ঢাকা ১০ চৈত্র ১৪৩১, সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫
English

ইনকোয়ারি করতে হবে

প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৪৩ পিএম
ইনকোয়ারি করতে হবে
আবু আলম মো. শহীদ খান

দলীয় সরকার থাকলে তখন একটা চাপ থাকেই। শেখ হাসিনার সরকারের যে একটা চাপ ছিল, সে কারণে দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে নাই, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নাই। এখন যেহেতু তারা চাপমুক্ত, সে কারণে তারা রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে প্রথম স্টেজে যেসব ইনকোয়ারি করা দরকার সেগুলো করবে এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে পাশাপাশি শুধুই রাজনৈতিক ব্যক্তি কেন? প্রশাসন, পুলিশ, জুডিশিয়ারিসহ যার বিরুদ্ধেই অভিযোগ আসুক না কেন, তাদের সবার বিষয়ে রেগুলার ইনকোয়ারি করতে হবে। কোনো বাছবিচার করা যাবে না। সংবিধান ও আইন তো কাউকে বাছবিচার করার সুযোগ দেয়নি। তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তারা কাজটা করবে। তারা হয়তো তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী আগে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে। দুদক যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে, আগে রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে পরে সরকারি চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, এরকম বাছবিচার করা যাবে না। তাতে হয়তো জনমনে প্রশ্ন উঠবে যে, তাহলে কি সরকারি কর্মকর্তারা আইনের ঊর্ধ্বে থাকবেন? 

 সাবেক সচিব 

যক্ষ্মা থেকে রক্ষার উপায় কী!

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৫, ০২:১৬ পিএম
যক্ষ্মা থেকে রক্ষার উপায় কী!
ডা. মুশতাক হোসেন

আগামী ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। বাংলাদেশে যক্ষ্মা এখনো একটি বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যক্ষ্মা রোগী রয়েছে এমন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। যক্ষ্মা একটি প্রতিরোধযোগ্য এবং সহজে সারিয়ে তোলা যায় এমন একটি রোগ। তবুও ২০২২ সালে করোনাভাইরাসের পরে দ্বিতীয় রোগ যার দ্বারা সর্বাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, সেটা হচ্ছে যক্ষ্মা। যক্ষ্মায় বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা এইচআইভি/এইডস-এ মৃত্যুর সংখ্যার দ্বিগুণ। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১ কোটির বেশি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়। জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব সদস্য রাষ্ট্র ২০৩০ সাল নাগাদ যক্ষ্মার মহামারি শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে, যার জন্য জরুরিভাবে কাজে নেমে পড়া দরকার।

যক্ষ্মা একটি বায়ুবাহিত রোগ। জীবাণুর নাম মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারক্যুলোসিস। যক্ষ্মায় আক্রান্ত মানুষের কাশি থেকে বায়ুতে যক্ষ্মা ছড়ায়। যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশের পরে দুই বছরের মধ্যে যক্ষ্মায় ভোগার সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে (মোটামুটি ৫ ভাগ)। এর পরে ঝুঁকি অনেক কমে যায়। যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশের পরও কেউ কেউ সংক্রমণকে পরাজিত করতে পারেন। যত মানুষ যক্ষ্মায় ভোগেন, তাদের ৯০ ভাগ পূর্ণ বয়স্ক। নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে যক্ষ্মা রোগী বেশি পাওয়া যায়। পৃথিবীর আনুমানিক এক-চতুর্থাংশ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। 

যক্ষ্মার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অবিরাম কাশি, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা, জ্বর, রাতের বেলা ঘেমে যাওয়া। যদি চিকিৎসা না হয়, তবে এতে মৃত্যুও হতে পারে। যক্ষ্মা সাধারণতঃ ফুসফুসকে আক্রান্ত করে, তবে শরীরের অন্যান্য অংশও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতে পারে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যক্ষ্মা শনাক্তে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার ভালো উন্নতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যক্ষ্মা শনাক্তের জন্য কতকগুলো রেপিড মলিকিউলার পরীক্ষা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন করেছে। এসব পরীক্ষা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মাকেও একই সঙ্গে শনাক্ত করতে পারে। এ ধরনের পরীক্ষা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে করা যেতে পারে। রোগী যখন চিকিৎসাকেন্দ্রে আসেন তখনই তার প্রশ্রাব নিয়ে লেটারাল ফ্লো পরীক্ষা করে যক্ষ্মা শনাক্ত করা যেতে পারে। এ পরীক্ষাটিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন করে। এ পরীক্ষার প্রধান ব্যবহার হচ্ছে গুরুতর এইচআইভি রোগীর যক্ষ্মা শনাক্তে। রেপিড মলিকিউলার পরীক্ষার সঙ্গে এটিও পরীক্ষা করা হয়। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এখনো মাইক্রোস্কোপে থুতু পরীক্ষা করে যক্ষ্মা শনাক্ত করা হয়। এ পরীক্ষাটি ১০০ বছরেরও আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে দ্রুত হারে এ পরীক্ষার বদলে এখন রেপিড পরীক্ষা চালু হচ্ছে। যক্ষ্মা শনাক্তের জন্য কালচার পরীক্ষা হচ্ছে আদর্শ পদ্ধতি। তবে যক্ষ্মা শনাক্তের পর তার চিকিৎসায় অগ্রগতি হচ্ছে কি না তা জানার জন্য কালচার বা থুতু পরীক্ষা করা যেতে পারে। 

বাংলাদেশে যক্ষ্মার প্রকোপ কতটুকু সেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর আগে বৈজ্ঞানিক অনুমান করে বের করত। এ দেশে যক্ষ্মার প্রথম জাতীয়ভিত্তিক জরিপ হয় ২০১৫-১৬ সালে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি সহায়তায় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এ জরিপ পরিচালনা করে। আমি এ জরিপ কর্মের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলাম। প্রধান অনুসন্ধানকারী ছিলেন আইইডিসিআর-এর তৎকালীন পরিচালক প্রফেসর ডা. মাহমুদুর রহমান।

এ জরিপের লক্ষ্য ছিল মাইকোব্যাকটেরিয়ম টিউবারকুলোসিস (যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া) দ্বারা সংক্রমিত রোগের বিস্তার ভালোভাবে বোঝা এবং বাংলাদেশে যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও উন্নত করার উপায় বের করা। উদ্দেশ্য ছিল: (ক) ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী মানুষের মাঝে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় (কালচার জিনএক্সপার্ট অথবা রিফামপিসিন সংবেনশীল) নিশ্চিত হওয়া ফুসফুসের যক্ষ্মা রোগীর ব্যাপকতা (প্রিভ্যালেন্স) পরিমাপ করা; (খ) ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী মানুষের মাঝে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া রোগীদের মাঝে থুতু পরীক্ষায় শনাক্ত যক্ষ্মা রোগীদের ব্যাপকতা পরিমাপ করা; (গ) লক্ষণ দেখে অনুমান করা যক্ষ্মা রোগীদের ব্যাপকতা পরিমাপ করা।

জরিপটি প্রস্থচ্ছেদ নকশা (ক্রসসেকশনাল ডিজাইন) অনুসরণ করেছে। নমুনার আকার হিসাব করা হয়েছিল ১ লাখ মানুষ। আকারের সমানুপাতিক সম্ভাবনা (প্রোব্যাবিলিটি প্রোপোরশনালিটি টু সাইজ) সূত্র ব্যবহার করে ১২৫টি গুচ্ছকে শহর অঞ্চলে ৪৬টি এবং গ্রামাঞ্চলে ৭৯টি গুচ্ছ (ক্লাস্টার) বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গুচ্ছে ৮০০ জন মানুষকে জরিপের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়। গ্রামাঞ্চলে একটা ইউনিয়নকে প্রাথমিক নমুনা একক (প্রাইমারি স্যাম্পল ইউনিট) হিসেবে ধরা হয়, অনুরূপভাবে শহরাঞ্চলে একটা ওয়ার্ডকে প্রাথমিক নমুনা একক ধরা হয়। গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রতিজনকে যক্ষ্মার লক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় ও তার বুকের এক্স-রে করা হয়। যাদের লক্ষণ অথবা অস্বাভাবিক এক্স-রে দ্বারা যক্ষ্মা সন্দেহ করা হয়েছে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে থুতু দিতে বলা হয়েছে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার জন্য। তাদের পরদিন সকালেও থুতু দিতে বলা হয়েছে। এ থুতু জাতীয় যক্ষ্মা রেফারেন্স ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা, কালচার ও জিনএক্সপার্ট/ রিপামপিসিন সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করা হয়েছে। বুকের এক্স-রে কেন্দ্রীয় রেডিওলজিস্টরাও পর্যালোচনা করেছেন। 

একটি কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞ দল যক্ষ্মার লক্ষণ বাছাই ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষার ফলাফল, কালচার ও জিনএক্সপার্ট/ রিফামপিসিন পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে জরিপে অংশ নেওয়া মানুষের জরিপের সংজ্ঞা অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করেছেন।

অংশগ্রহণকারীদের মাঝে ১৯,০৫৮ (১৯.৩ ভাগ) ছিলেন ধূমপায়ী। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে যক্ষ্মায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি পাওয়া গেছে। যত বয়স বেশি তত বেশি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দেখা গেছে। যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি তাদের মধ্যে যক্ষ্মার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। গ্রামাঞ্চলের চাইতে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে যক্ষ্মার ঝুঁকি বেশি পাওয়া গেছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তার বেশি বয়সী প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ২৬০ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত। সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে অনুমিত হয় যে, প্রতি বছর প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ২২১ জন নতুন করে (ইনসিডেন্স) যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। আরও হিসাব করে দেখা গেছে যে, যতজন মানুষ যক্ষ্মা রোগী বলে স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে প্রজ্ঞাপিত (নোটিফিকেশন) হয়েছেন, যক্ষ্মা রোগীর ব্যাপকতা (প্রিভ্যালেন্স) তার চেয়ে ২.৮ গুণ। অর্থাৎ সব বয়সী যক্ষ্মা রোগীর অর্ধেকেরও বেশি শনাক্তের বাইরে থাকেন। পঁয়ষট্টি বছর বা তার বেশি বয়সী রোগীদের মাঝে এ হার অনেক বেশি, ৪.৩ গুণ। এ জরিপ হয়েছে প্রায় ১০ বছর হয়ে গেছে। নতুন আর একটি জাতীয়ভিত্তিক জরিপের সময় হয়েছে। গত জরিপের ফলাফল এবং অভিজ্ঞতা নতুন জরিপের সময় বিবেচনায় নিতে হবে।

বাংলাদেশে যক্ষ্মার উচ্চ হারের জন্য কতকগুলো কারণকে দায়ী করা যেতে পারে। (১) দেরি করে চিকিৎসা নেওয়া; (২) হাতুড়ে চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া: (৩) সচেতনতার ঘাটতি। সরকার বিনামূল্যে ডটস কর্মসূচির মাধ্যমে যক্ষ্মার ওষুধ দিয়ে থাকে, এটা অনেক মানুষ জানেন না; (৪) দারিদ্র্য।

যক্ষ্মার জন্য যে বিসিজি টিকা আছে, সেটা আবিষ্কার হয়েছিল ১৯২১ সালে। এটা নবজাতক শিশুকে দেওয়া হয়। এরপ আর কোনো নতুন উন্নত টিকা আবিষ্কৃত হয়নি, যদিও যক্ষ্মা পৃথিবীর অন্যতম একটি মরণব্যাধি। এ টিকা শিশুদের মাঝে টিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোগায়, কিন্তু বয়স যত বাড়ে তত এর প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। তাই নতুন আরও উন্নত টিকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। 

একটি নতুন যক্ষ্মার টিকা এম৭২/এএস০১ই-এর তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। জিএসকে বায়োফার্মা কোম্পানি প্রথম এ টিকা প্রস্তুত করেছিল। বয়োসন্ধি ও পূর্ণ বয়স্ক মানুষ যারা সুপ্ত যক্ষ্মায় (ল্যাটেন্ট টিবি) আক্রান্ত তারা এ টিকা থেকে যক্ষ্মা প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করবেন। বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে যক্ষ্মা সংক্রমণের উচ্চহার, সেখানে প্রচুর মানুষের মধ্যে সুপ্ত যক্ষ্মা রয়েছে। যাদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে, দেহে সুপ্ত যক্ষ্মা থাকলেও তারা সাধারণতঃ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন না। 

যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে নিজের দেশকে প্রত্যাহার করে সব চাঁদা বন্ধ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া ইউএসএআইডির সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন, এবং এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যক্ষ্মা, এইচআইভ/এইডসসহ বিভিন্ন জরুরি স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের কার্যকলাপে। এর ফলে যক্ষ্মাজনিত মৃতুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যেতে পারে।
তবে বাংলাদেশ এত দরিদ্র নয়। আমরা কয়েক বছরের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছি। দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করা দেশের সম্পদ দিয়েই সম্ভব। দরকার শুধু অগ্রাধিকার নির্ণয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর কার্যকরী পরিষদ সদস্য
[email protected]

ঈদযাত্রায় অনলাইন টিকিট: দরকার ‘আন্তরিক নজর’

প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৫, ০২:১১ পিএম
ঈদযাত্রায় অনলাইন টিকিট: দরকার ‘আন্তরিক নজর’
পার্থ সারথি দাস

হাতের আঙুলে গোনা আর কয়েকটা দিন পেরোলেই পবিত্র ঈদুল ফিতর। এ উপলক্ষে বিভিন্ন প্রস্তুতির মধ্যে অন্যতম প্রস্তুতি হলো পরিবারের সবার সঙ্গে মিলে পবিত্র দিনটি পালন করা। তার জন্য ঢাকা থেকে, বিভিন্ন জেলা থেকে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিতে হয়। শুরু হয় ঈদযাত্রা। এবার ঈদের ছুটিও মিলছে বেশি। বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য এই ছুটি অপেক্ষাকৃত বেশি দিনের। ফলে আনন্দে বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েই গেছে। এবার যাত্রা শুরুর জন্য যাত্রীদের বড় অংশের প্রস্তুতি চলছে। অনেকে ঝামেলা এড়াতে আগেই বাড়ি ফিরছেন। তবে যাত্রীর মূল স্রোত শুরু হয়নি। তা অবশ্য দেখতে দেখতেই শুরু হয়ে যাবে। কয়েক বছর ধরে আগের চেয়ে ঈদযাত্রায় বিঘ্ন কম হচ্ছে। এবার এই যাত্রা আরও ভোগান্তিমুক্ত হোক, সেটাই কামনা। বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে এমনকি উড়োজাহাজে ঈদযাত্রীদের মূল চাপ শুরুর আগেই ভোগান্তি বেশি দেখা যেত টিকিট সংগ্রহে। এবারও যে এ ক্ষেত্রে হয়রানিতে পড়তে হয়নি, তা নয়।

 এই হয়রানি কমানোর ক্ষেত্রে টিকিটপ্রত্যাশীদের সঠিক তথ্য জেনে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে এগোতে হবে। তাহলে হয়রানি বা ভোগান্তির মাত্রা কমবে। এটা বলতেই হবে যে, টিকিট পাওয়ার জন্য অনলাইনে যে ব্যবস্থা চালু রয়েছে তার ব্যবহার বা সুযোগ নেওয়ার বিকল্প নেই। এখন তো ট্রেনের টিকিট শতভাগই বিক্রি হয়েছে অনলাইনে। অথচ এক সময় ট্রেনের টিকিট পেতে আগের রাতেই টিকিটপ্রত্যাশীদের লাইন ধরতে হতো রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে। 

ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য যেমন তেমনি ঈদের পর আবার বাড়ি থেকে ফেরার জন্য বাস, ট্রেন ও লঞ্চের টিকিট সংগ্রহের জন্য জনভোগান্তির শেষ ছিল না। দেড় দশক আগেও এই ভোগান্তি ছিল ভয়াবহ। বাড়িতে যাওয়ার ক্ষেত্রে টিকিট পেতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হতো যাত্রীদের। দেখা যেত, টিকিট না পেয়ে শেষে ট্রাকে, পিকআপে, মোটরসাইকেলেও যাত্রীরা ছুটতেন চরম ঝুঁকি নিয়ে। সড়ক-মহাসড়কে এ কারণেও ঘটত অহরহ দুর্ঘটনা।  

ঈদে বাড়ি যাওয়ার ভোগান্তির মধ্যে অন্যতম ছিল এই টিকিট সংগ্রহের ঝক্কি-ঝামেলা। আকাশপথের বাহনের টিকিট সংগ্রহের জন্যও ভোগান্তি কম ছিল না। অনলাইনে দেশের মানুষ বিভিন্ন সেবা পেতে শুরু করার পর তার ওপর এখন ভরসা বাড়ছেই। এখন তো নিজের ঘরে বসেই টিকিট কাটা যাচ্ছে অনলাইনে। 

প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে ধারাবাহিকভাবেই। গাড়িচালক তার ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করতে পারছেন ঘরে বসেই। মিলছে ভূমিসংক্রান্ত বিভিন্ন সেবা। জীবনের আরও জরুরি সেবার জন্য আগের মতো ছুটতে হচ্ছে না অফিসে। দেশের পরিবহন সেবায়ও অনলাইন বিভিন্ন সেবা পাওয়াকে সহজ করে দিয়েছে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগই এ ব্যবস্থাকে বিকাশের ক্ষেত্রে আরও সহায়ক করে তুলছে। টিকিট কেনার ভোগান্তির জন্য রেলস্টেশনে আগের রাতে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে ধৈর্যধারণ করার পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। বাস কাউন্টারে ভোর থেকে লেগে যেত লাইন। তার পরও টিকিট মিলত না। এই  যে ভোগান্তির দৃশ্য তা আগে আরও ভয়াবহ ছিল। তা আমাদের অনেকের স্মৃতিতেই আছে। 

যাত্রীভোগান্তির ওই অবস্থার লাগাম টেনে ধরতে শুরু করে অনলাইন টিকেটিং ব্যবস্থা। ঘরে, অফিসে বা অন্য কোনো জায়গায় বসে এই টিকিট সংগ্রহ করা সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে। তথ্যই শক্তি। তথ্য না জানলেই বহু বিপদ, বহু ভোগান্তি চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। এটা সচেতন সবাই স্বীকার করে থাকবেন। মাঠের খবর নিলে জানা যায়, অনেকে এখনো অনলাইনে কীভাবে টিকিট সংগ্রহ করতে হয়, সে বিষয়ে স্পস্ট ধারণা রাখেন না। তা না জানার কারণে, অভিজ্ঞতার অভাবে মনের মধ্যে ই-টিকেটিং নিয়ে তাই ভয়, বিভ্রান্তি কাজ করে। তৈরি হয় বিব্রতকর অবস্থা। কিন্তু যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা সুফল ভোগ করার অধিকার হাতছাড়া করেন না। এবারও বাড়ি যাওয়ার আগাম বিক্রি শুরু হয়েছে আগেই। বাস-ট্রেন-লঞ্চের টিকিট বিক্রিও হয়ে গেছে। ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের জন্য গত ১৪ মার্চ থেকে অনলাইনে ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শুরু হয়। শুরু হয় অনলাইনে বিরাট যুদ্ধ।

 তার প্রমাণ মেলে প্রথম দিনেই। প্রথম দিনেই সকাল ৮টা থেকে আধ ঘণ্টার মধ্যে ১৫ হাজার ৭৭৩টি টিকিটের বিপরীতে ২০ লাখ হিট পড়ে। আমরা তা জানতে পারি বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছ থেকে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, আগামী ২৭ মার্চ ভ্রমণের জন্য অগ্রিম টিকিট কাটতে গত ১৭ মার্চ সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ১ কোটি ৫০ লাখ হিট বা টিকিট কাটার চেষ্টা করা হয়। তাতেই বোঝা যায়, টিকিটের চাহিদা কত প্রবল। গেল ২০ মার্চ ৩০ মার্চের টিকিট বিক্রির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে ট্রেনে আগাম টিকিট বিক্রি। শেষ হয়েছে ট্রেনে টিকিট পাওয়ার জন্য অনলাইনে যুদ্ধ। তথ্য বলছে, ২০১২ সালের ২৯ মে সরকারিভাবে চালু হয় অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটার ব্যবস্থা। এক যুগেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ডিজিটাল টিকিট পদ্ধতি আরও সহজ হয়েছে। নানান আলোচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর একটা অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে এই ব্যবস্থা। 

অনেকেই জানেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের ওয়েবসাইট থেকে সর্বোচ্চ ১০ দিন আগে থেকে ট্রেনের টিকিট কেনা যায়। প্রথমেই দরকার হবে সাইটটিতে নিবন্ধন করা। এরপর জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বর দিতে হয়। পরে স্টেশন, ভ্রমণের তারিখ, ট্রেনের শ্রেণি নির্বাচন করতে হয়। এখানে বিদ্যমান আসনের ভিত্তিতে প্রদর্শিত আসনের তালিকা থেকে এক বা একাধিক আসন বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে। দাম পরিশোধ বা পেমেন্টের পদ্ধতিতে রয়েছে ক্রেডিট/ডেবিট বা বিকাশের মতো জনপ্রিয় মোবাইল পেমেন্ট গেটওয়ে। দাম পরিশোধের পর  প্রাপ্ত ই-টিকিটের প্রিন্ট নিয়ে যাত্রার আগে রেলস্টেশনে পৌঁছুতে হয় যাত্রীকে। বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব অ্যাপ ‘রেলসেবা’ আছে অ্যান্ড্রয়েড ও আইফোন উভয় প্ল্যাটফর্মের জন্য। 

বাংলাদেশ রেলওয়ের আগেই অনলাইনে বাংলাদেশ বিমানের আগাম টিকিট পাওয়ার সুবিধা শুরু হয়। সেটি শুরু হয় ২০১০ সাল থেকে। সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে ঘরে বসেই সম্পন্ন করা যায় বিমানের টিকিট বুকিংয়ের কাজ। এখানে গন্তব্য, তারিখ, শ্রেণি নির্বাচন ও ই-মেইল আইডি ও মোবাইল নম্বরসহ যাত্রীর বিস্তারিত তথ্য দিতে হয়। পরে ডিজিটাল ব্যাংকিং বা মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেমের মধ্যে যে একটির মাধ্যমে পরিশোধ করা যায় টিকিটের দাম। শেষে ই-টিকিট প্রদান করা হয় যাত্রীর ই-মেইলে। বিমানের টিকিট সংগ্রহ করা যায় বিমান অ্যাপ থেকেও।

দেশি ও আন্তর্জাতিক পরিবহন মাধ্যমগুলোর ই-টিকিট পেতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে সহজ নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ট্রেনের টিকিটগুলো বিআরআইটিএসের (বাংলাদেশ রেলওয়ে ইন্টিগ্রেটেড টিকেটিং সিস্টেম) সঙ্গে যৌথভাবে ইস্যু করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৪ সাল থেকে সহজ বাস, ট্রেন, লঞ্চ ও বিমানে একক মঞ্চের আওতায় সেবা দেওয়া শুরু করে। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে প্রতিটি পরিবহন মাধ্যমের জন্য আলাদাভাবে রওনা হওয়ার স্থান, গন্তব্য ও যাত্রার তারিখ দেওয়ার পদ্ধতি রয়েছে। এজন্য টিকিট সংগ্রহকারীকে সবসময় ব্যবহার করে এমন ইমেইল ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর দিতে বলা হয়। মোবাইল বা ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমে দাম পরিশোধের পর টিকিটের সফটকপির লিংক পাওয়া যায় ই-মেইল বা এসএমএসের মাধ্যমে। পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায় স্মার্টফোন থেকেও।

অনলাইনে টিকিট সেবার জন্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি গোজায়ান ২০১৭ সাল থেকে দেশের ভেতরের ও বাইরের এয়ার ফ্লাইটকেন্দ্রিক টিকিট সেবা দেওয়া শুরু করে। যদিও ই-টিকিটের পাশাপাশি এটি হোটেল, ট্যুর ও ভিসাসংক্রান্ত সুবিধাও প্রদান করে থাকে। এখান থেকে টিকিট অর্ডার করতে হলে প্রথমে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এর অধীনে টিকিট প্রাপ্তিসহ ফ্লাইটের যাবতীয় আপডেট পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটে ফ্লাইট সার্চের পাশাপাশি একাধিক ফ্লাইটের মধ্যে তুলনা করারও ফিচার রয়েছে। ব্যাংকিং ও মোবাইল পেমেন্ট সিস্টেমগুলোর মধ্যে প্রায় সবগুলোই থাকায় সব শ্রেণির গ্রাহকরাই তা ব্যবহার করতে পারেন।
শেয়ার ট্রিপ নামের প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সাল থেকে দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের জন্য অনলাইন টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা চালু করে। এ ছাড়া ‘ফ্লাইট এক্সপার্ট’ ২০১৭ সালের ১ মার্চ নিয়ে আসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিকিটিং পদ্ধতি। ঘরে বসে বাসের টিকিট সংগ্রহের জন্য রবি আজিয়াটার টিকিটিং পোর্টাল- বিডিটিকিটস, বাইটিকিটস, যাত্রী, পরিবহন.কমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম টিকিটিং সেবা প্রদান করছে। 

অনলাইনে টিকিট পাওয়ার ব্যবস্থা বিকশিত হচ্ছে নীরবে। তবে কোন প্রতিষ্ঠানের সেবা কেমন তা মূল্যায়নের জন্য একটা কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলা যেতে পারে। তা গড়ে তোলা যেতে পারে সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে। তা করা হলে হয়রানি বা অন্য কোনো কারণে প্রতারিত যাত্রীরা অভিযোগ করে প্রতিকার বা সুবিচার পেতে পারেন। সবশেষে বলব, যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে অনলাইনে টিকিট পাওয়ার ব্যবস্থা আরও সহজ করা দরকার। দরকার এ বিষয়ে যাত্রী সচেতনতাও। অনলাইন টিকিট ব্যবস্থার বিকাশে দরকার সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার ‘আন্তরিক নজর’।

লেখক: সাংবাদিক

আন্দোলন করেই এগিয়ে যেতে হবে

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৫, ০৮:৪৯ পিএম
আন্দোলন করেই এগিয়ে যেতে হবে
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

আমাদের দেশে মাদ্রাসা শিক্ষার পেছনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাটা বড়ই পরিষ্কার। সরকারি দান-অনুদান ক্রমাগত বাড়ছে। সনদের স্বীকৃতিও দেওয়া হচ্ছে। সরকার বদল হয়, কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষাকে উৎসাহিত করার নীতিতে কোনো প্রকার ইতরবিশেষ ঘটে না। বরঞ্চ এ ব্যাপারে সরকারগুলো একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। এর পেছনে ভোট পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা তো রয়েছেই, আরও একটি গোপন অভিপ্রায়ও কাজ করে। সেটা হলো, গরিব মানুষকে গরিব করে রাখা।

তা ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগেও মাদ্রাসা খোলা হয় এবং হচ্ছেও। স্কুল খোলার চেয়ে মাদ্রাসা খোলা সহজ এবং লাভজনক। মাদ্রাসা খুলতে খরচ পড়ে কম। সরকারি অনুদান পাওয়া যায়। না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই, ধর্মপ্রাণ মানুষ দান-খয়রাত করবে। কাজটা লাভজনকও বৈকি। একদিকে নয়, দুই দিকে। প্রথমত, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাতারা বড় মাপের ভালো মানুষ বলে খ্যাতি পায়। লোকটি আসলে হয়তো খাঁটি দুর্বৃত্ত, কিন্তু তার সেই পরিচয়টা চাপা পড়ে যায় ধর্মপরায়ণতার লেবাসের অন্তরালে। সামাজিকভাবে এটি একটি ভালো বিনিয়োগ। দ্বিতীয়, এতে পুণ্যলাভও ঘটে। সেটা আরেক ধরনের বিনিয়োগ। তাই দেখা যায়, বিত্তবানরা মাদ্রাসার জন্য টাকা দেয়, কিন্তু স্কুলের ব্যাপারে উৎসাহ দেখায় না। এমনকি অপেক্ষাকৃত কম টাকার মালিক যারা তারাও মনে মনে আশা রাখে, একটা মাদ্রাসা খুলবে।

মাদ্রাসা শিক্ষা যে কত ভয়ংকর হতে পারে, পাকিস্তানের শাসকরা এখন তা অস্থিমজ্জায় টের পাচ্ছে। এক সময় মার্কিন অর্থে তারা মহোৎসাহে মাদ্রাসা খুলেছে, সেখানে জঙ্গিরা তৈরি হয়েছে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হটাবে বলে। তালেবানরা ওইসব মাদ্রাসাতেই শিক্ষিত। এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আর নেই। কিন্তু ওই যে জঙ্গিদের তৈরি করা হয়েছিল তারা তো আছে। আফগানিস্তানে তারা ছিল, এখনো আছে, অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছে। তারা এখন শত্রু খোঁজে, কমিউনিস্টদের না পেয়ে খোদ মার্কিনিদেরই শত্রু মনে করছে। কমিউনিস্টরা শয়তান ছিল, কেননা তারা ছিল ‘নাস্তিক’, এখন মার্কিনিরা শত্রু হয়েছে। কেননা, তারা হলো বিধর্মী। মার্কিনিদের নেতা সন্ত্রাসীশ্রেষ্ঠ জর্জ বুশ তাদের একদা মিত্র তালেবান, আল-কায়েদার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।

 প্রতিক্রিয়ায় ইসলামি জঙ্গিরা নিজেদের মুসলমান পরিচয়টিকে উচ্চে তুলে ধরে বলেছে, তারা জিহাদে লিপ্ত রয়েছে। উভয়পক্ষের অবস্থানই ধর্মীয় মৌলবাদী। বুশের পক্ষে আফগানিস্তান, ইরাক, পারলে ইরান দখল করে নেওয়ার জন্য ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করা অনেক বেশি কার্যকর ছিল। আমেরিকা বিপন্ন, আমাদের খ্রিষ্টান সভ্যতা হুমকির মুখে- এ ধরনের আওয়াজ অধিকতর উপযোগী অন্য দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন, আমাদের তাই যুদ্ধে যেতে হবে বলার তুলনায়। বুশ ছিলেন নব্য-হিটলার। হিটলার ব্যবহার করেছিলেন বর্ণবাদী বিদ্বেষকে, ইনি কাজে লাগিয়েছিলেন ধর্মীয় অহমিকাকে, আর পরিহাসের বিষয় এটাও, যে ইহুদিরা এক সময় হিটলারের বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হয়েছিল, এখন তারাই মার্কিনিদের সাহায্য নিয়ে প্যালেস্টাইনে আরবদের ওপর নির্মম গণহত্য চালাচ্ছে।

সাম্রাজ্যবাদীদের মহানায়ক জর্জ বুশ নিজেকে বলছেন খ্রিষ্টান, তার আক্রমণে বিপন্নরা আত্মপরিচয় খুঁজতে গিয়ে নিজেদের বলছে মুসলমান। শোষক ও শোষিতের ঝগড়াটা তাই পরিণত হচ্ছে খ্রিষ্টান-মুসলমান কলহে। আত্মপরিচয়ের এই প্রশ্নটা আমাদের এ অঞ্চলেও জরুরি হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ আমলে কেউ ছিল হিন্দু, কেউ মুসলমান; পাকিস্তান শাসনামলে আমরা নিজেদের চিনলাম বাঙালি বলে। কিন্তু দেখা গেল, ক্রমে বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে সেই পরিত্যক্ত মুসলমান পরিচয়টিই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। লক্ষণটা কিন্তু একেবারে শুরুতেই দেখা দিয়েছিল। বাহাত্তর সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে নতুন রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব যে বক্তৃতা দেন তাতে তিনি বলেছিলেন যে, আমরা হলাম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলমান রাষ্ট্র, সেই বলাটা কোনো আকস্মিক বিচ্যুতি ছিল না। তার নিজের ভেতরে এবং অনেকের ভেতরেই মুসলমান পরিচয়টি নিয়ে সুপ্ত একটা গর্ববোধ ছিল বৈকি। সুপ্তের ঘুমভাঙা কি আর অস্বাভাবিক ঘটনা?

পরে বাঙালিত্ব নিয়ে গর্বটা কমেছে, কেননা বাঙালির নতুন রাষ্ট্র মানুষকে মুক্তি দেয়নি, যেভাবে দেওয়ার কথা ছিল; আর সেই ফাঁকে মুসলমানত্বের অহমিকাটা নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। পরবর্তী শাসকরা ওই মুসলমান পরিচয়টাকেই বড় করে তুলেছেন। প্রমাণ? সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় করে দেওয়া। আর এরশাদের তো কথাই নেই। তিনি তো একজন ‘সাচ্চা’ মুসলমানই! রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ আরও এগিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছে।

বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভ যখন বাড়ে তখন সেটার জন্য প্রকাশের পথ থাকে দুটো। একটি ডানের, অপরটি বামের। আমাদের শাসকরা বামপন্থাকেই সবচেয়ে বিপজ্জনক বলে মনে করে। যে জন্য আমরা দেখেছি যে, একাত্তরের পরে শেখ মুজিব মনুষ্যসভ্যতার এবং বাঙালির নিকৃষ্টতম শত্রু আল-বদর, রাজাকারদের বিচার করে যেতে পারেননি, কিন্তু নকশাল দেখামাত্রই গুলি করা হবে বলে হুকুম জারি করেছেন। আর ক্ষমতায় এসে জিয়া দেখেছেন তার প্রধান প্রতিপক্ষ হচ্ছে আওয়ামী লীগ, যার জন্য আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রধান ভিত্তি যে ধর্মনিরপেক্ষতা তাকে নির্মূল করার পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু তিনিও জানতেন যে, তার প্রকৃত শত্রু যদি কেউ থাকে তবে তারা আওয়ামী লীগ নয়, বামপন্থিরাই। তাই বামপন্থি কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির মঞ্চে উঠতে হয়েছে এবং রাজাকাররা মন্ত্রী হতে পেরেছে। বামপন্থিদের ধ্বংস করার জন্য তিনি আরও একটি কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, সেটা হলো নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের একাংশকে নিজের দলে টেনে নেওয়া। বামপন্থি ধারা শক্তিহীন হয়েছে, দক্ষিণপন্থিরা চাঙা হয়ে উঠেছে, বর্ষাকালের খালের মতো; তবে তারা খাল থাকেনি, পরিণত হয়েছে নদীতে। জিয়া যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন সেটাও ছিল স্বাভাবিক ঘটনা।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে যা দক্ষিণপন্থিদের সাহায্য করেছে। সেটা হলো তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতন। এর ফলে বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থিরা উল্লসিত এবং বামপন্থিরা বিষণ্ন হয়েছে। তবে বাংলাদেশে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তেমনটা বিশ্বের অন্য কোথাও চোখে পড়েছে কি না জানি না। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল বামপন্থিদের সবচেয়ে পুরানো এবং সর্ববৃহৎ সংগঠন। তাদের একাংশ বলে বসল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, চেষ্টা করল নিজেদের বিলুপ্ত করে দিতে।

বামদিকের পথ অবরুদ্ধ দেখে মানুষের বিক্ষোভ ডানদিকে মোড় নিতে চাইল। তাতে সুবিধা হলো ডানের, এবং ডানের শেষ মাথায় যাদের অবস্থান সেই জামায়াতে ইসলামীর, তারা ক্ষমতালাভের আশায় নাড়াচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে।
বাস্তবতার চেহারাটা এ রকমেরই নির্মম। কিন্তু উপায় কী? প্রতিকার আসবে কোন পথে? গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতায় যারা আস্থা রাখেন না অথচ গণতন্ত্রের কথা বলেন, তারা হয় অজ্ঞ নয়তো ভণ্ড। আমরা আমাদের পরিচয় দিতে চাই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে, মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে নয়। কিন্তু আমাদের শাসকশ্রেণি তা চায় না।

নিজেদের গণতন্ত্রের পথযাত্রী করতে হলে যা করতে হবে তা হলো রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনা এবং সেই সঙ্গে সমাজে মৌলিক অর্থাৎ বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটানো। এই দুটি অত্যাবশ্যকীয় কাজের কোনোটিই সম্ভব হবে না, যদি না শাসকশ্রেণিকে পরাভূত করা যায়। কিন্তু পরাভূত যে করব, সেটা কোন পথে? নির্বাচনের? নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে ওই কর্তব্যপালন সম্ভব নয়, সেটা তো অভিজ্ঞতাই আমাদের বলে দিচ্ছে। নির্বাচনের অর্থ হচ্ছে শাসকশ্রেণির কোন অংশের হাতে আমরা লাঞ্ছিত ও শোষিত হব সেটা ঠিক করা, তার বেশি নয়, কমও নয়। পথটা হলো আন্দোলনের। যে আন্দোলন আমরা অতীতে করেছি, এখন প্রয়োজন তাকে আরও সুসংহত করে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে যাওয়া। নইলে আমরা কেবল আক্ষেপই করব, মুক্তি পাব না। এমনকি সামনে এগোতেই পারব না।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সিরিয়াকে সহায়তা দেওয়া

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৫, ০৮:৪৬ পিএম
যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সিরিয়াকে সহায়তা দেওয়া
ড. আমাল মুদাল্লালি

বাশার আল-আসাদ পরিবারের শাসনামলের কয়েক দশকের নৃশংস সহিংসতা ও নিপীড়নের পর সিরিয়ার আবার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু দেশটির ভাগ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা এখন নির্ভর করছে সিরিয়ার সরকার, তার অংশীদার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। যুক্তরাষ্ট্র আগামী সপ্তাহ এবং মাসগুলোতে কী করে বা কী করতে ব্যর্থ হয় তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। 
গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে সিরিয়াবিষয়ক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট সম্মেলনে মূল বক্তৃতা দেওয়ার সময় পররাষ্ট্র দপ্তরের কাছে পূর্ববিষয়ক সিনিয়র ব্যুরোর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিমোথি লেন্ডারকিং বিষয়টি ভালোভাবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি এবং আমার সহকর্মীসহ আমেরিকান নীতিনির্ধারকদের আগামী চ্যালেঞ্জ সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে কারণ এখন সিরিয়া এবং বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত চলছে’।

এখন সময়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ওয়াশিংটনের নতুন প্রশাসন তাদের সিরিয়ানীতি প্রণয়ন করছে। আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক কৌশলগত সাফল্যে প্রশাসন মজা লুটতে পারে। কারণ ইরানকে বিতাড়িত করা হয়েছে। হিজবুল্লাহ ইরান থেকে যাবতীয় অস্ত্র সরবরাহের জন্য স্থলপথ হারিয়েছে। রাশিয়া দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং সিরিয়ায় তাদের উপস্থিতির ভবিষ্যৎ এখন ক্ষীণ। গত মাসে সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান জিম রিশ ‘আগুনের বলয়’-এর অবসানকে স্বাগত জানিয়েছেন, যা ‘কয়েক দশক ধরে সন্ত্রাসী প্রক্সি এবং অস্থিতিশীলতা দিয়ে ইসরায়েলকে ঘিরে রেখেছিল এবং এখন তা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন যে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হচ্ছে তা নতুন সিরিয়ায় তার ভবিষ্যৎ সম্পর্ক এবং সেখানে তার সামরিক উপস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ওয়াশিংটনের সিরিয়া বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, দেশ এবং এ অঞ্চলকে স্থিতিশীল করার জন্য বড় একটা সুযোগ এসেছে। তারা ওয়াশিংটনকে তার সতর্কতা পরিত্যাগ করে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ সিরিয়ার যাতে আরব প্রজাতন্ত্রকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে সঠিক পথে আনা যায় এবং সরকারকে শক্তিশালী করা যায়। যেহেতু সিরিয়ায় এখন নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। 

সিনেটর রিশ সিরিয়ানীতি সম্পর্কে ওয়াশিংটনের মনোভাব তুলে ধরে বলেন- ‘সুযোগ এবং ঝুঁকির মধ্যে বিশাল এক বাস্তবতা রয়েছে। অতি শিগগিরই খুব বেশি সম্পৃক্ততা দেখালে আরও নিরাপত্তা সমস্যা তৈরি হতে পারে। কোথাও খুব কম সম্পৃক্ততা দেখালে রাশিয়া এবং ইরান আবারও উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা দেখাবে। এতে ইঙ্গিত বহন করতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আগ্রহ নেই, যা বড় ভুল ধারণা হবে। 

গত সপ্তাহের মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট সম্মেলনে তিনটি থিংকট্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ‘রিইমেজিনিং সিরিয়া’ নামে একটি নতুন প্রতিবেদনে সিরিয়ার উত্তরণকে ‘সফল হওয়ার বড় সুযোগ’ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। এটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পক্ষে এবং যুক্তি দেয় যে বিচ্ছিন্নতার চেয়ে ‘সিরিয়ায় পরিবর্তনের সুযোগ এবং দিকনির্দেশ করার’ ক্ষেত্রে সম্পৃক্ততার সম্ভাবনা বেশি।

যদিও নতুন সিরিয়ার নেতারা এখন পর্যন্ত সঠিক কথা বলেছেন এবং সেভাবেই করেছেন। তবুও কিছু সংশয়বাদী এবং অন্যরা আছেন, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের নাতাশা হলের মতে, ‘সিরিয়ার সরকার ব্যর্থ হোক এবং সিরিয়ায় বিশৃঙ্খলা চায়’। তিনি বিশ্বাস করেন যে, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করলে ‘এই সরকার টিকে থাকার কোনো উপায় নেই’। বিশেষজ্ঞরা ওয়াশিংটনকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, শ্বাসরুদ্ধকর নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখে নতুন সিরিয়াকে রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া উচিত নয়। অন্যদিকে, সংশয়বাদীরা সরকারের কিছু পদক্ষেপকে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন।

দুর্ভাগ্যবশত, সম্প্রতি সিরিয়ার উপকূলে সংঘটিত সহিংসতা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে বিরোধিতাকারী সন্দেহবাদীদের আরও শক্তিশালী করেছে। এখন বাস্তব আশঙ্কা হলো, যা ঘটেছে তা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে ওয়াশিংটনের অবস্থানকে আরও শক্ত করে তুলতে পারে।

এখনো পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বিষয়টি নিয়ে কোনো গুরুত্ব দেননি। তবে এই সময়কালে প্রশাসন এগিয়ে যাওয়ার দিকে ঝুঁকেছে। অন্যান্য রপ্তানি সীমিত করে সিরিয়ায় মানবিক সহায়তা বাড়ানোর দিকে হাত দিয়েছে। 
জানুয়ারিতে, বাইডেন প্রশাসন সিরিয়ায় ছয় মাসের জন্য সীমিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার মঞ্জুর করে। রয়টার্সের মতে, গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসন কাতারকে জর্ডানের মাধ্যমে সিরিয়ায় গ্যাস সরবরাহের অনুমোদন দিয়েছে, যাতে দেশটির বিদ্যুৎ সরবরাহে সহায়তা করা যায়।

হোয়াইট হাউস সিরিয়া সরকার এবং কুর্দিশ সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেসের মধ্যে চুক্তির আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে জানা গেছে। যেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ সিরিয়ায় একীভূত করার’ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।

কিন্তু সিরিয়া এখনো পরীক্ষাধীন। লেন্ডারকিং বলেন, দামেস্কের অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে ওয়াশিংটনের ‘বড় প্রশ্ন’ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এই নতুন নেতৃত্ব এবং (অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার ওপর নজর রাখছি এবং সতর্কতা নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি যাতে তারা প্রকৃত কি না তা দেখা যায়’।
এর মধ্যে বড় পরীক্ষা হলো উপকূলে যা ঘটেছিল তার জবাবদিহি করা। লেন্ডারকিং বলেন, ‘সিরিয়ায় জবাবদিহি কেবল একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতাই নয়, স্থিতিশীলতা ও সামাজিক সংহতির জন্যও এটি অপরিহার্য’। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং বিদেশি যোদ্ধাদের সিরিয়ার ভবিষ্যৎ সরকার বা সামরিক বাহিনীতে কোনো ভূমিকা থাকা উচিত নয়। লেন্ডারকিং বলেন, ‘সিরীয় ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতি অঙ্গীকারের নিদর্শন হিসেবে’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় বিদেশি যোদ্ধাদের সরকারি পদ এবং দেশ থেকে বহিষ্কার করা হোক।

১৯৭৯ সাল থেকে সিরিয়া নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে, কিন্তু ২০১৯ সালের সিজার সিরিয়া বেসামরিক সুরক্ষা আইন যা সিরিয়ার জনগণের বিরুদ্ধে বর্বরতার কারণে বাশার আসাদ এবং তার সরকারকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছিল। এখন সেই একই সিরিয়ান জনগণকে সাহায্য করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে যাদের সুরক্ষার জন্য এটি প্রণীত করা হয়েছিল। সিরিয়া সরকার এবং তার সামরিক মেরুদণ্ডকে ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিন্তু দেশ এবং তার অর্থনীতিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের হাত বাঁধা থেকে নিষেধাজ্ঞাগুলো থামানো কঠিন প্রমাণিত হচ্ছে।

গত মাসে রিশ ‘সিজার নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে তুলে নেওয়ার’ প্রস্তাব করেছিলেন এবং নতুন সরকার কীভাবে কাজ করে তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে, ‘আমরা সেই নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেওয়ার ধারা অব্যাহত রাখব’। তিনি শর্তসাপেক্ষ এবং ধীরে ধীরে নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটি ‘গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা স্বার্থ’ তুলে ধরেছিলেন। দেশটিকে ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমাদের অংশীদারদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলার জন্য ‘লঞ্চিং প্যাড’ হতে না দেওয়া, সিরিয়া থেকে রাশিয়া এবং ইরানকে স্থায়ীভাবে বিতাড়িত করা, আসাদের মাদক সাম্রাজ্য ধ্বংস করা, আসাদ সরকারের হাতে আটক আমেরিকান সিরিয়ানদের জন্য জবাবদিহি করা এবং স্বৈরশাসনে ফিরে না আসা নিশ্চিত করা।

কিন্তু এমন কিছু লোক আছেন যারা বিশ্বাস করেন যে, দামেস্কের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের একমাত্র উপায় হলো ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তিতে যোগদানের বিষয়ে আলোচনা শুরু করা। যার অর্থ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা যেমনটি আটলান্টিক কাউন্সিলের থমাস ওয়ারিক গত সপ্তাহে MEI সম্মেলনে বলেছিলেন।
ওয়াশিংটন যখন তার সিরিয়ানীতি নির্ধারণ করছে, তখন মনে রাখা ভালো যে, কৌশলগত সুবিধাগুলো সংরক্ষণ করা। এমন একটি উন্মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সিরিয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালানো যা ইরানের অক্ষের অংশ নয় বা তার প্রতিবেশীদের জন্য হুমকি না হয়। এ ধরনের সিরিয়া অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাস্তবে ছিল না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উচিত সিরিয়াকে একটি সুযোগ দেওয়া এবং দেশটির বিষয়ে পুরানোদের কথা না শোনা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। 

লেখক: জাতিসংঘে লেবাননের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত 
অনুবাদ: সানজিদ সকাল

বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বদলানো এখন সময়ের দাবি

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:৪২ পিএম
বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বদলানো এখন সময়ের দাবি
আনু মুহাম্মদ

বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির জন্য পুরো ব্যবস্থার বদল দরকার। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বৈষম্যের ভিত তৈরি করে। শিক্ষা হতে হবে সব নাগরিকের অধিকার এবং তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। অভিন্ন এবং উন্নত মানের শিক্ষা শ্রেণি, জাতি, লিঙ্গ, ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে একই সঙ্গে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য অভিভাবকদের আর্থিক দুশ্চিন্তা বা সংকটের সমাধান করতে হবে।...

দেশে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শিক্ষাবঞ্চিত অথবা শ্রমিক। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় অনেকেই লেখাপড়ার পরিবেশ থেকে দূরে সরে গেছে। এই অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই নেওয়ার কথা। তা এখনো অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘু অনেক মানুষ নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে দিন-রাত কাটাচ্ছেন এখনো। বহু কারখানা অচল হয়ে বর্তমানে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার। বহু শ্রমিককে বকেয়া মজুরির জন্য এখনো পথে নামতে হচ্ছে। বেশির ভাগ জিনিসপত্রের দাম এখনো সেই ক্রয়ক্ষমতার ওপরেই আছে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ এখনো বিশ্বের মধ্যে নিকৃষ্ট। যানজট, দুর্ঘটনা বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত আছে।  
যেসব প্রকল্প ও চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিপজ্জনক, বাংলাদেশের প্রাণপ্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ এবং যা বড় আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে- এসব প্রকল্প এবং চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন দরকার।

 যেগুলো খুবই ক্ষতিকর, সেগুলো বাতিল করা দরকার। সেজন্য এগুলোর বোঝা থেকে কীভাবে বাংলাদেশ ও মানুষকে রক্ষা করা যায়- সেটা নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া শুরু করা এই সরকারেরই দায়িত্ব। অন্যদিকে বৈষম্যবাদী রাজনীতির নড়াচড়া ক্রমেই বাড়ছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে খাটো বা অস্বীকার করে এই জনপদের মানুষের লড়াইয়ের ঐতিহ্যকে খারিজ করা, সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। জোরজবরদস্তি, ট্যাগিং, মব ভায়োলেন্স ও নারীবিদ্বেষী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মাত্রায়। বলাই বাহুল্য, গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গেলে এসবের পরিবর্তন হতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে সরকারের সরব ও সক্রিয় হওয়াই প্রধান পদক্ষেপ হতে পারে। এখন পর্যন্ত সরকারের ভূমিকা খুবই দুর্বল বলতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, যাদের এই সরকারের না চেনার কথা নয়। এ ছাড়া আবার শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি, যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে এবং এগুলো বহুদিন ধরেই চলছে। এই যে কতিপয় গোষ্ঠীর বাজার নিয়ন্ত্রণ, এটা আগের সরকার ভাঙার বদলে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। বর্তমান সরকারও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এতে সরকারের বিশেষ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। 


বাংলাদেশ ব্যাংককে একটা কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো, যেসব ব্যাংক রাজনৈতিক ও কতিপয় গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল সেগুলোকে পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেওয়া, মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় মুদ্রানীতি প্রণয়ন এগুলো করার জন্য কমিশনের সংস্কার কর্মসূচি বা কমিশনের রিপোর্টের অপেক্ষার দরকার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার যদি ঠিকমতো হয়, ব্যাংকিং ক্ষেত্রে অনিয়মগুলো যদি দূর হয়, বাজারে মুদ্রাব্যবস্থা যদি সুস্থ অবস্থায় আসে, ডলার এক্সচেঞ্জ রেট স্বাভাবিক অবস্থায় আসে, এসবই মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এগুলো নিয়ে আগেই সক্রিয় ভূমিকা দরকার ছিল। সে ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভাষ্য বা কার্যকর উদ্যোগ এখনো আমরা দেখতে পাইনি।

সরকারকে আস্থা তৈরি করতে হবে। অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার হঠাৎ করে গত সরকারের স্টাইলে মানুষের ওপর ভ্যাট ও করের বোঝা চাপিয়ে দিল তা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আস্থা কমাবে, আরও কঠিন অবস্থা তৈরি করবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য। শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত অর্থনীতির যে গতি বা ধারা ছিল, সেখানে অচিন্তনীয় মাত্রায় কতিপয় গোষ্ঠীর লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল। ফলে দীর্ঘমেয়াদি অনেক ক্ষতি হয়েছে। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে থাকে। অতি ব্যয়ে করা ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোর জন্য ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় ব্যাপকভাবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উঁচু দেখালেও তা কর্মসংস্থানের সমস্যা কমাতে পারেনি। অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ে। এর সঙ্গে সম্পদ কেন্দ্রীভবন, বৈষম্য বৃদ্ধি- এগুলো যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতে হাসিনা সরকারের পতন না ঘটলে, এই সংকটগুলো আরও বেশি ঘনীভূত হতো। এসব ঋণ শোধের চাপ সামনে আরও বাড়বে। 

তবে জনগণের নামে একটা ভূমিকা নিতে পারে সরকার। বলতে পারে, এগুলো যেহেতু অনির্বাচিত সরকার জনসম্মতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেরা কমিশন পাওয়ার জন্য এবং কিছু গোষ্ঠী থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য নিয়েছে, যেহেতু দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার হয়েছে এর বড় অংশ, সেহেতু এর দায়িত্ব আমরা কেন নেব? এই প্রশ্ন তুলতে হবে। দরকষাকষি করে সময় বাড়াতে হবে, সুদ এবং আসল কমাতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না বরং পূর্ণমাত্রায় সচল রাখতে হবে। এরকম একটি দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে সরকারকে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের দায়িত্ব সরকারের কোনো কোনো প্রতিনিধিকে নিতে হবে। 

শিক্ষা নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। তবে তা যেন নতুন সমস্যা তৈরি না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে যেকোনো রাজনৈতিক দলের দাপট দূর করা উচিত। তবে রাজনৈতিক সচেতনতা, সুস্থ বিতর্ক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই থাকতে হবে। বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির জন্য পুরো ব্যবস্থার বদল দরকার। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বৈষম্যের ভিত তৈরি করে। শিক্ষা হতে হবে সব নাগরিকের অধিকার এবং তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। অভিন্ন এবং উন্নত মানের শিক্ষা শ্রেণি, জাতি, লিঙ্গ, ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে একই সঙ্গে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য অভিভাবকদের আর্থিক দুশ্চিন্তা বা সংকটের সমাধান করতে হবে। 

অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে মৌলিক কিছু পার্থক্যের সূচনা করতে হবে সরকারকে। আগের সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পুলিশকে অনেক বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। কতিপয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক খাত। বিপরীতে যারা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য ও চাপের সম্মুখীন হয়েছেন তার মধ্যে প্রধানত হচ্ছে সর্বজনের জন্য প্রয়োজনীয় খাতগুলো। যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, নিয়োগ, অবহেলার কারণে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি শ্রমিকদের কথাও আমরা বলতে পারি। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে গেলে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দের বর্তমান চিত্র পরিবর্তন করে তা আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে আসতে হবে। জিডিপির শতকরা কমপক্ষে ছয় ভাগ বরাদ্দের ধারা তৈরি করলে ব্যয় বাড়বে বর্তমানের তিন থেকে পাঁচ গুণ। তার যথাযথ ব্যবহারের জন্য এই দুটি খাতে বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস দরকার আছে। পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে প্রয়োজনীয় সব খাতেই সংস্কারের কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার।

লেখক: শিক্ষাবিদ