ঢাকা ৫ চৈত্র ১৪৩১, বুধবার, ১৯ মার্চ ২০২৫
English

গণজাগরণের বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০১:১৩ পিএম
গণজাগরণের বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম
দীপক চৌধুরী

আবহমান বাংলার জনজীবনের চালচিত্র যার সৃষ্টিতে বিদ্যমান- তিনি জনগণের বাউল। তার নাম শাহ আবদুল করিম। গণজাগরণের বাউল তিনি। বাংলার জমিনের প্রান্তরে প্রান্তরে তার রচিত গান বিভিন্ন বাউলশিল্পীর কণ্ঠে শোনা যায়। শাহ আবদুল করিম লোকোৎসব শুরু হয়েছে। ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাইয়ের উজানধল মাঠে চলছে এ অনুষ্ঠান। ভাটি বাংলার এ জনপ্রিয় বাউল লোকসংগীতকে উচ্চস্তরে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছেন। 
করিমের জন্ম সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের ধল আশ্রম গ্রামে। দিনটি ছিল ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার। ইব্রাহিম আলী ও নাইওরজান বিবির ঘর আলো করে প্রথম সন্তান হিসেবে জন্ম নেন তিনি। জন্মসংক্রান্ত তারিখ নিয়ে তার রচনা:
তেরশো বাইশ বাংলায় জন্ম আমার।
মা বলেছেন ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার।
বাউল করিমের জনপ্রিয় অসংখ্য গান রয়েছে। সেসব গানে বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির প্রভাব প্রচণ্ড। একতারা হাতেই তার কাব্য রচনা শুরু।
বাউল করিমের রচিত গান: যে গুণে বন্ধুরে পাব সে গুণ আমার নাই গো
যে গুণে বন্ধুরে পাব।।
প্রাণপাখি মনের আনন্দে ঠেকেছে পিরিতের ফান্দে
তবে কেন নিরানন্দে কেঁদে দিন কাটাই গো ।।
যে গুণে আনন্দ বাড়ে আদর করে রাখে ধারে
গুণ নাই আমি করজোড়ে চরণ ছায়া চাই গো ।।

আর্থিক অসংগতির কারণে লেখা-পড়া করার জন্য বিদ্যালয়ে যেতে পারেননি। পরিবারে অভাব ছিল। সেই অভাব দূর করতে করিম মাত্র দুই টাকা বেতনে গ্রামের মোড়লবাড়িতে রাখালের চাকরি নেন। তখন তার বয়স মাত্র এগারো বছর।
ইমাম ঈদের জামাতে নামাজ পড়াতে চাননি আবদুল করিমকে। তাকে তওবা করতে বলা হয়েছিল। তখন উপস্থিত একজন সমঝদার মানুষ বিষয়টা 
ঈদের দিনে নয়, পরবর্তীকালে ফয়সালা করার জন্য পরামর্শ দেন।

আবদুল করিম তার গানের ছন্দে বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তিনি গানের জন্য তৈরি হলেন। গান তিনি নিজেই রচনা করতেন। সুরও দিতেন এবং গাইতেন। তবে সঠিক তাল ও লয় শেখার উদ্দেশ্যে নিজ গ্রামের করম উদ্দিনকে ওস্তাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। এ বিষয়েও তার একটি রচনা রয়েছে। করিমের মুর্শিদ ছিলেন মওলা বক্স। পীর ছিলেন শাহ ইব্রাহীম মস্তান, তৈমুর চৌধুরী বাংলা বর্ণমালা ও ছমরু মিয়া মুন্সী কোরআন শেখাতেন। আরও তার ওস্তাদ ছিলেন সাধক রশিদ উদ্দিন।

গ্রামের নৈশবিদ্যালয়ে মাত্র আট দিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন।
প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও তিনি মানুষের কর্ম জীবন, দর্শন, দেহ তত্ত্ব, গণসংগীত, নিগূঢ় তত্ত্ব, বিচ্ছেদ, সারিগান ও আঞ্চলিক গানসহ দেশপ্রেমের গান রচনা করেছেন। প্রায় সাত দশক নানা ঘাত-প্রতিঘাত এবং কখনো কখনো প্রতিকূল পরিবেশে তিনি অপ্রতিরোধ্য গতিতে সংগীত সাধনা চালিয়ে গেছেন। ক্লান্তিহীন পথে তিনি নিজের অজান্তেই এমন কিছু গান সৃষ্টি করেছেন, যা পরিশুদ্ধ ভালোবাসা বহন করে। রাজনীতি ও সামাজিক বিষয়ে দারুণ সচেতন বাউল করিমের গানে রয়েছে যুগান্তকারী নানা দিক। জ্বর, অসুস্থতা, বার্ধক্য তাকে গান রচনায় বাধা দিতে পারেনি।

১৯৪৫ সালের দিকে একই উপজেলার চণ্ডীপুর গ্রামে দূরসম্পর্কের এক মামাতো বোনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। স্ত্রীর নাম ছিল কাঁচামালা বিবি। বিয়ের পরও আবদুল করিম গানের আসরে ছুটে যেতেন। দিনের পর দিন এভাবে চলার পর এক দিন কাঁচামালা বিবির আত্মীয়রা করিমের সঙ্গে রাগারাগি করেন। প্রশ্ন ওঠে, করিম কী সংসার করবে? নাকি করবে না? পরবর্তীকালে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের মধ্যে। 

১৯৪৮ সালে আবদুল করিম মমতাজ বিবি ওরফে বৈশাখী নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম তিনিই বদলে রাখেন- সরলা।
আমরা জানি কাব্য ও সংগীতে এসবের প্রভাব থেকে আমরা কখনো বা কোনো দিনই বিচ্ছিন্ন হতে পারব না। বাউল করিমের রচনায় আমরা ভালোবাসা ও বিচ্ছেদের নানা রকম লোকগান গাই।
ধল আশ্রম গ্রামে ‘বাউল গান’ করার পরিবেশে করিম সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সেই সময় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি নতুনভাবে বাড়ি বদল করার চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম ভাঙ্গাডহর যাবেন। কারণ তারা গান-বাজনাতে আপত্তি আনবে না। কিন্তু পরবর্তীকালে ধলগ্রাম ছেড়ে পাশের এলাকা উজানধল গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। 

শাহ আবদুল করিম ১৯৬৪ ও ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাজ্য সফর করেন। সেখানে তার গানগুলো দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিলাতের স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি দীর্ঘ একটি রচনা তৈরি করেন। চমৎকার শিল্পগুণে রচিত ‘ভাটির চিঠি’ নামে একটি গ্রন্থ। এতে লন্ডনের জীবনধারা নিয়ে রয়েছে গান। 

শাহ আবদুল করিমের প্রথম প্রকাশিত গানের বই ‘আফতাব সংগীত।’ এরপর তার ‘গণসংগীত’; ‘কালনীর ঢেউ’; ‘ধলমেলা’ ও ‘ভাটির চিঠি’ আমাদের মুগ্ধ করে। একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল শাহ আবদুল করিমের গানে ধর্মচেতনা, মানবতাবাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখতে পাই আমরা। বাংলাদেশ জাতীয় ইউনেসকো কমিশনের সহযোগিতায় প্রকাশ হয়েছে, ‘শাহ্ আবদুল করিম: জীবন ও সংগীতসমগ্র’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এটি সম্পাদনা করেছেন বাউলসম্রাট করিমের ছেলে ও গীতিকবি শাহ নূরজালাল। আলোচিত এ গ্রন্থে সহযোগী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন শাহ আবদুল করিমের স্নেহধন্য, কবি, গীতিকার ও উন্নয়ন সংগঠক দ্রুপদ চৌধুরী নূপুর। তিনি রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট সোসাইটির (রাস) নির্বাহী পরিচালক। এ ছাড়াও এ কাজে রয়েছেন করিমের ভাগ্নে ও গীতিকবি আবদুল তোয়াহেদ ও করিমশিষ্য গীতিকবি বাউল আবদুর রহমান।

সহজ-সরল ভাষায় ও রচনার চমৎকারিত্বে অসাধারণ স্বাদ পাওয়া যায় বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের গানে। আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সকল স্তরে সরব পদচারণা রয়েছে তার। কথায় সৌন্দর্য ও সুরের আকর্ষণ থাকে রচনায়। খুশি আনন্দ-উচ্ছ্বাস মিশে যায় মানুষের মনে। স্মৃতি সব সময়ই মধুময়। কিছু কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু কিছু অনুভূতি আমাদের কখনো কখনো মুগ্ধ করে। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে আমরা কিন্তু তাও পাই: 
ফুরু থাকতে যে খেইর খেলতাম
পুয়াপুড়ি বইয়া, হাততালি দিয়া
কেমন সুন্দর বিয়ার গান গাইতাম। অথবা 
এই সময়ের অতি জনপ্রিয় একটি গান আমরা শুনি:
আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান, ঘাটুগান গাইতাম।
অতি সহজ ও সরল ভাষায় রচিত গানগুলোতে রয়েছে সুরের মূর্ছনা। অতি জনপ্রিয় একটি গান উল্লেখ করতে হয়:
কই থেকে আইলাম
কই বা যাইতাম
কেন বা আইলাম, ভাবিয়া না পাইলাম
কার কাছে সেই খবর নিতাম।
আমরা যদি গভীর ভাবে দেখি তাহলে মানুষ-মানুষের মধ্যে যে বৈষম্য, ভালোবাসার মধ্যে যে গূঢ়তত্ত্বও তার রচনায় পাই। অতি সহজ ও সরল এবং সরাসরি কথোপকথন:
চাল চানিত কামলা চাচা দিলায় না।
মাইয়ে করলা মুরুগ জবো
আইয়া তুমি খাইলায় না।
বাংলা একাডেমি থেকে তার দশটি গান ইংরেজিতে ভাষান্তর করা হয়েছে। বইগুলো থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে কয়েকটি গান।
তার চেতনার গভীরতা বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি তিনি সৃষ্টিকর্মের রচনার মধ্যে নানা প্রকার দলিল তৈরি করে গেছেন। এক অপরাজেয় শক্তি যেন এ বাউল কবির মধ্যে বাস করে। শাহ আবদুল করিম সংগীত সাধনায় আমরা এমন কিছু গান পাই যা আমাদের নানাভাবে মুগ্ধ করে। এসব গানে আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে, মানবতা-সম্পর্কে সচেতন করেছে। গভীর গূঢ়তত্ত্ব পাই- এমন একটি গান উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না।
বাউল করিমের রচিত এমন একটি গান:    মানুষ যদি হইতে চাও, কর মানুষের ভজনা
সবার উপরে মানুষ, সৃষ্টিতে নাই যার তুলনা।
আবদুল করিম হুঁশে থাকো, মানুষ ভালোবাসতে শিখ।
অন্তরে অন্তরে মাখ, রবে না ভব যন্ত্রণা।
তার কোনো কোনো গানে পাষাণচিত্তের মানুষও সাড়া না দিয়ে পারে না। প্রকৃতপক্ষে বাংলার ঐতিহ্য ও শিকড়ের সন্ধান মেলে। বৈষ্ণব ধারার এ ধামাইল গানটি খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
বাউল করিমের খুবই জনপ্রিয় রচিত একটি গান-            সখি কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
মনে চায় প্রাণে চায় দিলে চায় যারে-
সখি কুঞ্জ সাজাও গো ।।    

স্বশিক্ষিত শাহ আবদুল করিম ৩০-এর দশক থেকে একতারা নিয়ে যেসব ক্ষুরধার কাব্য রচনা করে গেছেন, তা এক কথায় আমাদের সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে যায়। বাউল করিমের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছেন এমন কবি, লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কবি দিলওয়ার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, ব্যারিস্টার আরশ আলী, সিকান্দর আলী, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক দীপক চৌধুরী, সৈয়দ আবদুর রহমান, সাংবাদিক ও লেখক সুমন কুমার দাস। তাদের বিভিন্ন স্মৃতিচারণা ও লেখায় ফুটে উঠেছে- প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও জীবনকে বহুমাত্রায় দেখার তার দৃষ্টি ছিল ক্ষুরধার ও গভীর। 

 আমরা এটা উপলব্ধি করতে পারি যে, মরমি কবিরা সাধারণত মৌলিক অনুভূতিতে আমাদের স্পর্শ করে থাকেন। আমরা মুগ্ধ হই। তার রচিত সংগীতকে ঘিরে আছে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা আর চেতনা। বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর আমাদের ছেড়ে চলে যান পরপারে।

লেখক: সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক

সংস্কার ও রোহিঙ্গা ইস্যু  জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ প্রশংসনীয়

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম
সংস্কার ও রোহিঙ্গা ইস্যু 
জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ প্রশংসনীয়
এম. হুমায়ুন কবির

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস চার দিনের সফরে গত ১৫ মার্চ শনিবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি তার পুরো সফরই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মিটিং করেছেন। তার পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে মিটিং করেছেন। তিনি কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা দেখা ও তাদের সম্পর্কে মূল্যায়ন করার জন্যই সারা দিন ক্যাম্পে কাটিয়েছেন। সন্ধ্যায় জাতিসংঘের মহাসচিব ও ড. ইউনূস প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতারে অংশগ্রহণ করেন। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ আরও বাড়ানো দরকার। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আমরা অনেকদিন ধরেই দরবার করছি। এখানে আলাপ-আলোচনা চলছে, কীভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন করা যায়। দুবার চেষ্টা করেও প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়নি, এটাই বাস্তবতা। সেই প্রেক্ষপটে জাতিসংঘ মহাসচিবের এবারের সফর কতখানি সাফল্য বয়ে আনবে তা নিয়ে আমি সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই।

দুটো প্রধান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশ সফর করছেন। প্রথমত হচ্ছে, বাংলাদেশে বর্তমান একটা ট্রানজিশন পিরিয়ড চলছে অর্থাৎ সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সুষ্ঠু একটা নির্বাচন করার মাধ্যমে টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করা। এই চলমান প্রক্রিয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ মহাসচিব বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে সমর্থন দিয়েছেন। দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়। মায়ানমারের বর্তমান যে অবস্থা, এর প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কাজে তারা কী করতে পারে তার একটা মূল্যায়ন দরকার। এই দুটো প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় দুটো বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। 

দেশ এখন একটা ট্রানজিশন প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছি। জাতিসংঘ মহাসচিব প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে তাকে অবহিত করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব সংস্কার ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের টেকসই কাঠামোর প্রতিও জাতিসংঘের হয়ে সমর্থন জানিয়েছেন। কাজেই তার দিক থেকে স্পষ্ট করে বলা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তিনি বর্তমান সংস্কার কার্যক্রম এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবর্তনকে সমর্থন করেছেন। আগামী দিনে বাংলাদেশে টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং তরুণ প্রজন্মের যে প্রত্যাশা অর্থাৎ একটা দায়বদ্ধ সরকার এবং মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকদের যে দায়-দায়িত্ব আছে, তার প্রতি সম্মানজনক একটা নতুন বাংলাদেশ তৈরি হোক। জাতিসংঘের সমর্থনটা সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান বলে মনে হয়। 

এখনকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে প্রেক্ষাপট চলমান রয়েছে, সেদিক থেকে আমি মনে করি, আলোচনাটা ফলপ্রসূ হয়েছে। এখানে প্রধান উপদেষ্টা দুটো ইঙ্গিত করেছেন। একটা হচ্ছে, সংস্কার কার্যক্রম। যদি সংক্ষিপ্ত সংস্কার কার্যক্রম করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া যায়, তাহলে নির্বাচন ডিসেম্বরে হতে পারে। এরকম একটা ইঙ্গিত কিন্তু আমাদের প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন। কাজেই এখানে আমাদের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে- তার ইঙ্গিত প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে পাওয়া গেল। তেমনিভাবে রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণে জাতিসংঘ আমাদের পাশে থাকবে তার ইঙ্গিত বা অঙ্গীকার পাওয়া গেল জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছ থেকে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বলা যায়, জাতিসংঘ মহাসচিব খুব কাছ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন সমস্যা বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেখানে দু-তিনটা বিষয় আছে। প্রথমত হচ্ছে, আমরা ইতোমধ্যে জানি, মার্কিন প্রশাসন মানবিক সাহায্য স্থগিত করেছে এবং সেটা যদিও খাদ্য সাহায্য স্থগিত আদেশের বাইরে রাখা হয়েছে। 

কিন্তু মানবিক সাহায্যের উন্নয়নগুলো ৯০ দিনের জন্য বন্ধ আছে। তার একটা প্রভাব কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর পড়ছে। এর কারণ হলো- রোহিঙ্গাদের এখানে থাকা, খাওয়া, পড়া, তাদের অবস্থান, চিকিৎসা- যাবতীয় ব্যয়ভার আন্তর্জাতিক সংস্থাই বহন করে। এটা জাতিসংঘ কো-অর্ডিনেট করে থাকে। সেই নতুন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সাহায্য বন্ধ করার ফলে যে ঘাটতিটা হবে- সেই ঘাটতি কীভাবে মেটানো যায়- এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন তাদের এ কাজে সহায়তা দেন। সেটাও আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি যে, ডব্লিউএফপি খাদ্য সাহায্যের জন্য তাদের যে অনুদান দিয়েছিল জনপ্রতি, সেটা অর্ধেকে নামিয়েছে। আগামী এপ্রিল মাস থেকে খাদ্য সরবরাহে একটা ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মহাসচিব নিজে এখানে এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের চিন্তাভাবনা কী, বাংলাদেশ সরকারের চিন্তাভাবনা কী- বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন। এটা অনেক বেশি শক্তিশালী হবে বলে আমার ধারণা। তিনি ইতোমধ্যে প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক।

দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন। এটা নিয়ে আমরা অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু সাত থেকে আট বছরে কোনো অগ্রগতি করতে পারিনি। দুবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে উদ্যোগ সফল হয়নি। সাম্প্রতিকালে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটাও সফল হয়নি। কাজেই এখন পর্যন্ত এই প্রত্যাবর্তনের জায়গায় আমরা খুব বেশি অগ্রগতি করতে পারিনি। সে ক্ষেত্রে আমরা চাচ্ছি রোহিঙ্গারা সম্মানজনকভাবে তাদের অধিকার নিয়ে মায়ানমারে ফেরত যাক- এ কথাটা তিনি আমাদের কাছ থেকে যেমন শুনেছেন, রোহিঙ্গারাও কিন্তু তাকে সে কথাই বলেছে। তিনি সংবাদ সম্মেলনে যে কথাটা বলেছেন, রোহিঙ্গারা মায়ানমারে ফেরত যেতে চায়। কাজেই তারা যাতে ওখানে অধিকারের সঙ্গে যেতে পারে, এটাই হবে আমাদের কাজ। রোহিঙ্গাদের যাওয়ার ব্যাপারে মায়ানমারে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা দরকার। অধিকার রক্ষা করা দরকার মায়ানমারে- এ কথাটাও জোরের সঙ্গে তিনি বলেছেন। মোটাদাগে তার অর্থ, রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে সম্মানজনকভাবে অধিকার নিয়ে ফেরত যাওয়া উচিত। সারা পৃথিবীতে জাতিসংঘ মহাসচিবের মেসেজটা যাবে।

 রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের অধিকার নিয়ে ফেরত যাক, এই বক্তব্য তিনি আমাদের মুখ থেকে যেমন শুনেছেন, তেমনি রোহিঙ্গাদের মুখ থেকেও শুনেছেন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ উদ্যোগ নিচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার। সেটা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তৃতীয় বিষয় হচ্ছে, রাখাইন প্রদেশে এখন সামরিক সংঘাত চলছে। সেখানে ৬ লাখের মতো রোহিঙ্গা এখন এই সংঘাতের সঙ্গে জড়িত। জাতিসংঘের মতে, ইতোমধ্যে ওখানে এখন দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। সন্দেহ করা হচ্ছে যে, এই দুর্ভিক্ষ অবস্থা যদি চলমান থাকে, গভীরতম হয় তাহলে রোহিঙ্গারা তখন মানবিক কারণেই বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসতে পারে, এমন একটা আশঙ্কার কথাই বলা হচ্ছে। আপনারা পত্রপত্রিকায় দেখেছেন রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে ঢুকছে। সরকারি পর্যায় থেকেও এ কথা বলা হচ্ছে।

 কাজেই এখন জাতিসংঘের একটা উদ্যোগ হচ্ছে- এই লোকগুলোর জন্য যদি আমরা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মানবিক সাহায্য রাখাইনে পাঠাতে পারি, তাহলে যারা দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির আশঙ্কায় রয়েছে, সেই মানুষগুলোকে সেখানেই রেখে তাদের সহায়তা বা সাহায্য করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা সহায়তা করেছিল বলে পত্রপত্রিকার খবরে দেখলাম। আমার ধারণা, জাতিসংঘের মহাসচিব এই মানবিক উদ্যোগে অর্থাৎ রাখাইন প্রদেশে এখনো যে রোহিঙ্গারা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় আছেন, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মানবিক সাহায্য পাঠানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাইবেন। বাংলাদেশ সরকার এটা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে। আরাকান আর্মি সীমান্তের অন্যদিকে এখন প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাদের সঙ্গে কাজ করে যদি খানিকটা আস্থা তৈরি করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এই আস্থার ওপর ভিত্তি করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাহায্য পাঠানোর একটা সুযোগ হয়তো তৈরি হতে পারে। সেটা সফল হবে কি না, এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। আমি মনে করি, সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা প্রত্যাশা করি। 

এই উদ্যোগটা যদি সফল করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের আরাকানে আবার ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি হতে পারে। কারণ দীর্ঘমেয়াদে সেটা বাংলাদেশের জন্য যেমন লাভজনক হবে, তেমনি মায়ানমারের জন্য লাভজনক হবে। বাংলাদেশ-মায়ানমার সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ প্রক্রিয়ায় একটা ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে জাতিসংঘের মহাসচিবের চার দিনের সফর ইতিবাচক। তিনি যে উদ্যোগটা নিয়েছেন তার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। আগামী দিনেও তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। সেই আলোকে তার উদ্যোগ সফল হোক, এটাই আমার প্রত্যাশা।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

পাঠ্যবই সরবরাহে বিলম্ব, বড় চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষা

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:০১ পিএম
পাঠ্যবই সরবরাহে বিলম্ব, বড় চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষা

শিক্ষা একটি জাতির অগ্রগতির মূল হাতিয়ার। সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথকে সহজ করে দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার চরম অব্যবস্থাপনা ও নীতিগত দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক সংকট তৈরি করেছে। বিশেষ করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের নামে অব্যবস্থাপনা, ভুলত্রুটি সংশোধনে দীর্ঘসূত্রতা এবং পাঠ্যবই সরবরাহে গাফিলতির কারণে শিক্ষাব্যবস্থা আজ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও উন্নতিতে পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। একজন শিক্ষার্থীর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পাঠ্যপুস্তক তার মনের চিন্তাধারাকে সুগঠিত করে এবং সেই সঙ্গে তার মনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে ধারণ করে পাঠ্যপুস্তক। সমগ্র পৃথিবীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানের সর্বাধিক পরিচিত মাধ্যম পাঠ্যপুস্তক। আজও তা যেমন আছে আগামী দিনেও তেমনি থাকবে। বাংলাদেশের শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যতম বৃহৎ জাতীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।

 দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ও শিক্ষার প্রসারে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনন্য। তিন মাস চলে গেল, আর কবে সব বই পাবে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিকের ৩০ কোটি ৪০ লাখ বই। সরবরাহ হয়েছে ২৪ কোটি ১৭ লাখ ৭২ হাজার। প্রাথমিকে পাঠ্যবই ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৫২৬। সরবরাহ হয়েছে ৯ কোটি ৩ লাখ ৪৪ হাজার। শিক্ষা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে গত ১ জানুয়ারি। এখনো বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পাঠ্যবই পায়নি। এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। কারণ পাঠ্যবই না থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে বসানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রথম থেকে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই চলতি জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে চায় সরকার। বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলবিমুখ হচ্ছে। ফলে অন্য সময়ের তুলনায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার এখন অনেক বেশি। বই না থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ বই ছাড়া ক্লাস করতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম। এই অজুহাতে শিক্ষকরাও ক্লাস নিতে চাচ্ছেন না। ফলে পড়াশোনা থেকে শিক্ষার্থীরা দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। 

পড়াশোনার বদলে খেলাধুলা আর আড্ডা দিয়ে তাদের সময় কাটছে, যা তাদের পড়াশোনায় অপূরণীয় ক্ষতির সৃষ্টি করছে। মূলত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এর আসল ভুক্তভোগী, যা তাদের মৌলিক শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অর্থাৎ, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু শিক্ষাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে না, বরং তাদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা ও বাস্তব জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতাও ব্যাহত হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এ ঘটনা শুধু অমানবিক নয়, বরং জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি ভয়াবহ অবিচার। সরকারি নীতিমালা অনুসারে, শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই বিনামূল্যে সরবরাহ করার কথা, অথচ কিছু অসাধু ব্যক্তি ও ছাপাখানার মালিক এসব বই অবৈধভাবে গুদামজাত করে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এটি স্পষ্টতই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন।

একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও উন্নতিতে পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। একজন শিক্ষার্থীর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পাঠ্যপুস্তক তার মনের চিন্তাধারাকে সুগঠিত করে এবং সেই সঙ্গে তার মনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে এবার শিক্ষাক্রম সংশোধন করে পুরানো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। পাঠ্যবই পরিমার্জনের কারণে ছাপার কাজ বিলম্বিত হবে, তা অনুমেয় ছিল। দরপত্র, অনুমোদন ও চুক্তির প্রক্রিয়া সময়মতো সম্পন্ন না হওয়া এবং কাগজসংকটের কারণে বিলম্ব আরও বেড়েছে। এদিকে দীর্ঘ ছুটির কারণে বই বিতরণ আরও বিলম্বিত হতে পারে বলে অভিভাবক ও শিক্ষকদের আশঙ্কা। এরই মধ্যে পবিত্র রমজান ও আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিদ্যালয়গুলোতে লম্বা ছুটি শুরু হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের সব পাঠ্যবই হাতে পেতে অপেক্ষাও দীর্ঘ হচ্ছে। এদিকে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সব বিদ্যালয়ে অবশিষ্ট বই সময়মতো দেওয়া সম্ভব হবে কি না, এ বিষয়ে সবাই চিন্তিত। মার্চ মাসের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার হয়েছে। শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছানো সরকারের দায়িত্ব হলেও এখনো পর্যন্ত সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায়নি। 

ফলে স্কুলগুলোতে পুরোদমে এখনো ক্লাস শুরু করা যায়নি বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মূল্যবান এই দেড় মাস সময় নষ্ট করা অত্যন্ত দুঃখজনক। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার দুই মাস পার হলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৬ কোটি ৩৮ লাখের বেশি বই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছায়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানিয়েছে, কাগজসংকটসহ নানা কারণে বই সরবরাহে এই বিলম্ব হচ্ছে। এর মধ্যে মাধ্যমিকের বই প্রায় ৬ কোটি ২২ লাখের মতো রয়েছে। এনসিটিবির তথ্যানুসারে, চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মোট ৩৯ কোটির বেশি বই মুদ্রণ করা হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে (মাদ্রাসার ইবতেদায়িসহ) বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি ৪০ লাখ, যার মধ্যে ২ মার্চ পর্যন্ত ২৭ কোটি ৯০ লাখ ৯০ হাজার বই ছাপানো হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহের অনুমোদন (পিডিআই) পাওয়া গেছে ২৪ কোটি ১৭ লাখ ৭২ হাজার বইয়ের, অর্থাৎ এখনো ৬ কোটি ২২ লাখ ২৮ হাজার বই বিতরণ করা হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার বই ছাপানো হলেও, ৯ কোটি ৩ লাখ ৪৪ হাজার বই সরবরাহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ফলে এখনো ১৬ লাখ বই বিতরণের অপেক্ষায় রয়েছে।

 নতুন শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে পুরানো শিক্ষাক্রমে ফিরছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এবার পাঠ্যবইয়েও অনেক প্রত্যাশিত পরিবর্তন এসেছে; অনেক বিষয়বস্তু সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে মানসম্মত বই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীরা যাতে উচ্চ নৈতিকতা ও উন্নত মূল্যবোধের চর্চায় আগ্রহী হয়, সে বিষয়েও তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এসব বিষয়ে সমাজ পিছিয়ে থাকলে শিক্ষার্থীরা কতটা এগিয়ে যেতে পারবে, এটাও এক প্রশ্ন। অতীতে ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। কাজেই মানসম্মত ও ত্রুটিমুক্ত বই প্রকাশে কর্তৃপক্ষকে মনোযোগী হতে হবে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে পুরানো শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই ছাপিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। পাঠ্যবই পরিমার্জনের কারণে বই ছাপার কাজ দেরি হবে, তা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু দরপত্র, অনুমোদন, চুক্তির মতো কাজগুলোও যথাসময়ে না করায় এবং কাগজসংকটের কারণে আরও বেশি দেরি হচ্ছে। অবশ্য এনসিটিবির কর্তৃপক্ষ  বলছেন, বিদ্যালয় ছুটি হলেও শিক্ষার্থীদের হাতে বই দেওয়া যাবে। তারা উপজেলা পর্যায়ে বই পাঠাচ্ছেন। 

সেখান থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বই সংগ্রহ করে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করবেন। এ ক্ষেত্রে মুদ্রণকারীদের আন্তরিকতা প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকাঠামো মূলত দাঁড়িয়ে থাকে চারটি স্তম্ভের ওপর শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষালয় ও পাঠ্যপুস্তক। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রেণিশিক্ষার উপকরণ হিসেবে সঠিক শব্দে, চিত্রে, অনুশীলনে যা লেখা হয়, তাকে মূলত পাঠ্যপুস্তক বা টেক্সট বুক বলা হয়। পাঠ্যপুস্তকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বেশ গোছালো তথ্যে সহজ ভাষায় মৌলিক বিষয়গুলোয় আলোকপাত করা হয়। এ ধরনের বই পড়ে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুশীলন ও প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে পাঠবোধগম্যতা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, কল্পনাশক্তি জ্ঞানের চেয়ে মূল্যবান। জ্ঞানের আলোর শক্তি ব্যবহার করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা সম্ভব। পাঠ্যপুস্তকের কাজ হলো জ্ঞানের আলোয় কল্পনাশক্তিকে শাণিত করা। আমাদের শিক্ষার্থীরাও এমন পাঠ্যপুস্তক পাবে এটাই আমাদের সবার আশা।

লেখক: কলাম লেখক 
ও সাবেক রেজিস্টার, জেএসটিইউ
[email protected]

মানুষ ব্যবস্থা বদলের ঐক্যের জন্য অপেক্ষমাণ

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৯ পিএম
মানুষ ব্যবস্থা বদলের ঐক্যের জন্য অপেক্ষমাণ
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

রাষ্ট্র তারুণ্যকে ভয় করে, সমাজও যে তারুণ্যকে পছন্দ করে তা নয়। তারুণ্যকে দমিত করার সব ব্যবস্থা রাষ্ট্র তার নিজের অভ্যাসবশতই করে থাকে, সমাজও তাতে যোগ দেয়। একটা ব্যাপার ছোট মনে হতে পারে কিন্তু মোটেই ছোট নয়; সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন না দেওয়া। সেখানে দুঃসহ একাধিপত্য চলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রদের। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষাটা তরুণরা পেতে পারে শিক্ষায়তনিক ছাত্রসংসদ থেকেই। ছাত্রসংসদ আগে ছিল; এমনকি সামরিক শাসনের সময়েও ছাত্রসংসদকে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯৯১-তে, স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর থেকে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকাররা যখন ক্ষমতায় আসা-যাওয়া শুরু করল ঠিক তখন থেকেই ছাত্রসংসদ লুপ্ত হয়ে গেল, চলল ক্ষমতাসীন দলীয় ছাত্র নামধারীদের স্বৈরাচার। এই যে ‘অগ্রগতি’, এর তাৎপর্যটা কী? তাৎপর্য হলো এটাই যে, ইতোমধ্যে রাষ্ট্র আরও বেশি স্বৈরতান্ত্রিক হয়েছে, যাত্রা করেছে ফ্যাসিবাদের অভিমুখে। তরুণরা গুন্ডা-বদমাশ হোক, মাদকের পাল্লায় পড়ুক, তারুণ্য গোল্লায় যাক, কিশোর গ্যাং গঠিত হোক- কোনো কিছুতেই আপত্তি তো নেই-ই, বরং সাগ্রহ অনুমতি আছে; কারণ তরুণ যত তার তারুণ্য খোয়াবে শাসকদের গদি ততই পোক্ত হবে। সোজা হিসাব!

বৈষম্যবিরোধিতার আওয়াজটা কিন্তু মোটেই নতুন নয়। এটি বঞ্চিতদের অতি পুরাতন রণধ্বনি; কিন্তু তাকে বারবার তুলতে হয়। কারণ বৈষম্য দূর হয় না, হবেও না যদি ব্যবস্থা না বদলায়। ব্যবস্থা না বদলালে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে, এবং বাড়ছেও। ঊনসত্তরের ব্যবস্থা-কাঁপানো ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পরে মওলানা ভাসানী তার সেই অসামান্য তরুণ কণ্ঠে আওয়াজটা নতুন করে তুলেছিলেন; বলেছিলেন, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না।’ বিশ্ববরেণ্য এক কবিতার বুঝি প্রথম পঙ্‌ক্তি। ওই ঊনসত্তরেই ভাসানীপন্থি তরুণ আসাদ যখন পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে শহিদ হন তখন তার সহযোদ্ধারা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র’। একই আওয়াজ, ভিন্ন শব্দগুচ্ছে। আসাদের পূর্বসূরি বায়ান্নর শহিদ বরকতও ছিলেন একই রাজনৈতিক ধারার মানুষ। সে ধারাও বৈষম্যবিরোধিতারই, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। 

ওই ধারা জয়যুক্ত হয়নি। যে জন্য বারবার আমাদের আন্দোলনে যেতে হচ্ছে, ঘটাতে হচ্ছে নতুনতর অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান জনগণই ঘটান, কিন্তু ক্ষমতায় রয়ে যান বুর্জোয়ারাই। নতুন পোশাকে, নতুন নামে, নতুন ভাষায় তারাই আসেন, বারবার ফিরে ফিরে ঘুরে ঘুরে। পরের শাসক আগের শাসকের তুলনায় অধিকতর নির্মম হন। বুর্জোয়া শাসনের পতন কোনোকালেই ঘটবে না যদি না পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিদায় নেয়। আমাদের দেশে রাজনীতিতে দল অনেক, কিন্তু ধারা মাত্র দুটি। একটি বুর্জোয়াদের, অপরটি জনগণের। বুর্জোয়া ধারাটিই প্রধান। আওয়ামী লীগ, বিএনপি থেকে শুরু করে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। অতিশয় ভদ্র উদারনৈতিকরা যেমন ভয়াবহ রকমের রক্ষণশীলরাও তেমনি এই ধারারই অন্তর্গত। বাইরে যা হোন না কেন, অন্তরে এরা সবাই ব্যক্তিমালিকানায় ও ব্যক্তিগত মুনাফায় বিশ্বাসী, এবং পুঁজিবাদের সমর্থক। এই ধারার বিপরীতে এবং সম্পূর্ণরূপে বিপক্ষে রয়েছে জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক ধারাটি। সেটি সমাজতান্ত্রিক। ওই ধারার লক্ষ্য সম্পত্তিতে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা। আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রীদের প্রধান দুর্বলতা ঐক্যের অভাব। 

পুঁজিবাদীদের জন্য কিন্তু সেই সমস্যাটা নেই; তাদের মধ্যে ঝগড়া আছে অবশ্যই, খুনোখুনিও ঘটে, বিষয় সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে পরিবারের মধ্যে যেমনটা ঘটে থাকে; কিন্তু আদর্শগত লক্ষ্যে তারা ঐক্যবদ্ধ, আর সে লক্ষ্যটা হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা চালু রাখা। এ ক্ষেত্রে তারা একাট্টা; এবং তাদের সবার সুনির্দিষ্টি শত্রু হলো সমাজতন্ত্রীরা। সমাজতন্ত্রীরা চান সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। সামাজিক সম্পর্কগুলোকে মানবিক করতে ও টিকিয়ে রাখতে। অর্থাৎ মানুষের মনুষ্যত্বকে বজায় রাখতে এবং বিকশিত করতে। বুর্জোয়াদের সাধনা শোষণ ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার। দ্বন্দ্বের ওই নাটকটা চলছে, অভ্যুত্থানও ঘটছে, কিন্তু বৈষম্য ঘুচছে না, ক্ষমতা রয়ে যাচ্ছে নিপীড়ক বুর্জোয়াদের হাতেই। হাতবদল ও হাতসাফাই-ই ঘটছে শুধু, খেলার তাসের মতো। এবং সেই ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়োজনেই বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে দানবে পরিণত করতে চায়। নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধি পায়, কারণ বিক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ে, তারা বিক্ষোভ করে, বিদ্রোহে অংশ নেয়, এবং সম্ভাবনা দেখা দেয় পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামটা জোরদার হওয়ার।

 
আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রীরা সব গণ-অভ্যুত্থানেই থেকেছেন, অভ্যুত্থানের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজও করেছেন; কিন্তু তারা নেতৃত্ব দিতে পারেন না, বিভক্তি ও বিভ্রান্তির কারণে। 
তারুণ্যের জয় হয়েছে। তারুণ্য যে কতটা অদম্য ও সৃষ্টিশীল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে তরুণদের এই আন্দোলনে, যখন তারা বিপদ ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে নতুন নতুন কর্মসূচি দিয়েছে, এবং তরুণদের উদ্যমে এবং তরুণদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও সমর্থনে যেগুলো যখন সফল হয়েছে। 
ইতোমধ্যে অবস্থা যে বদলেছে তা কিন্তু নয়, মনে হবে নতুন একটা বাস্তবতাই তৈরি হয়েছে। কিন্তু সারবস্তুতে সত্যি সত্যি কোনো বদল ঘটেছে কী? আসলে কিন্তু বাস্তবতার ওপরটাই যা বদলেছে, ভেতরের বস্তু আগের মতোই। পুরাতন বাস্তবতার নানা প্রকাশ তাই দেখতে পাচ্ছি। যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন। শিশু ও নারী ধর্ষণের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে দেশ। চতুর্দিকে অরাজক পরিস্থিতি। মানুষ অনিরাপদে তো বটেই, চরম উৎকণ্ঠায় জীবন অতিবাহিত করছে।

বিশ্বব্যাপীই এখন মানুষের নিদারুণ দুর্দশা চলছে। তা থেকে মুক্তির উপায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ও মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বিদায় করে সামাজিক মালিকানার নতুন বিশ্ব গড়ে তোলা। সে জন্য কেবল রাষ্ট্রীয় সংস্কার নয়, সামাজিক বিপ্লবও প্রয়োজন হবে। রাজা ও প্রজার সম্পর্ক ছিন্ন করে, বৈষম্য ঘুচিয়ে ফেলে প্রতিষ্ঠিত করা চাই প্রকৃত সাম্য ও মৈত্রীর সম্পর্ক। তার জন্য সামাজিক বিপ্লব ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই। সংস্কারে কুলাবে না। লুণ্ঠন এবং ত্রাণ তৎপরতা দুটোই সত্য; প্রথমটি ঘটে ব্যক্তিগত মুনাফার লোভে; দ্বিতীয়টি প্রকাশ পায় সমষ্টিগত মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায়। প্রথমটির পরিণতি ফ্যাসিবাদে; দ্বিতীয়টি সৃষ্টি চায় সামাজিক বিপ্লবের। ত্রাণকে সামনে আনতে হলে দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা অপ্রয়োজনীয়, কারণ দুর্যোগ এখন সার্বক্ষণিক, দুর্যোগ থেকে মানুষের মনুষ্যত্বকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পীড়ন থেকে পরিত্রাণ।
রোগ সমাজের গভীরে, এবং রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সংস্কারে কুলাবে বলে আশা করাটা যে বর্তমানে নিতান্তই ভ্রান্তিবিলাস, সেটা যেন না ভুলি। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনকে গুটিয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নেই। সেটা সম্বিতে সার্বক্ষণিকভাবেই থাকা আবশ্যক। 

মানুষ কাজ চায়, কেবল জীবিকার নয়, মানুষ জীবনের কাজও করতে প্রস্তুত; জীবনের কাজটা সমাজ বদলের। অভাব যার সেটি হলো আন্দোলন। ওই আন্দোলন বুর্জোয়ারা করবেন না, বুর্জোয়ারা বৈষম্যবিরোধী নন, তারা বৈষম্য সৃষ্টি ও লালন-পালনের পক্ষে; আন্দোলন করতে হবে সামাজিক বৈষম্যবিরোধীদের, অর্থাৎ সমাজতন্ত্রীদের। সমাজতন্ত্রীরা যদি একটি সুনির্দিষ্ট ও অতীব প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন, তবে দেখা যাবে সেই ফ্রন্টে মানুষ কীভাবে সাড়া দিচ্ছেন, এবং অসম্ভবকে সম্ভব করার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে পাঁচমিশালি একটি যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল, তাতে মুসলিম লীগের পতন ভিন্ন অন্যকিছু অর্জিত হয়নি; এখন আর পাঁচমিশালি না, প্রয়োজন সমাজতন্ত্রীদের যুক্তফ্রন্ট। শিক্ষার্থীদের কোটা-বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাফল্য সামাজিক বৈষম্য দূর করবার জন্য সমাজতন্ত্রীদের আবারও বলছে, মিলিত হতে, মিলিত হয়ে সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব করে তুলবার পথে এগোতে। এই যুক্তফ্রন্ট জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে; ওই পথে সামাজিক বিপ্লব ঘটবে এই আশা নিয়ে নয়, সমাজ বিপ্লবের পক্ষে জাতীয় সংসদের ভেতরে এবং বাইরে জনমত ও জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। নির্বাচনের আগে দাবি হওয়া চাই প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে আসন বণ্টনের; এবং নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক উপাদান যুক্ত করার অধিকার দানের। রাষ্ট্রয় ভাবে এই ঘোষণাটাও থাকা চাই যে, বায়াত্তরের সংবিধানে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত ছিল সংবিধানকে তা কোনোমতেই অমান্য করবে না।  

সমাজ পরিবর্তনকামীদের ঐক্যটা হবে সামাজিক বাস্তবতার পরিবর্তনের লক্ষ্যে। এবং ঐক্য যতটা না নেতাদের হবে তার চেয়ে বেশি হবে কর্মীদের। দেশের মানুষ ওই ঐক্যের জন্য অপেক্ষমাণ। বুর্জোয়াদের রাজনীতিতে তাদের আস্থা শেষ হয়ে গেছে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ধর্ষণের ভয়াবহতা এবং বিকৃত মানসিকতা

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৫ পিএম
ধর্ষণের ভয়াবহতা এবং বিকৃত মানসিকতা
মো. সাখাওয়াত হোসেন

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনায় সবাই হকচকিত। স্কুলগামী শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। মানসিকভাবে বিকৃত, রুচিহীন, কুপ্রবৃত্তি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এক ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে। ঘর থেকে নারীরা বের হয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে কি না, সে ব্যাপারে আতঙ্কের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে প্রায় সবাই। মাগুরার আছিয়ার ঘটনায় পুরো দেশ ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যাপারে রাস্তায় নেমে এসেছে জনগণ। ধর্ষণের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ প্রত্যেককে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে ‍তুলতে হবে।  

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন। এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার দুটি ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে পাঁচজন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীও রয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে তিনজন কিশোরী ও ১৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুজন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে। 

এ ধরনের পরিসংখ্যান অত্যন্ত উদ্বেগের, ভয়াবহ ও সবার জন্য আতঙ্কের। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে; যার সঙ্গে ঘটনাটি ঘটছে কিংবা যাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তারা প্রত্যেকেই ঘটনার পরবর্তীতে ট্রমার মধ্যে চলে যায়। এ ট্রমাটাইজড অবস্থা পর্যায়ক্রমে বিদ্যমান থাকলে ক্ষতিগ্রস্তরা মানসিক পীড়নের মধ্যদিয়ে জীবন যাপন করে। ক্ষতিগ্রস্ততার এ রেশ দীর্ঘমেয়াদি, একজন ভুক্তভোগী সহজে আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। মানসিকভাবে ওই ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত তথা ভুক্তভোগীকে সহজ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ পরিবেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে। তা না হলে ধর্ষিত নারীরা কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন? ধর্ষণের ঘটনা ক্রমান্বয়ে কেন ঘটেই চলবে? ধর্ষণের ঘটনা যে কেবল এখনই ঘটছে বিষয়টা তা নয়, তবে সেটি বর্তমানে মহামারি আকার ধারণ করছে। অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সমাজ থেকে গৃহীত ব্যবস্থাও কার্যাকরভাবে ফলপ্রসূ হচ্ছে না, যে কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। 

ধর্ষণের ঘটনা কেন ঘটছে এবং কারা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত? এর কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের পাশাপাশি ধর্ষণ প্রতিহতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নীতি-নৈতিকতার অভাব, পারিবারিক শিক্ষার অবক্ষয়, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে অপারগতা, বিকৃত মানসিকতা, সমাজচ্যুত, বিচ্ছিন্নতা, কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া প্রভূত কারণে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে। পরিবার হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের সর্বোচ্চ শিক্ষাস্থল। পারিবারিক শিক্ষাই মানুষকে বড় করে তোলে, ভালোমন্দের পার্থক্য নিরূপণে সহায়তা করে, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল ও দায়বদ্ধ হিসেবে গড়ে তোলে। অন্যায়, অনিয়মকে পরিহার করে জীবন পরিচালনার শিক্ষা দেয়। যাদের মধ্যে পারিবারিক শিক্ষা নেই, নৈতিক অবক্ষয়ে শামিল, ধর্মীয় শিক্ষা নেই, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই, রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই কেবলমাত্র তাদের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে। কেননা, কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক ও স্বচ্ছ চিন্তার মানুষের দ্বারা ধর্ষণের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়।   

নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পরিচিতদের দ্বারা। সাম্প্রতিককালে এ ব্যাপারটি আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করেছে। মাগুরার শিশু ধর্ষণের ঘটনাটিকে যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে শিশুটিকে ধর্ষক দীর্ঘদিন ধরেই চেনে ও জানে। শিশুর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ধর্ষক শিশুটিকে চরমভাবে নির্যাতন করে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয়। এদিকে শিশুর যারা অভিভাবক ছিলেন তারা ক্ষুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেননি তাদের আত্মীয়ের দ্বারা এ ধরনের রোমহর্ষক ঘটনা ঘটবে। বিকৃতমনা তথা পাষণ্ডটি দীর্ঘদিন ধরেই লোলুপ দৃষ্টি ধারণ করে শিশুটিকে ধর্ষণ করার মনোবৃত্তি পোষণ করেছিল। 

আর শিশুটি যেহেতু নিজেকে পাষণ্ডের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি, তাই ধর্ষকের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে শিশুটি সহজ টার্গেট ছিল। এসব কিছুর সংমিশ্রণে ধর্ষক সহজেই তার কুপ্রবৃত্তিকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছে। মাগুরার আছিয়ার ঘটনার মতো অন্যান্য ঘটনাতেও দেখা যায়, ধর্ষিতা ধর্ষকের পূর্ব পরিচিত এবং এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ধর্ষকরা প্রতিনিয়ত উন্মাদ হয়ে উঠছে। সুতরাং, অপরাধে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তি, সহজ লক্ষ্যবস্তু ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি এ তিনের সমন্বয়ে অপরাধের ঘটনা ঘটে, মাগুরার ঘটনাটিতেও এ তিনটি বিষয়বস্তুর সমন্বয় ঘটেছে। এ ব্যাপারগুলোতে সতর্ক হয়ে সব অভিভাবকের সন্তান প্রতিপালন ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। 

ধর্ষণের শিকার ক্ষতিগ্রস্তরা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেকেই ট্রমা মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ধর্ষিতার পরিবারকেও নেতিবাচক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। অথচ এ ব্যবস্থায় ধর্ষিতা নারীর পরিবারের পাশে সবাইকে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। চলমান ধর্ষণ ঘটনার ফলে প্রত্যেক পরিবার ভয়ে সন্ত্রস্ত। উঠতি বয়সী তরুণী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, কিশোরী ও শিশুরাও মাত্রাতিরিক্ত ধর্ষণ ঘটনার কারণে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না। ঘর থেকে বের হওয়াই আতঙ্কের। এহেন পরিস্থিতি কোনোভাবে কাম্য নয়। সাধারণত দেখা যায়, প্রত্যেকেই নিজের সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকে, সেটি থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে নিজের সন্তানের পাশাপাশি অন্যের সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে যদি প্রত্যেকে সোচ্চার হই, তাহলে একটি মানবিক সমাজ কাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব। ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ওঠে মোকাবিলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। কেননা, সমাজ থেকে ধর্ষণের মতো জঘন্য ও ঘৃণিত কর্মকাণ্ডকে উৎখাত করতে না পারলে যেকোনো পরিবার আক্রান্ত হতে পারে। এ বোধ-বিবেচনার জায়গাটুকু সবার মধ্যে উদিত হওয়া উচিত।  

ধর্ষণের ভয়াবহতাকে প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতে দ্রুত ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করে স্বল্প সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। দেখা যায়, ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত অনেকেই জামিন নিয়ে বের হয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ শ্রেণিটিকে অক্ষম করতে তথা নিষ্ক্রিয় করতে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে, যেমন এমন একটি সমাজব্যবস্থা চালু রাখা যেখানে ধর্ষক হয়ে উঠবে না কেউই কিংবা ধর্ষক হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। কর্মক্ষম নাগরিক উপহার দিতে পারলে সমাজ থেকে অনিয়ম ও নৈরাজ্য অচিরেই দূরীভূত হবে। এ ছাড়া ধর্ষকের বিরুদ্ধে প্রচলিত শাস্তির মাত্রা বাড়ানো উচিত। ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে, একঘরে করে দিতে হবে। 

ধর্ষকদের পরিবারের সঙ্গে কেউই আত্মীয়তা করতে পারবে না, কোনোরকম সামাজিক সম্পর্কে জড়ানো যাবে না ধর্ষক পরিবারের সঙ্গে। ধর্মীয় নেতাদের ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আলোচনা জারি রাখতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে (স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান) ধর্ষণের বিরুদ্ধে নিয়মিত সভা, সমাবেশ, সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতন ও সতর্ক করে তুলতে হবে। ধর্ষক পরিবারের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে বয়কটের ঘোষণা অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি ধর্ষকদের চূড়ান্ত শাস্তি ধর্ষণ থেকে ধর্ষকদের বিরত রাখতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে ধর্ষকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রজ্ঞাপন দিতে হবে। সর্বোপরি ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. বদিউল আলম মজুমদার অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১১:৫৩ এএম
অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে
ড. বদিউল আলম মজুমদার

ড. বদিউল আলম মজুমদার একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ‘দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর বাংলাদেশ শাখার পরিচালক ও বৈশ্বিক সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া তিনি নাগরিক সংগঠন ‘সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। আগামীতে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এ দেশের প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কারের নানা দিক নিয়ে তিনি খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সম্পাদকীয় বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক শেহনাজ পূর্ণা

নির্বাচন অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে অর্থাৎ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনে যারা ভোট দেবে তারা নারী-পুরুষ এবং সমাজে পিছিয়ে পরা মানুষ- সবাই যেন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। কেউ যেন বাদ না পড়ে। আর আওয়ামী লীগের ব্যাপারে বলব, এটা আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনই নির্ধারণ করবে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি পারবে না। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীকে পরিপূর্ণভাবে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে। সীমাহীন দলীয়করণের মাধ্যমে বিগত সরকার ও প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যকার বিভাজন প্রায় সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে পড়েছিল। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অনেকেই দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করেছেন। তারা সরকারের দমন-পীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিল। এগুলো দূর করেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে।…

খবরের কাগজ: আপনি নির্বাচন কমিশনারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের মূল প্রস্তাবগুলো কী কী?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে আমাদের সুপারিশ ছিল। তার মধ্যে কতগুলো হলো- নির্বাচন কমিশনসংক্রান্ত অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন গঠন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, নির্বাচন কমিশনের কর্মপরিধি, নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা ও ক্ষমতা ইত্যাদি। তার পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত দিক ও নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদিসহ সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক আদেশ। এর মধ্যে সংশোধনের বিষয়ে আমরা বেশ কিছু প্রস্তাব করেছি। আমরা প্রস্তাব করেছি সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারে। আমরা মনে করি, আন্তর্জাতিকভাবে সীমানা নির্ধারণ করা দরকার। কতগুলো নীতিমালা আছে- আমরা ভবিষ্যতের জন্য ইনডিপেনডেন্ট কমিটি দিয়ে বা ইনডিপেনডেন্ট অথরিটি দিয়ে তা করার কথা বলেছি। তবে এ বছর নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা কমিটি করা দরকার। তারপর ভোটারের ব্যাপারেও আমরা প্রস্তাব করেছিলাম। আমরা 'না' ভোটের প্রস্তাব করেছি। সংসদে উচ্চকক্ষের কথা বলেছি। প্রধানমন্ত্রী দুই মেয়াদ থাকতে পারবেন, আমরা সে কথাও বলেছি। সংসদে উচ্চকক্ষের নির্বাচনের প্রস্তাব করেছি। এ রকম আমরা অনেক বিষয়ে প্রস্তাব করেছি। আরও প্রস্তাব করেছি, রাজনৈতিক দলের বিষয়ে অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক বিষয়গুলোসহ রাজনৈতিক দলের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের মতামত পেশ করেছি। মনোনয়নের ক্ষেত্রে তারা নিজের সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে তিনজনের একটা প্যানেল তৈরি করতে পারে। তারা প্রত্যেকে কনস্টিটিউটে তিনজনের প্যানেল তৈরি করে মনোনয়ন বোর্ডের কাছে পাঠাবে। সেই প্যানেল থেকেই মনোনয়ন বোর্ড মনোনয়ন দেবে বা কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। 

খবরের কাগজ: রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কেউ কেউ বলছেন, প্রদেশ, আবার কেউ কেউ বলছেন ৩০০ আসনের পরিবর্তে ৫০০ আসন। আপনারা সংস্কার প্রস্তাবে এ বিষয়ে কিছু বলেছেন কি না। 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা প্রদেশ করার বিষয়ে বলিনি। আমরা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রস্তাব করেছি। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য সংসদে আসন ৪০০-এ উন্নীত করার কথা আমরা বলেছি। ৪০০-এর মধ্যে ১০০ আসন হতে হবে নারীদের জন্য সংরক্ষিত। প্রধান উপদেষ্টার কাছে পেশকৃত প্রতিবেদনে আমরা এ ব্যাপারে প্রস্তাব করেছি।

খবরের কাগজ: নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছেন অনেকেই। আপনাদের সংস্কার প্রস্তাবে এ বিষয়ে কিছু বলেছেন কি না? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: অবশ্যই আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব করেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে আমি আদালতে গিয়েছি। এ ব্যাপারে আদালতে রায় হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সংশোধনী বাতিল করা হবে। আপিল বিভাগে একটা রিভিউ পিটিশন আছে। যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে তার রিভিউ করার ব্যাপারে আমরা দরখাস্ত করেছি। আমরা আশা করি যে, আমরা এর প্রতিফলন দেখতে পাব এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসবে। আমরা সংস্কার প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে সুপারিশ করেছি। 

খবরের কাগজ: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসংগঠনের নেতারা বলছেন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। অন্যদিকে বলা হচ্ছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: নির্বাচন অবশ্যই অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে অর্থাৎ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনে যারা ভোট দেবে তারা নারী-পুরুষ এবং সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষ- সবাই যেন এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। কেউ যেন বাদ না পড়ে। আর আওয়ামী লীগের ব্যাপারে বলব, এটা আইন দ্বারা নির্ধারিত হবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনই নির্ধারণ করবে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে কি পারবে না। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীকে পরিপূর্ণভাবে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে। সীমাহীন দলীয়করণের মাধ্যমে বিগত সরকার ও প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যকার বিভাজন প্রায় সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে পড়েছিল। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের অনেকেই দলীয় ক্যাডারের মতো আচরণ করেছেন। তারা সরকারের দমন-পীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়ে কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছিল। এগুলো দূর করেই নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে। 

খবরের কাগজ: বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন ভারতের নির্বাচন কমিশনের চেয়েও অধিক শক্তিশালী। সে ক্ষেত্রে ভারত যদি অবাধ নির্বাচন করতে পারে, বাংলাদেশে কেন সেটা সম্ভব হয় না? সে ক্ষেত্রে ত্রুটিগুলো কী কী বলে আপনি মনে করেন? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমাদের আইনগুলো শক্তিশালী। কিন্তু ভিত্তিগুলো দুর্বল। অর্থাৎ দুর্বল চিত্তের ব্যক্তিদের, দুর্বল চরিত্রের ব্যক্তিদের- যাদের দলীয় আনুগত্য আছে, সেই সব ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার ফলে তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। এটা ব্যক্তির সমস্যা, এটা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা। কারণ, বিধিবিধান যদি সঠিকভাবে না মানা হয়, তাহলে তা প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে। কিন্তু ব্যক্তির সমস্যাই হচ্ছে বড় সমস্যা। সে জন্যই সংস্কার প্রয়োজন। বিধিবিধানের প্রয়োজন। পদ্ধতির সংস্কার ও প্রক্রিয়ার সংস্কার প্রয়োজন। একই সঙ্গে আইনি কাঠামোর পরিবর্তন, সাংবিধানিক সংস্কার- এ সবকিছুই দরকার। আমরা যদি একটা ইতিবাচক পদ্ধতিতে যাই, আমরা যদি এগুলোতে মনোযোগ দিই, আমরা যদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর হিসেবে দেখতে চাই, তাহলে কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কার প্রয়োজন হবে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচনের জন্য এটা দরকার হবে। বাংলাদেশ অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে আমরা এ কথাও বলি যে, এখনো স্বাধীনতার অনেক স্বপ্ন আমাদের পূরণ হয়নি। মানুষ ভোট দিতে গেছে কিন্তু ভোট দিতে পারেনি। ভোটের মাঠে বিকল্প থাকতে হয়। নিজেদের মধ্যে ভোট হলে তো সেই বিকল্প থাকে না। তাই মানুষ অতীতে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। পছন্দমতো প্রার্থী বাছাই করতে নির্বাচন সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক হওয়া প্রয়োজন, যা বিগত সময়গুলোতে দেখা যায়নি। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে গণতন্ত্র, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ভোটাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের সচেতন ব্যক্তিদের ভূমিকা রয়েছে। মানুষের ভোটের অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত একটি মানবাধিকার। তাই নির্বাচনে জনগণ যেন তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, সেটি আমাদের দেখতে হবে। আমাদের এই ত্রুটিগুলো বিবেচনায় নিয়ে সেগুলো দূর করার ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে।
  
খবরের কাগজ: প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি করেছে। কিন্তু জামায়াতসহ অন্য দলগুলো স্থানীয় নির্বাচনের দাবি করেছে। এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সে ক্ষেত্রে বলব, দলগুলো দুই দিকেই যুক্ত আছে এবং এই দুই দলেরই মতামত এখন এক জায়গায় পৌঁছতে হবে। কোন পন্থায় কোন দিকে, কোন পক্ষের সিদ্ধান্ত যাবে- এখানে বিতর্কিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করবে। আমি আশা করি যে, নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করার উদ্যোগ নিয়েছি এবং তা সফল হবে। এর মাধ্যমে কতগুলো বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভিত্তিতে গণ-আদেশের মাধ্যমে সংশোধন হবে। সেটা কাজে লাগিয়ে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার ব্যবস্থা করতে হবে।

খবরের কাগজ: আমরা অতীতেও দেখেছি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপিকে ভোটের বাইরে রেখেছিল। এখন আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। এখনো যদি দলগুলোকে ভোটের বাইরে রাখার ভাবনা থাকে, তাহলে বৈষম্য তো রয়েই গেল। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে স্থিতিশীলতা কীভাবে ফিরে আসবে?  

ড. বদিউল আলম মজুমদার: বিগত সময়ে বিএনপিকে দমনকরণের মাধ্যমে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ পালিয়ে গেছে। তা ছাড়া অতীতে আওয়ামী লীগ লাগামহীন অন্যায় করেছে। এখন অবধি  তারা এই অন্যায়ের দায় স্বীকার করে না। অপরাধের জন্য তারা  ক্ষমাপ্রার্থনাও করেনি। এই আওয়ামী লীগ সরকার ১৫ বছর ধরে মানুষকে বাকশক্তি, বাকস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করেছে। এখন রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, তারা যে অপরাধ করেছে- সেটার বিচার হওয়া দরকার। এরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। এই বিচার না করলে নির্বাচন করা সম্ভব নয়। আর এই বিচার যদি না করা হয়, তাহলে আবারও সবকিছু চোরের দেশে পরিণত হবে। মিথ্যাবাদীদের দোসরে পরিণত হবে। এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আইনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দেবে।

খবরের কাগজ: আপনি বহুদিন ধরে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেশে দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর কারণগুলো কী কী? 

ড. বদিউল আলম মজুমদার: মানুষ যদি সহিংসতামুক্ত হয়, তাহলেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে। মানুষ নির্বাচনবিমুখ অবস্থা কাটিয়ে নির্বাচনমুখী অবস্থায় ফিরে যেতে সক্ষম হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম উপাদান গণমানুষের ভোটের অধিকার। কিন্তু সেই অধিকার বিগত সরকারের আমলে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে সর্বত্র দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন সংঘটিত হয়েছে। বিগত সময়ে একদিকে ভোটারদের ভোট প্রদানে যেমন অনীহা তৈরি হয়েছিল, তেমনি এটি একটি রোগ অথবা রোগের উপসর্গে পরিণত হয়েছিল। কাজেই এই রোগের চিকিৎসা করতে হলে শুধু উপসর্গকে চিহ্নিত করলে হবে না। রোগের কারণও চিহ্নিত করতে হবে। সাধারণ মানুষ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তা নিয়ে অনাগ্রহের মূল কারণ আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। এর মূল কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মানুষের প্রতি অনাস্থা। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমাদের উচিত এই ব্যবস্থাকে রোধ করে একটি জবাবদিহিমূলক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি করা। আমরা মানুষের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে। কোনো দলের পক্ষে নই, আমরা নিরপেক্ষ। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের যা করণীয়, আমরা এখনো তা করতে পারিনি। আমাদের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।  নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হওয়ার কারণ- ভোট দিতে গেলে সঠিকভাবে ভোট দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে তাদের মনে শঙ্কা ছিল। দেশে বহুদিন ধরে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না বলে অনেকে মনে করে থাকে। এ ধরনের নানান শঙ্কা তাদের মনে কাজ করে। কাজেই তারা ভোট দিলে বা না দিলে তাতে কিছু এসে যায় না। ক্ষমতাসীনরা যাদের চায় তারাই নির্বাচিত হবে। এই নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষের ব্যাপক অনাস্থা। এর একটি কারণ হলো, যে প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে তার মধ্যে অন্যতম হলো নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের ওপর মানুষের অনাস্থার কারণ ছিল ব্যাপক দলীয়করণ। অনাস্থা নির্বাচনি ব্যবস্থাপনার ওপর এবং এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর। এসব কারণে মানুষ ভোট দিতে চায়নি এবং তারা মনে করে তারা ভোট দিলেও তাদের প্রত্যাশিত প্রার্থীদের পরাজয় নিশ্চিত। কাজেই ভোটদানে তারা অনীহা প্রকাশ করে এসেছে সব সময়। কাজেই আমরা বলেছি, নির্বাচনি ব্যবস্থাপনায় ব্যাপকভাবে সংস্কার দরকার। 

খবরের কাগজ: আমরা দেখেছি একটা সময় নির্বাচনকে মানুষ উৎসবমুখর জাতীয় আয়োজন বলে মনে করত। বিগত সরকারের সময়গুলোতে জনগণ ভোটবিমুখ হয়ে পড়েছিল। ভোটবিমুখ অবস্থা থেকে মানুষকে নির্বাচনমুখী করার ক্ষেত্রে কী কী উপায় আছে বলে মনে করেন?

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সংস্কারের মাধ্যমে এ অবস্থা দূর করতে হবে। তা না হলে নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। অর্থাৎ নির্বাচনব্যবস্থা কোনোভাবেই কার্যকর হবে না। বিগত সরকারের আমলে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নির্বাচনে টাকার খেলা। যোগ্য-অযোগ্য যেই হোক, তারা মনোনয়ন কিনে নিত। মনোনয়নের পর তারা বিভিন্নভাবে টাকা-পয়সা ব্যয় করে তাদের জয় নিশ্চিত করত। কাজেই দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন হলেই চলবে না। গণতন্ত্র, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, ভোটাধিকারসহ সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনের সচেতন ব্যক্তিদের ভূমিকা রয়েছে। মানুষের ভোটের অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত একটি মানবাধিকার। তাই নির্বাচনে জনগণ যেন তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত না হন, সেটি আমাদের দেখতে হবে। তাহলে নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশ ফিরে আসবে। মানুষ নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবে। আমরা আমাদের সংস্কার প্রস্তাবে জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সর্বতোভাবে উৎসবমুখর নির্বাচনি ব্যবস্থা গড়ে তোলার সপক্ষে মতামত দিয়েছি। নিজে কেন্দ্রে গিয়ে ভোটদানের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ আবারও নির্বাচনমুখর হয়ে উঠবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। 
ড. বদিউল আলম মজুমদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।