ড. বদিউল আলম মজুমদার একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর বাংলাদেশ শাখার পরিচালক ও বৈশ্বিক সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া তিনি নাগরিক সংগঠন ‘সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। আগামীতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এ দেশের প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কারের নানা দিক নিয়ে তিনি খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা
নির্বাচন অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে অর্থাৎ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনে যারা ভোট দেবে তারা নারী-পুরুষ এবং সমাজে পিছিয়ে পরা মানুষ- সবাই যেন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। কেউ যেন বাদ না পড়ে। আর আওয়ামী লীগের ব্যাপারে বলব, এটা আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনই নির্ধারণ করবে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি পারবে না। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীকে পরিপূর্ণভাবে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে। সীমাহীন দলীয়করণের মাধ্যমে বিগত সরকার ও প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যকার বিভাজন প্রায় সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে পড়েছিল। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অনেকেই দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করেছেন। তারা সরকারের দমন-পীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিল। এগুলো দূর করেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে।…
খবরের কাগজ: আপনি নির্বাচন কমিশনারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের মূল প্রস্তাবগুলো কী কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে আমাদের সুপারিশ ছিল। তার মধ্যে কতগুলো হলো- নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিধি, নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা ও ক্ষমতা ইত্যাদি। তার পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত দিক ও নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদিসহ সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক আদেশ। এর মধ্যে সংশোধনের বিষয়ে আমরা বেশ কিছু প্রস্তাব করেছি। আমরা প্রস্তাব করেছি সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারে। আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিকভাবে সীমানা নির্ধারণ করা দরকার। কতগুলো নীতিমালা আছে- আমরা ভবিষ্যতের জন্য ইনডিপেনডেন্ট কমিটি দিয়ে বা ইনডিপেনডেন্ট অথরিটি দিয়ে তা করার কথা বলেছি। তবে এ বছর নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা কমিটি করা দরকার। তারপর ভোটারের ব্যাপারেও আমরা প্রস্তাব করেছিলাম। আমরা 'না' ভোটের প্রস্তাব করেছি। সংসদে উচ্চকক্ষের কথা বলেছি। প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদ থাকতে পারবেন, আমরা সে কথাও বলেছি। সংসদে উচ্চকক্ষের নির্বাচনের প্রস্তাব করেছি। এ রকম আমরা অনেক বিষয়ে প্রস্তাব করেছি। আরও প্রস্তাব করেছি, রাজনৈতিক দলের বিষয়ে অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক বিষয়গুলোসহ রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের মতামত পেশ করেছি। মনোনয়নের ক্ষেত্রে তারা নিজের সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে তিনজনের একটা প্যানেল তৈরি করতে পারে। তারা প্রত্যেকে কনস্টিটিউটে তিনজনের প্যানেল তৈরি করে মনোনয়ন বোর্ডের কাছে পাঠাবে। সেই প্যানেল থেকেই মনোনয়ন বোর্ড মনোনয়ন দেবে বা কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
খবরের কাগজ: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, প্রদেশ, আবার কেউ কেউ বলছেন ৩০০ আসনের পরিবর্তে ৫০০ আসন। আপনারা সংস্কার প্রস্তাবে এ বিষয়ে কিছু বলেছেন কি না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা প্রদেশ করার বিষয়ে বলিনি। আমরা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রস্তাব করেছি। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সংসদে আসন ৪০০-এ উন্নীত করার কথা আমরা বলেছি। ৪০০-এর মধ্যে ১০০ আসন হতে হবে নারীদের জন্য সংরক্ষিত। প্রধান উপদেষ্টার কাছে পেশকৃত প্রতিবেদনে আমরা এ ব্যাপারে প্রস্তাব করেছি।
খবরের কাগজ: নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছেন অনেকেই। আপনাদের সংস্কার প্রস্তাবে এ বিষয়ে কিছু বলেছেন কি না?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: অবশ্যই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব করেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে আমি আদালতে গিয়েছি। এ ব্যাপারে আদালতে রায় হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সংশোধনী বাতিল করা হবে। আপিল বিভাগে একটা রিভিউ পিটিশন আছে। যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে তার রিভিউ করার ব্যাপারে আমরা দরখাস্ত করেছি। আমরা আশা করি যে, আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাব এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসবে। আমরা সংস্কার প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে সুপারিশ করেছি।
খবরের কাগজ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসংগঠনের নেতারা বলছেন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচন অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে অর্থাৎ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনে যারা ভোট দেবে তারা নারী-পুরুষ এবং সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষ- সবাই যেন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। কেউ যেন বাদ না পড়ে। আর আওয়ামী লীগের ব্যাপারে বলব, এটা আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনই নির্ধারণ করবে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি পারবে না। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীকে পরিপূর্ণভাবে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে। সীমাহীন দলীয়করণের মাধ্যমে বিগত সরকার ও প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যকার বিভাজন প্রায় সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে পড়েছিল। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অনেকেই দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করেছেন। তারা সরকারের দমন-পীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিল। এগুলো দূর করেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে।
খবরের কাগজ: বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ভারতের নির্বাচন কমিশনের চেয়েও অধিক শক্তিশালী। সে ক্ষেত্রে ভারত যদি অবাধ নির্বাচন করতে পারে, বাংলাদেশে কেন সেটা সম্ভব হয় না? সে ক্ষেত্রে ত্রুটিগুলো কী কী বলে আপনি মনে করেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমাদের আইনগুলো শক্তিশালী। কিন্তু ভিত্তিগুলো দুর্বল। অর্থাৎ দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিদের, দুর্বল চরিত্রের ব্যক্তিদের- যাদের দলীয় আনুগত্য আছে, সেই সব ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার ফলে তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এটা ব্যক্তির সমস্যা, এটা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা। কারণ, বিধিবিধান যদি সঠিকভাবে না মানা হয়, তাহলে তা প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে। কিন্তু ব্যক্তির সমস্যাই হচ্ছে বড় সমস্যা। সে জন্যই সংস্কার প্রয়োজন। বিধিবিধানের প্রয়োজন। পদ্ধতির সংস্কার ও প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। একই সঙ্গে আইনি কাঠামোর পরিবর্তন, সাংবিধানিক সংস্কার- এ সবকিছুই দরকার। আমরা যদি একটা ইতিবাচক পদ্ধতিতে যাই, আমরা যদি এগুলোতে মনোযোগ দিই, আমরা যদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর হিসেবে দেখতে চাই, তাহলে কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কার প্রয়োজন হবে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনের জন্য এটা দরকার হবে। বাংলাদেশ অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা এ কথাও বলি যে, এখনো স্বাধীনতার অনেক স্বপ্ন আমাদের পূরণ হয়নি। মানুষ ভোট দিতে গেছে কিন্তু ভোট দিতে পারেনি। ভোটের মাঠে বিকল্প থাকতে হয়। নিজেদের মধ্যে ভোট হলে তো সেই বিকল্প থাকে না। তাই মানুষ অতীতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। পছন্দমতো প্রার্থী বাছাই করতে নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক হওয়া প্রয়োজন, যা বিগত সময়গুলোতে দেখা যায়নি। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে গণতন্ত্র, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ভোটাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের সচেতন ব্যক্তিদের ভূমিকা রয়েছে। মানুষের ভোটের অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত একটি মানবাধিকার। তাই নির্বাচনে জনগণ যেন তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, সেটি আমাদের দেখতে হবে। আমাদের এই ত্রুটিগুলো বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো দূর করার ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে।
খবরের কাগজ: প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি করেছে। কিন্তু জামায়াতসহ অন্য দলগুলো স্থানীয় নির্বাচনের দাবি করেছে। এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সে ক্ষেত্রে বলব, দলগুলো দুই দিকেই যুক্ত আছে এবং এই দুই দলেরই মতামত এখন এক জায়গায় পৌঁছতে হবে। কোন পন্থায় কোন দিকে, কোন পক্ষের সিদ্ধান্ত যাবে- এখানে বিতর্কিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করবে। আমি আশা করি যে, নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করার উদ্যোগ নিয়েছি এবং তা সফল হবে। এর মাধ্যমে কতগুলো বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভিত্তিতে গণ-আদেশের মাধ্যমে সংশোধন হবে। সেটা কাজে লাগিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
খবরের কাগজ: আমরা অতীতেও দেখেছি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপিকে ভোটের বাইরে রেখেছিল। এখন আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। এখনো যদি দলগুলোকে ভোটের বাইরে রাখার ভাবনা থাকে, তাহলে বৈষম্য তো রয়েই গেল। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে স্থিতিশীলতা কীভাবে ফিরে আসবে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: বিগত সময়ে বিএনপিকে দমনকরণের মাধ্যমে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ পালিয়ে গেছে। তা ছাড়া অতীতে আওয়ামী লীগ লাগামহীন অন্যায় করেছে। এখন অবধি তারা এই অন্যায়ের দায় স্বীকার করে না। অপরাধের জন্য তারা ক্ষমাপ্রার্থনাও করেনি। এই আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছর ধরে মানুষকে বাকশক্তি, বাকস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে। এখন রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, তারা যে অপরাধ করেছে- সেটার বিচার হওয়া দরকার। এরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। এই বিচার না করলে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আর এই বিচার যদি না করা হয়, তাহলে আবারও সবকিছু চোরের দেশে পরিণত হবে। মিথ্যাবাদীদের দোসরে পরিণত হবে। এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আইনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দেবে।
খবরের কাগজ: আপনি বহুদিন ধরে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেশে দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর কারণগুলো কী কী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: মানুষ যদি সহিংসতামুক্ত হয়, তাহলেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে। মানুষ নির্বাচনবিমুখ অবস্থা কাটিয়ে নির্বাচনমুখী অবস্থায় ফিরে যেতে সক্ষম হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম উপাদান গণমানুষের ভোটের অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার বিগত সরকারের আমলে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে সর্বত্র দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন সংঘটিত হয়েছে। বিগত সময়ে একদিকে ভোটারদের ভোট প্রদানে যেমন অনীহা তৈরি হয়েছিল, তেমনি এটি একটি রোগ অথবা রোগের উপসর্গে পরিণত হয়েছিল। কাজেই এই রোগের চিকিৎসা করতে হলে শুধু উপসর্গকে চিহ্নিত করলে হবে না। রোগের কারণও চিহ্নিত করতে হবে। সাধারণ মানুষ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তা নিয়ে অনাগ্রহের মূল কারণ আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। এর মূল কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মানুষের প্রতি অনাস্থা। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমাদের উচিত এই ব্যবস্থাকে রোধ করে একটি জবাবদিহিমূলক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করা। আমরা মানুষের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে। কোনো দলের পক্ষে নই, আমরা নিরপেক্ষ। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের যা করণীয়, আমরা এখনো তা করতে পারিনি। আমাদের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হওয়ার কারণ- ভোট দিতে গেলে সঠিকভাবে ভোট দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে তাদের মনে শঙ্কা ছিল। দেশে বহুদিন ধরে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না বলে অনেকে মনে করে থাকে। এ ধরনের নানান শঙ্কা তাদের মনে কাজ করে। কাজেই তারা ভোট দিলে বা না দিলে তাতে কিছু এসে যায় না। ক্ষমতাসীনরা যাদের চায় তারাই নির্বাচিত হবে। এই নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষের ব্যাপক অনাস্থা। এর একটি কারণ হলো, যে প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে তার মধ্যে অন্যতম হলো নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের ওপর মানুষের অনাস্থার কারণ ছিল ব্যাপক দলীয়করণ। অনাস্থা নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার ওপর এবং এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর। এসব কারণে মানুষ ভোট দিতে চায়নি এবং তারা মনে করে তারা ভোট দিলেও তাদের প্রত্যাশিত প্রার্থীদের পরাজয় নিশ্চিত। কাজেই ভোটদানে তারা অনীহা প্রকাশ করে এসেছে সব সময়। কাজেই আমরা বলেছি, নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় ব্যাপকভাবে সংস্কার দরকার।
খবরের কাগজ: আমরা দেখেছি একটা সময় নির্বাচনকে মানুষ উৎসবমুখর জাতীয় আয়োজন বলে মনে করত। বিগত সরকারের সময়গুলোতে জনগণ ভোটবিমুখ হয়ে পড়েছিল। ভোটবিমুখ অবস্থা থেকে মানুষকে নির্বাচনমুখী করার ক্ষেত্রে কী কী উপায় আছে বলে মনে করেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সংস্কারের মাধ্যমে এ অবস্থা দূর করতে হবে। তা না হলে নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। অর্থাৎ নির্বাচনব্যবস্থা কোনোভাবেই কার্যকর হবে না। বিগত সরকারের আমলে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নির্বাচনে টাকার খেলা। যোগ্য-অযোগ্য যেই হোক, তারা মনোনয়ন কিনে নিত। মনোনয়নের পর তারা বিভিন্নভাবে টাকা-পয়সা ব্যয় করে তাদের জয় নিশ্চিত করত। কাজেই দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই চলবে না। গণতন্ত্র, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ভোটাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের সচেতন ব্যক্তিদের ভূমিকা রয়েছে। মানুষের ভোটের অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত একটি মানবাধিকার। তাই নির্বাচনে জনগণ যেন তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, সেটি আমাদের দেখতে হবে। তাহলে নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশ ফিরে আসবে। মানুষ নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবে। আমরা আমাদের সংস্কার প্রস্তাবে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সর্বতোভাবে উৎসবমুখর নির্বাচনি ব্যবস্থা গড়ে তোলার সপক্ষে মতামত দিয়েছি। নিজে কেন্দ্রে গিয়ে ভোটদানের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ আবারও নির্বাচনমুখর হয়ে উঠবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।