
প্রতিটি শহরের জন্য সবুজ নেটওয়ার্ক তৈরিতে, সবুজ এলাকা, জলাশয় এবং গণপরিসর রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে স্বতন্ত্র রূপকল্প এবং কার্যকর সরকারি নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার ড্যাপ (২০২২-৩৫) অনুযায়ী প্রস্তাবিত পাঁচটি আঞ্চলিক পার্ক, ২৪টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, চারটি ইকোপার্ক এবং অন্যান্য পার্কের অবস্থান, আকার, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বন-নীতিতে নগর সবুজায়ন অন্তর্ভুক্ত করে ছোট পার্ক ও সবুজ করিডোর নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকা বা ওয়ার্ডভিত্তিক খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে এবং পাবলিক ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত মাঠগুলো থেকে ক্লাব অপসারণ করতে হবে।...
ঢাকার পয়োনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহব্যবস্থা বর্তমানে জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে অপর্যাপ্ত। বর্তমানে রাজধানীতে ওয়াসার মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায় পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা রয়েছে। বস্তি এলাকায় নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনের মতো পরিষেবা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ক্রমাগত উত্তোলনের কারণে রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় নিঃশেষিত। এ ছাড়া, নগরের চারপাশের নদনদী ক্রমশ দূষিত হচ্ছে। প্রধানত নয়টি শিল্পঘন এলাকা- টঙ্গী, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, ডিইপিজেড ও ঘোড়াশাল থেকে পাঁচটি নদীতে প্রায় ৬০ হাজার ঘনমিটার বিষাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ হয়। বায়ু এবং পানিদূষণের ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ভারী ধাতু নগরবাসীর খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। এর পাশাপাশি, ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিকবর্জ্য সর্বত্র এক সংকটের সৃষ্টি করছে। ঢাকায় বর্তমানে মাথাপিছু ২৪ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ঢাকার জলাশয়গুলোয় প্রতি ঘনমিটার পানিতে ৩৬ হাজার পিস মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। নগরে সৃষ্ট কঠিনবর্জ্যের একটি বড় অংশ (প্রায় ৪০ শতাংশ) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংগৃহীত হয় না। নগর কর্তৃপক্ষ যেটুকু কঠিনবর্জ্য সংগ্রহ করে তার বেশির ভাগই ল্যান্ডফিলে ফেলা হয়, যা বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত ভূমিস্বল্প এবং ঘনবসতির দেশের জন্য উপযোগী পন্থা নয়।
সেহেতু, উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে আধুনিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানি পরিশোধন প্রকল্প স্থাপন এবং সুষম পানি সরবরাহ নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নগরবাসীদের জন্য বিশেষ করে নারী, শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীদের জন্য স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে প্রতি আধা কিলোমিটার পর পর গণপ্রক্ষালন কেন্দ্র এবং সুপেয় পানির সংস্থান করতে হবে। রেস্টুরেন্ট, পেট্রোল পাম্প, শপিং মল, গণপরিসরের মতো স্থানগুলোয় নগরবাসীর ব্যবহারের জন্য প্রক্ষালন কেন্দ্রের সংস্থান বাধ্যতামূলক এবং সর্বজনীন করতে হবে। প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স এবং অন্যান্য অনুমতিপত্র প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, এ ধরনের নগর সুবিধার অবস্থান ও তথ্য মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কঠিনবর্জ্যের ক্ষেত্রে, ‘পুনর্ব্যবহার ও চক্রায়িত ব্যবহার’ সুগম করার জন্য বর্জ্যের শ্রেণিভুক্তিকরণ চালু করতে হবে। কঠিনবর্জ্যের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যে ‘কম ব্যবহার, পুনর্ব্যবহার, চক্রায়িত ব্যবহার’-এর নীতি অনুসরণ করতে হবে। বিশেষত, ‘একবার ব্যবহার্য’ (সিঙ্গেল ইউজ) পণ্য কেনা ও ব্যবহারের বিস্তৃতি রোধ এবং জৈবক্ষয়িষ্ণু (বায়ো-ডিগ্রেডেবল) প্লাস্টিক ব্যবহারে উদ্যোগী হতে হবে। কার্যকর বর্জ্যব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তুলতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ তৈরির প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। কঠিনবর্জ্যকে সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে এবং তা ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে সচেষ্ট হতে হবে।
জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কার্যকর রেফারেলভিত্তিক ত্রিস্তরীয় পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং সে লক্ষ্যে ‘একীভূত স্বাস্থ্য’ ধারণাকে স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। প্রান্তিক নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নেটওয়ার্কের আওতায় এনে স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান করতে হবে।
নগরবন্যা, গণপরিসর ও আন্তনীল সংযোগ
যেহেতু, নগরবন্যা ও জলাবদ্ধতা বাংলাদেশের নগরের একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকা নগরবন্যায় প্লাবিত হয়। ২০১০ সালের ড্যাপে চিহ্নিত ঢাকার জলাশয়গুলো অনেকাংশেই বিলীন হয়েছে। তার পরও ড্যাপ (২০২২-২০৩৫)-এ ঢাকা শহরের ৬৬ শতাংশ এলাকা বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে তার ৫৩ শতাংশই ‘শর্তসাপেক্ষে’ উন্নয়নের আওতাধীন করা হয়েছে। ‘রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (RDRC)’ ঢাকার মোট ৭৮টি খাল চিহ্নিত করেছে, যার সঙ্গে ঢাকার পার্শ্বস্ত চারটি নদীর সরাসরি সংযোগ ছিল বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। খাল খননের মাধ্যমেই ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার প্রায় ৮০ শতাংশের সমাধান হতে পারে। কিন্তু নগরবাসীর কাঙ্ক্ষিত ‘ব্লু নেটওয়ার্ক বা আন্তনীল সংযোগ’ প্রতিষ্ঠায় এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। গত চার বছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি।
এ ছাড়া, ঢাকা শহর ২০০২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ সবুজ আবরণ হারিয়েছে। ঢাকায় সবুজ আচ্ছাদনের পরিমাণ বর্তমানে ৮ শতাংশেরও কম। অথচ, বাসযোগ্য নগরীতে ১২ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান ও ১৫ শতাংশ এলাকায় সবুজের আচ্ছাদন থাকার কথা। বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকার অবস্থান ধারাবাহিকভাবে অবনমিত হচ্ছে। গণপরিসর এবং সবুজ এলাকার অভাব নগরের বাসিন্দাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
নগরবন্যা ও জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে, নগরের বারিপাত অঞ্চলগুলোর প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা এবং পানি ধারণের জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রাকৃতিক ঢালের পরিস্থিতি অনুযায়ী পানি নিষ্কাশনের জন্য নতুন নালা (স্টর্ম ড্রেন) নির্মাণ করতে হবে এবং সেই নালাগুলোকে প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ২০১০ সালের ড্যাপে চিহ্নিত জলাশয়গুলোকে পুনরুদ্ধার করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এ লক্ষ্যে ড্যাপ ২০২২-৩৫ সংশোধন আশু প্রয়োজন। উল্লেখ্য, ড্যাপের ২০১৫ সালের সমীক্ষা অনুসারে ঢাকা মহানগরীতে মোট জলাশয় ও জলাধার (নদী, খাল, লেক, পুকুর, নালা, জলাভূমি)-এর পরিমাণ প্রায় ২১৭ বর্গকিলোমিটার।
বন্যা ও জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় এ ধরনের সমস্যা দূরীকরণে সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (যেমন- পানি ধারণ পুকুর, পানি সংরক্ষণ/রিজার্ভার, বৃষ্টিবাগান, ছাদবাগান, সড়ক বিভাজকে বায়ো-সোয়েল স্থাপন ইত্যাদি) গ্রহণ করতে হবে। নগরের অভ্যন্তরীণ খালগুলো সমন্বিতভাবে পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত করে এগুলোকে কীভাবে পরস্পরের এবং পার্শ্ববর্তী নদনদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা যায় তার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি ‘ব্লু নেটওয়ার্ক বা আন্তনীল সংযোগ’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে, প্রথমেই আন্তনীল সংযোগ পুনরুদ্ধারে ‘ভূ-প্রাকৃতিক সমীক্ষার’ (Geomorphological Survey) মাধ্যমে ডাটাবেজ তৈরি করে খাল ও জলাশয়ের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হবে। একই সঙ্গে পানির প্রবাহ ও বারিপাতের ধারা বুঝতে গাণিতিক মডেল এবং হাইড্রো-মরফোলজিকাল মডেল ব্যবহার করে জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে উপযুক্ত জল ধারণ এলাকা নির্ধারণ করা জরুরি। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে খাল পুনরুজ্জীবিতকরণের পাশাপাশি এসব জলাশয় ব্যবস্থাপনায় ও রক্ষণাবেক্ষণে নগরবাসীর অভিভাবকত্ব (Stewardship) নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি বাস্তবায়নমুখী রূপরেখা তৈরি করে খাল ও নদীর সংযোগ স্থাপন এবং দুর্যোগব্যবস্থাপনার জন্য আন্তনীল সংযোগ প্রতিষ্ঠা করায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন’কে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এসব জলাশয় পুনরুদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা হ্রাস, জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি এবং নাগরিকদের জন্য বিনোদনমূলক সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।
পাশাপাশি, প্রতিটি শহরের জন্য সবুজ নেটওয়ার্ক তৈরিতে, সবুজ এলাকা, জলাশয় এবং গণপরিসর রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে স্বতন্ত্র রূপকল্প এবং কার্যকর সরকারি নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার ড্যাপ (২০২২-৩৫) অনুযায়ী প্রস্তাবিত পাঁচটি আঞ্চলিক পার্ক, ২৪টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, চারটি ইকোপার্ক এবং অন্যান্য পার্কের অবস্থান, আকার, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বন-নীতিতে নগর সবুজায়ন অন্তর্ভুক্ত করে ছোট পার্ক ও সবুজ করিডোর নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকা বা ওয়ার্ডভিত্তিক খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে এবং পাবলিক ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত মাঠগুলো থেকে ক্লাব অপসারণ করতে হবে।
পরিশেষে, ঢাকা মহানগরী একটি ‘অপরিপক্ব নগর’, যেখানে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় মৌলিক সুবিধাগুলোর প্রবল অভাব রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন একটি সুসংহত, টেকসই এবং আধুনিক নগর পরিকল্পনা- যা শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, বরং পরিবেশ, সামাজিক সেবা, নিরাপত্তা এবং নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সেই লক্ষ্যে, সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, সুশীল সমাজ এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন কৌশল এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ এবং সুস্থ জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখক: স্থপতি ও নগরবিদ
[email protected]