ঢাকা ৬ চৈত্র ১৪৩১, বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ৬ চৈত্র ১৪৩১

নগরের পয়োনিষ্কাশন ও পানি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:৩৩ পিএম
নগরের পয়োনিষ্কাশন ও পানি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল
ইকবাল হাবিব

প্রতিটি শহরের জন্য সবুজ নেটওয়ার্ক তৈরিতে, সবুজ এলাকা, জলাশয় এবং গণপরিসর রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে স্বতন্ত্র রূপকল্প এবং কার্যকর সরকারি নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার ড্যাপ (২০২২-৩৫) অনুযায়ী প্রস্তাবিত পাঁচটি আঞ্চলিক পার্ক, ২৪টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, চারটি ইকোপার্ক এবং অন্যান্য পার্কের অবস্থান, আকার, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বন-নীতিতে নগর সবুজায়ন অন্তর্ভুক্ত করে ছোট পার্ক ও সবুজ করিডোর নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকা বা ওয়ার্ডভিত্তিক খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে এবং পাবলিক ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত মাঠগুলো থেকে ক্লাব অপসারণ করতে হবে।...

ঢাকার পয়োনিষ্কাশন ও পানি সরবরাহব্যবস্থা বর্তমানে জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে অপর্যাপ্ত। বর্তমানে রাজধানীতে ওয়াসার মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায় পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা রয়েছে। বস্তি এলাকায় নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনের মতো পরিষেবা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ক্রমাগত উত্তোলনের কারণে রাজধানী ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় নিঃশেষিত। এ ছাড়া, নগরের চারপাশের নদনদী ক্রমশ দূষিত হচ্ছে। প্রধানত নয়টি শিল্পঘন এলাকা- টঙ্গী, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, তারাবো, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর, ডিইপিজেড ও ঘোড়াশাল থেকে পাঁচটি নদীতে প্রায় ৬০ হাজার ঘনমিটার বিষাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ হয়। বায়ু এবং পানিদূষণের ফলে ক্ষতিকর রাসায়নিক ও ভারী ধাতু নগরবাসীর খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে জনস্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। এর পাশাপাশি, ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিকবর্জ্য সর্বত্র এক সংকটের সৃষ্টি করছে। ঢাকায় বর্তমানে মাথাপিছু ২৪ কেজি প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ঢাকার জলাশয়গুলোয় প্রতি ঘনমিটার পানিতে ৩৬ হাজার পিস মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। নগরে সৃষ্ট কঠিনবর্জ্যের একটি বড় অংশ (প্রায় ৪০ শতাংশ) কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংগৃহীত হয় না। নগর কর্তৃপক্ষ যেটুকু কঠিনবর্জ্য সংগ্রহ করে তার বেশির ভাগই ল্যান্ডফিলে ফেলা হয়, যা বাংলাদেশের মতো অত্যন্ত ভূমিস্বল্প এবং ঘনবসতির দেশের জন্য উপযোগী পন্থা নয়।

সেহেতু, উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে আধুনিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানি পরিশোধন প্রকল্প স্থাপন এবং সুষম পানি সরবরাহ নিশ্চিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নগরবাসীদের জন্য বিশেষ করে নারী, শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি ও প্রতিবন্ধীদের জন্য স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে প্রতি আধা কিলোমিটার পর পর গণপ্রক্ষালন কেন্দ্র এবং সুপেয় পানির সংস্থান করতে হবে। রেস্টুরেন্ট, পেট্রোল পাম্প, শপিং মল, গণপরিসরের মতো স্থানগুলোয় নগরবাসীর ব্যবহারের জন্য প্রক্ষালন কেন্দ্রের সংস্থান বাধ্যতামূলক এবং সর্বজনীন করতে হবে। প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স এবং অন্যান্য অনুমতিপত্র প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি, এ ধরনের নগর সুবিধার অবস্থান ও তথ্য মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কঠিনবর্জ্যের ক্ষেত্রে, ‘পুনর্ব্যবহার ও চক্রায়িত ব্যবহার’ সুগম করার জন্য বর্জ্যের শ্রেণিভুক্তিকরণ চালু করতে হবে। কঠিনবর্জ্যের পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যে ‘কম ব্যবহার, পুনর্ব্যবহার, চক্রায়িত ব্যবহার’-এর নীতি অনুসরণ করতে হবে। বিশেষত, ‘একবার ব্যবহার্য’ (সিঙ্গেল ইউজ) পণ্য কেনা ও ব্যবহারের বিস্তৃতি রোধ এবং জৈবক্ষয়িষ্ণু (বায়ো-ডিগ্রেডেবল) প্লাস্টিক ব্যবহারে উদ্যোগী হতে হবে। কার্যকর বর্জ্যব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তুলতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ তৈরির প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে। কঠিনবর্জ্যকে সম্পদ হিসেবে দেখতে হবে এবং তা ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে সচেষ্ট হতে হবে।
জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে কার্যকর রেফারেলভিত্তিক ত্রিস্তরীয় পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতি গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং সে লক্ষ্যে ‘একীভূত স্বাস্থ্য’ ধারণাকে স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। প্রান্তিক নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা নেটওয়ার্কের আওতায় এনে স্বাস্থ্য কার্ড প্রদান করতে হবে।

নগরবন্যা, গণপরিসর ও আন্তনীল সংযোগ
যেহেতু, নগরবন্যা ও জলাবদ্ধতা বাংলাদেশের নগরের একটি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিস্তীর্ণ এলাকা নগরবন্যায় প্লাবিত হয়। ২০১০ সালের ড্যাপে চিহ্নিত ঢাকার জলাশয়গুলো অনেকাংশেই বিলীন হয়েছে। তার পরও ড্যাপ (২০২২-২০৩৫)-এ ঢাকা শহরের ৬৬ শতাংশ এলাকা বন্যাপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে তার ৫৩ শতাংশই ‘শর্তসাপেক্ষে’ উন্নয়নের আওতাধীন করা হয়েছে। ‘রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (RDRC)’ ঢাকার মোট ৭৮টি খাল চিহ্নিত করেছে, যার সঙ্গে ঢাকার পার্শ্বস্ত চারটি নদীর সরাসরি সংযোগ ছিল বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। খাল খননের মাধ্যমেই ঢাকার জলাবদ্ধতা সমস্যার প্রায় ৮০ শতাংশের সমাধান হতে পারে। কিন্তু নগরবাসীর কাঙ্ক্ষিত ‘ব্লু নেটওয়ার্ক বা আন্তনীল সংযোগ’ প্রতিষ্ঠায় এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। গত চার বছরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা খরচ করলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। 

এ ছাড়া, ঢাকা শহর ২০০২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ সবুজ আবরণ হারিয়েছে। ঢাকায় সবুজ আচ্ছাদনের পরিমাণ বর্তমানে ৮ শতাংশেরও কম। অথচ, বাসযোগ্য নগরীতে ১২ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান ও ১৫ শতাংশ এলাকায় সবুজের আচ্ছাদন থাকার কথা। বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকার অবস্থান ধারাবাহিকভাবে অবনমিত হচ্ছে। গণপরিসর এবং সবুজ এলাকার অভাব নগরের বাসিন্দাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

নগরবন্যা ও জলাবদ্ধতার সমস্যা সমাধানে, নগরের বারিপাত অঞ্চলগুলোর প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা এবং পানি ধারণের জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে এবং অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। প্রাকৃতিক ঢালের পরিস্থিতি অনুযায়ী পানি নিষ্কাশনের জন্য নতুন নালা (স্টর্ম ড্রেন) নির্মাণ করতে হবে এবং সেই নালাগুলোকে প্রাকৃতিক পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। ২০১০ সালের ড্যাপে চিহ্নিত জলাশয়গুলোকে পুনরুদ্ধার করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এ লক্ষ্যে ড্যাপ ২০২২-৩৫ সংশোধন আশু প্রয়োজন। উল্লেখ্য, ড্যাপের ২০১৫ সালের সমীক্ষা অনুসারে ঢাকা মহানগরীতে মোট জলাশয় ও জলাধার (নদী, খাল, লেক, পুকুর, নালা, জলাভূমি)-এর পরিমাণ প্রায় ২১৭ বর্গকিলোমিটার। 

বন্যা ও জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকায় এ ধরনের সমস্যা দূরীকরণে সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (যেমন- পানি ধারণ পুকুর, পানি সংরক্ষণ/রিজার্ভার, বৃষ্টিবাগান, ছাদবাগান, সড়ক বিভাজকে বায়ো-সোয়েল স্থাপন ইত্যাদি) গ্রহণ করতে হবে। নগরের অভ্যন্তরীণ খালগুলো সমন্বিতভাবে পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত করে এগুলোকে কীভাবে পরস্পরের এবং পার্শ্ববর্তী নদনদীর সঙ্গে সংযুক্ত করা যায় তার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি ‘ব্লু নেটওয়ার্ক বা আন্তনীল সংযোগ’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে, প্রথমেই আন্তনীল সংযোগ পুনরুদ্ধারে ‘ভূ-প্রাকৃতিক সমীক্ষার’ (Geomorphological Survey) মাধ্যমে ডাটাবেজ তৈরি করে খাল ও জলাশয়ের বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হবে। একই সঙ্গে পানির প্রবাহ ও বারিপাতের ধারা বুঝতে গাণিতিক মডেল এবং হাইড্রো-মরফোলজিকাল মডেল ব্যবহার করে জলাবদ্ধতা প্রতিরোধে উপযুক্ত জল ধারণ এলাকা নির্ধারণ করা জরুরি। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে খাল পুনরুজ্জীবিতকরণের পাশাপাশি এসব জলাশয় ব্যবস্থাপনায় ও রক্ষণাবেক্ষণে নগরবাসীর অভিভাবকত্ব (Stewardship) নিশ্চিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি বাস্তবায়নমুখী রূপরেখা তৈরি করে খাল ও নদীর সংযোগ স্থাপন এবং দুর্যোগব্যবস্থাপনার জন্য আন্তনীল সংযোগ প্রতিষ্ঠা করায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন’কে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এসব জলাশয় পুনরুদ্ধার ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা হ্রাস, জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি এবং নাগরিকদের জন্য বিনোদনমূলক সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।

পাশাপাশি, প্রতিটি শহরের জন্য সবুজ নেটওয়ার্ক তৈরিতে, সবুজ এলাকা, জলাশয় এবং গণপরিসর রক্ষা ও পুনরুদ্ধারে স্বতন্ত্র রূপকল্প এবং কার্যকর সরকারি নীতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার ড্যাপ (২০২২-৩৫) অনুযায়ী প্রস্তাবিত পাঁচটি আঞ্চলিক পার্ক, ২৪টি জলকেন্দ্রিক পার্ক, চারটি ইকোপার্ক এবং অন্যান্য পার্কের অবস্থান, আকার, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি ও তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বন-নীতিতে নগর সবুজায়ন অন্তর্ভুক্ত করে ছোট পার্ক ও সবুজ করিডোর নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রতিটি এলাকা বা ওয়ার্ডভিত্তিক খেলার মাঠ নিশ্চিত করতে হবে এবং পাবলিক ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত মাঠগুলো থেকে ক্লাব অপসারণ করতে হবে।

পরিশেষে, ঢাকা মহানগরী একটি ‘অপরিপক্ব নগর’, যেখানে নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রয়োজনীয় মৌলিক সুবিধাগুলোর প্রবল অভাব রয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন একটি সুসংহত, টেকসই এবং আধুনিক নগর পরিকল্পনা- যা শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন নয়, বরং পরিবেশ, সামাজিক সেবা, নিরাপত্তা এবং নাগরিক সুবিধার ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সেই লক্ষ্যে, সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন, সুশীল সমাজ এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন কৌশল এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ এবং সুস্থ জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।

লেখক: স্থপতি ও নগরবিদ
[email protected]

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সুসংগঠিত করা জরুরি

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ০৫:২৫ পিএম
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সুসংগঠিত করা জরুরি
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে যেকোনো দেশের অর্থনীতি বাইরের পৃথিবীর পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। বহিঃখাত থেকে যে অভিঘাতগুলো আসে তা অভ্যন্তরীণভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করতে হয়। আমরা আজও আমাদের অর্থনীতিতে শক্ত ভিত্তির ওপর পুরোপুরি দাঁড়াতে পারিনি। ফলে অর্থনীতি একটা বড় রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আছে। দেশে খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে মূল্যস্ফীতিকে আরও অসহনীয় করে তুলছে। এর পেছনে বিগত সরকারের অব্যবস্থাপনা বহুলাংশে দায়ী। কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ম্যানিপুলেশন করে বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এটা যেন করতে না পারে, সেদিকটা লক্ষ রাখা জরুরি।

বাজার পরিস্থিতি সব সময়ই অস্থির করে তোলে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সেখানে সঠিকভাবে মনিটরিং না থাকার কারণেই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা দ্রুত সামাল দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে বিগত কয়েক বছরে বহু লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। কতসংখ্যক তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। নিম্নমধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের মান ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে। এ পরিস্থিতি এখনই মোকাবিলা করতে হবে। তা না হলে এ সমস্যা দিনে দিনে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

 বর্তমানে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে আঞ্চলিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। এমতাবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সুসংগঠিত করতে হবে। এটা ভেঙে পড়লে এই অস্থিরতা আরও বাড়বে। দেশে সরবরাহব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হারের অঙ্কটি অনেক বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে আসন্ন মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। আগের বিভিন্ন সময়ের মন্দা আমাদের দেখিয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন দুর্বল থাকে, তখন লম্বা সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে দেওয়া ঝুঁকি তৈরি করে। 

আমাদের এমন সব মধ্যমেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা করতে হবে, যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে এবং দরিদ্র ও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আছে- এমন পরিবারকে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট ব্যর্থতা আছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি বা বাজার ম্যানিপুলেশন করার জন্য সাধারণত কৃষক বা উৎপাদনকারী দায়ী নয়। দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়িক শ্রেণি। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ হয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করে থাকে। কৃষক উৎপাদন করে কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই কৃষক বা সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। দেশের সাধারণ মানুষ দিন আনে দিন খায়। হঠাৎ পণ্যের দাম বেড়ে গেলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের একটি অংশকে ঋণ করে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। 

এখন ভোক্তাঋণের সুদ বাড়ানোর ফলে তারা হয়তো চাপে পড়বেন। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে। দেরিতে হলেও আংশিকভাবে আমরা সেই পথে গেছি। তবে বিদ্যমান নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে করমুক্ত আয়ের সীমা কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে। আমাদের কর সীমা বাড়ানো উচিত। বিগত বছরগুলোতে করমুক্ত আয়ের সীমা একই আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। আর সেটা করতে হলে রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। এই অনুপাত অবশ্যই বাড়াতে হবে। যাদের টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) আছে, তাদের সবাই যাতে কর দেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। করের হার কমিয়েও কিন্তু রাজস্ব আদায় বাড়ানো যায়। 

দেশে আমদানি খরচ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া আরেকটা বড় রকম সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও আমদানির তুলনায় তা অনেক কম। ফলে বিশাল এক ধরনের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এখানে একটি বিষয় খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। দেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়েছে। যদি এটা হয়ে থাকে, তাহলে যে করে হোক তা বন্ধ করতে হবে। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেলে রপ্তানিকারকরা লাভবান হন। প্রবাসীরাও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হয়।

সে ক্ষেত্রে করের আওতা বাড়াতে হবে। যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের সবার কাছ থেকে কর আদায় করতে হবে। নতুন নতুন খাতকে করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উদ্বেগজনক বলতে হবে। অর্থনীতি এখন একটা বেশ বড় সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলা যায়। দেশ থেকে অনেক টাকা পাচার হয়ে গেছে। সেগুলোর আইনি প্রয়োগে যথেষ্ট অবহেলা ছিল। আইনগুলো শক্তিশালী হওয়া দরকার ছিল কিন্তু তা হয়নি। এসব বিষয় অর্থনীতির ভিত্তিকে আরও দুর্বল করেছে। ফলে অর্থনীতি একটা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে; অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আছে। অন্য সূচকগুলোর দিকে তাকালে স্বস্তির ব্যাপারও আছে। রপ্তানি আয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছুদিন ধরে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। যে কারণে অযথা ভয় বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি না হয়ে আরও ঝুঁকির মধ্যে আছে। যা মানুষের জীবনযাত্রার মানকে অনেক বেশি নিচের দিকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। এমতাবস্থায় সচেতন হয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি আরও বেশি সমস্যাসংকুল হবে। মূল্যস্ফীতির ফলে আমাদের রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রমগুলো ও বিনিয়োগ ব্যাহত হলে যেসব সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধান কঠিন হয়ে যাবে। অর্থনীতির সঙ্গে সমাজের অনেক মানুষ সম্পৃক্ত- নীতিনির্ধারক যারা আছে, যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে, যারা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, প্রান্তিক মানুষের জন্য নিরাপত্তাবেষ্টনী বৃদ্ধি ও সুসংগঠিত করার পাশাপাশি অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগী হতে হবে। 

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ

নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ০৫:২২ পিএম
নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

জাতীয় রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত ব্যক্তির নামে ঐতিহাসিক স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণের রীতি উন্নত-অনুন্নত প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচলিত রয়েছে। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়, এটি একটি দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক চেতনার প্রতিফলন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাস্তা, ভবন, প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিস্তম্ভ, শহর কিংবা পুরো দেশের নাম পরিবর্তনের ঘটনা দেখা যায়।

 এই পরিবর্তনগুলোর পেছনে থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়ন, সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা বা ঔপনিবেশিক অতীত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। নামকরণ ও নাম পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা সমাজের মূল্যবোধ ও আদর্শকে প্রকাশ করে। কিন্তু শুধু সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশে বা দলবাজির কারণে নাম বদলের খেলা বোধহয় বাংলাদেশে ছাড়া অন্য কোথাও প্রদর্শিত হয় না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নাম পরিবর্তন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অবশ্য নাম বদলের এই ঐতিহ্য আমরা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো কোনো সময় সংকীর্ণ দলীয় চিন্তার ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় নেতাদের সম্মানার্থে নামকরণের প্রবণতা দেখা গেছে। একসময় রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর এলাকাটির নাম রাখা হয় শেরেবাংলা নগর, ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের নাম দেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সবচেয়ে প্রশস্ত অ্যাভিনিউয়ের নাম রাখা হয় মানিক মিয়া (তফাজ্জেল হোসেন, যিনি ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের অকুতোভয় সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব) অ্যাভিনিউ। এসব নামকরণ বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিতে ক্রমেই নামকরণ ও নাম বদলের খেলাটি প্রতিযোগিতায় রূপ লাভ করেছে। 

নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র বিমানবন্দরের নাম ছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর। ১৯৭৯ সালে ঢাকার অদূরে কুর্মিটোলার আন্তর্জাতিক মানের নতুন একটি বিমানবন্দর চালু হলে তার নাম রাখা হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১৯৮১ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়ার নামানুসারে তদানীন্তন বিএনপি সরকারের নাম দেয় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিন্তু ২০১০ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় শাসনামলে বিমানবন্দরটির নাম বদলিয়ে রাখা হয় ‘হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।’ এই নাম পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে এ দেশের মানুষ যেহেতু সুফি-আউলিয়াদের শ্রদ্ধা করে, সেহেতু একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের স্মৃতি রক্ষার্থে এই নামকরণ হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার এক সিদ্ধান্তে বলা হয়, যেহেতু হাইকোর্ট কর্তৃক পঞ্চম সংবিধান বাতিল এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা জবরদখলকারী অবৈধ শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেহেতু তার নামে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান রাখা যাবে না। 

শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে উন্নীত করে স্বাধীনতা ঘোষণার পাঠক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নামানুসারে রাখা হয় ‘এম এ হান্নান বিমানবন্দর’। পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সে নাম পাল্টিয়ে রাখে ‘শাহ্ আমানত বিমানবন্দর’। এ নাম এখনো বহাল রয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নির্মিত ভৈরব সেতুর নাম পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নামানুসারে রাখে ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু’। জোট সরকার ওই নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু’। এই সেতু উদ্বোধনকালে বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান মন্তব্য করেন, ‘কোথাকার কে নজরুল ইসলাম, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ‘বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটর’ নাম দিয়ে দেশের প্রথম নভোথিয়েটরটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কর্তৃক উদ্বোধনের সময় এর নাম দেওয়া হয় ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নভোথিয়েটার’। কিন্তু শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতার এসে বঙ্গবন্ধু নামটি পুনঃস্থাপন করেন। এভাবে অসংখ্য নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের বিষয়টি নিজেদের দলীয় সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বিশেষ করে একই ব্যক্তির নামে অসংখ্য স্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করার বিষয়টি অতিমাত্রায় দেখা গেছে। যেটি দেশের মানুষ কোনোভাবেই ইতিবাচক হিসেবে দেখেনি। 

ধারণা করা হয়েছিল, ২০২৪-এর আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নামকরণের এই নেতিবাচক প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেষ হবে। এমনকি পরস্পরকে দোষারোপ বা ঘায়েল করার সংস্কৃতিও শেষ হবে। কিন্তু বিগত সময়ের রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতোই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে নাম পরিবর্তন কিংবা নামকরণের। কিছুদিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার শুধু পুরোনো ধারার রাজনীতি উৎসাহিতই করছে না; কোনো কোনো ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার শাসনের চিহ্ন মোছার নামে বাঙালির ইতিহাসকে মুছতে শুরু করেছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আমাদের চোখে পড়ছে। এ বিষয়ে খুলনা এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ সামনে আনা যেতে পারে। 

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু হলের নাম পরিবর্তন করে শাহ আজিজুর রহমানের নাম দেওয়া হয়েছে। সব মহলেই এ বিষয়ে সমালোচনা হচ্ছে যে বাংলাদেশের একজন স্বাধীনতাবিরোধীর নামে নামকরণ করার বিষয়টি কোনোভাবেই মানানসই নয়। এ ছাড়া উল্লেখ্য, গত ৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৯টি স্থাপনার নতুন নামকরণ করা হয়েছে। এটা করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, কবি জীবনানন্দ দাশ, লালন সাঁই, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শহিদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, জি সি দেব, ডা. আলীম চৌধুরীসহ বেশ ক’জন ক্ষণজন্মা মনীষীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, যারা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঙালি জাতিসত্তার মনন নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই এটিকে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার একটি প্রয়াস হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। 

বিগত সরকার বা অন্যান্য সরকার কোনো বিজ্ঞানী, কোনো মনীষীকে বিগত সরকার সম্মান দিয়ে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করেছিল- সেটিকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে পারি। যেসব বিজ্ঞানী কিংবা মনীষী তাদের কাজের মাধ্যমে যুগে যুগে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ঋদ্ধ করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কোনো স্থাপনার নামকরণ নিছক শেখ হাসিনার আমলে হয়েছিল বলেই তা মুছে ফেলতে হবে- এটি কোনো যৌক্তিক কার্যক্রম হতে পারে না। আবার নামকরণের বা পরিবর্তনের এই সংস্কৃতিতে কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর নাম বসানোর বিষয়টিও দেশের মানুষ ভালোভাবে নেবে না বা নিচ্ছে না। বিগত সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারগুলো মূলত প্রতিহিংসা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে নামকরণ ও নাম হরণের প্রতিযোগিতা শুরু করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসেও এমন সংস্কৃতি বজায় থাকার বিষয়টি কোনোভাবেই ন্যায্য এবং যুক্তিসংগত নয়। 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ 
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বিশ্বব্যাপী শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৮:৩৬ পিএম
বিশ্বব্যাপী শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে

১৯৪৫ সালে লীগ অব নেশনস ব্যর্থ হওয়ার পর মানবতাকে আত্ম-ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল সম্মিলিত নিরাপত্তার জন্য একটি সাহসী পরীক্ষা। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ রোধ করতে এবং সহিংসতার পরিবর্তে কূটনীতির মাধ্যমে সংঘাত পরিচালনার জন্য এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
তবুও, ৮০ বছর পরে আমরা নিজেদের বিপর্যয়ের প্রান্তে দেখতে পাচ্ছি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করেছে; যা বিজ্ঞানীরা দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় বিপৎসীমা হিসেবে দেখেন। প্রতিষ্ঠান এবং গণতন্ত্রের ওপর জনসাধারণের আস্থা অত্যন্ত কমে গেছে এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। কী হয়েছে?

জাতিসংঘ বিভিন্ন কারণে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। সহিংসতা, সংঘাত এমনকি গণহত্যার মতো ঘটনা এখনো উদ্বেগজনকভাবে ঘটছে। সংস্থাটি গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে সাধারণত অকার্যকর, অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক এবং অন্যায্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

সমস্যাটি হলো জাতিসংঘ একবিংশ শতাব্দীর মৌলিক সমস্যাগুলোর ওপর বিংশ শতাব্দীর যুক্তি উপস্থাপন করে যাচ্ছে। আজকের সবচেয়ে জরুরি চ্যালেঞ্জগুলো- যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক সংক্রমণ এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত যা কোনো সীমানা মেনে চলে না। তবুও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো ঈর্ষান্বিতভাবে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী জাতি রাষ্ট্রগুলোর কাঠামোর মধ্যে আটকে আছে। আমাদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল জাতীয় সীমানা সম্পর্কে পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য তৈরি করা হয়নি। জাতিসংঘ কেবল ধীরগতির নয়, এটি কাঠামোগতভাবেও এই ধরনের সমস্যাগুলো ব্যাপকভাবে মোকাবিলা করতে অক্ষম।

ক্রমবর্ধমান উপজাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবাদের মুখে প্রচলিত শাসন কাঠামোও যখন ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে, তখন প্রচলিত শাসনব্যবস্থার যে কোনো প্রস্তাবিত নতুন দৃষ্টান্ত ইউটোপিয়ানরা শুনতে চায় না। সৌভাগ্যবশত, বিশ্বের ইতোমধ্যেই একটি কার্যকর সংস্থা রয়েছে তা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সব ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এই ব্লকটি প্রমাণ করেছে যে, জাতীয় ফেডারেশন কাজ করতে পারে। যুদ্ধরত দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে সার্বভৌমত্বকে একত্রিত করার সুযোগ দিয়েছে। এটি তেমন কোনো মৌলিক ধারণাও নয়। ১৯৪৬ সালের গলআপ জরিপে, ৫৪ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করেছিলেন যে, ‘জাতিসংঘকে শক্তিশালী করা উচিত যাতে এটি এমন একটি বিশ্ব সরকারে পরিণত হয় যার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব জাতির সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে’।

২০২৪ সালে ৫৮ শতাংশ আমেরিকান মনে করতেন, জাতিসংঘ ‘খারাপ কাজ’ করছে। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় জাতিসংঘকে আরও সাহসী ভূমিকা পালন করা উচিত। দার্শনিক টিমোথি মর্টন বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো বৃহৎ সমস্যাগুলোকে ‘অতি-বস্তু’ বলেছেন। এগুলো ‘এত ক্ষণস্থায়ী এবং স্থানিক মাত্রার সত্তা’ যেগুলোর জন্য মৌলিকভাবে ভিন্ন ধরনের মানবিক যুক্তি প্রয়োজন। এ ধরনের সমস্যাগুলো সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করার জন্য বুদ্ধিগত এবং মানসিক উভয় পরিবর্তনের প্রয়োজন। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন যাকে ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ বলেছিলেন।

বুদ্ধিগতভাবে চিন্তা করলে ইহজাগতিক চিন্তাভাবনার জন্য নিজস্ব তাত্ত্বিক কাঠামো প্রয়োজন। এই দাবি নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীতে, জন মেনার্ড কেইনস বিশ্বব্যাপী মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন এবং ডলারকেন্দ্রিক ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিস্থাপনের জন্য ‘ব্যাংকর’-এর প্রস্তাব করেছিলেন। হান্না আরেন্ডট রাজনীতির বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকেও এগিয়ে নিয়েছিলেন। পিয়েরে টেলহার্ড ডি চার্ডিন ‘নুস্ফিয়ার’ (সম্মিলিত মানব চেতনা) সম্পর্কে তার ধারণাটি দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক স্কলারশিপে ‘গ্রহের সীমানা’ সম্পর্কে জোহান রকস্ট্রমের কাজ থেকে শুরু করে ব্রুনো লাটোরের পরিবেশগত যুগের বর্ণনা পর্যন্ত- নতুন গ্রহগত দৃষ্টান্তের বৌদ্ধিক উপাদানগুলো একত্রিত হতে শুরু করেছে।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাদের একটি নতুন আখ্যানের প্রয়োজন। ঐতিহাসিক জুবাল নোয়া হারারি যুক্তি দেন যে, মানবসভ্যতা জাতীয়তাবাদ এবং পুঁজিবাদের মতো সাধারণ মিথের ওপর গড়ে উঠেছে। এই পৃথিবীর শাসনব্যবস্থার সুফল পেতে হলে এটিকে নতুনভাবে সাজাতে হবে। সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কে পুরানো ধারণার বাইরে গিয়ে মানবতার আন্তসংযোগকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

মানুষ যেখানে আছে সেখান থেকে উঠে আসার জন্য উন্নত চিন্তাভাবনার সঙ্গে শক্তিশালী স্থানীয় চিন্তাভাবনাও থাকতে হবে। বার্গগ্রুয়েন ইনস্টিটিউটের জোনাথন ব্লেক এবং নিলস গিলম্যান বলেছেন, আমাদের শাসন কাঠামোর উন্নতির জন্য ‘ওপরে এবং নিচে’ উভয় দিকেই নজর রাখতে হবে। জাতিরাষ্ট্র একটি উপাদান হিসেবে থাকবে। তবে শহর, অঞ্চল ও স্থানীয় নেটওয়ার্কগুলোকে আরও মনোযোগ দিতে হবে এবং কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে একীভূত করা হবে। এই ধরনের নেস্টেড পদ্ধতি অর্থাৎ বসে থাকা জাতি রাষ্ট্রের পুরানো ব্যবস্থার বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে ভাবতে হবে। 
২০০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয় থেকে শুরু করে মহামারি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তাতে জাতিসংঘের ব্যর্থতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জাতিসংঘ নিজেই লিগ অব নেশনসের খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন জাতিসংঘকে নতুন করে গড়ে তোলার সময় এসেছে। শাসনব্যবস্থাকে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার জাতিরাষ্ট্রভিত্তিক যুক্তি থেকে ব্যাংকরের  সংবেদনশীলতার দিকে পরিচালিত করতে হবে। এমনকি যদি জাতিসংঘ বিশ্বের জাতিগুলোকে একত্রিত করতে সফল হয়, তবুও এর বর্তমান নকশা বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হবে। আমাদের পৃথিবীর বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীভূত নতুন সম্প্রদায়গুলোকে কল্পনা করার সময় এসেছে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন অধ্যয়ন বিভাগ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি সদস্য। আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল 

অর্থনীতির গতি ফেরাতে সরকারের করণীয়

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৮:৩৩ পিএম
অর্থনীতির গতি ফেরাতে সরকারের করণীয়
নেছার আহমদ

সাম্প্রতিক সময়ে সরকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সব পর্যায়ে অলিখিতভাবে গ্যাস সংযোগ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে। আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে অপরিণামদর্শী এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। বিগত সরকারের সময়ে জনবিরোধী সিদ্ধান্তে শিল্পে বিনিয়োগ তলানিতে এসে গিয়েছিল। পরিস্থিতি বিবেচনা না করে স্বৈরতান্ত্রিক চিন্তাভাবনায় অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়ে যায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গঠিত সরকার আমলাদের এসব মনোভাব থেকে বের হতে না পারলে সংস্কার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

গ্যাস ও বিদ্যুৎ দেশের শিল্পোন্নয়নে এবং অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। সম্প্রতি গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে অস্থিরতা বাড়ছে। সরকারের নেতিবাচক সিদ্ধান্তে নানা শঙ্কায় ভুগছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। সরকারের উচ্চমহল থেকে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির তোড়জোড় শুরু হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, আমদানিকৃত এলএনজির খরচ যা পড়বে সেই দর অনুযায়ী নতুন শিল্পকারখানার মালিকদের কাছ থেকে গ্যাসের দাম আদায় করা হবে।

শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। এ সিদ্ধান্ত যদি বাস্তবায়ন হয়, ধ্বংস হয়ে যাবে দেশের শিল্প খাত, বন্ধ হয়ে যাবে শিল্পে বিনিয়োগ। নতুন করে এ দেশে আর কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে না। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন সরকারের আত্মঘাতী ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে, যা দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিগত সরকারের সময়ে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালে নির্বাহী আদেশে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে তিন গুণ করে। কিন্তু দুই বছর পরও শিল্পে গ্যাস সংকট কাটেনি। বরঞ্চ সরকারের এসব সিদ্ধান্তে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। বেকার হয়ে পড়েছে অনেক শ্রমিক। গ্যাস-বিদ্যুৎ সেক্টর একটি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান কিন্তু প্রতিনিয়ত লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধি পেলেও সেবার মান দিন দিন নিম্নমুখী হয়েছে।

পেশাগত কারণে গ্যাস সেক্টরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। সেখানে নিত্য যে পরিবেশ দেখা যায় তাতে পুরানো দিনের প্রবাদ বাক্যটি বারবার মনে পড়ে- ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’। এ সেক্টরে গ্রাহকসেবার বালাই তো নেই, প্রতিদিন চলছে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মিটিং-আলোচনা, ফলে সময় চলে যায় দিন দিন। কর্মকর্তাদের মধ্যে গ্রাহকসেবার পরিবর্তে গ্রাহক হয়রানির মানসিকতা বেশি। কিছু সময়ের জন্য বাইরের কর্মকর্তা এনে দায়িত্ব দিলে তার কাছ থেকে আন্তরিকতা পাওয়া যায় না। দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সময় কাটিয়ে কোনোভাবে চাকরি শেষ করাটাই প্রাধান্য পায়। 

উন্নত আধুনিক সমাজব্যবস্থায় সেবার মান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের কথা বলা হলেও গ্যাস সেক্টরে প্রতিনিয়ত ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা গ্যাস সেক্টরের কোম্পানিগুলোতে নেই। ইতিপূর্বে যেসব সিদ্ধান্ত কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তারা গ্রহণ করতেন সেসব বিষয়ে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা কোম্পানির বোর্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সরঞ্জাম পরিবর্তন, সরঞ্জাম পুনর্বিন্যাসের মতো আবেদনগুলো মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে অনুমোদন করার বিধান ছিল। বর্তমানে সেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা স্ব স্ব কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা গর্ব করে কোম্পানি গঠিত বোর্ডে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোম্পানির বোর্ড মিটিংও একটি প্রক্রিয়ার বিষয়, মাসে একটি বোর্ড মিটিংও হয় না। বোর্ডে একবার নিতে না পারলে তা দু-তিন মাস এমনকি বছর পর্যন্ত গড়িয়ে যায়, কোনো অনুমোদন হয় না।

কোম্পানিগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা অনুমোদনের কোনো ক্ষমতা না থাকায় কর্মকর্তাদের মাঝে অলসতা, কর্মবিমুখতা লক্ষ্যণীয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে দিনকে দিন ক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার পরিবর্তন হলেও গ্রাহক হয়রানি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণের পরিবর্তে কেন্দ্রীয়করণের যে প্রবণতা তা পরিবর্তন হয় না। সরকার যায় সরকার আসে, সাধারণ মানুষের সেবা প্রদানের মান দিন দিন নিম্নগামী হচ্ছে। বিগত সরকারের যেসব আবেদন ও সংযোগ প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছিল, সাধারণ মানুষ মনে করেছিল সরকার পরিবর্তনের ফলে তাদের সংযোগের কাজ চালু করা হবে। কিন্তু বর্তমানে সরকারের নানামুখী সিদ্ধান্তে জনগণের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে।

পেট্রোবাংলার অধীনস্ত কোম্পানিগুলোকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও তার অধীনস্ত কর্মকর্তাদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করা প্রয়োজন। যেসব বিষয়ে অতীতে কোম্পানি পর্যায়ে অনুমোদনের ব্যবস্থা ছিল, সেই একইভাবে লোড বৃদ্ধি, সরঞ্জাম পুনর্বিন্যাস ইত্যাদি বিষয়ে অনুমোদনের ক্ষমতা কোম্পানি পর্যায়ে প্রদান করা এখন সময়ের দাবি। এতে গ্রাহকসেবার মান বৃদ্ধি পাবে এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে, দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশীলতা অর্জন করবে। স্বল্প সময়ে গ্রাহকের চাহিদা পূরণ সম্ভব হবে। এতে দুর্নীতি বন্ধ হবে। কোম্পানির বোর্ডগুলোয় পরিচালকদের গ্যাস সংযোগ ও কারিগরি বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, তাছাড়া সংক্ষিপ্ত মিটিংয়ে জটিল কারিগরি সিদ্ধান্ত নেওয়াও সম্ভব নয়। ফলে দিন দিন পুঞ্জীভূত সমস্যায় জর্জড়িত হয়ে পড়ছে বিপণন কোম্পানিগুলো। কোম্পানির পরিচালনা পরিষদে গ্রাহক প্রতিনিধি না থাকায় গ্রাহকের স্বার্থ দেখার কেউ নেই। যা এক প্রকার বৈষম্য বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ মহল।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত সরকারের কেন্দ্রীয়করণের যে ভুল সিদ্ধান্ত তা পরিহার করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীয়করণ জরুরি। এখনই এ বিষয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে হবে পেট্রোবাংলাকে।
ইতিপূর্বে আমি এ বিষয়ে অনেকবার লিখেছি, গ্যাস সেক্টরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কর্মকর্তাদের অলসতা এবং কোম্পানিগুলোতে যোগ্যদের পদায়ন না করে বাইরের কর্মকর্তাদের নিয়ে এসে চাপিয়ে দেওয়া এবং কারিগরি জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সর্বোচ্চ পদে পদায়ন করে অভিজ্ঞদের অবমূল্যায়ন করে এ সেক্টরকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে রাখা হয়েছে। বৈষম্যের কারণে ক্ষমতার রদবদল হলেও সরকারের প্রতিটি বিভাগে বৈষম্যের কারণে ক্ষোভ রয়েই গেছে।

চলমান উচ্চমূল্যস্ফীতির এ সময়ে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূসক বা ভ্যাটের সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে নিত্য ব্যবহাৰ্য জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের মতো ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর এ সিদ্ধান্তকে ‘গণবিরোধী’ বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই। তাদের ভাষায়, সরকার খালি কর বাড়ানোর তালে আছে। আয় বাড়ল কি না তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। একে তো মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের নিচে নামে না। এর মধ্যে আবার ভ্যাট বাড়ানোয় অবশ্যই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। এ অবস্থায় সাধারণ জনগণ যাবে কই?

সরকারের এ ধরনের অনেক অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তে দেশের শিল্পকারখানা বন্ধ হয়েছে। লাখ লাখ লোক চাকরিহারা, বেকারত্বের চাপ দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রত্যেক ঘরে ঘরে অসহায়ত্ব ও বেকারত্বের কান্নার রোল। তার ওপর নীতিনির্ধারকরা প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের পরিবর্তে অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নিত্যনতুন অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করছে। সরকারের দায়িত্বশীল মহল থেকে দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডের যে অব্যবস্থাপনা নজরে এসেছে তাতে সব প্রশাসনিক বিভাগ ঝিমিয়ে পড়েছে। সরকারি, বেসরকারি, অর্থ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগ রয়েছে যেখানে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে মাঠপর্যায়ের মতামতের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিয়ে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যে লাউ সেই কদুর মতো কাজ করছে, প্রতিটি বিভাগ। দেশের উন্নয়নের জন্য দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এবং জনগণকে স্বল্প পরিসরে সেবা প্রদানের যে পরিকল্পনা বা ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন তার কোনোটাই নেই। ফলে দিন দিন অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং কাজের চেয়ে বেকাজে সময় নষ্ট হচ্ছে প্রচুর। অন্তর্বর্তী সরকারের যে কাজ নয়, সেই কাজে সময় ব্যয় করতে গিয়ে সমস্যা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে এবং নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।

একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন- চট্টগ্রাম দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। কিন্তু সুদূর অতীতে এবং বর্তমানেও প্রতিটি ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বঞ্চনার শিকার। গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির অন্যতম জোগানদার। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রামের মানুষ। প্রান্তিক পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা। তার শাসনকালীন যদি চট্টগ্রাম উপেক্ষিত থাকে, তার চেয়ে বেদনার আর কিছু থাকে না। চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি জড়িত। এ বিষয়টি সবাই স্বীকার করলেও কার্যক্ষেত্রে এর প্রমাণ মেলে না। নতুন সময়ে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গ্যাস সেক্টরের মতো জনসেবামূলক সংস্থাগুলোকে ইগো ত্যাগ করে জনস্বার্থে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। চট্টগ্রামের দুঃখগাথা হয়ে আছে জলাবদ্ধতা। বর্ষা মৌসুমে ভারী কিংবা অল্প বৃষ্টিতে নগরের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এ নিয়তি চট্টগ্রামবাসী এক প্রকার মেনেই নিয়েছে। বৃষ্টি না থাকলেও অনেক সময় জোয়ারের পানিতে ডুবে যায় খাতুনগঞ্জের মতো বিখ্যাত ভোগ্যপণের পাইকারি বাজার, হাসপাতাল। বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার ঘটনা এখনো নৈমিত্তিক।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চট্টগ্রাম নগরের জলবদ্ধতার মূল কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জলপ্রবাহের যে ধারা তা বন্ধ করে উন্নয়ন কাজগুলো করা হয় কিন্তু পরবর্তীতে তা চালু করার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মেঘা প্রকল্পের জলাবদ্ধতা নিরসনে যে সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তা বাস্তাবয়ন জরুরি।

প্রকৃত প্রস্তাবে ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সেবামূলক সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রকৃত অর্থে জনগণের সেবায় মনোযোগ দিতে হবে, কাজে-কর্মে-পরিকল্পনায় দায়িত্বশীল হতে হবে। জবাবদিহি এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

সংস্কার ও রোহিঙ্গা ইস্যু  জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ প্রশংসনীয়

প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৬ পিএম
সংস্কার ও রোহিঙ্গা ইস্যু 
জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ প্রশংসনীয়
এম. হুমায়ুন কবির

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস চার দিনের সফরে গত ১৫ মার্চ শনিবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি তার পুরো সফরই ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মিটিং করেছেন। তার পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে মিটিং করেছেন। তিনি কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা দেখা ও তাদের সম্পর্কে মূল্যায়ন করার জন্যই সারা দিন ক্যাম্পে কাটিয়েছেন। সন্ধ্যায় জাতিসংঘের মহাসচিব ও ড. ইউনূস প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতারে অংশগ্রহণ করেন। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ আরও বাড়ানো দরকার। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আমরা অনেকদিন ধরেই দরবার করছি। এখানে আলাপ-আলোচনা চলছে, কীভাবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন করা যায়। দুবার চেষ্টা করেও প্রত্যাবর্তন সম্ভব হয়নি, এটাই বাস্তবতা। সেই প্রেক্ষপটে জাতিসংঘ মহাসচিবের এবারের সফর কতখানি সাফল্য বয়ে আনবে তা নিয়ে আমি সংক্ষেপে আলোচনা করতে চাই।

দুটো প্রধান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশ সফর করছেন। প্রথমত হচ্ছে, বাংলাদেশে বর্তমান একটা ট্রানজিশন পিরিয়ড চলছে অর্থাৎ সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সুষ্ঠু একটা নির্বাচন করার মাধ্যমে টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি করা। এই চলমান প্রক্রিয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘ মহাসচিব বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে সমর্থন দিয়েছেন। দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়। মায়ানমারের বর্তমান যে অবস্থা, এর প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কাজে তারা কী করতে পারে তার একটা মূল্যায়ন দরকার। এই দুটো প্রধান উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি চার দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমাদের বর্তমান বাস্তবতায় দুটো বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ। 

দেশ এখন একটা ট্রানজিশন প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছি। জাতিসংঘ মহাসচিব প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা বর্তমান সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে তাকে অবহিত করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব সংস্কার ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের টেকসই কাঠামোর প্রতিও জাতিসংঘের হয়ে সমর্থন জানিয়েছেন। কাজেই তার দিক থেকে স্পষ্ট করে বলা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। তিনি বর্তমান সংস্কার কার্যক্রম এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবর্তনকে সমর্থন করেছেন। আগামী দিনে বাংলাদেশে টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং তরুণ প্রজন্মের যে প্রত্যাশা অর্থাৎ একটা দায়বদ্ধ সরকার এবং মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকদের যে দায়-দায়িত্ব আছে, তার প্রতি সম্মানজনক একটা নতুন বাংলাদেশ তৈরি হোক। জাতিসংঘের সমর্থনটা সে ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটা উপাদান বলে মনে হয়। 

এখনকার বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে প্রেক্ষাপট চলমান রয়েছে, সেদিক থেকে আমি মনে করি, আলোচনাটা ফলপ্রসূ হয়েছে। এখানে প্রধান উপদেষ্টা দুটো ইঙ্গিত করেছেন। একটা হচ্ছে, সংস্কার কার্যক্রম। যদি সংক্ষিপ্ত সংস্কার কার্যক্রম করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া যায়, তাহলে নির্বাচন ডিসেম্বরে হতে পারে। এরকম একটা ইঙ্গিত কিন্তু আমাদের প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন। কাজেই এখানে আমাদের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে- তার ইঙ্গিত প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে পাওয়া গেল। তেমনিভাবে রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণে জাতিসংঘ আমাদের পাশে থাকবে তার ইঙ্গিত বা অঙ্গীকার পাওয়া গেল জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছ থেকে। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বলা যায়, জাতিসংঘ মহাসচিব খুব কাছ থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন সমস্যা বোঝার চেষ্টা করেছেন। সেখানে দু-তিনটা বিষয় আছে। প্রথমত হচ্ছে, আমরা ইতোমধ্যে জানি, মার্কিন প্রশাসন মানবিক সাহায্য স্থগিত করেছে এবং সেটা যদিও খাদ্য সাহায্য স্থগিত আদেশের বাইরে রাখা হয়েছে। 

কিন্তু মানবিক সাহায্যের উন্নয়নগুলো ৯০ দিনের জন্য বন্ধ আছে। তার একটা প্রভাব কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর পড়ছে। এর কারণ হলো- রোহিঙ্গাদের এখানে থাকা, খাওয়া, পড়া, তাদের অবস্থান, চিকিৎসা- যাবতীয় ব্যয়ভার আন্তর্জাতিক সংস্থাই বহন করে। এটা জাতিসংঘ কো-অর্ডিনেট করে থাকে। সেই নতুন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সাহায্য বন্ধ করার ফলে যে ঘাটতিটা হবে- সেই ঘাটতি কীভাবে মেটানো যায়- এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন তাদের এ কাজে সহায়তা দেন। সেটাও আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি যে, ডব্লিউএফপি খাদ্য সাহায্যের জন্য তাদের যে অনুদান দিয়েছিল জনপ্রতি, সেটা অর্ধেকে নামিয়েছে। আগামী এপ্রিল মাস থেকে খাদ্য সরবরাহে একটা ঘাটতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মহাসচিব নিজে এখানে এসে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের চিন্তাভাবনা কী, বাংলাদেশ সরকারের চিন্তাভাবনা কী- বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছেন। এটা অনেক বেশি শক্তিশালী হবে বলে আমার ধারণা। তিনি ইতোমধ্যে প্রেস কনফারেন্সে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক।

দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন। এটা নিয়ে আমরা অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি। কিন্তু সাত থেকে আট বছরে কোনো অগ্রগতি করতে পারিনি। দুবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে উদ্যোগ সফল হয়নি। সাম্প্রতিকালে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটাও সফল হয়নি। কাজেই এখন পর্যন্ত এই প্রত্যাবর্তনের জায়গায় আমরা খুব বেশি অগ্রগতি করতে পারিনি। সে ক্ষেত্রে আমরা চাচ্ছি রোহিঙ্গারা সম্মানজনকভাবে তাদের অধিকার নিয়ে মায়ানমারে ফেরত যাক- এ কথাটা তিনি আমাদের কাছ থেকে যেমন শুনেছেন, রোহিঙ্গারাও কিন্তু তাকে সে কথাই বলেছে। তিনি সংবাদ সম্মেলনে যে কথাটা বলেছেন, রোহিঙ্গারা মায়ানমারে ফেরত যেতে চায়। কাজেই তারা যাতে ওখানে অধিকারের সঙ্গে যেতে পারে, এটাই হবে আমাদের কাজ। রোহিঙ্গাদের যাওয়ার ব্যাপারে মায়ানমারে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা দরকার। অধিকার রক্ষা করা দরকার মায়ানমারে- এ কথাটাও জোরের সঙ্গে তিনি বলেছেন। মোটাদাগে তার অর্থ, রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে সম্মানজনকভাবে অধিকার নিয়ে ফেরত যাওয়া উচিত। সারা পৃথিবীতে জাতিসংঘ মহাসচিবের মেসেজটা যাবে।

 রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের অধিকার নিয়ে ফেরত যাক, এই বক্তব্য তিনি আমাদের মুখ থেকে যেমন শুনেছেন, তেমনি রোহিঙ্গাদের মুখ থেকেও শুনেছেন। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ উদ্যোগ নিচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার। সেটা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তৃতীয় বিষয় হচ্ছে, রাখাইন প্রদেশে এখন সামরিক সংঘাত চলছে। সেখানে ৬ লাখের মতো রোহিঙ্গা এখন এই সংঘাতের সঙ্গে জড়িত। জাতিসংঘের মতে, ইতোমধ্যে ওখানে এখন দুর্ভিক্ষের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। সন্দেহ করা হচ্ছে যে, এই দুর্ভিক্ষ অবস্থা যদি চলমান থাকে, গভীরতম হয় তাহলে রোহিঙ্গারা তখন মানবিক কারণেই বাংলাদেশের দিকে ছুটে আসতে পারে, এমন একটা আশঙ্কার কথাই বলা হচ্ছে। আপনারা পত্রপত্রিকায় দেখেছেন রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে ঢুকছে। সরকারি পর্যায় থেকেও এ কথা বলা হচ্ছে।

 কাজেই এখন জাতিসংঘের একটা উদ্যোগ হচ্ছে- এই লোকগুলোর জন্য যদি আমরা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মানবিক সাহায্য রাখাইনে পাঠাতে পারি, তাহলে যারা দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির আশঙ্কায় রয়েছে, সেই মানুষগুলোকে সেখানেই রেখে তাদের সহায়তা বা সাহায্য করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটা সহায়তা করেছিল বলে পত্রপত্রিকার খবরে দেখলাম। আমার ধারণা, জাতিসংঘের মহাসচিব এই মানবিক উদ্যোগে অর্থাৎ রাখাইন প্রদেশে এখনো যে রোহিঙ্গারা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় আছেন, তাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে মানবিক সাহায্য পাঠানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাইবেন। বাংলাদেশ সরকার এটা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছে। আরাকান আর্মি সীমান্তের অন্যদিকে এখন প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাদের সঙ্গে কাজ করে যদি খানিকটা আস্থা তৈরি করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এই আস্থার ওপর ভিত্তি করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সাহায্য পাঠানোর একটা সুযোগ হয়তো তৈরি হতে পারে। সেটা সফল হবে কি না, এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। আমি মনে করি, সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা প্রত্যাশা করি। 

এই উদ্যোগটা যদি সফল করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের আরাকানে আবার ফেরত দেওয়ার ক্ষেত্রে সুযোগ তৈরি হতে পারে। কারণ দীর্ঘমেয়াদে সেটা বাংলাদেশের জন্য যেমন লাভজনক হবে, তেমনি মায়ানমারের জন্য লাভজনক হবে। বাংলাদেশ-মায়ানমার সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ প্রক্রিয়ায় একটা ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে। এ বিষয়গুলো সামনে রেখে জাতিসংঘের মহাসচিবের চার দিনের সফর ইতিবাচক। তিনি যে উদ্যোগটা নিয়েছেন তার জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। আগামী দিনেও তিনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন। সেই আলোকে তার উদ্যোগ সফল হোক, এটাই আমার প্রত্যাশা।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত