
বিকেন্দ্রীকরণনীতির মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ব্যতীত অন্যান্য নগর বিশেষত, আঞ্চলিক শহরগুলোয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিল্পে অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারকে আরও কার্যকরভাবে নগর উন্নয়ন ও পরিচালনের ক্ষমতা দিতে হবে। মফস্বল শহরগুলোকে শিল্প, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোসহ আঞ্চলিক হাব তৈরি করা গেলে রাজধানী ঢাকায় অভিবাসন হার কমানো সম্ভব। এ ছাড়া, ‘পলিসেন্ট্রিক সিটি’ মডেলের মাধ্যমে বিভিন্ন শহরকে সংযুক্ত করা হলে ঢাকা শহরের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমবে এবং সুষম সম্পদ বিতরণ নিশ্চিত করবে।...
বাংলাদেশে নগরায়ণে ভৌগলিক বৈষম্য বিদ্যমান। সমগ্র বাংলাদেশের শুধু ১ শতাংশ ভূমি নিয়ে ঢাকা মহানগর এলাকা গঠিত হলেও দেশের নগর জনসংখ্যার প্রায় ৩২ শতাংশ রাজধানী ঢাকায় বাস করে এবং দেশজ জিডিপির ৩০ শতাংশেরও বেশি আসে ঢাকা শহর থেকে। কেন্দ্রীভূত নগরায়ণের ফলে দেশের অন্যান্য নগর, বিশেষ করে জেলা শহরগুলোয় বিকাশের অভাব এই বৈষম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে গ্রামীণ এলাকায় জনগণ পরিপূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং রাজধানী ঢাকায় অভিবাসনের চাপ বাড়ছে।
সেহেতু বিকেন্দ্রীকরণনীতির মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রাম ব্যতীত অন্যান্য নগর বিশেষত, আঞ্চলিক শহরগুলোয় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিল্পে অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারকে আরও কার্যকরভাবে নগর উন্নয়ন ও পরিচালনের ক্ষমতা দিতে হবে। মফস্বল শহরগুলোকে শিল্প, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোসহ আঞ্চলিক হাব তৈরি করা গেলে রাজধানী ঢাকায় অভিবাসন হার কমানো সম্ভব। এ ছাড়া, ‘পলিসেন্ট্রিক সিটি’ মডেলের মাধ্যমে বিভিন্ন শহরকে সংযুক্ত করা হলে ঢাকা শহরের ওপর অতিরিক্ত চাপ কমবে এবং সুষম সম্পদ বিতরণ নিশ্চিত করবে।
নগর দূষণ
অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও নির্মাণ, শিল্পের বর্জ্য নিঃসরণ, যানবাহনের দূষণ এবং অব্যবস্থাপিত বর্জ্য নিষ্কাশনের কারণে ঢাকা শহরের পরিবেশদূষণ বর্তমানে এক উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। ঢাকার বায়ুমান প্রায়শই ‘দুর্যোগপূর্ণ’ অবস্থায় পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ ছাড়া নগর জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে রয়েছে তীব্র শব্দদূষণ।
সেহেতু, নগরের বায়ুদূষণ হ্রাসের লক্ষ্যে চারপাশের বেআইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত ইটভাটাগুলো অনতিবিলম্বে বন্ধ করে প্রচলিত ইটের পরিবর্তে কম মাটি এবং কম জ্বালানি ব্যবহারকারী অথচ অধিক গুণাবলিসম্পন্ন ইট ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। ‘আইওটি’ (Internet of Things) ভিত্তিক বায়ুর গুণমান নিরীক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা এবং শিল্প ও যানবাহনে নিঃসরণের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শক্তিশালী করা জরুরি। নবায়নযোগ্য শক্তি এবং পরিবেশবান্ধব যানবাহন প্রচলনে সহযোগী হতে হবে। নগরীতে শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬’-এর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কঠিন বর্জ্যব্যবস্থাপনা নীতির আওতায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য পদ্ধতি এবং বর্জ্য থেকে শক্তি উৎপাদনের প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।
নগর পরিবহনব্যবস্থা
যেকোনো নগরের মেরুদণ্ড হওয়া উচিত তার গণ-যাতায়াত ও পরিবহনব্যবস্থা। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশে নগর যাতায়াত ও পরিবহনব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সরকারি প্রচেষ্টায় ধনীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব পরিদৃষ্ট হয়। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার ৭৭ শতাংশ সড়ক প্রাইভেট গাড়ির দখলে থাকে আর নগরবাসীর ৮৫ শতাংশের মাত্র ২৩ শতাংশ সড়ক ব্যবহার করছে। বিশ্বব্যাংকের একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরে যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে ৬.৪ কিলোমিটারে নেমে এসেছে এবং যাতায়াতের এই মন্থরতার কারণে জিডিপি প্রায় ৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ‘আপডেটিং রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (আরএসটিপি)’-এর একটি জরিপ মতে, দুরবস্থাপূর্ণ বাস পরিষেবার কারণে ঢাকায় বাস ব্যবহারকারীদের আশঙ্কাজনক হারে কমছে, বিপরীতে হেঁটে চলার প্রবণতা বাড়ছে। ঢাকা শহরের প্রায় ৬০ শতাংশ যাতায়াত হয় হেঁটে; অথচ শহরের অনেক রাস্তায় ফুটপাত নেই, অথবা থাকলেও সেগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রশস্ত, দখলকৃত এবং হাঁটার উপযুক্ত নয়। নগরবাসীর জন্য মেট্রোরেল এবং ‘বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)’-এর মতো গণপরিবহনব্যবস্থায় অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও ৫টি মেট্রোরেল বাস্তবায়নে ২০৩৫ সাল নাগাদ মোট যাত্রার কেবল ১১ শতাংশই বহন করতে পারবে।
উদ্ভূত এই পরিস্থিতির উত্তরণে, ব্যক্তিগত গাড়িকে যাতায়াতের মূল মডেল হিসেবে দেখা এবং ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধিকে সমৃদ্ধির প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা বন্ধ করে গণপরিবহনের ওপর সর্বাত্মক গুরুত্ব দিতে হবে। ‘বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজি’ এবং বিআরটি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা উচিত, যাতে সময়সাশ্রয়ী পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। পাশাপাশি, পদচারীবান্ধব অবকাঠামো তৈরি
করা এবং সাইকেলভিত্তিক যাতায়াতের প্রতি জোর দিতে হবে।
পরিশেষে, ২০১৫ সালের ড্যাপ সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা মহানগরীর প্রায় ৩৫৬ বর্গকিলোমিটার হচ্ছে নগরায়িত ভূমি, শহরতলি ভূমির পরিমাণ প্রায় ৯৯ বর্গকিলোমিটার, উন্ননয়কৃত ভূমির পরিমাণ প্রায় ৫৪ বর্গকিলোমিটার এবং কৃষি ও প্লাবনভূমি রয়েছে প্রায় ৭৪৫ বর্গকিলোমিটার। প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে ঢাকার নগরায়ণের ধারা বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঢাকা মহানগরীর আয়তন কেবল উত্তর দিকেই সম্প্রসারিত হচ্ছে, পূর্ব-পশ্চিমে বৃদ্ধি পায়নি; এমনকি দক্ষিণেও সম্প্রসারণের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম। এ ছাড়া, পুরো মহানগরীতে পাকা, সেমি পাকা ও কাঁচা রাস্তা মিলে মোট সড়কের পরিমাণ প্রায় ৫৬ বর্গকিলোমিটার। কাঁচা, সেমি পাকা, পাকা এবং নির্মাণাধীনসহ ঢাকায় প্রায় সাড়ে ২১ লাখ স্থাপনার বিন্যাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এসব স্থাপনার ৭৫ শতাংশই রাস্তার ৭ থেকে ২০ মিটার দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত। অর্থাৎ, এই ৫৪ বছরে, ঢাকায় ইমারতের আয়তন ক্রমাগত ঘনীভূত (Densification) হয়ে কেন্দ্রীভূতভাবে নগরায়িত হয়েছে; বন্যাপ্রবণ এই মহানগরীতে মূলত অবকাঠামোকে (সড়কব্যবস্থা) অনুসরণ করেই নগর সম্প্রসারিত হয়েছে। একদিকে যেখানে সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব, সেখানে অন্যদিকে নগরীর প্রায় তিন চতুর্থাংশই এখনো অবিকশিত অবস্থায় রয়ে গেছে। তার পরও নগরায়ণ এবং নগর ভাবনায় ঢাকাকেন্দ্রিকতা অসম এবং বৈষম্যপূর্ণ উন্নয়নকেই ত্বরান্বিত করছে। ফলে, ঢাকা মহানগরী হয়েছে একটি ‘অপরিপক্ব নগর’, যেখানে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় মৌলিক সুবিধাগুলোর প্রবল অভাব রয়েছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন একটি সুসংহত, টেকসই এবং আধুনিক নগর পরিকল্পনা; যা শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, বরং পরিবেশ, সামাজিসেবা, নিরাপত্তা এবং নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সেই লক্ষ্যে, সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, সুশীল সমাজ এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন কৌশল এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ এবং সুস্থ জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক: স্থপতি ও নগরবিদ
[email protected]