
‘পুরানো পৃথিবী আজ অবসানের পথে এবং নতুন বিশ্ব জন্ম নেওয়ার জন্য সংগ্রাম করছে। এখন সময় হলো দানবদের’। আন্তোনিও গ্রামসির এই বিখ্যাত উদ্ধৃতিটি আজ অনেকটা প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। কারণ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গত শতাব্দী থেকে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার মাধ্যমে এমনটি হয়েছিল। প্রথমটি ১৯৪৫ সালের পরে এসেছিল, যখন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা জাতিসংঘ এবং ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয়টি ঘটেছিল ১৯৮৯ সালে, যখন বার্লিন প্রাচীরের পতনে স্নায়ুযুদ্ধে পশ্চিমের বিজয় হয়েছিল। তার পর থেকে আমরা উচ্চমাত্রার বৈশ্বিক একীকরণের মাধ্যমে এক মেরুকরণ বিশ্বে বসবাস করছি। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের গঠনকারী নিয়মাবলি মার্কিন নিরাপত্তা গ্যারান্টির মাধ্যমে নিশ্চিত হতো। ধারণা করা হয়, অর্থনৈতিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে অতিক্রম করবে। আজকের পৃথিবীটা সম্পূর্ণই আলাদা।
এখন বহুমুখী বিশ্ব যেখানে চীন, রাশিয়া, ভারত, তুরস্ক, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলো পুরানো আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে যাচ্ছে। এসব দেশ অন্য উদীয়মান শক্তিগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নিয়মকানুন গঠনে জোর দাবি রাখে। ইতোমধ্যে ‘সর্বজনীন মূল্যবোধ’ এবং ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়’-এর প্রতি মানুষের বিশ্বাস কমে গেছে। গাজা, সুদান এবং অনেক জায়গায় মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালীন ভ্যাকসিন মজুদকারী ধনী দেশগুলো ভণ্ডামি ও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপ এবং জাপানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা গ্যারান্টিগুলো প্রত্যাহার করা, অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা ছেড়ে দেওয়া এবং বন্ধু ও শত্রুদের ওপর একইভাবে বাণিজ্য শুল্কারোপের হুমকি দিয়েছেন। সিস্টেমের গ্যারান্টার যখন এটি থেকে দূরে চলে যায়, তখন কী হতে পারে? আমরা হয়তো এমন একটি শূন্য-ক্রম জগতের দিকে যাচ্ছি, যেখানে নিয়মগুলো শক্তির মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হবে। ক্ষুদ্র দেশগুলোর টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।
এটি একটি বৃহৎ আঞ্চলিক ব্লকের বিশ্ব হতে যাচ্ছে, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার গোলার্ধে আধিপত্য বিস্তার করছে। চীন পূর্ব এশিয়ার ওপর আধিপত্য বিরাজ করছে এবং রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করে যাচ্ছে। আদর্শগতভাবে, আমরা একটি নতুন নিয়মভিত্তিক আদেশে আমাদের পথ খুঁজে পেতে পারি, যা আমাদের বহুমুখী বিশ্বকে আরও সঠিকভাবে প্রতিফলিত করবে। সেখানে যাওয়ার জন্য আমাদের আরও ভালোভাবে বুঝতে হবে কেন পুরানো অর্ডার ব্যর্থ হয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনা তাদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার বা ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানে ভোটের মাধ্যমে তা শেয়ার করা হোক। উন্নত অর্থনীতিতে উপেক্ষিত কারণ হলো বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক চুক্তির ব্যর্থতা।
সামাজিক চুক্তি- নিয়ম, অধিকার ও বাধ্যবাধকতা যা জাতীয় সংহতি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। পরিবারগুলোকে সংগঠিত করা থেকে শুরু করে বেকারত্ব, অসুস্থতা এবং বার্ধক্যের মতো চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যায়- সেগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার এই ব্যবস্থাগুলোর ব্যর্থতা উন্নত অর্থনীতিতে তীব্র ছিল। উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো একসময় পুরানো আদেশের মাধ্যমে চলত।
যে দেশগুলো বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করেছিল এবং এটি থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল, তারা এখন তাদের সামাজিক চুক্তিতে সবচেয়ে বেশি চাপে আছে। বিশ্বায়ন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হচ্ছে তারা।
এই গতিশীলতা অর্থনীতিবিদদের পক্ষে উপলব্ধি করা প্রায়শই কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ পেশাটি ইতিবাচক-সমষ্টির ধারণার মধ্যে নিহিত থাকে। দেশগুলো বাণিজ্য থেকে উপকৃত হয়। ভোক্তাদের জন্য প্রতিযোগিতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধিকারী নীতিগুলো সমাজকে আরও ভালো করে তোলে। অর্থনীতিবিদরা শূন্য-সমষ্টি চিন্তায় কম পারদর্শী। তারা বিশ্বাস করেন যে, যখন কেউ লাভবান হয়, তখন অন্য কেউ অবশ্যই হারাতে থাকে। এটি সাম্প্রতিক নীতিনির্ধারণের অ্যাকিলিসের হিল যা বণ্টনসংক্রান্ত বিষয়গুলোয় মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে। তারা কীভাবে ইতিবাচক-সমষ্টির অর্থনৈতিক নীতিগুলোর জন্য রাজনৈতিক সমর্থন বজায় রাখা যায় তা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
আমাদের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোর সবচেয়ে বড় উদাহরণটি বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করা সমীক্ষায় পাওয়া যায় যে, তারা মনে করে তাদের সন্তানরা তাদের চেয়ে ভালো বা খারাপ হবে। প্রতিটি উন্নত অর্থনীতিতে- বিশেষ করে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে অভিভাবকরা বিশ্বাস করেন তাদের সন্তানদের অবস্থা আরও খারাপ হবে। বিপরীতভাবে, প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশে বিপরীতটা সত্য। বেশির ভাগ উন্নত অর্থনীতিতে সহস্রাব্দ এবং জেনারদের প্রকৃত আয় একই বয়সে তাদের বাবা-মায়ের আয়ের তুলনায় খুব কম। তারা উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ঋণী এবং বাড়ির মালিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সীমিত সামাজিক গতিশীলতার সময়কালে বেড়ে ওঠা লোকেদের শূন্য-সমষ্টির মানসিকতা বিকাশের সম্ভাবনা বেশি। যেহেতু উন্নত অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে এবং সামাজিক গতিশীলতা হ্রাস পেয়েছে। বাম এবং ডান উভয়জুড়েই শূন্য-সমষ্টির রাজনীতির সমর্থন বেড়েছে।
হাভার্ড এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অর্থনীতিবিদদের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় আমেরিকানদের চার প্রজন্মের শূন্য-সমষ্টি চিন্তার উৎস এবং প্রভাব পরীক্ষা করেছে। তাতে দেখা যায়, ‘শূন্য-সমষ্টির মানসিকতা সরকারি পুনর্বণ্টন, জাতি এবং লিঙ্গভিত্তিক ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং সীমাবদ্ধ অভিবাসন নীতিগুলোর সঙ্গে যুক্ত’। এই ধরনের চিন্তাভাবনা ব্যক্তি এবং তাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে চিহ্নিত করা যেতে পারে, যার মধ্যে তারা কতটা আন্তপ্রজন্মীয় ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতা অর্জন করেছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন হয়েছে বা বৃহত্তর অভিবাসী জনসংখ্যার সম্প্রদায়গুলোতে বসবাস করেছে কি না এবং তারা দাসত্ব করেছে কি না।
যদিও বেশির ভাগ দেশে মেয়ে এবং ছেলেদের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ রয়েছে, তবুও কর্মক্ষেত্রে নারীরা অনগ্রসর। কারণ তারা পুরুষদের তুলনায় প্রতিদিন দুই ঘণ্টা বেশি অবৈতনিক শ্রম দেয়; যার মধ্যে রয়েছে গৃহস্থালির কাজ এবং যত্ন নেওয়া। পিতা-মাতার ছুটিতে নমনীয়তা, পরিবারকে সমর্থন করাতে পাবলিক তহবিল বৃদ্ধি এবং বাড়িতে শ্রমের ন্যায্য বিভাজন সমাজে নারী প্রতিভার আরও ভালো ব্যবহার করতে সক্ষম করবে।
প্রতিটি সমাজে একটি ন্যূনতম আয়ের স্তর স্থাপন করা সম্ভব, যার নিচে কেউ পড়বে না। এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নগদ অর্থ-হস্তান্তর প্রোগ্রাম বা উন্নত অর্থনীতিতে স্বল্প মজুরি কর্মীদের জন্য ট্যাক্স ক্রেডিটের মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে। আমি যেকোনো দেশে সর্বজনীন মৌলিক আয় সম্পর্কে সন্দিহান রয়েছি। কারণ, যাদের প্রয়োজন নেই তাদেরই অর্থ প্রদান করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা যেমন শূন্য-সমষ্টির চিন্তাভাবনা এবং বণ্টনসংক্রান্ত বিষয়গুলোতে যথেষ্ট মনোযোগ দেন না, তেমনি তারা পরিচয়ের গুরুত্বকে অবমূল্যায়ন করার প্রবণতাও দেখান। আমি বিশ্বাস করি, অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক নীতিগুলো সমাজকে আবার একত্রিত করতে পারে। এই বিশ্বাস থেকেই আমি আমার বইটি ‘ওয়াট উই ও ইচ আদার’ লিখতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আমাকে একটি কার্যকর সামাজিক চুক্তি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। পরিচয় হলো এমন একটা বিষয় যা সামাজিক চুক্তিকে একসঙ্গে ধরে রাখে। জাতীয়তাবাদের প্রয়াত পণ্ডিত আর্নেস্ট গেলনার শিক্ষাব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক একতাবদ্ধকরণ, সাধারণ ভাষা এবং জাতীয় পরিচয়ের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন।
সুইজারল্যান্ড এবং ভারতের মতো দেশগুলো দেখায় যে, একাধিক ভাষাসহ ফেডারেল সিস্টেমেও একটি জাতীয় পরিচয় গড়ে তোলা সম্ভব। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পরিচয় কোনো মনোলিথ (পাথরের স্তম্ভ) নয়, বা এটি শুধু জাতিগত বা ধর্ম সম্পর্কও নয়। আমাদের প্রত্যেকেরই শিক্ষা, পেশা, যৌন অভিযোজন এবং ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে একাধিক পরিচয় রয়েছে। কিন্তু ভাগ্যের অনুভূতি যা সমাজকে একত্রিত করে এবং নাগরিকত্বের দায়িত্ব নিতে আমাদের অনুপ্রাণিত করে। অভিবাসনের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনতাবাদী রাজনীতিবিদদের মাধ্যমে এই সমস্যা উত্থাপিত হয়েছে।
যদিও বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ যুক্তি দেখান যে, অভিবাসন সাধারণত বৃদ্ধির জন্য ভালো। অভিবাসন নিয়ে অর্থনৈতিক বিতর্ক খুবই কম। পরিচয়ের ওপর কেন্দ্রীভূত হওয়া ঠিক নয়। সমাজিক মানুষ হিসেবে আমরা কে এবং কোথায় থেকে এসেছি এটা বিষয় নয়। সবাইকে সামাজিক চুক্তিতে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত। এ কারণেই অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য প্রায়শই অভিবাসীদের বা উদ্বাস্তুদের আবাসন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যার মতো সরকারি পরিষেবাগুলোর ওপর প্রভাব পড়ে। যেগুলোকে কয়েক প্রজন্মের অবদানের মাধ্যমে অর্জিত সুবিধা হিসেবে দেখা হয়।
আমরা বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনায় মৌলিক পুনর্বিন্যাসের মধ্যে আছি, যার ফল এখনো অস্পষ্ট। আমি নিশ্চিত যে, একটি ইতিবাচক-সমষ্টি আন্তর্জাতিক আদেশ অর্জনের জন্য শক্তিশালী দেশ-স্তরের সামাজিক চুক্তির প্রয়োজন হবে, যা অগ্রগতি ও নিরাপত্তা প্রদান করবে। যারা শূন্য-সমষ্টি, বর্জনীয় এবং স্বার্থপর তাদের আমরা বৈশ্বিক বিবেচনায় আধিপত্য বিস্তার করতে দিতে পারি না। এই জাতীয় সমস্যাগুলোর ওপর কাজ করার মাধ্যমে, আমরা একটি ন্যায্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তৈরির সম্ভাবনা বাড়াতে পারি, যা সবার জন্য আরও ভালো ফল বয়ে আনবে।
লেখক: সাবেক সভাপতি, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স, যুক্তরাষ্ট্র
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল