
সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, সাগর মেঘলা গিরি কুন্তলা, প্রাচ্যের সৌন্দর্যের রানি এ চট্টলা। বীর প্রসাবিনী চট্টলা যেমনি অনেক বীর সন্তানের জন্ম দিয়েছে, তেমনি সমাজের নানা শাখা-প্রশাখায় বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে চট্টলার কৃতী সন্তানরা তাদের ক্রিয়াকর্মের কারণে সারা দেশ আলোকিত করেছেন। প্রকৃতির লীলাভূমি ‘শৈলকিরীটিনী’ সাগর কুন্তলা-চট্টলভূমির অনন্য এক কৃতিমান পুরুষের নাম মীর মোবাশ্বের আলী। পিতা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের বিখ্যাত মীর পরিবারের মীর সেকান্দর আলীর সন্তান মীর হাবীব আলী। যিনি চট্টগ্রামের ডিস্ট্রিক ফিজিক্যাল অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন। চাকরি ও বিবাহসূত্রে চট্টগ্রামের বাসিন্দা। মা মাহমুদা বেগম, যিনি চট্টগ্রাম কলেজের আরবি ও ফার্সি বিভাগের অধ্যাপক ও চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক অলি খাঁ মসজিদের পেশ ইমাম প্রফেসর আব্দুল লতিফ খানের বড় মেয়ে।
প্রকৌশলীদের সাহিত্য ও সুকুমার শিল্পের বিকাশ ও মানবিক মননে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৬২ সালে মোবাশ্বের আলী (ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) ইউকসুর সভাপতি নির্বাচিত হন এবং প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। ১৯৬২ সালেই প্রথম ইউকসু প্রতিষ্ঠিত হয়। সে হিসেবে তিনি ইউকসুর প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ছিলেন। মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে একই কলেজে একই বিভাগে শিক্ষক হিসেবে মনোনীত হন এবং ডেপুটেশনে সদ্য শুরু হওয়া স্থাপত্য শিক্ষায় হাতেখড়ি। ১৯৬৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডায় যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস এইডের উদ্যোগে উচ্চতর স্থাপত্য শিক্ষার লক্ষ্যে বিদেশ চলে যান। ‘ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়’ যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য গেইলভিনে অবস্থিত। একটি অতি মর্যাদাপূর্ণ সরকারি গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, এর স্কুল অব আর্কিটেকচার যা কলেজ অব ডিজাইন, কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড প্ল্যানিংয়ের অন্তর্ভুক্ত এবং স্থাপত্য শিক্ষার জন্য সুপরিচিত এবং সুপ্রসিদ্ধ।
উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে ১৯৬৬তে দেশে ফিরে স্থপতি হিসেবে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগে শিক্ষকতার জীবন শুরু। বাংলাদেশের স্থাপত্যশিল্প বিকাশে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবনের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন একটি অসাধারণ ভবন, একটি অসাধারণ স্থাপত্যকর্ম, এ দেশের ইতিহাসে এই ভবনের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। এই ভবনের পরিকল্পনা শুরু ১৯৬২ সালের দিকে, এ দেশের স্থাপত্য শিক্ষার সূচনা বা শুরুও তখন থেকেই। স্থাপত্য শিক্ষার অগ্রগতি ও বিকাশের ক্ষেত্রে এই ভবন বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের স্থাপত্য শিক্ষার বিকাশ ও উৎকর্ষ অপরিমেয়। ইউএস এইডের সহায়তায় চারজন যুক্তরাষ্ট্রীয় শিক্ষক নিয়ে শুরু হয়। এখান থেকে আমাদের কয়েকজনকে স্থাপত্য বিদ্যায় শিক্ষিত করে শিক্ষক হিসেবে এ দেশে স্থাপত্য শিক্ষার গোড়া পত্তন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬৮ সালের মধ্যে সব বিদেশি শিক্ষক দেশে ফিরে যান। স্থাপত্য শিক্ষার পটভূমি তখনো সুদৃঢ়ভাবে তৈরি হয়নি। তাদের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে সদ্য পাস করা পাঁচজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা হলেন ১. শাহ আলম জহির উদ্দিন, ২. ড. মো. আ. মুকতাদির, ৩. জাহেদুল হাসান, ৪. আজমল হায়াত আহমদ, ৫. আমাকে (মীর মোবাশ্বের আলী) এত কম বয়সের কয়েকজনের ঘাড়ে এসে পড়ে স্থাপত্য শিক্ষা ও পেশার বিকাশ ঘটানোর দায়িত্ব। আজকে পেছনের দিকে তাকালে মনে হয় তারা তাদের কর্তব্য নিষ্টার সঙ্গে পালন করেছিল। যার ফলে এ শিক্ষা ও পেশা খুবই সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। আজ স্থাপত্য শিক্ষা ও পেশায় প্রভূত উন্নতি ও প্রসার ঘটেছে এর অনেকটা কৃতিত্ব উপরোক্ত শিক্ষকদের ওপর বর্তায়। (সূত্র: সমতটে সংসদ বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি লুই কান ও সংসদ ভবন, পুস্তকের হার্ড কভার প্রকাশক, জার্নিম্যান বুকস, দ্রষ্টব্য)
দেশে-বিদেশে তার অনেক পাবলিকেশন রয়েছে। তিনি সমতটে সংসদ বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি লুই কান ও সংসদ ভবন শিরোনামে একটি মূল্যবান গ্রন্থ লিখেছেন, যা জার্নিম্যান বুকস থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি স্থাপত্য জগতে প্রচুরভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এ বইয়ে বাংলাদেশের সংসদ ভবনের নির্মাণ ও নকশার বিষয়ে নতুন এক তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি লেখেন, লুই কানের মৃত্যুর পর এই ভবনের (অর্থাৎ জাতীয় সংসদ ভবনের) অসমাপ্ত কাজ প্রখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম কর্তৃক শেষ করা হয় বলে প্রচারিত। এ কথাটি সঠিক নয়।
এ কাজটি বাংলাদেশ সরকারের স্থাপত্য অধিদপ্তরের তদারকিতে শেষ হয়। সংসদ ভবনের ডিজাইনের কাজে ‘লুই কান’কে নিয়োগের সময় মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্য অধিদপ্তরে স্থপতি হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। আলাদাভাবে তার কাজ পাওয়া বা করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে মাজহারুল ইসলাম বাংলাদেশের স্থাপত্য পেশার গুরু। স্থাপত্য পেশার উৎকর্ষ সাধনে তার প্রভাব অপরিসীম। (সূত্র: সমতটে সংসদ বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি লুই কান ও সংসদ ভবন পুস্তক দ্রষ্টব্য)
তিনি মূলত একজন প্রচারবিমুখ এবং আত্মকেন্দ্রিক মানুষ ছিলেন। দীর্ঘ জীবনে তিনি যে ব্যক্তিগত ও পেশাগত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, তা সামগ্রিকভাবে প্রকাশিত হলে নগর প্রশাসনের আনাচে-কানাচে বিদ্যমান বিভিন্ন অবিশ্বাস্য ঘটনার ইতিবৃত্ত জনসমক্ষে উদ্ঘাটিত হতো। প্রবন্ধ আকারে দেশে-বিদেশে নানা প্রকাশনার সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত থেকে কাজ করেছেন। অসাধারণ মেধাবী স্থপতি ও সংগঠক মীর মোবাশ্বের আলী ভালো রচনা আধুনিকতা এবং প্রযুক্তির মিশ্রণে দৃঢ় বিশ্বাসী বোসার্ট স্কুলের নীতিমালা মেনে চলতেন।
তিনি দৃঢ়ভাবে দাবি করেন যে ‘পশ্চিমা শিল্প আন্দোলনগুলোকে অন্ধভাবে অনুকরণ ও অনুসরণ করা উচিত নয়। বরং বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যে স্থাপত্য অনুশীলনের প্রাসঙ্গিকতায় গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন।’ ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার মানুষ হিসেবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে কাজ করেছেন। ধর্মীয় সম্প্রীতি নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। তার বাগ্মিতা ও প্রজ্ঞার জন্য তিনি সুধী মহলে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। প্রচারের প্রতি বিরূপ হলেও তার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের স্থাপত্য এবং নগর প্রশাসনের ক্ষেত্রে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। প্রখ্যাত স্থপতি বাংলাদেশের স্থাপত্য শিক্ষার একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা অধ্যাপক মীর মোবাশ্বের আলী ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ শনিবার সকালে দীর্ঘ বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। দেশের ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব ও স্থাপত্য শিক্ষার অন্যতম পুরোধা মীর মোবাশ্বের আলীর মৃত্যুতে জাতি একজন বিরল প্রচারবিমুখ মেধাবী স্থপতি ও শিক্ষককে হারিয়েছে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
[email protected]