
কানাডার অন্যতম প্রধান শহর টরন্টো। এই টরন্টোর বাঙালি অধ্যুষিত মেইন স্ট্রিট থেকে ফার্মেসি রোড পর্যন্ত সিটি করপোরেরেশন ‘বাংলা টাউন’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ব্রিক লেন, জ্যাকসন হাইটের মতো ডেনফোর্থে বাংলাদেশের সবই পাওয়া যায়- সেটি খাবার-দাবার, জামা-কাপড়, চাল-ডাল, বই-পুস্তক থেকে সবই। বিকেল-সন্ধ্যের আড্ডা-তাও। সুখবর হলো- বাঙালিরা পৃথিবীর যেখানেই গেছেন, সেখানেই একখণ্ড বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। যেমন- টরন্টো। বিশেষ করে যারা লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক-সংস্কৃতিজন তারা রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, বাংলা বইমেলা, বিভিন্ন জাতীয় দিবস এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানাদি পালন করেন আনন্দঘন আয়োজনের মাধ্যমে। আনন্দের বিষয় হলো, ডেনফোর্থের প্রধান অ্যাভিনিউয়ের অনতিদূরেই ড্যান্টোনিয়া পার্কের পাশে বাঙালিরা বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় ভাষাসংগ্রামীদের স্মরণে গড়ে তুলেছেন শহিদ মিনার।
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে প্রথমবারের মতো কানাডা সফরে গিয়ে এই চমৎকার শহিদ মিনারটি দেখার দারুণ আশা পূর্ণ হলো। আমার অগ্রজ কবি ও সাংবাদিক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল একদিন সকালে শহিদ মিনারটি দেখাতে নিয়ে গেলেন। উল্লেখ্য, শহিদ মিনারটি তার বাসা থেকে মাত্র ছয় মিনিটের হাঁটা পথ। সকালের অদ্ভুত সুন্দর রোদ, মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানালাম। তার পর আমার কয়েকটি ছবি তুলে দিলেন তিনি। এর পর এক মিনিটের পথ হাঁটিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন একটি বাড়ির সামনে, আমার আজকের লেখার শুরুটা এখানেই। ‘টেইক এ বুক গিভ এ বুক’। কানাডিয়ান এক ভদ্রলোকের বাড়ির সামনে দিয়ে একটি ছোট্ট রাস্তা এভোনলি ব্লোবার্ড গেছে এবং তার পাশেই আমাকে দাঁড় করিয়ে আমাকে দেখালেন ছোট্ট একটি লাইব্রেরি- ‘টেইক এ বুক গিভ এ বুক’।
সেটি হলো, আমাদের বাড়ির সামনে যে রকম চিঠির জন্য বক্স থাকে, ঠিক তেমনি। কাঠের তৈরি ঢাকনা বা ডালা দিয়ে আটকানো, ভিতরে গ্লাস ও তাকের ওপর রাখা ১৫ থেকে ১৬টি বই। তিনি জানালেন, এটি একটি উন্মুক্ত পাঠাগার বা লাইব্রেরি, যেখান থেকে যে কোনো ব্যক্তি বা পথচারী পছন্দসই বইটি পড়ার জন্য নিয়ে যেতে পারেন, পড়া শেষে ফেরত দিতেও পারেন, না দিলেও কেউ কিছু বলবেন না। আবার অনেকেই স্ব-ইচ্ছায় এখানে বই রেখে বা দান করেও যেতে পারেন। এতে অন্যকে তার পছন্দের বই পড়ার জন্য দিয়ে যান। কোনো কৃপণতা নেই, উদারতা। বরং বলা যায়, ভালোবাসা অথবা বইয়ের প্রতি নিজের প্রেম অন্যকে বিলিয়ে দেওয়া। এই বইপ্রেমের স্থানটিতে দাঁড়িয়ে আমার এক নতুন অনুভূতি জাগ্রত হলো! এই মিনি বইঘর থেকে তিনি একটি বই পড়তে নিয়ে গেলেন। তার পর আমাকে নিয়ে গেলেন পাশের আরেকটি গলিতে, থ্যারা এভিনিউ; সেখানেও আরও একটি মিনি পাঠাগার। বিচিত্র হলো এই ছোট্ট পাঠাগারের মালিক একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান।
মনে মনে ভাবলাম, ঢাকায় এসে আমার ঘরের পাশে এমন একটা বুক কেস বানাব। আমার উদ্যোগের আগেই আজই অগ্রজের মাধ্যমে খবর পেলাম এ বিষয়ে একটি আনন্দের খবর- সেটি হলো ঢাকার ধানমন্ডি-৭ লেকের পাশে গত ১৪ নভেম্বর রূপা-রাফি নামের এক দম্পত্তি স্থাপন করেছেন একটি উন্মুক্ত লাইব্রেরি। ছবিসহ একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে তিনি তার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। মিসেস রূপার পোস্ট থেকে একটু তুলে ধরছি- ‘জার্মানিতে রাস্তাঘাটে অথবা পার্কে এমন পাবলিক লাইব্রেরি অনেক দেখা যায়। পথচলতি মানুষ সম্পূর্ণ ফ্রিতে এখানে বই পড়তে পারেন। নিজের বাড়িতে বই থাকলে শেয়ারও করা যায়। পড়া হয়ে গেলে ফের যথাস্থানে পাঠকরা বই রেখে দিয়ে যান। এখানে না আছে কোনো নিরাপত্তাকর্মী, না আছে কোনো মেম্বারশিপের ব্যবস্থা।
কেউ চুরিও করে না। অনেক সময় বনে-জঙ্গলে আর নদীর পাশেও এমন লাইব্রেরি দেখেছি আমি।... আমার মনে হলো আমিও তো বাড়ির পাশের লেকে এমন বুক কেস বইসহ বসাতে পারি, মানুষ বই পড়তে পারবে। লেকের এমন একটা জায়গা বেছে নিলাম যেখানে অনেক মানুষ এসে বসে, আড্ডা দেয়, গান গায়। আমি যোগ করে দিলাম বই। যার পড়তে ইচ্ছে করবে, সে পড়বে। এই বুক কেসটা ধানমন্ডি লেকে (রোড-৭) আজ বসালাম আপনাদের সবার জন্য।... বুক কেস আর বইগুলো আপনাদের জন্য উপহার। মানুষ উপহার পাওয়া সবকিছু অনেক যত্ন করে রাখে, নষ্ট হতে দেয় না। আমি জানি আপনারাও এই উপহারগুলো অনেক যত্ন করে রাখবেন, নষ্ট হতে দেবেন না। বইগুলো যত্নের সঙ্গে পড়বেন, তাহলে আপনার পরে আরও অনেক মানুষ পড়তে পারবে। বই পড়া শেষ হলে যত্নের সঙ্গে বুক কেসে রেখে দেবেন।... আপনারাও চাইলে আরও বই যোগ করতে পারেন এখানে। চাইলে সরকার এমন বুক কেস অনেক জায়গায় বসাতে পারে। চাইলে আপনারাও নিজ উদ্যোগে বসাতে পারেন। বড়, ছোট যেকোনো সাইজের বুক কেস। ভালো কাজের সঙ্গে থাকুন, সুখী হোন’। কী চমৎকার কথা। এ তো গেল এক ধরনের পাঠাভ্যাসের উদাহরণ, পাশাপাশি বইপাঠের আরেকটি চমৎকার উদাহরণ আগে আমেরিকায় এবং পরে কানাডা সফরে এসে বাসে এবং মেট্রোতে উঠে দেখলাম এক অপূর্ব দৃশ্য- সেটি হলো অসংখ্য যাত্রী বই পড়ছেন, অর্থাৎ কামরার প্রায় অর্ধেক যাত্রী বই পড়ছেন। যে ক’দিন ট্রেনে উঠেছি- প্রত্যেক দিন বই পড়ার দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি, মনে হয়েছে- ট্রেনের কামড়া যেন একটি লাইব্রেরি।
এখন সবাই বলছেন, মানুষের পাঠাভ্যাস কমে গেছে! কেন কমে গেছে- তার জবাব, মানুষের এখন সময় কম। এখন যান্ত্রিক ও যুক্তির অবাধ তথ্য-প্রবাহের সময়, তাই মানুষ ছুটছে বিত্তবৈভবের পেছনে, মানুষ ছুটছে অন্ধ নেশায়- কী সে নেশা, কী সে স্বপ্ন, কী সে চাওয়া কিংবা কতটা পাওয়া? আগে মানুষ প্রচুর বই কিনত, প্রিন্টেট বই পড়ে অনেক আনন্দ পেত। আগে মানুষ বই কিনে উপহার দিত বিয়ে-জন্মদিন বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে। কিন্তু এখন? এখন সেটিও কমে গেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের বইমেলা হয় বাংলাদেশে, এটি অমর একুশে গ্রন্থমেলা। এ ছাড়া সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সারা বছরই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বইমেলা হয় কিন্তু বইয়ের ক্রেতা তেমন নেই, মানে বইয়ের পাঠক নেই? এখনকার ছেলেমেয়রা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তারা সৃজনশীল বই পড়ছে না। ইতিহাসের বই পড়ছে না। কেন? অনেকে বলছেন, পড়ছে তবে অনলাইনে, মেলা থেকে বইয়ের ক্রেতা কমেনি, কারণ দেশের লোকসংখ্যা বেড়েছে আগের চেয়ে। মত দুদিকেই থাকুক, কিন্তু প্রকৃত সত্য এই প্রজন্মের পাঠাভ্যাস কমে গেছে। তাহলে? তাহলে আর কী- আমরা মানসিকভাবে বড় হতে চাই না? এই না চাওয়ার মধ্যে আমরা অভিভাবকরাও আছি, শিক্ষকরাও আছি, সবাই আছি।
আমরা যে বলি, আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এই ভবিষ্যৎগামীদের কি আমরা কিছু দিতে পারছি, তারা যে আপনার-আমার সামনেই আচার-আচরণে বদলে যাচ্ছে- তা কি আমরা টের পাচ্ছি না? এ দেশে অসংখ্য মেধাবী তরুণ আছে। তাদের সঠিক উপায়ে গড়ে তুলতে হবে, তাদের পরিচর্যা করে পরিশীলিত করে গড়ে তুলতে হবে। এই তোলার ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হলো তাদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এজন্য দিনের ২৪ ঘণ্টার অন্তত ১ ঘণ্টা সময় আমরা বই নিয়ে কাটাব, আমাদের ভেতরে যতই ক্রাইসিস থাকুক? প্রবাদে আছে- নিজে বাঁচলে বাপের নাম। কাজেই আসুন, আজই আমরা আমাদের সন্তানের হাতে ভালো বই তুলে দিই, অনুরোধ করি বই পড়তে। শিক্ষিত জাতি আর উন্নত দেশ গড়তে এর বিকল্প নেই।
লেখক: কবি
[email protected]