
আবহমান বাংলার জনজীবনের চালচিত্র যার সৃষ্টিতে বিদ্যমান- তিনি জনগণের বাউল। তার নাম শাহ আবদুল করিম। গণজাগরণের বাউল তিনি। বাংলার জমিনের প্রান্তরে প্রান্তরে তার রচিত গান বিভিন্ন বাউলশিল্পীর কণ্ঠে শোনা যায়। শাহ আবদুল করিম লোকোৎসব শুরু হয়েছে। ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাইয়ের উজানধল মাঠে চলছে এ অনুষ্ঠান। ভাটি বাংলার এ জনপ্রিয় বাউল লোকসংগীতকে উচ্চস্তরে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছেন।
করিমের জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের ধল আশ্রম গ্রামে। দিনটি ছিল ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার। ইব্রাহিম আলী ও নাইওরজান বিবির ঘর আলো করে প্রথম সন্তান হিসেবে জন্ম নেন তিনি। জন্মসংক্রান্ত তারিখ নিয়ে তার রচনা:
তেরশো বাইশ বাংলায় জন্ম আমার।
মা বলেছেন ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার।
বাউল করিমের জনপ্রিয় অসংখ্য গান রয়েছে। সেসব গানে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির প্রভাব প্রচণ্ড। একতারা হাতেই তার কাব্য রচনা শুরু।
বাউল করিমের রচিত গান: যে গুণে বন্ধুরে পাব সে গুণ আমার নাই গো
যে গুণে বন্ধুরে পাব।।
প্রাণপাখি মনের আনন্দে ঠেকেছে পিরিতের ফান্দে
তবে কেন নিরানন্দে কেঁদে দিন কাটাই গো ।।
যে গুণে আনন্দ বাড়ে আদর করে রাখে ধারে
গুণ নাই আমি করজোড়ে চরণ ছায়া চাই গো ।।
আর্থিক অসংগতির কারণে লেখা-পড়া করার জন্য বিদ্যালয়ে যেতে পারেননি। পরিবারে অভাব ছিল। সেই অভাব দূর করতে করিম মাত্র দুই টাকা বেতনে গ্রামের মোড়লবাড়িতে রাখালের চাকরি নেন। তখন তার বয়স মাত্র এগারো বছর।
ইমাম ঈদের জামাতে নামাজ পড়াতে চাননি আবদুল করিমকে। তাকে তওবা করতে বলা হয়েছিল। তখন উপস্থিত একজন সমঝদার মানুষ বিষয়টা
ঈদের দিনে নয়, পরবর্তীকালে ফয়সালা করার জন্য পরামর্শ দেন।
আবদুল করিম তার গানের ছন্দে বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তিনি গানের জন্য তৈরি হলেন। গান তিনি নিজেই রচনা করতেন। সুরও দিতেন এবং গাইতেন। তবে সঠিক তাল ও লয় শেখার উদ্দেশ্যে নিজ গ্রামের করম উদ্দিনকে ওস্তাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। এ বিষয়েও তার একটি রচনা রয়েছে। করিমের মুর্শিদ ছিলেন মওলা বক্স। পীর ছিলেন শাহ ইব্রাহীম মস্তান, তৈমুর চৌধুরী বাংলা বর্ণমালা ও ছমরু মিয়া মুন্সী কোরআন শেখাতেন। আরও তার ওস্তাদ ছিলেন সাধক রশিদ উদ্দিন।
গ্রামের নৈশবিদ্যালয়ে মাত্র আট দিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন।
প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও তিনি মানুষের কর্ম জীবন, দর্শন, দেহ তত্ত্ব, গণসংগীত, নিগূঢ় তত্ত্ব, বিচ্ছেদ, সারিগান ও আঞ্চলিক গানসহ দেশপ্রেমের গান রচনা করেছেন। প্রায় সাত দশক নানা ঘাত-প্রতিঘাত এবং কখনো কখনো প্রতিকূল পরিবেশে তিনি অপ্রতিরোধ্য গতিতে সংগীত সাধনা চালিয়ে গেছেন। ক্লান্তিহীন পথে তিনি নিজের অজান্তেই এমন কিছু গান সৃষ্টি করেছেন, যা পরিশুদ্ধ ভালোবাসা বহন করে। রাজনীতি ও সামাজিক বিষয়ে দারুণ সচেতন বাউল করিমের গানে রয়েছে যুগান্তকারী নানা দিক। জ্বর, অসুস্থতা, বার্ধক্য তাকে গান রচনায় বাধা দিতে পারেনি।
১৯৪৫ সালের দিকে একই উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামে দূরসম্পর্কের এক মামাতো বোনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। স্ত্রীর নাম ছিল কাঁচামালা বিবি। বিয়ের পরও আবদুল করিম গানের আসরে ছুটে যেতেন। দিনের পর দিন এভাবে চলার পর এক দিন কাঁচামালা বিবির আত্মীয়রা করিমের সঙ্গে রাগারাগি করেন। প্রশ্ন ওঠে, করিম কী সংসার করবে? নাকি করবে না? পরবর্তীকালে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের মধ্যে।
১৯৪৮ সালে আবদুল করিম মমতাজ বিবি ওরফে বৈশাখী নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম তিনিই বদলে রাখেন- সরলা।
আমরা জানি কাব্য ও সংগীতে এসবের প্রভাব থেকে আমরা কখনো বা কোনো দিনই বিচ্ছিন্ন হতে পারব না। বাউল করিমের রচনায় আমরা ভালোবাসা ও বিচ্ছেদের নানা রকম লোকগান গাই।
ধল আশ্রম গ্রামে ‘বাউল গান’ করার পরিবেশে করিম সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সেই সময় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি নতুনভাবে বাড়ি বদল করার চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম ভাঙ্গাডহর যাবেন। কারণ তারা গান-বাজনাতে আপত্তি আনবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে ধলগ্রাম ছেড়ে পাশের এলাকা উজানধল গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
শাহ আবদুল করিম ১৯৬৪ ও ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাজ্য সফর করেন। সেখানে তার গানগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিলাতের স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি দীর্ঘ একটি রচনা তৈরি করেন। চমৎকার শিল্পগুণে রচিত ‘ভাটির চিঠি’ নামে একটি গ্রন্থ। এতে লন্ডনের জীবনধারা নিয়ে রয়েছে গান।
শাহ আবদুল করিমের প্রথম প্রকাশিত গানের বই ‘আফতাব সংগীত।’ এরপর তার ‘গণসংগীত’; ‘কালনীর ঢেউ’; ‘ধলমেলা’ ও ‘ভাটির চিঠি’ আমাদের মুগ্ধ করে। একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল শাহ আবদুল করিমের গানে ধর্মচেতনা, মানবতাবাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখতে পাই আমরা। বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেসকো কমিশনের সহযোগিতায় প্রকাশ হয়েছে, ‘শাহ্ আবদুল করিম: জীবন ও সংগীতসমগ্র’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এটি সম্পাদনা করেছেন বাউলসম্রাট করিমের ছেলে ও গীতিকবি শাহ নূরজালাল। আলোচিত এ গ্রন্থে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন শাহ আবদুল করিমের স্নেহধন্য, কবি, গীতিকার ও উন্নয়ন সংগঠক দ্রুপদ চৌধুরী নূপুর। তিনি রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট সোসাইটির (রাস) নির্বাহী পরিচালক। এ ছাড়াও এ কাজে রয়েছেন করিমের ভাগ্নে ও গীতিকবি আবদুল তোয়াহেদ ও করিমশিষ্য গীতিকবি বাউল আবদুর রহমান।
সহজ-সরল ভাষায় ও রচনার চমৎকারিত্বে অসাধারণ স্বাদ পাওয়া যায় বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের গানে। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সকল স্তরে সরব পদচারণা রয়েছে তার। কথায় সৌন্দর্য ও সুরের আকর্ষণ থাকে রচনায়। খুশি আনন্দ-উচ্ছ্বাস মিশে যায় মানুষের মনে। স্মৃতি সব সময়ই মধুময়। কিছু কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু কিছু অনুভূতি আমাদের কখনো কখনো মুগ্ধ করে। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে আমরা কিন্তু তাও পাই:
ফুরু থাকতে যে খেইর খেলতাম
পুয়াপুড়ি বইয়া, হাততালি দিয়া
কেমন সুন্দর বিয়ার গান গাইতাম। অথবা
এই সময়ের অতি জনপ্রিয় একটি গান আমরা শুনি:
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান, ঘাটুগান গাইতাম।
অতি সহজ ও সরল ভাষায় রচিত গানগুলোতে রয়েছে সুরের মূর্ছনা। অতি জনপ্রিয় একটি গান উল্লেখ করতে হয়:
কই থেকে আইলাম
কই বা যাইতাম
কেন বা আইলাম, ভাবিয়া না পাইলাম
কার কাছে সেই খবর নিতাম।
আমরা যদি গভীর ভাবে দেখি তাহলে মানুষ-মানুষের মধ্যে যে বৈষম্য, ভালোবাসার মধ্যে যে গূঢ়তত্ত্বও তার রচনায় পাই। অতি সহজ ও সরল এবং সরাসরি কথোপকথন:
চাল চানিত কামলা চাচা দিলায় না।
মাইয়ে করলা মুরুগ জবো
আইয়া তুমি খাইলায় না।
বাংলা একাডেমি থেকে তার দশটি গান ইংরেজিতে ভাষান্তর করা হয়েছে। বইগুলো থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে কয়েকটি গান।
তার চেতনার গভীরতা বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি তিনি সৃষ্টিকর্মের রচনার মধ্যে নানা প্রকার দলিল তৈরি করে গেছেন। এক অপরাজেয় শক্তি যেন এ বাউল কবির মধ্যে বাস করে। শাহ আবদুল করিম সংগীত সাধনায় আমরা এমন কিছু গান পাই যা আমাদের নানাভাবে মুগ্ধ করে। এসব গানে আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে, মানবতা-সম্পর্কে সচেতন করেছে। গভীর গূঢ়তত্ত্ব পাই- এমন একটি গান উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না।
বাউল করিমের রচিত এমন একটি গান: মানুষ যদি হইতে চাও, কর মানুষের ভজনা
সবার উপরে মানুষ, সৃষ্টিতে নাই যার তুলনা।
আবদুল করিম হুঁশে থাকো, মানুষ ভালোবাসতে শিখ।
অন্তরে অন্তরে মাখ, রবে না ভব যন্ত্রণা।
তার কোনো কোনো গানে পাষাণচিত্তের মানুষও সাড়া না দিয়ে পারে না। প্রকৃতপক্ষে বাংলার ঐতিহ্য ও শিকড়ের সন্ধান মেলে। বৈষ্ণব ধারার এ ধামাইল গানটি খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বাউল করিমের খুবই জনপ্রিয় রচিত একটি গান- সখি কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
মনে চায় প্রাণে চায় দিলে চায় যারে-
সখি কুঞ্জ সাজাও গো ।।
স্বশিক্ষিত শাহ আবদুল করিম ৩০-এর দশক থেকে একতারা নিয়ে যেসব ক্ষুরধার কাব্য রচনা করে গেছেন, তা এক কথায় আমাদের সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে যায়। বাউল করিমের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছেন এমন কবি, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কবি দিলওয়ার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, ব্যারিস্টার আরশ আলী, সিকান্দর আলী, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক দীপক চৌধুরী, সৈয়দ আবদুর রহমান, সাংবাদিক ও লেখক সুমন কুমার দাস। তাদের বিভিন্ন স্মৃতিচারণা ও লেখায় ফুটে উঠেছে- প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও জীবনকে বহুমাত্রায় দেখার তার দৃষ্টি ছিল ক্ষুরধার ও গভীর।
আমরা এটা উপলব্ধি করতে পারি যে, মরমি কবিরা সাধারণত মৌলিক অনুভূতিতে আমাদের স্পর্শ করে থাকেন। আমরা মুগ্ধ হই। তার রচিত সংগীতকে ঘিরে আছে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা আর চেতনা। বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর আমাদের ছেড়ে চলে যান পরপারে।
লেখক: সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক