
মোদির এবারের মার্কিন সফর নিয়ে বাংলাদেশেও সমান কৌতূহল। ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির আলোচনায় আমেরিকার প্রসাদ ওঠে কি না, তা নিয়ে তুমুল কৌতূহল ছিল। বাংলাদেশের ভার ট্রাম্প পুরোপুরি মোদির ওপর দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে ভারত ও আমেরিকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা খাতে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থান আরও সুদীর্ঘ হবে।...
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ট্রাম্প জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বিষয়টি তিনি মোদির ওপর ছাড়ছেন। ওই দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে আমেরিকার কোনো গুপ্ত ভূমিকা নেই বলেও দাবি করেছেন তিনি।
মোদির এবারের মার্কিন সফর নিয়ে বাংলাদেশেও সমান কৌতূহল। ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির আলোচনায় আমেরিকার প্রসাদ ওঠে কি না, তা নিয়ে তুমুল কৌতূহল ছিল। বাংলাদেশের ভার ট্রাম্প পুরোপুরি মোদির ওপর দিয়েছেন।
ট্রাম্প প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার পরও বাংলাদেশ নিয়ে সরাসরি নাক গলাতেন না। ভারতের সঙ্গে সমন্বয় করে চলত মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক। এবারও সেই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটালেন না ট্রাম্প। যা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বেশ চাপের বলেই মনে করা হচ্ছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাবেক মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ। অন্যদিকে হিলারির সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক একেবারেই জানা নয়। ঘটনাক্রমে ট্রাম্প এমন একসময় বাংলাদেশ নিয়ে মোদিকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার দিয়েছেন, যখন শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে ভারতের ওপর চাপ গড়াতে চাইছে ঢাকা।
শুধু ট্রাম্প নয়, সদ্য নিয়োগ পাওয়া মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা অধিকর্তা হিন্দু মার্কিনি তুলসী গ্যাবার্ডের সঙ্গে মোদির আলোচনাতেও এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। তুলসী ইতোপূর্বে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় মুখ খুলেছেন।
গত বৃহস্পতিবার ট্রাম্প-মোদির বৈঠকের কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ফোন করেন ট্রাম্পের বন্ধু ইলন মাস্ক। তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে তা জানায়নি বাংলাদেশ প্রশাসন। তবে মনে করা হয় একটি ব্যবসায়িক ডিল নিয়ে কথা হয়েছে।
ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বাংলাদেশে তাদের সব প্রকল্পের কাজ বন্ধ করতে নির্দেশিকা জারি করে। বাংলাদেশকে আর্থিক সাহায্য তো বটেই, সে দেশের মাটিতে আমেরিকার তরফে সব উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এই পদক্ষেপের কয়েক দিনের মধ্যেই দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছেন মোদি-ট্রাম্প। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সাফ জানিয়ে দেন, ‘হাসিনার পতনের নেপথ্যে আমেরিকার কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি দীর্ঘদিন কাজ করছেন, তাই এই বিষয়টি তার ওপরেই ছেড়ে দিলাম।’ পরে বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি জানান, বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তার কারণ রয়েছে। সেগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে জানিয়েছেন মোদি।
মার্কিন মুলুক থেকে প্রত্যেক বেআইনি অনুপ্রবেশকারী নাগরিককে ফিরিয়ে নেবে ভারত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর এই কথাই জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার সাফ কথা, বেআইনিভাবে প্রবেশ করে বিশ্বের কোনো দেশেই থাকার অধিকার নেই। সেই সঙ্গে জানালেন, আমজনতাকে ভুল বুঝিয়ে পাচার করা হচ্ছে।
গত সপ্তাহে হাতকড়া পরিয়ে, পায়ে শিকল বেঁধে আমেরিকা থেকে ফেরানো হয়েছিল ১০৪ ভারতীয়কে। তারপর এই প্রথমবার অনুপ্রবেশকারীদের ফেরানো প্রসঙ্গে কথা বলতে শোনা গেল মোদিকে। মার্কিন মুলুকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তিনি বলেন, ভারতের দরিদ্র যুবকদের ভুল বুঝিয়ে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। অতি সাধারণ পরিবারের সন্তানদের বড় বড় স্বপ্ন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। অনেকে জানেও না কেন তাদের এভাবে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। অনেককে পাচার করে দেওয়া হয়েছে।
মোদি আরও বলেন, মানব পাচারের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে কাজ করতে হলে ভারত এবং আমেরিকাকে। পাচার চক্রকে নির্মূল করতে ‘যুদ্ধে’ নেমেছে ভারত। প্রধানমন্ত্রীর আশা, এই যুদ্ধে সর্বতোভাবে সাহায্য করবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। প্রসঙ্গত, প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসেই ‘অনুপ্রবেশকারী হটাও’ অভিযান শুরু করেছেন ট্রাম্প। মার্কিন মুলুক থেকে ‘তাড়ানো’ হচ্ছে শয়ে শয়ে মানুষ। উল্লেখ্য, মোদি বরাবর ভারত থেকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের সরানোর কথা বলেছেন। তাই মার্কিন মুলুক থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
এদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি শুল্ক নিয়ে আলোচনা করেন। ভারত-মার্কিন ক্ষুদ্র বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও আলোচনা হয়। মোদির সফরের প্রাথমিক লক্ষ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি এড়ানো।
এ ছাড়া ট্রাম্প ইতোমধ্যে চীন থেকে আমদানির ওপর ১০ শতাংশ হারে ব্যাপক শুল্ক আরোপ করেছেন, ফলে বেইজিং আমেরিকান জ্বালানির ওপর শুল্ক আরোপ করতে বাধ্য হয়েছে। ভারত বিলাসবহুল গাড়ি এবং সোলার সেলসহ ৩০টিরও বেশি পণ্যের ওপর সারচার্জ নিয়ে পর্যালোচনা করছে। ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনার খবরের পর ধাতব স্টকগুলোর শেয়ারের দাম কমেছে। ভারতের এক শিল্পপতি মন্তব্য করেছেন, ট্রাম্প প্রস্তাবিত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলে দেশটির প্রকৌশল পণ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ রপ্তানি ঝুঁকির মুখে পড়বে। এর মধ্যে রয়েছে ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়াম এবং মূল্য প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার। তিনি আরও মন্তব্য করেন, আমরা অপেক্ষা এবং দেখার নীতিতে রয়েছি এবং আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে।
আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিরক্ষা বিষয়েও বিশদ আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে। আমেরিকায় লুকিয়ে থাকা ভারতের শত্রুদের ভালো দিন এবার শেষ হতে চলেছে। যারা আমেরিকায় লুকিয়ে বসে ভারতের মাটিতে অপরাধ ও নাশকতা সংঘটিত করে তাদের কঠিন সময় আসতে চলেছে। তাদের কুকীর্তির কুণ্ডলী তৈরি করেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। আমেরিকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বিষয়টি কার্যকরী করার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মপরিকল্পনাও তৈরি করা হয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো আমেরিকায় লুকিয়ে বসে ভারতে নাশকতা চালানো ১২ গ্যাংস্টারের তালিকা এবং তাদের কাজকর্মের কুণ্ডলী তৈরি করে।
নরেন্দ্র মোদি এই তালিকা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শেয়ার করেছেন বলে জানা গেছে। আমেরিকাকে ওই সব গ্যাংস্টার সম্পর্কে সচেতন করার উদ্দেশ্যই হলো তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়া। আশা করা হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির সফরের মধ্য দিয়ে ভারত ও আমেরিকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা খাতে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের অবস্থান আরও সুদীর্ঘ হবে।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক