই মেধাবীদের দেশে রাখার চেষ্টার পরিবর্তে পাচার কাজে সহায়তা করছেন কেন? এদের শিক্ষকরাও বেশ মেধাবী। তাদের উচিত এদের পাচার হওয়া থেকে ঠেকানো। তার বদলে তারা নিজেরাও বেআইনি পথে সেই উন্নত দেশে গিয়ে থেকে যাচ্ছেন।
অর্থাৎ মেধা পাচারে সহযোগিতা করছেন। এমনিতে স্কুলে অভিভাবক প্রতিনিধি থেকে শুরু করে নানা শ্রমিক সংঘ, অ্যাসোসিয়েশন, ওয়ার্ড কমিশনার এবং সংসদ সদস্য পর্যন্ত হওয়ার জন্য দেখি তীব্র প্রতিযোগিতা, সংঘাত এবং মনোনয়ন-বাণিজ্যের বিস্তর অভিযোগ ও মামলার কথা। তার মানে নেতৃত্ব দেওয়ার লোকের কোনো অভাব নেই। এই ভিড়ের মধ্যে ৫২ হাজার প্রতিবছর বিদেশ গেলে তা সিন্ধু থেকে বিন্দু মাত্র। তাই মেধা ও নেতৃত্বশূন্যতার এই উদ্বেগ জনহিতকর বলে মনে হয় না। এই শিক্ষার্থীরা এই দেশের ভিড় ও চরম প্রতিযোগিতা থেকে উন্নত দেশে চলে গিয়ে উন্নত জীবন ও পেশা ভোগ করছে। কাজেই প্রশ্ন জাগে- এই মেধাশূন্যতা ও নেতৃত্বশূন্যতার অভিযোগটা কাদের? এটা কর্তৃপক্ষেরও বোধ বলে মনে হয় না। কারণ তারাও সরকারিভাবে চেষ্টা করছেন দিল্লি থেকে ভিসা সেন্টারগুলো ঢাকায় স্থানান্তরিত করে যাতে বাংলাদেশের মেধাবীরা সহজেই পশ্চিমের দেশগুলোতে ভর্তি ও ভিসা নিয়ে যেতে পারে।
বেলজিয়ামে অবস্থিত ইউরোপীয় দূতাবাসগুলোয় আমাদের রাষ্ট্রদূতরাও চেষ্টা করছেন যাতে ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করা যায়। কিন্তু তাতেও সুফল মিলছে না বলে সংবাদপত্রে এক রিপোর্টে ছাপা হয়েছে। ওইসব উন্নত দেশ আমাদের মেধাকে পাচার করার কাজে উৎসাহী হওয়ার কথা। কারণ এতে তারা লাভবান হচ্ছে, তাহলে বাস্তবে তারা অসহযোগিতা করছে কেন? যারা এই মুষ্টিমেয় তরুণদের বিদেশ যাওয়ার বিরোধিতা করেন, তাদের পরিমাপবোধটি বোধগম্য নয়। কারণ আমাদের প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৩ হাজার ৪৯৬, আর ভারতের জনসংখ্যার ঘনত্ব ১ হাজার ২৭৫। ভারত এই জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশকে বিদেশে পাঠানোর সুদক্ষ চেষ্টায় নিয়োজিত। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বছরে ২২ লাখ। এই ছোট্ট দেশে তার থেকে বছরে মাত্র ৫২ হাজার শিক্ষার্থী উন্নত দেশে চলে যাওয়া মানে দেশকে প্রচণ্ড এক চাপ থেকে কিছুটা হলেও রেহাই দেওয়া। কারণ এরা উন্নত দেশে গিয়ে উঁচু শ্রেণির হওয়ায় স্বদেশে বিদেশি মুদ্রা প্রেরণ না করলেও নিজেরা মর্যাদাকর পেশা এবং উঁচু বেতনভাতা ও নিরাপদ জীবন ভোগ করছে। তো এর মধ্যে বাধ সাধা কার স্বার্থ রক্ষা করবে? ১৯ কোটি লোক থাকার পরও যদি নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষ খুঁজে না পেয়ে সেখানে শূন্যতা দেখা দেয়, তাহলে আর কত কোটি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সেই নেতৃত্ব দেওয়ার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে? যদি নেতৃত্বশূন্যতাই হয়ে থাকে তাহলে তলাবিহীন ঝুঁড়ি থেকে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসা, গড় আয়ু ৭৪-এ উন্নীত হওয়া, সাক্ষরতা ও শিক্ষার্থীর হার উঁচু হওয়া, গড় আয় ১ হাজার ৪০০ ডলার হওয়া, হাজার হাজার মাইল মসৃণ সড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট, জাতীয় মহাসড়ক, স্বাস্থকেন্দ্র, জলসেচ, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং তাতে প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন হওয়া, ডিজিটালাইজেশনসহ দেশ গ্রাজুয়েশনে উন্নীত হওয়ার মতো কাজগুলো কারা সম্পন্ন করলেন? দেশের নেতৃত্ব কি বিদেশিরা দিয়েছেন? রাজনৈতিকসহ শিক্ষা, বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে হাজার হাজার মানুষ নেতৃত্ব না দিয়ে থাকলে এগুলো কি আপনা-আপনি সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে? পণ্ডিতরা এও বলেন যে, সম্পদ কোনো সমস্যা নয়, তাহলে তা পশ্চিমারা যদি নিয়ে যায়, বাধা দেব কেন? কাজেই যে রহস্যজনক কারণেই হোক যারা এই তথাকথিত মেধা পাচার ও পাশ্চাত্যের শোষণতত্ত্ব দীর্ঘদিন ধরে বলে এসেছেন, তাদের মতকে অগ্রাহ্য করে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান শিক্ষার্থীদের ভিসা ত্বরান্বিত করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। এটি অব্যাহত থাকুক এই প্রত্যাশা।
একদিকে পাশ্চাত্যকে বলব শোষক আবার অন্যদিক সেখানে হাজারে হাজারে যাওয়ার চেষ্টা করব- এই দ্বৈততা পরিষ্কার করে বোঝা জাতির জন্য প্রয়োজন।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল