ঢাকা ৮ চৈত্র ১৪৩১, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫
English

ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দৃঢ় হওয়ার আশা

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৮ পিএম
ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দৃঢ় হওয়ার আশা
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

মোদির এবারের মার্কিন সফর নিয়ে বাংলাদেশেও সমান কৌতূহল। ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির আলোচনায় আমেরিকার প্রসাদ ওঠে কি না, তা নিয়ে তুমুল কৌতূহল ছিল। বাংলাদেশের ভার ট্রাম্প পুরোপুরি মোদির ওপর দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে ভারত ও আমেরিকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা খাতে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থান আরও সুদীর্ঘ হবে।...

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ট্রাম্প জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বিষয়টি তিনি মোদির ওপর ছাড়ছেন। ওই দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে আমেরিকার কোনো গুপ্ত ভূমিকা নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি।

মোদির এবারের মার্কিন সফর নিয়ে বাংলাদেশেও সমান কৌতূহল। ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির আলোচনায় আমেরিকার প্রসাদ ওঠে কি না, তা নিয়ে তুমুল কৌতূহল ছিল। বাংলাদেশের ভার ট্রাম্প পুরোপুরি মোদির ওপর দিয়েছেন।

ট্রাম্প প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার পরও বাংলাদেশ নিয়ে সরাসরি নাক গলাতেন না। ভারতের সঙ্গে সমন্বয় করে চলত মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক। এবারও সেই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটালেন না ট্রাম্প। যা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বেশ চাপের বলেই মনে করা হচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাবেক মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ। অন্যদিকে হিলারির সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক একেবারেই জানা নয়। ঘটনাক্রমে ট্রাম্প এমন একসময় বাংলাদেশ নিয়ে মোদিকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দিয়েছেন, যখন শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে ভারতের ওপর চাপ গড়াতে চাইছে ঢাকা।

শুধু ট্রাম্প নয়, সদ্য নিয়োগ পাওয়া মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা অধিকর্তা হিন্দু মার্কিনি তুলসী গ্যাবার্ডের সঙ্গে মোদির আলোচনাতেও এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। তুলসী ইতোপূর্বে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় মুখ খুলেছেন।

গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প-মোদির বৈঠকের কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ফোন করেন ট্রাম্পের বন্ধু ইলন মাস্ক। তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে তা জানায়নি বাংলাদেশ প্রশাসন। তবে মনে করা হয় একটি ব্যবসায়িক ডিল নিয়ে কথা হয়েছে।

ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশে তাদের সব প্রকল্পের কাজ বন্ধ করতে নির্দেশিকা জারি করে। বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য তো বটেই, সে দেশের মাটিতে আমেরিকার তরফে সব উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই পদক্ষেপের কয়েক দিনের মধ্যেই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছেন মোদি-ট্রাম্প। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাফ জানিয়ে দেন, ‘হাসিনার পতনের নেপথ্যে আমেরিকার কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি দীর্ঘদিন কাজ করছেন, তাই এই বিষয়টি তার ওপরেই ছেড়ে দিলাম।’ পরে বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি জানান, বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তার কারণ রয়েছে। সেগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে জানিয়েছেন মোদি।

মার্কিন মুলুক থেকে প্রত্যেক বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নাগরিককে ফিরিয়ে নেবে ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর এই কথাই জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার সাফ কথা, বেআইনিভাবে প্রবেশ করে বিশ্বের কোনো দেশেই থাকার অধিকার নেই। সেই সঙ্গে জানালেন, আমজনতাকে ভুল বুঝিয়ে পাচার করা হচ্ছে।

গত সপ্তাহে হাতকড়া পরিয়ে, পায়ে শিকল বেঁধে আমেরিকা থেকে ফেরানো হয়েছিল ১০৪ ভারতীয়কে। তারপর এই প্রথমবার অনুপ্রবেশকারীদের ফেরানো প্রসঙ্গে কথা বলতে শোনা গেল মোদিকে। মার্কিন মুলুকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, ভারতের দরিদ্র যুবকদের ভুল বুঝিয়ে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। অতি সাধারণ পরিবারের সন্তানদের বড় বড় স্বপ্ন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। অনেকে জানেও না কেন তাদের এভাবে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। অনেককে পাচার করে দেওয়া হয়েছে।

মোদি আরও বলেন, মানব পাচারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে কাজ করতে হলে ভারত এবং আমেরিকাকে। পাচার চক্রকে নির্মূল করতে ‘যুদ্ধে’ নেমেছে ভারত। প্রধানমন্ত্রীর আশা, এই যুদ্ধে সর্বতোভাবে সাহায্য করবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসেই ‘অনুপ্রবেশকারী হটাও’ অভিযান শুরু করেছেন ট্রাম্প। মার্কিন মুলুক থেকে ‘তাড়ানো’ হচ্ছে শয়ে শয়ে মানুষ। উল্লেখ্য, মোদি বরাবর ভারত থেকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সরানোর কথা বলেছেন। তাই মার্কিন মুলুক থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি শুল্ক নিয়ে আলোচনা করেন। ভারত-মার্কিন ক্ষুদ্র বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও আলোচনা হয়। মোদির সফরের প্রাথমিক লক্ষ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি এড়ানো। 

এ ছাড়া ট্রাম্প ইতোমধ্যে চীন থেকে আমদানির ওপর ১০ শতাংশ হারে ব্যাপক শুল্ক আরোপ করেছেন, ফলে বেইজিং আমেরিকান জ্বালানির ওপর শুল্ক আরোপ করতে বাধ্য হয়েছে। ভারত বিলাসবহুল গাড়ি এবং সোলার সেলসহ ৩০টিরও বেশি পণ্যের ওপর সারচার্জ নিয়ে পর্যালোচনা করছে। ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনার খবরের পর ধাতব স্টকগুলোর শেয়ারের দাম কমেছে। ভারতের এক শিল্পপতি মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্প প্রস্তাবিত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলে দেশটির প্রকৌশল পণ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ রপ্তানি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এর মধ্যে রয়েছে ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়াম এবং মূল্য প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। তিনি আরও মন্তব্য করেন, আমরা অপেক্ষা এবং দেখার নীতিতে রয়েছি এবং আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে।

আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিরক্ষা বিষয়েও বিশদ আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে। আমেরিকায় লুকিয়ে থাকা ভারতের শত্রুদের ভালো দিন এবার শেষ হতে চলেছে। যারা আমেরিকায় লুকিয়ে বসে ভারতের মাটিতে অপরাধ ও নাশকতা সংঘটিত করে তাদের কঠিন সময় আসতে চলেছে। তাদের কুকীর্তির কুণ্ডলী তৈরি করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। আমেরিকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বিষয়টি কার্যকরী করার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করা হয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো আমেরিকায় লুকিয়ে বসে ভারতে নাশকতা চালানো ১২ গ্যাংস্টারের তালিকা এবং তাদের কাজকর্মের কুণ্ডলী তৈরি করে।

 নরেন্দ্র মোদি এই তালিকা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শেয়ার করেছেন বলে জানা গেছে। আমেরিকাকে ওই সব গ্যাংস্টার সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যই হলো তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া। আশা করা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে ভারত ও আমেরিকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা খাতে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থান আরও সুদীর্ঘ হবে।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বদলানো এখন সময়ের দাবি

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:৪২ পিএম
বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বদলানো এখন সময়ের দাবি
আনু মুহাম্মদ

বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির জন্য পুরো ব্যবস্থার বদল দরকার। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বৈষম্যের ভিত তৈরি করে। শিক্ষা হতে হবে সব নাগরিকের অধিকার এবং তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। অভিন্ন এবং উন্নত মানের শিক্ষা শ্রেণি, জাতি, লিঙ্গ, ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে একই সঙ্গে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য অভিভাবকদের আর্থিক দুশ্চিন্তা বা সংকটের সমাধান করতে হবে।...

দেশে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শিক্ষাবঞ্চিত অথবা শ্রমিক। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় অনেকেই লেখাপড়ার পরিবেশ থেকে দূরে সরে গেছে। এই অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই নেওয়ার কথা। তা এখনো অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘু অনেক মানুষ নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে দিন-রাত কাটাচ্ছেন এখনো। বহু কারখানা অচল হয়ে বর্তমানে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার। বহু শ্রমিককে বকেয়া মজুরির জন্য এখনো পথে নামতে হচ্ছে। বেশির ভাগ জিনিসপত্রের দাম এখনো সেই ক্রয়ক্ষমতার ওপরেই আছে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ এখনো বিশ্বের মধ্যে নিকৃষ্ট। যানজট, দুর্ঘটনা বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত আছে।  
যেসব প্রকল্প ও চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিপজ্জনক, বাংলাদেশের প্রাণপ্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ এবং যা বড় আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে- এসব প্রকল্প এবং চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন দরকার।

 যেগুলো খুবই ক্ষতিকর, সেগুলো বাতিল করা দরকার। সেজন্য এগুলোর বোঝা থেকে কীভাবে বাংলাদেশ ও মানুষকে রক্ষা করা যায়- সেটা নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া শুরু করা এই সরকারেরই দায়িত্ব। অন্যদিকে বৈষম্যবাদী রাজনীতির নড়াচড়া ক্রমেই বাড়ছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে খাটো বা অস্বীকার করে এই জনপদের মানুষের লড়াইয়ের ঐতিহ্যকে খারিজ করা, সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। জোরজবরদস্তি, ট্যাগিং, মব ভায়োলেন্স ও নারীবিদ্বেষী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মাত্রায়। বলাই বাহুল্য, গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গেলে এসবের পরিবর্তন হতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে সরকারের সরব ও সক্রিয় হওয়াই প্রধান পদক্ষেপ হতে পারে। এখন পর্যন্ত সরকারের ভূমিকা খুবই দুর্বল বলতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, যাদের এই সরকারের না চেনার কথা নয়। এ ছাড়া আবার শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি, যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে এবং এগুলো বহুদিন ধরেই চলছে। এই যে কতিপয় গোষ্ঠীর বাজার নিয়ন্ত্রণ, এটা আগের সরকার ভাঙার বদলে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। বর্তমান সরকারও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এতে সরকারের বিশেষ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। 


বাংলাদেশ ব্যাংককে একটা কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো, যেসব ব্যাংক রাজনৈতিক ও কতিপয় গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল সেগুলোকে পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেওয়া, মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় মুদ্রানীতি প্রণয়ন এগুলো করার জন্য কমিশনের সংস্কার কর্মসূচি বা কমিশনের রিপোর্টের অপেক্ষার দরকার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার যদি ঠিকমতো হয়, ব্যাংকিং ক্ষেত্রে অনিয়মগুলো যদি দূর হয়, বাজারে মুদ্রাব্যবস্থা যদি সুস্থ অবস্থায় আসে, ডলার এক্সচেঞ্জ রেট স্বাভাবিক অবস্থায় আসে, এসবই মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এগুলো নিয়ে আগেই সক্রিয় ভূমিকা দরকার ছিল। সে ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভাষ্য বা কার্যকর উদ্যোগ এখনো আমরা দেখতে পাইনি।

সরকারকে আস্থা তৈরি করতে হবে। অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার হঠাৎ করে গত সরকারের স্টাইলে মানুষের ওপর ভ্যাট ও করের বোঝা চাপিয়ে দিল তা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আস্থা কমাবে, আরও কঠিন অবস্থা তৈরি করবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য। শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত অর্থনীতির যে গতি বা ধারা ছিল, সেখানে অচিন্তনীয় মাত্রায় কতিপয় গোষ্ঠীর লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল। ফলে দীর্ঘমেয়াদি অনেক ক্ষতি হয়েছে। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে থাকে। অতি ব্যয়ে করা ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোর জন্য ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় ব্যাপকভাবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উঁচু দেখালেও তা কর্মসংস্থানের সমস্যা কমাতে পারেনি। অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ে। এর সঙ্গে সম্পদ কেন্দ্রীভবন, বৈষম্য বৃদ্ধি- এগুলো যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতে হাসিনা সরকারের পতন না ঘটলে, এই সংকটগুলো আরও বেশি ঘনীভূত হতো। এসব ঋণ শোধের চাপ সামনে আরও বাড়বে। 

তবে জনগণের নামে একটা ভূমিকা নিতে পারে সরকার। বলতে পারে, এগুলো যেহেতু অনির্বাচিত সরকার জনসম্মতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেরা কমিশন পাওয়ার জন্য এবং কিছু গোষ্ঠী থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য নিয়েছে, যেহেতু দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার হয়েছে এর বড় অংশ, সেহেতু এর দায়িত্ব আমরা কেন নেব? এই প্রশ্ন তুলতে হবে। দরকষাকষি করে সময় বাড়াতে হবে, সুদ এবং আসল কমাতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না বরং পূর্ণমাত্রায় সচল রাখতে হবে। এরকম একটি দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে সরকারকে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের দায়িত্ব সরকারের কোনো কোনো প্রতিনিধিকে নিতে হবে। 

শিক্ষা নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। তবে তা যেন নতুন সমস্যা তৈরি না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে যেকোনো রাজনৈতিক দলের দাপট দূর করা উচিত। তবে রাজনৈতিক সচেতনতা, সুস্থ বিতর্ক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই থাকতে হবে। বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির জন্য পুরো ব্যবস্থার বদল দরকার। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বৈষম্যের ভিত তৈরি করে। শিক্ষা হতে হবে সব নাগরিকের অধিকার এবং তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। অভিন্ন এবং উন্নত মানের শিক্ষা শ্রেণি, জাতি, লিঙ্গ, ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে একই সঙ্গে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য অভিভাবকদের আর্থিক দুশ্চিন্তা বা সংকটের সমাধান করতে হবে। 

অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে মৌলিক কিছু পার্থক্যের সূচনা করতে হবে সরকারকে। আগের সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পুলিশকে অনেক বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। কতিপয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক খাত। বিপরীতে যারা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য ও চাপের সম্মুখীন হয়েছেন তার মধ্যে প্রধানত হচ্ছে সর্বজনের জন্য প্রয়োজনীয় খাতগুলো। যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, নিয়োগ, অবহেলার কারণে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি শ্রমিকদের কথাও আমরা বলতে পারি। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে গেলে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দের বর্তমান চিত্র পরিবর্তন করে তা আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে আসতে হবে। জিডিপির শতকরা কমপক্ষে ছয় ভাগ বরাদ্দের ধারা তৈরি করলে ব্যয় বাড়বে বর্তমানের তিন থেকে পাঁচ গুণ। তার যথাযথ ব্যবহারের জন্য এই দুটি খাতে বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস দরকার আছে। পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে প্রয়োজনীয় সব খাতেই সংস্কারের কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার।

লেখক: শিক্ষাবিদ

গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী তরুণ নেতৃত্ব ও নাগরিক প্রত্যাশা

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩৯ পিএম
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী তরুণ নেতৃত্ব ও নাগরিক প্রত্যাশা
রায়হান আহমেদ তপাদার

বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য কেবল রাজনৈতিক সংকল্পই যথেষ্ট নয় বরং কার্যকর নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামোগত পরিবর্তন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস এবং জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এ রূপান্তর সম্ভব নয়। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সব শ্রেণির মানুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।...

আমাদের দেশের ইতিহাসে প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলন ও সামাজিক পরিবর্তনের মূল ভিত্তি ছিল সাম্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানও ছিল সেই ধারাবাহিকতার অংশ, যেখানে তরুণ প্রজন্ম রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি ন্যায্য সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য রয়ে গেছে। বৈষম্যের এ দুষ্টচক্র ভাঙতে গেলে গণ-আন্দোলনের পাশাপাশি প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তন। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, অসম উন্নয়ন এবং রাজস্ব বণ্টনের অসংগতি বৈষম্যকে আরও তীব্র করেছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অযোগ্যতা ও দুর্নীতির কারণে সাধারণ জনগণ কাঙ্ক্ষিত সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

 এ বাস্তবতায় এক নতুন অর্থনৈতিক রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা আজ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা আবারও নতুন এক স্বপ্নের মুখোমুখি হন, যেখানে তারা আশা করেছিলেন এক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার, যেখানে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হবে। পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলার মানুষ ভেবেছিল তারা পাবে ন্যায্য অধিকার, কিন্তু বাস্তবে তারা নতুন এক শোষণব্যবস্থার শিকার হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে শোষণের নীতিতে অটল থাকে, ফলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য আরও প্রকট হয়। সেই বৈষম্যের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তবে স্বাধীনতার পর পরই নতুন এক চ্যালেঞ্জ সামনে আসে- ধনতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্রের আদর্শিক দ্বন্দ্ব। রক্তাক্ত প্রক্রিয়ায় সে দ্বন্দ্বের একতরফা নিরসন হলেও নীতি ও বাস্তবতার পার্থক্যের ফলে এখনো সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বিদ্যমান।

চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এই তরুণরা চব্বিশের পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তারা রাজনৈতিক দল গড়ার মধ্য দিয়ে আরেক অধ্যায়ের জন্ম দিয়েছে। তরুণ নেতৃত্বের ডাকে সাড়া দিয়ে যেভাবে গত বছর সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, তার ফলেই দেড় দশকের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটে। এ কারণেই তরুণদের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি সে আস্থা কাজে লাগিয়ে কতটা রাজনীতি করতে পারবে; ভোটের মাঠের জটিল হিসেবে দলটি কতটা চমক আনতে পারবে, নিঃসন্দেহে তা দেখার বিষয়। মানুষের কাছে দলটি কতটা পৌঁছতে পারবে এবং মানুষকে তাদের এজেন্ডা কতটা বোঝাতে পারবে। দলটি যে বাংলাদেশ পন্থার কথা বলছে, সেটি নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের মানুষের ভাগ্য দেশের নাগরিকরাই নির্ধারণ করবে। নাগরিকদের দ্বারা এবং নাগরিকদের জন্যই বিশেষ করে যে রাজনীতি, তা দেশের মানুষকে জাতীয় নাগরিক পার্টি বোঝাতে পারলে জনভিত্তি তৈরি করাও সহজ হবে। দেশের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ। 

এ তারুণ্য আজ নানাবিধ সংকটে জর্জরিত। তরুণদের নেতৃত্বাধীন নাগরিক পার্টির এ বাস্তবতা ভালোই বোঝার কথা। সে জন্য তরুণদের অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষ কর্মসূচি দলটির থাকতেই হবে। তারুণ্যের বেকারত্ব আমাদের বড় সমস্যা। জাতীয় নাগরিক পার্টির তরুণ নেতৃত্বকে বেকারত্ব ঘোচাতে অভিনব ও বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে। অবশ্য কেবল তরুণদের জন্যই নয়, সব শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের জন্যও দলটির কর্মসূচি থাকতে হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখার কারণেই দলটির প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। ২০১৮ সালে তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ ছাত্র অবস্থায় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে অংশ নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।

একই বছরেই তারা কোটা সংস্কারের সফল আন্দোলন করেছিল। ২০২৪-এ এসে কোটা সংস্কার দিয়ে শুরু হওয়া তাদের আন্দোলন সরকার পতন পর্যন্ত গড়ায়। বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের পরও যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হয়নি, সেখানে তারুণ্য অল্প দিনেই আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে যে তরুণ সমাজ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে; বিগত সরকার নির্দয়ভাবে তাদের অনেককে হত্যা করে। অন্তত দেড় হাজার শহিদের কথা আমরা জানি। তাদের রক্তের ওপরেও দাঁড়িয়ে আছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। সে জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে শহিদদের আত্মত্যাগ তাদের স্মরণে রাখতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পার হওয়ার পরও জনপ্রত্যাশা পূরণের সরকার সে অর্থে দেখা যায়নি। জাতীয় নাগরিক কমিটি সেই স্থান পূরণ করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ এতটা সহজ নয়। তা ভেবেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

 বিদ্যমান রাজনৈতিক দলের বিপরীতে নাগরিক পার্টি কী বার্তা নিয়ে হাজির হচ্ছে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রচলিত ধারার রাজনীতিতে নেতাদের চাঁদাবাজি, দখল, টেন্ডারবাজি ইত্যাদি অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা যায়। জাতীয় নাগরিক পার্টির তৃণমূল হতে শুরু করে কেন্দ্র পর্যন্ত কোনো পর্যায়ের নেতা-কর্মীকে এ ধরনের অন্যায়ে যুক্ত হওয়া যাবে না। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃত্বে এসেছেন চিকিৎসক, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সরকারের উপদেষ্টা থেকে পদত্যাগ করে এসেছেন। অন্যান্য নেতৃত্বকেও মানুষ দীর্ঘ সময় না হলেও অনেক দিন ধরেই দেখে আসছেন। তারা অন্যায়ের কাছে আপসহীন হবেন এটাই প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে, রাজনীতির পথ খুব সহজ নয়। এখানে সাফল্য পেতে দীর্ঘ সাধনা প্রয়োজন, যেখানে জেল-জুলুম-নির্যাতনের শঙ্কা নিত্যসঙ্গী।

যারা রাজনীতি করেন, এটা ঘোষণা দিয়েই করেন- তারা দেশ ও দশের সেবা করতে চান। তাদের কাছে যেন নিজের উন্নতির চেয়ে দেশের উন্নতিই মুখ্য। তার ক্ষমতা পাওয়ার মূলেও রয়েছে দেশ আর সবার গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা। দিনশেষে জনগণের কাছে জবাবদিহির মানসিকতাও রাজনীতিকদের থাকা জরুরি। চব্বিশের জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থান বড় সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। দেশের অনেক জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন। অভ্যুত্থানের পর সে জন্যই সংস্কারের আলোচনা প্রধান হয়ে উঠেছে। নাগরিক কমিটির মতো অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারীদের দলের মাধ্যমেই সে সংস্কার বাস্তবায়ন হতে পারে। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে যে তরুণরা একদিন আন্দোলনে নেমেছে, আজ তারাই অভ্যুত্থানের মতো সাফল্য এনে দিয়ে দেশ গড়ার লক্ষ্যে রাজনীতিতে নিয়োজিত। সুতরাং দেশকে বৈষম্যমুক্ত করতে হবে। 

দেশের তরুণদের জন্য গতানুগতিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান নিয়ে গবেষণা করেই পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বৈষম্যহীন সমাজ রূপান্তরের জন্য যে অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রয়োজন তার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমতাবাদী করার উদ্যোগ নিতে হবে। জনক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সর্বক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়। কেবল আইন ও নীতির পরিবর্তন নয়, বরং প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে এমন প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে যাতে জনসাধারণের অংশগ্রহণমূলক শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার প্রসার ও স্বাস্থ্যসেবার সমতা না থাকলে সামাজিক বৈষম্য দূর করা সম্ভব নয়। বিশেষত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও শহরের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণির জন্য উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। উচ্চশিক্ষায় প্রবেশাধিকারকে আরও গণতান্ত্রিক করা প্রয়োজন, যাতে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে না পড়ে। 

একই সঙ্গে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে শ্রেণিভেদ দূর হয়। রাজস্ব আহরণের কাঠামোয় বৈষম্য দূর করতে হবে। ধনীদের ওপর আনুপাতিক হারে কর আরোপ এবং গরিবদের জন্য কর রেয়াত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। রাজস্ব ব্যবস্থায় বৈষম্য থাকলে সমাজে আয়বৈষম্য বাড়বে এবং ধনী-গরিবের ব্যবধান আরও গভীর হবে। নতুন রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্র পরিচালনায় তার রাজস্ব নীতিকে বৈষম্য নিরসনের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। স্থানীয় সরকারের ব্যাপক ক্ষমতায়ন করা প্রয়োজন। কারণ গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের কাঠামো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের অনুপস্থিতিতে ও জাতীয় সরকারের প্রাধান্যের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের উন্নয়ন অসমভাবে ঘটে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করলে স্থানীয় জনগণের চাহিদা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। 

নতুন রাজনৈতিক দলকে বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা বৃদ্ধি করার নীতি প্রণয়ন করতে হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের বৃহত্তর যুবসমাজের জন্য যথাযথ ও মানসম্মত কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা ব্যতীত বাংলাদেশ সামনে এগোবে না। নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে শিল্পায়ন, কৃষি ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বিকশিত করে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বেকারত্ব দূর না হলে সামাজিক বৈষম্য আরও প্রকট হবে। এ ক্ষেত্রে বৃহৎ শিল্পে অর্থায়নের পলিসি পরিবর্তন করে দেশে স্বল্প মূলধনী ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প (এসএমই) খাতে অর্থায়নের মাধ্যমে শিল্প সম্প্রসারণ করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে হবে। 

পাশাপাশি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা ন্যায্য পারিশ্রমিক পায়। স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সুরক্ষা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো নিশ্চিত করে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করা জরুরি। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রান্তিক মানুষ ও বিশেষত নারী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ও নাজুক হয়। টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের পাশাপাশি পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির উৎস ব্যবহার বাড়াতে পলিসি গ্রহণ করতে হবে। কৃষি খাত আধুনিকায়ন ও তরুণ প্রজন্মকে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহী করার পলিসি গ্রহণ করতে হবে। নতুন উদ্যোক্তাদের উৎপাদন পরিচালনার জন্য সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

 সাংগঠনিক সক্ষমতার জন্য তাদের উন্নত ও দক্ষ শিল্পায়িত দেশগুলোয় প্রয়োজন হলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বশেষ নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচি গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করা ভিন্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। রাজনৈতিক দলের অর্থায়নে স্বচ্ছতা, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র এবং নাগরিক অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে সুশাসনে সহায়ক হবে। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য কেবল রাজনৈতিক সংকল্পই যথেষ্ট নয় বরং কার্যকর নীতিমালা ও পরিকল্পনা প্রয়োজন। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাঠামোগত পরিবর্তন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাস এবং জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া এ রূপান্তর সম্ভব নয়। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য সব শ্রেণির মানুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
[email protected]

সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সুসংগঠিত করা জরুরি

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ০৫:২৫ পিএম
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সুসংগঠিত করা জরুরি
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে যেকোনো দেশের অর্থনীতি বাইরের পৃথিবীর পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। বহিঃখাত থেকে যে অভিঘাতগুলো আসে তা অভ্যন্তরীণভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করতে হয়। আমরা আজও আমাদের অর্থনীতিতে শক্ত ভিত্তির ওপর পুরোপুরি দাঁড়াতে পারিনি। ফলে অর্থনীতি একটা বড় রকম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আছে। দেশে খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সিন্ডিকেট করে মূল্যস্ফীতিকে আরও অসহনীয় করে তুলছে। এর পেছনে বিগত সরকারের অব্যবস্থাপনা বহুলাংশে দায়ী। কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ম্যানিপুলেশন করে বাজার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এটা যেন করতে না পারে, সেদিকটা লক্ষ রাখা জরুরি।

বাজার পরিস্থিতি সব সময়ই অস্থির করে তোলে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সেখানে সঠিকভাবে মনিটরিং না থাকার কারণেই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়। এই সমস্যা দ্রুত সামাল দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। মূল্যস্ফীতির কবলে পড়ে বিগত কয়েক বছরে বহু লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। কতসংখ্যক তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। নিম্নমধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের মান ক্রমাগত নিম্নমুখী হচ্ছে। এ পরিস্থিতি এখনই মোকাবিলা করতে হবে। তা না হলে এ সমস্যা দিনে দিনে আরও ভয়াবহ রূপ নেবে।

 বর্তমানে ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে আঞ্চলিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। এমতাবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী সুসংগঠিত করতে হবে। এটা ভেঙে পড়লে এই অস্থিরতা আরও বাড়বে। দেশে সরবরাহব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হারের অঙ্কটি অনেক বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে আসন্ন মন্দার ঝুঁকি এড়াতে ভোগ কমানোর চেয়ে বরং উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। আগের বিভিন্ন সময়ের মন্দা আমাদের দেখিয়েছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন দুর্বল থাকে, তখন লম্বা সময় ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে দেওয়া ঝুঁকি তৈরি করে। 

আমাদের এমন সব মধ্যমেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা করতে হবে, যেগুলোর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে এবং দরিদ্র ও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে আছে- এমন পরিবারকে সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের যথেষ্ট ব্যর্থতা আছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি বা বাজার ম্যানিপুলেশন করার জন্য সাধারণত কৃষক বা উৎপাদনকারী দায়ী নয়। দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ব্যবসায়িক শ্রেণি। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা সংঘবদ্ধ হয়ে বাজারকে অস্থিতিশীল করে থাকে। কৃষক উৎপাদন করে কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই কৃষক বা সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। দেশের সাধারণ মানুষ দিন আনে দিন খায়। হঠাৎ পণ্যের দাম বেড়ে গেলে তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের একটি অংশকে ঋণ করে জীবনযাত্রার বাড়তি খরচ মেটাতে হচ্ছে। 

এখন ভোক্তাঋণের সুদ বাড়ানোর ফলে তারা হয়তো চাপে পড়বেন। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করছে। দেরিতে হলেও আংশিকভাবে আমরা সেই পথে গেছি। তবে বিদ্যমান নীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে করমুক্ত আয়ের সীমা কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে। আমাদের কর সীমা বাড়ানো উচিত। বিগত বছরগুলোতে করমুক্ত আয়ের সীমা একই আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। আর সেটা করতে হলে রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত খুবই কম। এই অনুপাত অবশ্যই বাড়াতে হবে। যাদের টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) আছে, তাদের সবাই যাতে কর দেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। করের হার কমিয়েও কিন্তু রাজস্ব আদায় বাড়ানো যায়। 

দেশে আমদানি খরচ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া আরেকটা বড় রকম সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে রপ্তানি কিছুটা বাড়লেও আমদানির তুলনায় তা অনেক কম। ফলে বিশাল এক ধরনের বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। এখানে একটি বিষয় খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। দেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়েছে। যদি এটা হয়ে থাকে, তাহলে যে করে হোক তা বন্ধ করতে হবে। পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেলে রপ্তানিকারকরা লাভবান হন। প্রবাসীরাও বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হয়।

সে ক্ষেত্রে করের আওতা বাড়াতে হবে। যাদের সামর্থ্য আছে, তাদের সবার কাছ থেকে কর আদায় করতে হবে। নতুন নতুন খাতকে করের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা উদ্বেগজনক বলতে হবে। অর্থনীতি এখন একটা বেশ বড় সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলা যায়। দেশ থেকে অনেক টাকা পাচার হয়ে গেছে। সেগুলোর আইনি প্রয়োগে যথেষ্ট অবহেলা ছিল। আইনগুলো শক্তিশালী হওয়া দরকার ছিল কিন্তু তা হয়নি। এসব বিষয় অর্থনীতির ভিত্তিকে আরও দুর্বল করেছে। ফলে অর্থনীতি একটা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে; অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ আছে। অন্য সূচকগুলোর দিকে তাকালে স্বস্তির ব্যাপারও আছে। রপ্তানি আয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশ কিছুদিন ধরে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। যে কারণে অযথা ভয় বা আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরি না হয়ে আরও ঝুঁকির মধ্যে আছে। যা মানুষের জীবনযাত্রার মানকে অনেক বেশি নিচের দিকে নামিয়ে নিয়ে এসেছে। এমতাবস্থায় সচেতন হয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি আরও বেশি সমস্যাসংকুল হবে। মূল্যস্ফীতির ফলে আমাদের রপ্তানি-আমদানি কার্যক্রমগুলো ও বিনিয়োগ ব্যাহত হলে যেসব সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধান কঠিন হয়ে যাবে। অর্থনীতির সঙ্গে সমাজের অনেক মানুষ সম্পৃক্ত- নীতিনির্ধারক যারা আছে, যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করে, যারা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, প্রান্তিক মানুষের জন্য নিরাপত্তাবেষ্টনী বৃদ্ধি ও সুসংগঠিত করার পাশাপাশি অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগী হতে হবে। 

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ

নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ০৫:২২ পিএম
নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের সংস্কৃতি
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

জাতীয় রাজনীতি, শিল্প, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রখ্যাত ব্যক্তির নামে ঐতিহাসিক স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণের রীতি উন্নত-অনুন্নত প্রায় প্রতিটি দেশেই প্রচলিত রয়েছে। এটি কেবল একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়, এটি একটি দেশের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক চেতনার প্রতিফলন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাস্তা, ভবন, প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিস্তম্ভ, শহর কিংবা পুরো দেশের নাম পরিবর্তনের ঘটনা দেখা যায়।

 এই পরিবর্তনগুলোর পেছনে থাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ঐতিহাসিক পুনর্মূল্যায়ন, সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠা বা ঔপনিবেশিক অতীত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। নামকরণ ও নাম পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা সমাজের মূল্যবোধ ও আদর্শকে প্রকাশ করে। কিন্তু শুধু সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশে বা দলবাজির কারণে নাম বদলের খেলা বোধহয় বাংলাদেশে ছাড়া অন্য কোথাও প্রদর্শিত হয় না। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নাম পরিবর্তন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অবশ্য নাম বদলের এই ঐতিহ্য আমরা উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো কোনো সময় সংকীর্ণ দলীয় চিন্তার ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় নেতাদের সম্মানার্থে নামকরণের প্রবণতা দেখা গেছে। একসময় রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে সুন্দর এলাকাটির নাম রাখা হয় শেরেবাংলা নগর, ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের নাম দেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের সবচেয়ে প্রশস্ত অ্যাভিনিউয়ের নাম রাখা হয় মানিক মিয়া (তফাজ্জেল হোসেন, যিনি ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের অকুতোভয় সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব) অ্যাভিনিউ। এসব নামকরণ বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক মাত্রা পেয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতিতে ক্রমেই নামকরণ ও নাম বদলের খেলাটি প্রতিযোগিতায় রূপ লাভ করেছে। 

নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র বিমানবন্দরের নাম ছিল তেজগাঁও বিমানবন্দর। ১৯৭৯ সালে ঢাকার অদূরে কুর্মিটোলার আন্তর্জাতিক মানের নতুন একটি বিমানবন্দর চালু হলে তার নাম রাখা হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ১৯৮১ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়ার নামানুসারে তদানীন্তন বিএনপি সরকারের নাম দেয় জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। কিন্তু ২০১০ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় শাসনামলে বিমানবন্দরটির নাম বদলিয়ে রাখা হয় ‘হযরত শাহজালাল (রা.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।’ এই নাম পরিবর্তনের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয় যে এ দেশের মানুষ যেহেতু সুফি-আউলিয়াদের শ্রদ্ধা করে, সেহেতু একজন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের স্মৃতি রক্ষার্থে এই নামকরণ হয়েছে। এ ছাড়া মন্ত্রিসভার এক সিদ্ধান্তে বলা হয়, যেহেতু হাইকোর্ট কর্তৃক পঞ্চম সংবিধান বাতিল এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা জবরদখলকারী অবৈধ শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেহেতু তার নামে স্থাপনা বা প্রতিষ্ঠান রাখা যাবে না। 

শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে উন্নীত করে স্বাধীনতা ঘোষণার পাঠক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের নামানুসারে রাখা হয় ‘এম এ হান্নান বিমানবন্দর’। পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সে নাম পাল্টিয়ে রাখে ‘শাহ্ আমানত বিমানবন্দর’। এ নাম এখনো বহাল রয়েছে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নির্মিত ভৈরব সেতুর নাম পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নামানুসারে রাখে ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু’। জোট সরকার ওই নাম পরিবর্তন করে রাখে ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু’। এই সেতু উদ্বোধনকালে বিএনপি নেতা সাইফুর রহমান মন্তব্য করেন, ‘কোথাকার কে নজরুল ইসলাম, ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’। শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ‘বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটর’ নাম দিয়ে দেশের প্রথম নভোথিয়েটরটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কর্তৃক উদ্বোধনের সময় এর নাম দেওয়া হয় ‘মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নভোথিয়েটার’। কিন্তু শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতার এসে বঙ্গবন্ধু নামটি পুনঃস্থাপন করেন। এভাবে অসংখ্য নামকরণ এবং নাম পরিবর্তনের বিষয়টি নিজেদের দলীয় সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। বিশেষ করে একই ব্যক্তির নামে অসংখ্য স্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করার বিষয়টি অতিমাত্রায় দেখা গেছে। যেটি দেশের মানুষ কোনোভাবেই ইতিবাচক হিসেবে দেখেনি। 

ধারণা করা হয়েছিল, ২০২৪-এর আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নামকরণের এই নেতিবাচক প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেষ হবে। এমনকি পরস্পরকে দোষারোপ বা ঘায়েল করার সংস্কৃতিও শেষ হবে। কিন্তু বিগত সময়ের রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতোই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে নাম পরিবর্তন কিংবা নামকরণের। কিছুদিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার শুধু পুরোনো ধারার রাজনীতি উৎসাহিতই করছে না; কোনো কোনো ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার শাসনের চিহ্ন মোছার নামে বাঙালির ইতিহাসকে মুছতে শুরু করেছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আমাদের চোখে পড়ছে। এ বিষয়ে খুলনা এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণ সামনে আনা যেতে পারে। 

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু হলের নাম পরিবর্তন করে শাহ আজিজুর রহমানের নাম দেওয়া হয়েছে। সব মহলেই এ বিষয়ে সমালোচনা হচ্ছে যে বাংলাদেশের একজন স্বাধীনতাবিরোধীর নামে নামকরণ করার বিষয়টি কোনোভাবেই মানানসই নয়। এ ছাড়া উল্লেখ্য, গত ৮ ফেব্রুয়ারি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৯টি স্থাপনার নতুন নামকরণ করা হয়েছে। এটা করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, কবি জীবনানন্দ দাশ, লালন সাঁই, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, শহিদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, জি সি দেব, ডা. আলীম চৌধুরীসহ বেশ ক’জন ক্ষণজন্মা মনীষীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, যারা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঙালি জাতিসত্তার মনন নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন। বিষয়টি নিয়ে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই এটিকে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে মুছে ফেলার একটি প্রয়াস হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। 

বিগত সরকার বা অন্যান্য সরকার কোনো বিজ্ঞানী, কোনো মনীষীকে বিগত সরকার সম্মান দিয়ে বিভিন্ন স্থাপনার নামকরণ করেছিল- সেটিকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে পারি। যেসব বিজ্ঞানী কিংবা মনীষী তাদের কাজের মাধ্যমে যুগে যুগে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ঋদ্ধ করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কোনো স্থাপনার নামকরণ নিছক শেখ হাসিনার আমলে হয়েছিল বলেই তা মুছে ফেলতে হবে- এটি কোনো যৌক্তিক কার্যক্রম হতে পারে না। আবার নামকরণের বা পরিবর্তনের এই সংস্কৃতিতে কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর নাম বসানোর বিষয়টিও দেশের মানুষ ভালোভাবে নেবে না বা নিচ্ছে না। বিগত সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সরকারগুলো মূলত প্রতিহিংসা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে নামকরণ ও নাম হরণের প্রতিযোগিতা শুরু করে। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসেও এমন সংস্কৃতি বজায় থাকার বিষয়টি কোনোভাবেই ন্যায্য এবং যুক্তিসংগত নয়। 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ 
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

বিশ্বব্যাপী শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে

প্রকাশ: ১৯ মার্চ ২০২৫, ০৮:৩৬ পিএম
বিশ্বব্যাপী শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে

১৯৪৫ সালে লীগ অব নেশনস ব্যর্থ হওয়ার পর মানবতাকে আত্ম-ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল সম্মিলিত নিরাপত্তার জন্য একটি সাহসী পরীক্ষা। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ রোধ করতে এবং সহিংসতার পরিবর্তে কূটনীতির মাধ্যমে সংঘাত পরিচালনার জন্য এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
তবুও, ৮০ বছর পরে আমরা নিজেদের বিপর্যয়ের প্রান্তে দেখতে পাচ্ছি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করেছে; যা বিজ্ঞানীরা দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় বিপৎসীমা হিসেবে দেখেন। প্রতিষ্ঠান এবং গণতন্ত্রের ওপর জনসাধারণের আস্থা অত্যন্ত কমে গেছে এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। কী হয়েছে?

জাতিসংঘ বিভিন্ন কারণে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। সহিংসতা, সংঘাত এমনকি গণহত্যার মতো ঘটনা এখনো উদ্বেগজনকভাবে ঘটছে। সংস্থাটি গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে সাধারণত অকার্যকর, অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক এবং অন্যায্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

সমস্যাটি হলো জাতিসংঘ একবিংশ শতাব্দীর মৌলিক সমস্যাগুলোর ওপর বিংশ শতাব্দীর যুক্তি উপস্থাপন করে যাচ্ছে। আজকের সবচেয়ে জরুরি চ্যালেঞ্জগুলো- যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক সংক্রমণ এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত যা কোনো সীমানা মেনে চলে না। তবুও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো ঈর্ষান্বিতভাবে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী জাতি রাষ্ট্রগুলোর কাঠামোর মধ্যে আটকে আছে। আমাদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল জাতীয় সীমানা সম্পর্কে পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য তৈরি করা হয়নি। জাতিসংঘ কেবল ধীরগতির নয়, এটি কাঠামোগতভাবেও এই ধরনের সমস্যাগুলো ব্যাপকভাবে মোকাবিলা করতে অক্ষম।

ক্রমবর্ধমান উপজাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবাদের মুখে প্রচলিত শাসন কাঠামোও যখন ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে, তখন প্রচলিত শাসনব্যবস্থার যে কোনো প্রস্তাবিত নতুন দৃষ্টান্ত ইউটোপিয়ানরা শুনতে চায় না। সৌভাগ্যবশত, বিশ্বের ইতোমধ্যেই একটি কার্যকর সংস্থা রয়েছে তা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সব ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এই ব্লকটি প্রমাণ করেছে যে, জাতীয় ফেডারেশন কাজ করতে পারে। যুদ্ধরত দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে সার্বভৌমত্বকে একত্রিত করার সুযোগ দিয়েছে। এটি তেমন কোনো মৌলিক ধারণাও নয়। ১৯৪৬ সালের গলআপ জরিপে, ৫৪ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করেছিলেন যে, ‘জাতিসংঘকে শক্তিশালী করা উচিত যাতে এটি এমন একটি বিশ্ব সরকারে পরিণত হয় যার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব জাতির সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে’।

২০২৪ সালে ৫৮ শতাংশ আমেরিকান মনে করতেন, জাতিসংঘ ‘খারাপ কাজ’ করছে। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় জাতিসংঘকে আরও সাহসী ভূমিকা পালন করা উচিত। দার্শনিক টিমোথি মর্টন বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো বৃহৎ সমস্যাগুলোকে ‘অতি-বস্তু’ বলেছেন। এগুলো ‘এত ক্ষণস্থায়ী এবং স্থানিক মাত্রার সত্তা’ যেগুলোর জন্য মৌলিকভাবে ভিন্ন ধরনের মানবিক যুক্তি প্রয়োজন। এ ধরনের সমস্যাগুলো সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করার জন্য বুদ্ধিগত এবং মানসিক উভয় পরিবর্তনের প্রয়োজন। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন যাকে ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ বলেছিলেন।

বুদ্ধিগতভাবে চিন্তা করলে ইহজাগতিক চিন্তাভাবনার জন্য নিজস্ব তাত্ত্বিক কাঠামো প্রয়োজন। এই দাবি নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীতে, জন মেনার্ড কেইনস বিশ্বব্যাপী মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন এবং ডলারকেন্দ্রিক ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিস্থাপনের জন্য ‘ব্যাংকর’-এর প্রস্তাব করেছিলেন। হান্না আরেন্ডট রাজনীতির বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকেও এগিয়ে নিয়েছিলেন। পিয়েরে টেলহার্ড ডি চার্ডিন ‘নুস্ফিয়ার’ (সম্মিলিত মানব চেতনা) সম্পর্কে তার ধারণাটি দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক স্কলারশিপে ‘গ্রহের সীমানা’ সম্পর্কে জোহান রকস্ট্রমের কাজ থেকে শুরু করে ব্রুনো লাটোরের পরিবেশগত যুগের বর্ণনা পর্যন্ত- নতুন গ্রহগত দৃষ্টান্তের বৌদ্ধিক উপাদানগুলো একত্রিত হতে শুরু করেছে।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাদের একটি নতুন আখ্যানের প্রয়োজন। ঐতিহাসিক জুবাল নোয়া হারারি যুক্তি দেন যে, মানবসভ্যতা জাতীয়তাবাদ এবং পুঁজিবাদের মতো সাধারণ মিথের ওপর গড়ে উঠেছে। এই পৃথিবীর শাসনব্যবস্থার সুফল পেতে হলে এটিকে নতুনভাবে সাজাতে হবে। সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কে পুরানো ধারণার বাইরে গিয়ে মানবতার আন্তসংযোগকে স্বীকৃতি দিতে হবে।

মানুষ যেখানে আছে সেখান থেকে উঠে আসার জন্য উন্নত চিন্তাভাবনার সঙ্গে শক্তিশালী স্থানীয় চিন্তাভাবনাও থাকতে হবে। বার্গগ্রুয়েন ইনস্টিটিউটের জোনাথন ব্লেক এবং নিলস গিলম্যান বলেছেন, আমাদের শাসন কাঠামোর উন্নতির জন্য ‘ওপরে এবং নিচে’ উভয় দিকেই নজর রাখতে হবে। জাতিরাষ্ট্র একটি উপাদান হিসেবে থাকবে। তবে শহর, অঞ্চল ও স্থানীয় নেটওয়ার্কগুলোকে আরও মনোযোগ দিতে হবে এবং কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে একীভূত করা হবে। এই ধরনের নেস্টেড পদ্ধতি অর্থাৎ বসে থাকা জাতি রাষ্ট্রের পুরানো ব্যবস্থার বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে ভাবতে হবে। 
২০০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয় থেকে শুরু করে মহামারি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তাতে জাতিসংঘের ব্যর্থতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জাতিসংঘ নিজেই লিগ অব নেশনসের খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন জাতিসংঘকে নতুন করে গড়ে তোলার সময় এসেছে। শাসনব্যবস্থাকে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার জাতিরাষ্ট্রভিত্তিক যুক্তি থেকে ব্যাংকরের  সংবেদনশীলতার দিকে পরিচালিত করতে হবে। এমনকি যদি জাতিসংঘ বিশ্বের জাতিগুলোকে একত্রিত করতে সফল হয়, তবুও এর বর্তমান নকশা বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হবে। আমাদের পৃথিবীর বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীভূত নতুন সম্প্রদায়গুলোকে কল্পনা করার সময় এসেছে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন অধ্যয়ন বিভাগ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি সদস্য। আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল