ঢাকা ৬ চৈত্র ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১

নীতি সুদহার প্রশংসনীয় হলেও বিনিময় হার নিয়ন্ত্রিত

প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫১ এএম
আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৯ এএম
নীতি সুদহার প্রশংসনীয় হলেও বিনিময় হার নিয়ন্ত্রিত
ড. জাহিদ হোসেন

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এটি প্রশংসনীয়। কারণ এটা করা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্য কোনো উপায় ছিল না।

যদিও নীতি সুদহার কিছুটা কমানোর দাবি ছিল ব্যবসায়ীদের। তবে আমি মনে করছি দেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় নীতি সুদহার কমানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর নতুন সরকার আসার পর ৩ বার নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণে এখনই তা পুনরায় বৃদ্ধি যুক্তিযুক্ত নয়।

এখন যে নীতি নেওয়া মার্কেটে তার প্রভাব পড়তে সময় দিতে হবে। সেক্ষেত্রে নীতি সুদহার অপরিবর্তিত রাখাই যুক্তি সম্পন্ন ছিল। সেই সঙ্গে প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছে, সেটিও বাস্তবসম্মত।

গভর্নর যথার্থভাবেই বলেছেন, চলতি বছর আমাদের প্রবৃদ্ধির দিকে তাকানোর সময় না। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

তবে বিনিময় হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যে নীতিতে চলছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সেখানে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হলেও নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থাই ধরে রাখা হয়েছে। আর এই বিষয়ে গভর্নর যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে আগের গভর্নরের ধারাবাহিকতাই দেখা যাচ্ছে।

তিনি একদিকে বলছেন আমাদের চাহিদা কমে আসছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। আবার অন্যদিকে বিনিময় হারে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন। যা সাংঘর্ষিক। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ী বিনিময় হারকে ওঠানামা করতে দিতে হবে।

আর বাংলাদেশ ব্যাংক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানুপুলেশনের যে বক্তব্য দিচ্ছে তার প্রমাণ কি? তারা কেন শুধু বাংলাদেশকেই টার্গেট করবে। একই রকম বাজার তো শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, পাকিস্তান ও ভারতেও। তাদের কেন টার্গেট করছে না। তার ব্যাখ্যা তো বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া উচিত।

এক কথায় বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক না করে আটকিয়ে রাখা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ

বিশ্বব্যাপী শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৮:৩৬ পিএম
বিশ্বব্যাপী শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে

১৯৪৫ সালে লীগ অব নেশনস ব্যর্থ হওয়ার পর মানবতাকে আত্ম-ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল সম্মিলিত নিরাপত্তার জন্য একটি সাহসী পরীক্ষা। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ রোধ করতে এবং সহিংসতার পরিবর্তে কূটনীতির মাধ্যমে সংঘাত পরিচালনার জন্য এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
তবুও, ৮০ বছর পরে আমরা নিজেদের বিপর্যয়ের প্রান্তে দেখতে পাচ্ছি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করেছে; যা বিজ্ঞানীরা দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় বিপৎসীমা হিসেবে দেখেন। প্রতিষ্ঠান এবং গণতন্ত্রের ওপর জনসাধারণের আস্থা অত্যন্ত কমে গেছে এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। কী হয়েছে?

জাতিসংঘ বিভিন্ন কারণে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। সহিংসতা, সংঘাত এমনকি গণহত্যার মতো ঘটনা এখনো উদ্বেগজনকভাবে ঘটছে। সংস্থাটি গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে সাধারণত অকার্যকর, অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক এবং অন্যায্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

সমস্যাটি হলো জাতিসংঘ একবিংশ শতাব্দীর মৌলিক সমস্যাগুলোর ওপর বিংশ শতাব্দীর যুক্তি উপস্থাপন করে যাচ্ছে। আজকের সবচেয়ে জরুরি চ্যালেঞ্জগুলো- যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক সংক্রমণ এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত যা কোনো সীমানা মেনে চলে না। তবুও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো ঈর্ষান্বিতভাবে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী জাতি রাষ্ট্রগুলোর কাঠামোর মধ্যে আটকে আছে। আমাদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল জাতীয় সীমানা সম্পর্কে পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য তৈরি করা হয়নি। জাতিসংঘ কেবল ধীরগতির নয়, এটি কাঠামোগতভাবেও এই ধরনের সমস্যাগুলো ব্যাপকভাবে মোকাবিলা করতে অক্ষম।

ক্রমবর্ধমান উপজাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবাদের মুখে প্রচলিত শাসন কাঠামোও যখন ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে, তখন প্রচলিত শাসনব্যবস্থার যে কোনো প্রস্তাবিত নতুন দৃষ্টান্ত ইউটোপিয়ানরা শুনতে চায় না। সৌভাগ্যবশত, বিশ্বের ইতোমধ্যেই একটি কার্যকর সংস্থা রয়েছে তা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সব ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এই ব্লকটি প্রমাণ করেছে যে, জাতীয় ফেডারেশন কাজ করতে পারে। যুদ্ধরত দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে সার্বভৌমত্বকে একত্রিত করার সুযোগ দিয়েছে। এটি তেমন কোনো মৌলিক ধারণাও নয়। ১৯৪৬ সালের গলআপ জরিপে, ৫৪ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করেছিলেন যে, ‘জাতিসংঘকে শক্তিশালী করা উচিত যাতে এটি এমন একটি বিশ্ব সরকারে পরিণত হয় যার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব জাতির সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে’।

২০২৪ সালে ৫৮ শতাংশ আমেরিকান মনে করতেন, জাতিসংঘ ‘খারাপ কাজ’ করছে। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় জাতিসংঘকে আরও সাহসী ভূমিকা পালন করা উচিত। দার্শনিক টিমোথি মর্টন বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো বৃহৎ সমস্যাগুলোকে ‘অতি-বস্তু’ বলেছেন। এগুলো ‘এত ক্ষণস্থায়ী এবং স্থানিক মাত্রার সত্তা’ যেগুলোর জন্য মৌলিকভাবে ভিন্ন ধরনের মানবিক যুক্তি প্রয়োজন। এ ধরনের সমস্যাগুলো সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করার জন্য বুদ্ধিগত এবং মানসিক উভয় পরিবর্তনের প্রয়োজন। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন যাকে ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ বলেছিলেন।

বুদ্ধিগতভাবে চিন্তা করলে ইহজাগতিক চিন্তাভাবনার জন্য নিজস্ব তাত্ত্বিক কাঠামো প্রয়োজন। এই দাবি নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীতে, জন মেনার্ড কেইনস বিশ্বব্যাপী মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন এবং ডলারকেন্দ্রিক ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিস্থাপনের জন্য ‘ব্যাংকর’-এর প্রস্তাব করেছিলেন। হান্না আরেন্ডট রাজনীতির বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকেও এগিয়ে নিয়েছিলেন। পিয়েরে টেলহার্ড ডি চার্ডিন ‘নুস্ফিয়ার’ (সম্মিলিত মানব চেতনা) সম্পর্কে তার ধারণাটি দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক স্কলারশিপে ‘গ্রহের সীমানা’ সম্পর্কে জোহান রকস্ট্রমের কাজ থেকে শুরু করে ব্রুনো লাটোরের পরিবেশগত যুগের বর্ণনা পর্যন্ত- নতুন গ্রহগত দৃষ্টান্তের বৌদ্ধিক উপাদানগুলো একত্রিত হতে শুরু করেছে।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাদের একটি নতুন আখ্যানের প্রয়োজন। ঐতিহাসিক জুবাল নোয়া হারারি যুক্তি দেন যে, মানবসভ্যতা জাতীয়তাবাদ এবং পুঁজিবাদের মতো সাধারণ মিথের ওপর গড়ে উঠেছে। এই পৃথিবীর শাসনব্যবস্থার সুফল পেতে হলে এটিকে নতুনভাবে সাজাতে হবে। সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কে পুরানো ধারণার বাইরে গিয়ে মানবতার আন্তসংযোগকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

মানুষ যেখানে আছে সেখান থেকে উঠে আসার জন্য উন্নত চিন্তাভাবনার সঙ্গে শক্তিশালী স্থানীয় চিন্তাভাবনাও থাকতে হবে। বার্গগ্রুয়েন ইনস্টিটিউটের জোনাথন ব্লেক এবং নিলস গিলম্যান বলেছেন, আমাদের শাসন কাঠামোর উন্নতির জন্য ‘ওপরে এবং নিচে’ উভয় দিকেই নজর রাখতে হবে। জাতিরাষ্ট্র একটি উপাদান হিসেবে থাকবে। তবে শহর, অঞ্চল ও স্থানীয় নেটওয়ার্কগুলোকে আরও মনোযোগ দিতে হবে এবং কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে একীভূত করা হবে। এই ধরনের নেস্টেড পদ্ধতি অর্থাৎ বসে থাকা জাতি রাষ্ট্রের পুরানো ব্যবস্থার বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে ভাবতে হবে। 
২০০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয় থেকে শুরু করে মহামারি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তাতে জাতিসংঘের ব্যর্থতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জাতিসংঘ নিজেই লিগ অব নেশনসের খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন জাতিসংঘকে নতুন করে গড়ে তোলার সময় এসেছে। শাসনব্যবস্থাকে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার জাতিরাষ্ট্রভিত্তিক যুক্তি থেকে ব্যাংকরের  সংবেদনশীলতার দিকে পরিচালিত করতে হবে। এমনকি যদি জাতিসংঘ বিশ্বের জাতিগুলোকে একত্রিত করতে সফল হয়, তবুও এর বর্তমান নকশা বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হবে। আমাদের পৃথিবীর বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীভূত নতুন সম্প্রদায়গুলোকে কল্পনা করার সময় এসেছে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন অধ্যয়ন বিভাগ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি সদস্য। আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল 

অর্থনীতির গতি ফেরাতে সরকারের করণীয়

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৮:৩৩ পিএম
অর্থনীতির গতি ফেরাতে সরকারের করণীয়
নেছার আহমদ

সাম্প্রতিক সময়ে সরকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সব পর্যায়ে অলিখিতভাবে গ্যাস সংযোগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে অপরিণামদর্শী এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে জনবিরোধী সিদ্ধান্তে শিল্পে বিনিয়োগ তলানিতে এসে গিয়েছিল। পরিস্থিতি বিবেচনা না করে স্বৈরতান্ত্রিক চিন্তাভাবনায় অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ে যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গঠিত সরকার আমলাদের এসব মনোভাব থেকে বের হতে না পারলে সংস্কার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

গ্যাস ও বিদ্যুৎ দেশের শিল্পোন্নয়নে এবং অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সম্প্রতি গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে অস্থিরতা বাড়ছে। সরকারের নেতিবাচক সিদ্ধান্তে নানা শঙ্কায় ভুগছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। সরকারের উচ্চমহল থেকে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, আমদানিকৃত এলএনজির খরচ যা পড়বে সেই দর অনুযায়ী নতুন শিল্পকারখানার মালিকদের কাছ থেকে গ্যাসের দাম আদায় করা হবে।

শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। এ সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়ন হয়, ধ্বংস হয়ে যাবে দেশের শিল্প খাত, বন্ধ হয়ে যাবে শিল্পে বিনিয়োগ। নতুন করে এ দেশে আর কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে না। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন সরকারের আত্মঘাতী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিগত সরকারের সময়ে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালে নির্বাহী আদেশে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিন গুণ করে। কিন্তু দুই বছর পরও শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি। বরঞ্চ সরকারের এসব সিদ্ধান্তে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়ে পড়েছে অনেক শ্রমিক। গ্যাস-বিদ্যুৎ সেক্টর একটি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান কিন্তু প্রতিনিয়ত লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি পেলেও সেবার মান দিন দিন নিম্নমুখী হয়েছে।

পেশাগত কারণে গ্যাস সেক্টরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। সেখানে নিত্য যে পরিবেশ দেখা যায় তাতে পুরানো দিনের প্রবাদ বাক্যটি বারবার মনে পড়ে- ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’। এ সেক্টরে গ্রাহকসেবার বালাই তো নেই, প্রতিদিন চলছে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মিটিং-আলোচনা, ফলে সময় চলে যায় দিন দিন। কর্মকর্তাদের মধ্যে গ্রাহকসেবার পরিবর্তে গ্রাহক হয়রানির মানসিকতা বেশি। কিছু সময়ের জন্য বাইরের কর্মকর্তা এনে দায়িত্ব দিলে তার কাছ থেকে আন্তরিকতা পাওয়া যায় না। দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সময় কাটিয়ে কোনোভাবে চাকরি শেষ করাটাই প্রাধান্য পায়। 

উন্নত আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সেবার মান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের কথা বলা হলেও গ্যাস সেক্টরে প্রতিনিয়ত ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা গ্যাস সেক্টরের কোম্পানিগুলোতে নেই। ইতিপূর্বে যেসব সিদ্ধান্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তারা গ্রহণ করতেন সেসব বিষয়ে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা কোম্পানির বোর্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরঞ্জাম পরিবর্তন, সরঞ্জাম পুনর্বিন্যাসের মতো আবেদনগুলো মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে অনুমোদন করার বিধান ছিল। বর্তমানে সেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা স্ব স্ব কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা গর্ব করে কোম্পানি গঠিত বোর্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোম্পানির বোর্ড মিটিংও একটি প্রক্রিয়ার বিষয়, মাসে একটি বোর্ড মিটিংও হয় না। বোর্ডে একবার নিতে না পারলে তা দু-তিন মাস এমনকি বছর পর্যন্ত গড়িয়ে যায়, কোনো অনুমোদন হয় না।

কোম্পানিগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা অনুমোদনের কোনো ক্ষমতা না থাকায় কর্মকর্তাদের মাঝে অলসতা, কর্মবিমুখতা লক্ষ্যণীয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে দিনকে দিন ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার পরিবর্তন হলেও গ্রাহক হয়রানি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের পরিবর্তে কেন্দ্রীয়করণের যে প্রবণতা তা পরিবর্তন হয় না। সরকার যায় সরকার আসে, সাধারণ মানুষের সেবা প্রদানের মান দিন দিন নিম্নগামী হচ্ছে। বিগত সরকারের যেসব আবেদন ও সংযোগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছিল, সাধারণ মানুষ মনে করেছিল সরকার পরিবর্তনের ফলে তাদের সংযোগের কাজ চালু করা হবে। কিন্তু বর্তমানে সরকারের নানামুখী সিদ্ধান্তে জনগণের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে।

পেট্রোবাংলার অধীনস্ত কোম্পানিগুলোকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তার অধীনস্ত কর্মকর্তাদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করা প্রয়োজন। যেসব বিষয়ে অতীতে কোম্পানি পর্যায়ে অনুমোদনের ব্যবস্থা ছিল, সেই একইভাবে লোড বৃদ্ধি, সরঞ্জাম পুনর্বিন্যাস ইত্যাদি বিষয়ে অনুমোদনের ক্ষমতা কোম্পানি পর্যায়ে প্রদান করা এখন সময়ের দাবি। এতে গ্রাহকসেবার মান বৃদ্ধি পাবে এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে, দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশীলতা অর্জন করবে। স্বল্প সময়ে গ্রাহকের চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। এতে দুর্নীতি বন্ধ হবে। কোম্পানির বোর্ডগুলোয় পরিচালকদের গ্যাস সংযোগ ও কারিগরি বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, তাছাড়া সংক্ষিপ্ত মিটিংয়ে জটিল কারিগরি সিদ্ধান্ত নেওয়াও সম্ভব নয়। ফলে দিন দিন পুঞ্জীভূত সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পড়ছে বিপণন কোম্পানিগুলো। কোম্পানির পরিচালনা পরিষদে গ্রাহক প্রতিনিধি না থাকায় গ্রাহকের স্বার্থ দেখার কেউ নেই। যা এক প্রকার বৈষম্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত সরকারের কেন্দ্রীয়করণের যে ভুল সিদ্ধান্ত তা পরিহার করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীয়করণ জরুরি। এখনই এ বিষয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে পেট্রোবাংলাকে।
ইতিপূর্বে আমি এ বিষয়ে অনেকবার লিখেছি, গ্যাস সেক্টরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কর্মকর্তাদের অলসতা এবং কোম্পানিগুলোতে যোগ্যদের পদায়ন না করে বাইরের কর্মকর্তাদের নিয়ে এসে চাপিয়ে দেওয়া এবং কারিগরি জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সর্বোচ্চ পদে পদায়ন করে অভিজ্ঞদের অবমূল্যায়ন করে এ সেক্টরকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে রাখা হয়েছে। বৈষম্যের কারণে ক্ষমতার রদবদল হলেও সরকারের প্রতিটি বিভাগে বৈষম্যের কারণে ক্ষোভ রয়েই গেছে।

চলমান উচ্চমূল্যস্ফীতির এ সময়ে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূসক বা ভ্যাটের সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে নিত্য ব্যবহাৰ্য জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের মতো ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর এ সিদ্ধান্তকে ‘গণবিরোধী’ বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তাদের ভাষায়, সরকার খালি কর বাড়ানোর তালে আছে। আয় বাড়ল কি না তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। একে তো মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের নিচে নামে না। এর মধ্যে আবার ভ্যাট বাড়ানোয় অবশ্যই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এ অবস্থায় সাধারণ জনগণ যাবে কই?

সরকারের এ ধরনের অনেক অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তে দেশের শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। লাখ লাখ লোক চাকরিহারা, বেকারত্বের চাপ দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে অসহায়ত্ব ও বেকারত্বের কান্নার রোল। তার ওপর নীতিনির্ধারকরা প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের পরিবর্তে অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিত্যনতুন অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করছে। সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের যে অব্যবস্থাপনা নজরে এসেছে তাতে সব প্রশাসনিক বিভাগ ঝিমিয়ে পড়েছে। সরকারি, বেসরকারি, অর্থ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগ রয়েছে যেখানে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে মাঠপর্যায়ের মতামতের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিয়ে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যে লাউ সেই কদুর মতো কাজ করছে, প্রতিটি বিভাগ। দেশের উন্নয়নের জন্য দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এবং জনগণকে স্বল্প পরিসরে সেবা প্রদানের যে পরিকল্পনা বা ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন তার কোনোটাই নেই। ফলে দিন দিন অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কাজের চেয়ে বেকাজে সময় নষ্ট হচ্ছে প্রচুর। অন্তর্বর্তী সরকারের যে কাজ নয়, সেই কাজে সময় ব্যয় করতে গিয়ে সমস্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে এবং নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন- চট্টগ্রাম দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। কিন্তু সুদূর অতীতে এবং বর্তমানেও প্রতিটি ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বঞ্চনার শিকার। গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির অন্যতম জোগানদার। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রামের মানুষ। প্রান্তিক পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা। তার শাসনকালীন যদি চট্টগ্রাম উপেক্ষিত থাকে, তার চেয়ে বেদনার আর কিছু থাকে না। চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি জড়িত। এ বিষয়টি সবাই স্বীকার করলেও কার্যক্ষেত্রে এর প্রমাণ মেলে না। নতুন সময়ে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গ্যাস সেক্টরের মতো জনসেবামূলক সংস্থাগুলোকে ইগো ত্যাগ করে জনস্বার্থে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। চট্টগ্রামের দুঃখগাথা হয়ে আছে জলাবদ্ধতা। বর্ষা মৌসুমে ভারী কিংবা অল্প বৃষ্টিতে নগরের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এ নিয়তি চট্টগ্রামবাসী এক প্রকার মেনেই নিয়েছে। বৃষ্টি না থাকলেও অনেক সময় জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় খাতুনগঞ্জের মতো বিখ্যাত ভোগ্যপণের পাইকারি বাজার, হাসপাতাল। বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার ঘটনা এখনো নৈমিত্তিক।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম নগরের জলবদ্ধতার মূল কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জলপ্রবাহের যে ধারা তা বন্ধ করে উন্নয়ন কাজগুলো করা হয় কিন্তু পরবর্তীতে তা চালু করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মেঘা প্রকল্পের জলাবদ্ধতা নিরসনে যে সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা বাস্তাবয়ন জরুরি।

প্রকৃত প্রস্তাবে ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেবামূলক সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রকৃত অর্থে জনগণের সেবায় মনোযোগ দিতে হবে, কাজে-কর্মে-পরিকল্পনায় দায়িত্বশীল হতে হবে। জবাবদিহি এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

সংস্কার ও রোহিঙ্গা ইস্যু  জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ প্রশংসনীয়

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম
সংস্কার ও রোহিঙ্গা ইস্যু 
জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ প্রশংসনীয়
এম. হুমায়ুন কবির

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস চার দিনের সফরে গত ১৫ মার্চ শনিবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি তার পুরো সফরই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মিটিং করেছেন। তার পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে মিটিং করেছেন। তিনি কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা দেখা ও তাদের সম্পর্কে মূল্যায়ন করার জন্যই সারা দিন ক্যাম্পে কাটিয়েছেন। সন্ধ্যায় জাতিসংঘের মহাসচিব ও ড. ইউনূস প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতারে অংশগ্রহণ করেন। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ আরও বাড়ানো দরকার। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আমরা অনেকদিন ধরেই দরবার করছি। এখানে আলাপ-আলোচনা চলছে, কীভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন করা যায়। দুবার চেষ্টা করেও প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়নি, এটাই বাস্তবতা। সেই প্রেক্ষপটে জাতিসংঘ মহাসচিবের এবারের সফর কতখানি সাফল্য বয়ে আনবে তা নিয়ে আমি সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই।

দুটো প্রধান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশ সফর করছেন। প্রথমত হচ্ছে, বাংলাদেশে বর্তমান একটা ট্রানজিশন পিরিয়ড চলছে অর্থাৎ সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সুষ্ঠু একটা নির্বাচন করার মাধ্যমে টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করা। এই চলমান প্রক্রিয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ মহাসচিব বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে সমর্থন দিয়েছেন। দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়। মায়ানমারের বর্তমান যে অবস্থা, এর প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কাজে তারা কী করতে পারে তার একটা মূল্যায়ন দরকার। এই দুটো প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় দুটো বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। 

দেশ এখন একটা ট্রানজিশন প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছি। জাতিসংঘ মহাসচিব প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে তাকে অবহিত করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব সংস্কার ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের টেকসই কাঠামোর প্রতিও জাতিসংঘের হয়ে সমর্থন জানিয়েছেন। কাজেই তার দিক থেকে স্পষ্ট করে বলা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তিনি বর্তমান সংস্কার কার্যক্রম এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবর্তনকে সমর্থন করেছেন। আগামী দিনে বাংলাদেশে টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং তরুণ প্রজন্মের যে প্রত্যাশা অর্থাৎ একটা দায়বদ্ধ সরকার এবং মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকদের যে দায়-দায়িত্ব আছে, তার প্রতি সম্মানজনক একটা নতুন বাংলাদেশ তৈরি হোক। জাতিসংঘের সমর্থনটা সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান বলে মনে হয়। 

এখনকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে প্রেক্ষাপট চলমান রয়েছে, সেদিক থেকে আমি মনে করি, আলোচনাটা ফলপ্রসূ হয়েছে। এখানে প্রধান উপদেষ্টা দুটো ইঙ্গিত করেছেন। একটা হচ্ছে, সংস্কার কার্যক্রম। যদি সংক্ষিপ্ত সংস্কার কার্যক্রম করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া যায়, তাহলে নির্বাচন ডিসেম্বরে হতে পারে। এরকম একটা ইঙ্গিত কিন্তু আমাদের প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন। কাজেই এখানে আমাদের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে- তার ইঙ্গিত প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে পাওয়া গেল। তেমনিভাবে রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণে জাতিসংঘ আমাদের পাশে থাকবে তার ইঙ্গিত বা অঙ্গীকার পাওয়া গেল জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছ থেকে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বলা যায়, জাতিসংঘ মহাসচিব খুব কাছ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন সমস্যা বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেখানে দু-তিনটা বিষয় আছে। প্রথমত হচ্ছে, আমরা ইতোমধ্যে জানি, মার্কিন প্রশাসন মানবিক সাহায্য স্থগিত করেছে এবং সেটা যদিও খাদ্য সাহায্য স্থগিত আদেশের বাইরে রাখা হয়েছে। 

কিন্তু মানবিক সাহায্যের উন্নয়নগুলো ৯০ দিনের জন্য বন্ধ আছে। তার একটা প্রভাব কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর পড়ছে। এর কারণ হলো- রোহিঙ্গাদের এখানে থাকা, খাওয়া, পড়া, তাদের অবস্থান, চিকিৎসা- যাবতীয় ব্যয়ভার আন্তর্জাতিক সংস্থাই বহন করে। এটা জাতিসংঘ কো-অর্ডিনেট করে থাকে। সেই নতুন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সাহায্য বন্ধ করার ফলে যে ঘাটতিটা হবে- সেই ঘাটতি কীভাবে মেটানো যায়- এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন তাদের এ কাজে সহায়তা দেন। সেটাও আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি যে, ডব্লিউএফপি খাদ্য সাহায্যের জন্য তাদের যে অনুদান দিয়েছিল জনপ্রতি, সেটা অর্ধেকে নামিয়েছে। আগামী এপ্রিল মাস থেকে খাদ্য সরবরাহে একটা ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মহাসচিব নিজে এখানে এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের চিন্তাভাবনা কী, বাংলাদেশ সরকারের চিন্তাভাবনা কী- বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন। এটা অনেক বেশি শক্তিশালী হবে বলে আমার ধারণা। তিনি ইতোমধ্যে প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক।

দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন। এটা নিয়ে আমরা অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু সাত থেকে আট বছরে কোনো অগ্রগতি করতে পারিনি। দুবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে উদ্যোগ সফল হয়নি। সাম্প্রতিকালে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটাও সফল হয়নি। কাজেই এখন পর্যন্ত এই প্রত্যাবর্তনের জায়গায় আমরা খুব বেশি অগ্রগতি করতে পারিনি। সে ক্ষেত্রে আমরা চাচ্ছি রোহিঙ্গারা সম্মানজনকভাবে তাদের অধিকার নিয়ে মায়ানমারে ফেরত যাক- এ কথাটা তিনি আমাদের কাছ থেকে যেমন শুনেছেন, রোহিঙ্গারাও কিন্তু তাকে সে কথাই বলেছে। তিনি সংবাদ সম্মেলনে যে কথাটা বলেছেন, রোহিঙ্গারা মায়ানমারে ফেরত যেতে চায়। কাজেই তারা যাতে ওখানে অধিকারের সঙ্গে যেতে পারে, এটাই হবে আমাদের কাজ। রোহিঙ্গাদের যাওয়ার ব্যাপারে মায়ানমারে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা দরকার। অধিকার রক্ষা করা দরকার মায়ানমারে- এ কথাটাও জোরের সঙ্গে তিনি বলেছেন। মোটাদাগে তার অর্থ, রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে সম্মানজনকভাবে অধিকার নিয়ে ফেরত যাওয়া উচিত। সারা পৃথিবীতে জাতিসংঘ মহাসচিবের মেসেজটা যাবে।

 রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের অধিকার নিয়ে ফেরত যাক, এই বক্তব্য তিনি আমাদের মুখ থেকে যেমন শুনেছেন, তেমনি রোহিঙ্গাদের মুখ থেকেও শুনেছেন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ উদ্যোগ নিচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার। সেটা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তৃতীয় বিষয় হচ্ছে, রাখাইন প্রদেশে এখন সামরিক সংঘাত চলছে। সেখানে ৬ লাখের মতো রোহিঙ্গা এখন এই সংঘাতের সঙ্গে জড়িত। জাতিসংঘের মতে, ইতোমধ্যে ওখানে এখন দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। সন্দেহ করা হচ্ছে যে, এই দুর্ভিক্ষ অবস্থা যদি চলমান থাকে, গভীরতম হয় তাহলে রোহিঙ্গারা তখন মানবিক কারণেই বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসতে পারে, এমন একটা আশঙ্কার কথাই বলা হচ্ছে। আপনারা পত্রপত্রিকায় দেখেছেন রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে ঢুকছে। সরকারি পর্যায় থেকেও এ কথা বলা হচ্ছে।

 কাজেই এখন জাতিসংঘের একটা উদ্যোগ হচ্ছে- এই লোকগুলোর জন্য যদি আমরা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মানবিক সাহায্য রাখাইনে পাঠাতে পারি, তাহলে যারা দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির আশঙ্কায় রয়েছে, সেই মানুষগুলোকে সেখানেই রেখে তাদের সহায়তা বা সাহায্য করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা সহায়তা করেছিল বলে পত্রপত্রিকার খবরে দেখলাম। আমার ধারণা, জাতিসংঘের মহাসচিব এই মানবিক উদ্যোগে অর্থাৎ রাখাইন প্রদেশে এখনো যে রোহিঙ্গারা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় আছেন, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মানবিক সাহায্য পাঠানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাইবেন। বাংলাদেশ সরকার এটা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে। আরাকান আর্মি সীমান্তের অন্যদিকে এখন প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাদের সঙ্গে কাজ করে যদি খানিকটা আস্থা তৈরি করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এই আস্থার ওপর ভিত্তি করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাহায্য পাঠানোর একটা সুযোগ হয়তো তৈরি হতে পারে। সেটা সফল হবে কি না, এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। আমি মনে করি, সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা প্রত্যাশা করি। 

এই উদ্যোগটা যদি সফল করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের আরাকানে আবার ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি হতে পারে। কারণ দীর্ঘমেয়াদে সেটা বাংলাদেশের জন্য যেমন লাভজনক হবে, তেমনি মায়ানমারের জন্য লাভজনক হবে। বাংলাদেশ-মায়ানমার সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ প্রক্রিয়ায় একটা ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে জাতিসংঘের মহাসচিবের চার দিনের সফর ইতিবাচক। তিনি যে উদ্যোগটা নিয়েছেন তার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। আগামী দিনেও তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। সেই আলোকে তার উদ্যোগ সফল হোক, এটাই আমার প্রত্যাশা।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

পাঠ্যবই সরবরাহে বিলম্ব, বড় চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষা

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:০১ পিএম
পাঠ্যবই সরবরাহে বিলম্ব, বড় চ্যালেঞ্জের মুখে শিক্ষা

শিক্ষা একটি জাতির অগ্রগতির মূল হাতিয়ার। সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথকে সহজ করে দেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার চরম অব্যবস্থাপনা ও নীতিগত দুর্বলতা শিক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক সংকট তৈরি করেছে। বিশেষ করে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের নামে অব্যবস্থাপনা, ভুলত্রুটি সংশোধনে দীর্ঘসূত্রতা এবং পাঠ্যবই সরবরাহে গাফিলতির কারণে শিক্ষাব্যবস্থা আজ বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও উন্নতিতে পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। একজন শিক্ষার্থীর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পাঠ্যপুস্তক তার মনের চিন্তাধারাকে সুগঠিত করে এবং সেই সঙ্গে তার মনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিকে ধারণ করে পাঠ্যপুস্তক। সমগ্র পৃথিবীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদানের সর্বাধিক পরিচিত মাধ্যম পাঠ্যপুস্তক। আজও তা যেমন আছে আগামী দিনেও তেমনি থাকবে। বাংলাদেশের শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যতম বৃহৎ জাতীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।

 দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ও শিক্ষার প্রসারে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনন্য। তিন মাস চলে গেল, আর কবে সব বই পাবে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিকের ৩০ কোটি ৪০ লাখ বই। সরবরাহ হয়েছে ২৪ কোটি ১৭ লাখ ৭২ হাজার। প্রাথমিকে পাঠ্যবই ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৫২৬। সরবরাহ হয়েছে ৯ কোটি ৩ লাখ ৪৪ হাজার। শিক্ষা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে গত ১ জানুয়ারি। এখনো বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পাঠ্যবই পায়নি। এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। কারণ পাঠ্যবই না থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে বসানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রথম থেকে নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যবই চলতি জানুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে চায় সরকার। বই না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্কুলবিমুখ হচ্ছে। ফলে অন্য সময়ের তুলনায় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার এখন অনেক বেশি। বই না থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কারণ বই ছাড়া ক্লাস করতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম। এই অজুহাতে শিক্ষকরাও ক্লাস নিতে চাচ্ছেন না। ফলে পড়াশোনা থেকে শিক্ষার্থীরা দিন দিন দূরে সরে যাচ্ছে। 

পড়াশোনার বদলে খেলাধুলা আর আড্ডা দিয়ে তাদের সময় কাটছে, যা তাদের পড়াশোনায় অপূরণীয় ক্ষতির সৃষ্টি করছে। মূলত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এর আসল ভুক্তভোগী, যা তাদের মৌলিক শিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে। অর্থাৎ, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু শিক্ষাগতভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে না, বরং তাদের সৃজনশীলতা, বিশ্লেষণী দক্ষতা ও বাস্তব জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতাও ব্যাহত হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়নের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এ ঘটনা শুধু অমানবিক নয়, বরং জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি ভয়াবহ অবিচার। সরকারি নীতিমালা অনুসারে, শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবই বিনামূল্যে সরবরাহ করার কথা, অথচ কিছু অসাধু ব্যক্তি ও ছাপাখানার মালিক এসব বই অবৈধভাবে গুদামজাত করে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এটি স্পষ্টতই শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি চরম অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার প্রতিফলন।

একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও উন্নতিতে পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। একজন শিক্ষার্থীর জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য পাঠ্যপুস্তক তার মনের চিন্তাধারাকে সুগঠিত করে এবং সেই সঙ্গে তার মনকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে এবার শিক্ষাক্রম সংশোধন করে পুরানো শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। পাঠ্যবই পরিমার্জনের কারণে ছাপার কাজ বিলম্বিত হবে, তা অনুমেয় ছিল। দরপত্র, অনুমোদন ও চুক্তির প্রক্রিয়া সময়মতো সম্পন্ন না হওয়া এবং কাগজসংকটের কারণে বিলম্ব আরও বেড়েছে। এদিকে দীর্ঘ ছুটির কারণে বই বিতরণ আরও বিলম্বিত হতে পারে বলে অভিভাবক ও শিক্ষকদের আশঙ্কা। এরই মধ্যে পবিত্র রমজান ও আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিদ্যালয়গুলোতে লম্বা ছুটি শুরু হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের সব পাঠ্যবই হাতে পেতে অপেক্ষাও দীর্ঘ হচ্ছে। এদিকে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সব বিদ্যালয়ে অবশিষ্ট বই সময়মতো দেওয়া সম্ভব হবে কি না, এ বিষয়ে সবাই চিন্তিত। মার্চ মাসের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার হয়েছে। শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছানো সরকারের দায়িত্ব হলেও এখনো পর্যন্ত সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায়নি। 

ফলে স্কুলগুলোতে পুরোদমে এখনো ক্লাস শুরু করা যায়নি বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মূল্যবান এই দেড় মাস সময় নষ্ট করা অত্যন্ত দুঃখজনক। নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার দুই মাস পার হলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৬ কোটি ৩৮ লাখের বেশি বই শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছায়নি। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) জানিয়েছে, কাগজসংকটসহ নানা কারণে বই সরবরাহে এই বিলম্ব হচ্ছে। এর মধ্যে মাধ্যমিকের বই প্রায় ৬ কোটি ২২ লাখের মতো রয়েছে। এনসিটিবির তথ্যানুসারে, চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মোট ৩৯ কোটির বেশি বই মুদ্রণ করা হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে (মাদ্রাসার ইবতেদায়িসহ) বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি ৪০ লাখ, যার মধ্যে ২ মার্চ পর্যন্ত ২৭ কোটি ৯০ লাখ ৯০ হাজার বই ছাপানো হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহের অনুমোদন (পিডিআই) পাওয়া গেছে ২৪ কোটি ১৭ লাখ ৭২ হাজার বইয়ের, অর্থাৎ এখনো ৬ কোটি ২২ লাখ ২৮ হাজার বই বিতরণ করা হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার বই ছাপানো হলেও, ৯ কোটি ৩ লাখ ৪৪ হাজার বই সরবরাহের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ফলে এখনো ১৬ লাখ বই বিতরণের অপেক্ষায় রয়েছে।

 নতুন শিক্ষাবর্ষে নতুন শিক্ষাক্রম বাদ দিয়ে পুরানো শিক্ষাক্রমে ফিরছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এবার পাঠ্যবইয়েও অনেক প্রত্যাশিত পরিবর্তন এসেছে; অনেক বিষয়বস্তু সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে মানসম্মত বই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার্থীরা যাতে উচ্চ নৈতিকতা ও উন্নত মূল্যবোধের চর্চায় আগ্রহী হয়, সে বিষয়েও তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এসব বিষয়ে সমাজ পিছিয়ে থাকলে শিক্ষার্থীরা কতটা এগিয়ে যেতে পারবে, এটাও এক প্রশ্ন। অতীতে ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক নিয়ে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। কাজেই মানসম্মত ও ত্রুটিমুক্ত বই প্রকাশে কর্তৃপক্ষকে মনোযোগী হতে হবে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এবার শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে পুরানো শিক্ষাক্রমের আলোকে পাঠ্যবই ছাপিয়ে বিতরণ করা হচ্ছে। পাঠ্যবই পরিমার্জনের কারণে বই ছাপার কাজ দেরি হবে, তা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু দরপত্র, অনুমোদন, চুক্তির মতো কাজগুলোও যথাসময়ে না করায় এবং কাগজসংকটের কারণে আরও বেশি দেরি হচ্ছে। অবশ্য এনসিটিবির কর্তৃপক্ষ  বলছেন, বিদ্যালয় ছুটি হলেও শিক্ষার্থীদের হাতে বই দেওয়া যাবে। তারা উপজেলা পর্যায়ে বই পাঠাচ্ছেন। 

সেখান থেকে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বই সংগ্রহ করে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করবেন। এ ক্ষেত্রে মুদ্রণকারীদের আন্তরিকতা প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকাঠামো মূলত দাঁড়িয়ে থাকে চারটি স্তম্ভের ওপর শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষালয় ও পাঠ্যপুস্তক। একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রেণিশিক্ষার উপকরণ হিসেবে সঠিক শব্দে, চিত্রে, অনুশীলনে যা লেখা হয়, তাকে মূলত পাঠ্যপুস্তক বা টেক্সট বুক বলা হয়। পাঠ্যপুস্তকে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বেশ গোছালো তথ্যে সহজ ভাষায় মৌলিক বিষয়গুলোয় আলোকপাত করা হয়। এ ধরনের বই পড়ে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অনুশীলন ও প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে পাঠবোধগম্যতা যাচাইয়ের সুযোগ থাকে। আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, কল্পনাশক্তি জ্ঞানের চেয়ে মূল্যবান। জ্ঞানের আলোর শক্তি ব্যবহার করে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা সম্ভব। পাঠ্যপুস্তকের কাজ হলো জ্ঞানের আলোয় কল্পনাশক্তিকে শাণিত করা। আমাদের শিক্ষার্থীরাও এমন পাঠ্যপুস্তক পাবে এটাই আমাদের সবার আশা।

লেখক: কলাম লেখক 
ও সাবেক রেজিস্টার, জেএসটিইউ
[email protected]

মানুষ ব্যবস্থা বদলের ঐক্যের জন্য অপেক্ষমাণ

প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৯ পিএম
মানুষ ব্যবস্থা বদলের ঐক্যের জন্য অপেক্ষমাণ
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

রাষ্ট্র তারুণ্যকে ভয় করে, সমাজও যে তারুণ্যকে পছন্দ করে তা নয়। তারুণ্যকে দমিত করার সব ব্যবস্থা রাষ্ট্র তার নিজের অভ্যাসবশতই করে থাকে, সমাজও তাতে যোগ দেয়। একটা ব্যাপার ছোট মনে হতে পারে কিন্তু মোটেই ছোট নয়; সেটা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন না দেওয়া। সেখানে দুঃসহ একাধিপত্য চলে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রদের। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষাটা তরুণরা পেতে পারে শিক্ষায়তনিক ছাত্রসংসদ থেকেই। ছাত্রসংসদ আগে ছিল; এমনকি সামরিক শাসনের সময়েও ছাত্রসংসদকে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯৯১-তে, স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর থেকে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকাররা যখন ক্ষমতায় আসা-যাওয়া শুরু করল ঠিক তখন থেকেই ছাত্রসংসদ লুপ্ত হয়ে গেল, চলল ক্ষমতাসীন দলীয় ছাত্র নামধারীদের স্বৈরাচার। এই যে ‘অগ্রগতি’, এর তাৎপর্যটা কী? তাৎপর্য হলো এটাই যে, ইতোমধ্যে রাষ্ট্র আরও বেশি স্বৈরতান্ত্রিক হয়েছে, যাত্রা করেছে ফ্যাসিবাদের অভিমুখে। তরুণরা গুন্ডা-বদমাশ হোক, মাদকের পাল্লায় পড়ুক, তারুণ্য গোল্লায় যাক, কিশোর গ্যাং গঠিত হোক- কোনো কিছুতেই আপত্তি তো নেই-ই, বরং সাগ্রহ অনুমতি আছে; কারণ তরুণ যত তার তারুণ্য খোয়াবে শাসকদের গদি ততই পোক্ত হবে। সোজা হিসাব!

বৈষম্যবিরোধিতার আওয়াজটা কিন্তু মোটেই নতুন নয়। এটি বঞ্চিতদের অতি পুরাতন রণধ্বনি; কিন্তু তাকে বারবার তুলতে হয়। কারণ বৈষম্য দূর হয় না, হবেও না যদি ব্যবস্থা না বদলায়। ব্যবস্থা না বদলালে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে, এবং বাড়ছেও। ঊনসত্তরের ব্যবস্থা-কাঁপানো ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পরে মওলানা ভাসানী তার সেই অসামান্য তরুণ কণ্ঠে আওয়াজটা নতুন করে তুলেছিলেন; বলেছিলেন, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না।’ বিশ্ববরেণ্য এক কবিতার বুঝি প্রথম পঙ্‌ক্তি। ওই ঊনসত্তরেই ভাসানীপন্থি তরুণ আসাদ যখন পিতৃতান্ত্রিক স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে শহিদ হন তখন তার সহযোদ্ধারা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র’। একই আওয়াজ, ভিন্ন শব্দগুচ্ছে। আসাদের পূর্বসূরি বায়ান্নর শহিদ বরকতও ছিলেন একই রাজনৈতিক ধারার মানুষ। সে ধারাও বৈষম্যবিরোধিতারই, রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। 

ওই ধারা জয়যুক্ত হয়নি। যে জন্য বারবার আমাদের আন্দোলনে যেতে হচ্ছে, ঘটাতে হচ্ছে নতুনতর অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান জনগণই ঘটান, কিন্তু ক্ষমতায় রয়ে যান বুর্জোয়ারাই। নতুন পোশাকে, নতুন নামে, নতুন ভাষায় তারাই আসেন, বারবার ফিরে ফিরে ঘুরে ঘুরে। পরের শাসক আগের শাসকের তুলনায় অধিকতর নির্মম হন। বুর্জোয়া শাসনের পতন কোনোকালেই ঘটবে না যদি না পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিদায় নেয়। আমাদের দেশে রাজনীতিতে দল অনেক, কিন্তু ধারা মাত্র দুটি। একটি বুর্জোয়াদের, অপরটি জনগণের। বুর্জোয়া ধারাটিই প্রধান। আওয়ামী লীগ, বিএনপি থেকে শুরু করে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। অতিশয় ভদ্র উদারনৈতিকরা যেমন ভয়াবহ রকমের রক্ষণশীলরাও তেমনি এই ধারারই অন্তর্গত। বাইরে যা হোন না কেন, অন্তরে এরা সবাই ব্যক্তিমালিকানায় ও ব্যক্তিগত মুনাফায় বিশ্বাসী, এবং পুঁজিবাদের সমর্থক। এই ধারার বিপরীতে এবং সম্পূর্ণরূপে বিপক্ষে রয়েছে জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক ধারাটি। সেটি সমাজতান্ত্রিক। ওই ধারার লক্ষ্য সম্পত্তিতে সামাজিক মালিকানার প্রতিষ্ঠা। আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রীদের প্রধান দুর্বলতা ঐক্যের অভাব। 

পুঁজিবাদীদের জন্য কিন্তু সেই সমস্যাটা নেই; তাদের মধ্যে ঝগড়া আছে অবশ্যই, খুনোখুনিও ঘটে, বিষয় সম্পত্তির মালিকানা নিয়ে পরিবারের মধ্যে যেমনটা ঘটে থাকে; কিন্তু আদর্শগত লক্ষ্যে তারা ঐক্যবদ্ধ, আর সে লক্ষ্যটা হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটা চালু রাখা। এ ক্ষেত্রে তারা একাট্টা; এবং তাদের সবার সুনির্দিষ্টি শত্রু হলো সমাজতন্ত্রীরা। সমাজতন্ত্রীরা চান সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। সামাজিক সম্পর্কগুলোকে মানবিক করতে ও টিকিয়ে রাখতে। অর্থাৎ মানুষের মনুষ্যত্বকে বজায় রাখতে এবং বিকশিত করতে। বুর্জোয়াদের সাধনা শোষণ ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার। দ্বন্দ্বের ওই নাটকটা চলছে, অভ্যুত্থানও ঘটছে, কিন্তু বৈষম্য ঘুচছে না, ক্ষমতা রয়ে যাচ্ছে নিপীড়ক বুর্জোয়াদের হাতেই। হাতবদল ও হাতসাফাই-ই ঘটছে শুধু, খেলার তাসের মতো। এবং সেই ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়োজনেই বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে দানবে পরিণত করতে চায়। নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধি পায়, কারণ বিক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ে, তারা বিক্ষোভ করে, বিদ্রোহে অংশ নেয়, এবং সম্ভাবনা দেখা দেয় পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামটা জোরদার হওয়ার।

 
আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রীরা সব গণ-অভ্যুত্থানেই থেকেছেন, অভ্যুত্থানের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজও করেছেন; কিন্তু তারা নেতৃত্ব দিতে পারেন না, বিভক্তি ও বিভ্রান্তির কারণে। 
তারুণ্যের জয় হয়েছে। তারুণ্য যে কতটা অদম্য ও সৃষ্টিশীল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে তরুণদের এই আন্দোলনে, যখন তারা বিপদ ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যে নতুন নতুন কর্মসূচি দিয়েছে, এবং তরুণদের উদ্যমে এবং তরুণদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও সমর্থনে যেগুলো যখন সফল হয়েছে। 
ইতোমধ্যে অবস্থা যে বদলেছে তা কিন্তু নয়, মনে হবে নতুন একটা বাস্তবতাই তৈরি হয়েছে। কিন্তু সারবস্তুতে সত্যি সত্যি কোনো বদল ঘটেছে কী? আসলে কিন্তু বাস্তবতার ওপরটাই যা বদলেছে, ভেতরের বস্তু আগের মতোই। পুরাতন বাস্তবতার নানা প্রকাশ তাই দেখতে পাচ্ছি। যেমন নারী ও শিশু নির্যাতন। শিশু ও নারী ধর্ষণের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে দেশ। চতুর্দিকে অরাজক পরিস্থিতি। মানুষ অনিরাপদে তো বটেই, চরম উৎকণ্ঠায় জীবন অতিবাহিত করছে।

বিশ্বব্যাপীই এখন মানুষের নিদারুণ দুর্দশা চলছে। তা থেকে মুক্তির উপায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ও মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে বিদায় করে সামাজিক মালিকানার নতুন বিশ্ব গড়ে তোলা। সে জন্য কেবল রাষ্ট্রীয় সংস্কার নয়, সামাজিক বিপ্লবও প্রয়োজন হবে। রাজা ও প্রজার সম্পর্ক ছিন্ন করে, বৈষম্য ঘুচিয়ে ফেলে প্রতিষ্ঠিত করা চাই প্রকৃত সাম্য ও মৈত্রীর সম্পর্ক। তার জন্য সামাজিক বিপ্লব ভিন্ন অন্য কোনো পথ নেই। সংস্কারে কুলাবে না। লুণ্ঠন এবং ত্রাণ তৎপরতা দুটোই সত্য; প্রথমটি ঘটে ব্যক্তিগত মুনাফার লোভে; দ্বিতীয়টি প্রকাশ পায় সমষ্টিগত মঙ্গলের আকাঙ্ক্ষায়। প্রথমটির পরিণতি ফ্যাসিবাদে; দ্বিতীয়টি সৃষ্টি চায় সামাজিক বিপ্লবের। ত্রাণকে সামনে আনতে হলে দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা অপ্রয়োজনীয়, কারণ দুর্যোগ এখন সার্বক্ষণিক, দুর্যোগ থেকে মানুষের মনুষ্যত্বকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পীড়ন থেকে পরিত্রাণ।
রোগ সমাজের গভীরে, এবং রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সংস্কারে কুলাবে বলে আশা করাটা যে বর্তমানে নিতান্তই ভ্রান্তিবিলাস, সেটা যেন না ভুলি। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনকে গুটিয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নেই। সেটা সম্বিতে সার্বক্ষণিকভাবেই থাকা আবশ্যক। 

মানুষ কাজ চায়, কেবল জীবিকার নয়, মানুষ জীবনের কাজও করতে প্রস্তুত; জীবনের কাজটা সমাজ বদলের। অভাব যার সেটি হলো আন্দোলন। ওই আন্দোলন বুর্জোয়ারা করবেন না, বুর্জোয়ারা বৈষম্যবিরোধী নন, তারা বৈষম্য সৃষ্টি ও লালন-পালনের পক্ষে; আন্দোলন করতে হবে সামাজিক বৈষম্যবিরোধীদের, অর্থাৎ সমাজতন্ত্রীদের। সমাজতন্ত্রীরা যদি একটি সুনির্দিষ্ট ও অতীব প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন, তবে দেখা যাবে সেই ফ্রন্টে মানুষ কীভাবে সাড়া দিচ্ছেন, এবং অসম্ভবকে সম্ভব করার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। ১৯৫৪-এর নির্বাচনে পাঁচমিশালি একটি যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল, তাতে মুসলিম লীগের পতন ভিন্ন অন্যকিছু অর্জিত হয়নি; এখন আর পাঁচমিশালি না, প্রয়োজন সমাজতন্ত্রীদের যুক্তফ্রন্ট। শিক্ষার্থীদের কোটা-বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাফল্য সামাজিক বৈষম্য দূর করবার জন্য সমাজতন্ত্রীদের আবারও বলছে, মিলিত হতে, মিলিত হয়ে সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব করে তুলবার পথে এগোতে। এই যুক্তফ্রন্ট জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে; ওই পথে সামাজিক বিপ্লব ঘটবে এই আশা নিয়ে নয়, সমাজ বিপ্লবের পক্ষে জাতীয় সংসদের ভেতরে এবং বাইরে জনমত ও জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য। নির্বাচনের আগে দাবি হওয়া চাই প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে আসন বণ্টনের; এবং নির্বাচিত জাতীয় সংসদকে রাষ্ট্রীয় সংবিধানে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক উপাদান যুক্ত করার অধিকার দানের। রাষ্ট্রয় ভাবে এই ঘোষণাটাও থাকা চাই যে, বায়াত্তরের সংবিধানে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রগঠনের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত ছিল সংবিধানকে তা কোনোমতেই অমান্য করবে না।  

সমাজ পরিবর্তনকামীদের ঐক্যটা হবে সামাজিক বাস্তবতার পরিবর্তনের লক্ষ্যে। এবং ঐক্য যতটা না নেতাদের হবে তার চেয়ে বেশি হবে কর্মীদের। দেশের মানুষ ওই ঐক্যের জন্য অপেক্ষমাণ। বুর্জোয়াদের রাজনীতিতে তাদের আস্থা শেষ হয়ে গেছে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়