
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। তিনি ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হন। পরবর্তীতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৭০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। এ ছাড়া তিনি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র (সিরডাপ)-এর গবেষণাপ্রধান হিসেবে কাজ করেন। তিনি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড)-এর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, রাজস্বনীতি, মানবসম্পদ উন্নয়ন, তুলনামূলক উন্নয়ন অভিজ্ঞতাসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে কথা বলেছেন খবরের কাগজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজ-এর সম্পাদক মোস্তফা কামাল
খবরের কাগজ: অনুকূল পরিবেশ না থাকায় দেশের ব্যবসায়ীরা বেশ হতাশা প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে একটা বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, বড় বড় ব্যবসায়ীরা টাকা-পয়সা ব্যাংক থেকে নিয়েছেন। ব্যাংকে পর্যাপ্ত তারল্য সংকট। যে কারণে ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৬ থেকে ৭ শতাংশ ঋণখেলাপি। গরপরতা যদি ১৬ শতাংশ বলি, কিছু কিছু ব্যাংক বলে ৪০-৫০ শতাংশ। ৪ থেকে ৫ শতাংশের বেশি ভালো ব্যাংক নেই। ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধা পাচ্ছে না। এটা একটা সমস্যা। যদিও আমরা ২২ হাজার কোটি টাকা আগে দিয়েছি কয়েকটা ব্যাংককে। মানুষের ডিপোজিটের টাকা পরিশোধের জন্য এটি দেওয়া হয়েছে। এখানে চেকের প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে যায়। আমরা যা দিয়েছি তা পর্যাপ্ত নয়। ২২ হাজার কোটি টাকা বেশি নয়। আমাদের দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ব্যবসায়ীরা সময়মতো ঋণ পাচ্ছে না। সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনিতে তারা ঋণ কম পায়। আগে তাও সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত, দেশে ব্যবসায়ীরা ভয়ে কিছু করতে চাচ্ছে না। তারা দেখছে চোখের সামনে ব্যবসায়ীরা পালিয়ে গেছে। ওরা ভাবছে, এখন ব্যবসায় ঢুকলে আমাকে মনিটর করবে ব্যাংক। এরকমও হয়েছে- নরসিংদীর এক লোক আড়াই হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। তাকে কেউ চেনেও না। এখন এগুলো করা সম্ভব নয়। ব্যবসায়ীরাও জানে আমাদের ঋণ দেবে ব্যাংক, তাহলে এজেন্সিরা আমাদের তদারকি করবে। এনবিআর টাকা আদায়ে পদক্ষেপ নেবে। আগে আর্থিক লেনদেনগুলো ছিল অনেকটাই অস্বচ্ছ। এজন্য বন্ধ থাকত অনেক কিছু। তবু আমরা বলছি, এসব বিষয়ে চিন্তা করার দরকার নেই।
ভালো ব্যবসায়ীরা সব সময় ভালো ব্যবসা করে। একটু সময় লাগবে। ওরাও এক সময় এলসি প্রক্রিয়ার মধ্যে আসবে। অনেক শিল্পকারখানা নষ্ট হয়ে গেছে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়। এরপরও বলব, ব্যবসায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। আমদানি কিছুটা বেড়েছে। মেশিনারি আমদানি তেমন হয়নি। তবে সর্বপরি আমদানি কিছুটা ভালো হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করতে হবে।
খবরের কাগজ: বর্তমানে দেশে আমদানি-রপ্তানি পরিস্থিতি কেমন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: যদিও অনেকে বলেছে, রপ্তানি খারাপ। আসলে তা নয়। এটি অনেক ভালো অবস্থানে আছে। ছোট ছোট জায়গায় তারা সাব-কনট্রাক্ট করে। বাংলাদেশে শুধু আরএমজিতে গ্রিন ফ্যাক্টরি অনেক। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বড় চ্যালেঞ্জ। প্রধান ইস্যু হলো ব্যবসায়ের পরিবেশ, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার পলিসিগুলো কেমন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের আগে এসব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। মাঝখানে এয়ারলাইন্সের কিছু ঝামেলা হলো। টাকা-পয়সা নিতে পারেনি। এয়ারলাইন্স যদি লাভ করে তবে বাংলাদেশ ব্যাংক অডিট বোর্ড দেখে রিলিজ করে। গ্রামীণ ফোনের টাকা অনেকদিন ধরে পাঠাতে পারে না। সেভরনের টাকারও একই অবস্থা। তার পর মেটলাইফ আছে। তারাও বলছে একই কথা। তবে নিয়ম আছে, অ্যালাউ বা গ্রহণ করতে হবে। নিষেধ করা যাবে না। বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা যাতে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ পায়, কোনো ধরনের ঝক্কি-ঝামেলায় না পড়ে, সে জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো যেন আরও বন্ধুসুলভ হয়। আবার কাস্টমসের ব্যাপার আছে। আয়কর ও শুল্কে তথ্য দিতে ভুল হলে সময়ক্ষেপণ হয়। যা ব্যবসায়ীরা পছন্দ করেন না। পোর্টে আগে ছিল এ ধরনের সমস্যা। এখন এটা ঠিক হয়েছে। এখন একদিন বা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাস্টমসে চালান জমা দেওয়া হয়ে যাচ্ছে। আমরা একটা ন্যাশনাল উইনডো চালু করেছি। অর্থাৎ, সব তথ্য অনলাইনে দেওয়ার পর এনবিআর তা যাচাই-বাছাই করবে। চালান জমা, কপি দেওয়া, এগুলোতে দীর্ঘ সময় লাগে। এটা করলে কিছুটা সময় লাঘব হবে। এটা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ। প্রাইভেট সেক্টরের জন্য বাইরে থেকেও চেষ্টা করছি। ওপেক ফান্ডে আমি কথা বলেছি, তারা ১০০ মিলিয়ন দেবে। কোন কোন শিল্পকারখানায় অর্থ দেওয়া হবে তা তারা নির্ধারণ করবে। প্রাইভেট সেক্টরে কোন কোন ব্যাংককে দেবে সেটিও তারা নির্ধারণ করে থাকে। তাদের কয়েকটা ব্যাংক নির্ধারণ করা আছে। এর বাইরে তারা যাবে না। এ ক্ষেত্রে তাদের বেশকিছু বিষয় রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছি- একটা গ্যারান্টি দেবে ১ বিলিয়ন ডলার। সেটাও আবার প্রাইভেট ব্যাংক। ব্যাংক এলসি করবে এবং গ্যারান্টি দেবে। এতে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান লাভবান হবে।
খবরের কাগজ: তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। আপনি জানেন, বেকারদের একটা বড় অংশ এখানে ব্যবসা করছে। শেয়ারবাজারে বিদ্যমান অস্থিরতা দূর করার উপায় কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শেয়ারবাজার এখন নাজুক পরিস্থিতিতে আছে। এখানে বেশির ভাগ যারা বিনিয়োগ করেছে, তারা প্রতিদিন সেক্রেটারি কমিশনের চেয়ারম্যানের পদত্যাগ চায়। সমস্যা এখানে সেক্রেটারি কমিশনের চেয়ারম্যানের নয়। সমস্যা হলো পুঁজি মার্কেটে ফ্লোর কাস্ট দিয়েছে। ফ্লোর প্রাইজ আছে। নামলে হয়তো অর্ধেক চলে যাবে। আর জেড ক্যাটাগরির শেয়ারগুলোর এজিএমও হয় না। আগে খুব বিক্রয় হতো, এখন ফ্যাক্টরিই নেই। এখন চেয়ারম্যান আসার পর জেড ক্যাটাগরির শেয়ার কেউ কেনেও না, রিটার্নও দেয় না। সবাই শেয়ার কেনে না। প্রফিটেবল কোম্পানির শেয়ার সবাই কেনে না। এটা ব্লশিপ শেয়ার। আমরা চেষ্টা করছি, শেয়ার মার্কেটের উন্নতির জন্য। সাকিবের মতো লোক, তাকে ৪০ লাখ টাকা জরিমানা করল। তিনি কি জানতেন শেয়ার মার্কেটে ঝামেলা হয়। নিয়াজ মোরশেদেরও কোটি কোটি টাকা। তাকেও তো ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।
খবরের কাগজ: এবারের বাজেট কেমন হবে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এবার আমরা একটা রিভাইজ বাজেট করছি। বৈদেশিক বিনিময় বাড়াতে এক্সপোর্ট ডাইভারসিটি করতে চেষ্টা করব। এখন তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। এটির ওপর নির্ভর করা ঠিক না। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জ্বালানি প্রণোদনা। এ ক্ষেত্রে অনেক ভর্তুকি দিতে হবে। এবার ৪০ হাজার কোটি টাকা দিতে হয়েছে। পেট্রোল, কৃষিতে সার- এর জন্য ভর্তুকি দিতে হয়। সার যে দামে কেনা হয়, সে দামে কৃষক পায় না। তার থেকে অনেক কমে পায়। বাজেট খুব বড় হবে তা নয়। সেখানে কিছুটা কৃচ্ছ্রসাধন হবে। তবে পরিচালন ব্যয় কমানো যাবে না। আমরা বেতন-ভাতা দিই, ঋণের সুদহার আছে। এগুলো কমানো যাবে না। সে কারণে বাজেট কিছুটা ছোট করব। বড় বড় মেগা প্রকল্প হবে না। এ ক্ষেত্রে দেশি ও আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীর অর্থ প্রয়োজন হয়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমাদের বাজেটে সম্পদ নেই। জিডিপি ট্যাক্সে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ আছে। ভুটানে ১২%, জাপানে ২১ থেকে ২২%। আবার ফিনল্যান্ডে ৫০% ট্যাক্স হিসেবে দিয়ে দেয়। এর সুবিধা স্যোশাল বেনিফিট। উন্নত দেশগুলোতে ট্যাক্সের টাকায় তাদের প্রচুর সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। যেমন বৃদ্ধ বয়সে ওষুধ-হাসপাতাল অর্থাৎ ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। যদিও তাদের দেশে ট্যাক্সের পরিমাণ বেশি। আমাদের দেশে এ পর্যায়ে আসতে সময় লাগবে। কারণ আমাদের দেশে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রগুলো এখনো বিস্তৃত নয়। কী পরিমাণ ট্যাক্স আদায় হলো তার সঠিক পরিসংখ্যানও উঠে আসে না।
অনলাইন করাতে ট্যাক্সের বিষয়গুলো বুঝতে অনেকের অসুবিধা হচ্ছে। এ কারণে সময় বাড়াতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক স্টেটমেন্ট সময়ের পরে হলেও মেনে নিতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ করতে সময় বৃদ্ধি প্রয়োজন। ট্যাক্স আইনজীবীদের মতে, এখনো তারা অনেককিছু করতে পারেনি। ইতোমধ্যে ১২ লাখ লোক অনলাইনে রিটার্ন জমা দিয়েছে। গতবারের চেয়ে এবার অনেক বেশি। এটি আরেকটু বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১২ লাখ খারাপ নয়। কোম্পানির জন্য অনলাইনে রিটার্ন জমা এখনো বাধ্যতামূলক করিনি। কোম্পানিগুলোকে অনেক তথ্য দিতে হয়। তাদের বিভিন্ন লাইসেন্স দিতে হয়, না হলে ট্যাক্সের নাম নির্ধারণ করা যায় না। অতএব, এটা একটা বড় মোবিলাইজেশন। অতিদ্রুত খরচ কমাতে পারব না। এছাড়া বড় প্রকল্পগুলো অব্যাহত রাখার ব্যাপারে এডিবি, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক রাজি হয়েছে। এখন আমাদের বাজেটের ব্যাপারে নেটটা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। আরেকটা বিষয়, বাজেট যেন বাস্তবধর্মী হয়। কিছু বড় প্রকল্পের প্রয়োজন রয়েছে। অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ খাত এগুলোতে খরচ করতেই হবে। আবার বৈদ্যুতিক লাইন, কিছু পাইপ লাইন পুরাতন হয়ে গেছে, সেগুলো রিপ্লেস করতে হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থানে যদি আয় না থাকে তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি হবে। গত এক বছরে মালয়েশিয়া, দুবাই, আবুধাবি, কাতার, ওমানে লোক নিচ্ছে না। শুধু সৌদি আরব নিচ্ছে। আর ইতালিতে যাচ্ছে। সেটিও বৈধভাবে হচ্ছে না। জাহাজ দিয়ে, সাঁতার কেটে অবৈধভাবে যাচ্ছে বেশি। ইতালিতে বড় সংখ্যক কর্মী রয়েছে। আমাদের রাজস্ব চাপ বাড়ছে। সে কারণে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। কিন্তু সোশ্যাল সেক্টরে এগুলো সম্ভব নয়। এটা অবশ্য দাতারা বলছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক বিষয়গুলো কমাতে পারবে না। আমি যদি স্বাস্থ্য খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে দিই তাহলে বাজেটে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কমালে অনেক হাসপাতাল, অনেক মেডিকেল সেন্টার বন্ধ হয়ে যাবে। একইভাবে শিক্ষায়ও সমস্যা আছে। এরপর আইটিতে সমস্যা রয়েছে। আগে সরকারের যত টাকা খরচ হয়েছে, এসব টাকা মুষ্টিমেয় কয়েকজনের কাছে চলে গেছে।
খবরের কাগজ: কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে আপনার পরিকল্পনা কী?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আমাদের দেশে তরুণরা স্বউদ্যোগে কাজ করছে। তারা অনেক কষ্ট করছে। আইটি এমন একটি বিষয় যাতে তরুণরা সহজেই আকৃষ্ট হয়। প্রযুক্তির ব্যবসা অন্য ব্যবসার মতো মাটি কাটা বা দোকানদারের মতো না। আসলে এটার জন্য আউট সোর্স করতে হয়। ভারতে অধিক পরিমাণে আউট সোর্সিংয়ের কাজ চলছে। আমি যখন দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য টিকিট কিনি তখন ভারতীয় লোকজন রেসপন্স করে। বাইরের দেশগুলোতে তরুণরা আউট সোর্সিংয়ে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। তারা বিমান, রেলওয়ের টিকিট অনলাইনে বিক্রি করছে। ভারতীয় তরুণরা এদিক থেকে অনেক এগিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে এমন সুবিধা খুবই কম। পল্লি এলাকায় এ সেবা পাওয়া খুবই দুরূহ। তবে শহর এলাকায় ছেলেমেয়েরা এ কাজ সহজে করতে পারে ব্রডব্যান্ড, ইন্টারনেট, ওয়াইফাই ব্যবহারের মাধ্যমে। গ্রামে তেমন কোনো শক্তিশালী অবস্থা তৈরি হয়নি। তবুও সরকার গ্রাম এলাকায় বহু টাকা খরচ করছে ব্যান্ডউইথে। তবে খুব একটা সক্ষমতা এখনো অর্জন করতে পারেনি। এটা আমাদের সমস্যা। বাইরে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আমরা দক্ষ কর্মী পাঠাতে পারি। শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ভারত এবং ইন্দোনেশিয়ায়ও দক্ষ লোকবল আছে। কর্মসংস্থানের জন্য সবচেয়ে ভালো হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো। আপনি ছোট একটা টেক্সটাইল মিল করবেন। খরচ হবে ২০০ কোটি টাকা। এখানে ১০০ জনের বেশি জনবল কাজে লাগাতে পারবেন না। কারণ সবাই অটোমেটিকভাবে চলে। কিন্তু এই ২০০ কোটি টাকা যদি ২ কোটি টাকা করে ১০০ জনকে দেন তাহলে ১০ জন করে হলে ১ হাজার হবে। অতএব, তারা মোটামুটি টেকনিকও ব্যবহার করে। ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানও টেকনিক ব্যবহার করে। এখানে তাদের বৃহৎ কোনো মেশিন নেই। তাদের সুবিধা দিতে পারলে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করবে। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানও বাড়বে। আমরা চীন থেকে বিস্কুট আমদানি করি। এখন অনেকটা কমে গেছে। এখানে উৎপাদন হলে বৈদেশিক বিনিময় বাড়বে। এতে অনেকটা সাশ্রয় হবে। কর্মসংস্থানের আরেকটা ব্যাপার আছে, সেটা হলো- যে বড় বড় প্রকল্পগুলো আগে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোতে কর্মসংস্থান ছিল না। এখানে ছিল উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি। এলিভেটরে যারা কাজ করছে তাদের ক্ষেত্রে জনবল খুবই কম। আমরা শ্রমঘন স্থানীয় কিছু প্রকল্প নিতে চাই। যেমন- স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, স্থানীয় শিল্পকারখানা স্থাপন ইত্যাদি। এজন্য দরকার এডিপিতে ছোট ছোট প্রকল্প যুক্ত করা। এতে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ছোট মানে ১ থেকে ২ কোটি টাকা নয়। ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প। ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা এত না। এ ক্ষেত্রে আমাদের এখানে জমি কিনতে যাবেন দেখবেন যে, আরও ৫ জনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। পারবেন না কিনতে। জমির ক্ষেত্রে কোর্টে চলে যায় বছরের পর বছর। এই বিষয়গুলো উন্নতি না করলে হবে না। রাজনৈতিক সরকার থাকলে আরও বেশি। কোন মন্ত্রী এসে কী বলবে, এসে কী পরিবর্তন করবে। এখানে আবার প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছেমতো কাজ হবে। এগুলো বিদেশিরা পছন্দ করে না। তারা সব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে। এসব ব্যাপারে আমাদের অনেক দুর্বলতা আছে।
সবচেয়ে বাইরে ইনফ্লো ফরেন ইস্যু। ওরা যদি টের পেত দুর্নীতি হচ্ছে, ৫ বছরের প্রজেক্ট ১০ বছরে যাচ্ছে, তাহলে সবকিছু বন্ধ হয়ে যেত। এখনো ওরা টাকা-পয়সা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এসেছিল, তারা বলে আমরাও টাকা দেব। অতএব, আমরা এটাকে এক জায়গায় নিয়ে আসছি। এখন মোটামুটি একপর্যায়ে আছে। আজকে ডলার ১২০, পরশু ১১৭; এমন ওঠানামা করে। আমাদের অবস্থা এখনো খারাপ। এটা অনেক কারণে হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি আস্থা ফিরিয়ে আনতে। এ অবস্থা না হলে গ্রাহক ১ লাখ টাকার চেক ওঠাতে পারতেন না। কারণ, অনেক ব্যাংকে টাকা নেই। আমরা মাঝখানে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে ঠিক করেছি। আমরা যতদিন দায়িত্বে থাকি ততদিন দেশের অর্থনীতির জন্য কিছু কাজ করে যাব। আইন পরিবর্তন করতে পারব না। ব্যাংকিং আইন পরিবর্তন করতে সময় লাগে। পুঁজিবাজারে সময় লাগবে। আমরা কিছু কিছু সংস্কার করব। যেটা- ব্যাংক ঠিক করা, বোর্ডগুলো পরিবর্তন করা, কাস্টমস ডিউটিটা আরও উন্নত করা। এগুলো চলমান থাকবে। এর জন্য ছোট ছোট আইন লাগবে। এটা আমরা করব। নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনের আগে আমরা এমন একটা পদচিহৃ রেখে যেতে চাই যাতে আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারা যেন এভাবে চালিয়ে বা এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকারের প্রথম অংশ পড়ুন:
>> রোজায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে