
জনগণের ওপর ভ্যাটের চাপ না বাড়িয়ে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো যেত। এভাবে ভ্যাট বাড়ালে মানুষের জীবনযাত্রা আরও কষ্টকর হবে। মানুষ যে পরিমাণ ভ্যাট সরকারকে দিচ্ছে সেটা সংগ্রহ ঠিকমতো
হয় না। সেটাতে আরও জোর দেওয়া উচিত। দেশের ছোট ছোট ভ্যাট আদায়যোগ্য অধিকাংশ ব্যবসায়ী ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। এখন দেশে নতুন সরকার জনকল্যাণে কাজ করছে। তারা এ বিষয়টি সমাধানে গুরুত্ব দিতে পারে।...
রমজানে প্রতিবছরই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে। যেমন- ছোলা, বুট খেজুরসহ ইফতারের আইটেমগুলোর চাহিদা বেশি থাকে। মানুষ রমজানে ভালো খেতে চায়। ফলে সাধারণ সময়ে বিভিন্ন পণ্যে, বিশেষ করে রমজানের সময় পণ্যের যে চাহিদা থাকে তার দ্বিগুণ হয়। এর ফলে বাজারে বাড়তি একটা চাপ সৃষ্টি হয়। রমজানের সময় যারা বিত্তশালী তারা রমজানের শুরুতে বা রমজানের আগে আগে একসঙ্গে রমজানের জিনিসপত্র কিনে ফেলতে চায়- এটাও একটা বাড়তি চাহিদা তৈরি করে। যেহেতু চাহিদা বেড়ে যায়, সরবরাহ বাড়লেও ব্যবসায়ীরা একটা সুযোগ পায় লাভ করার জন্য। তখন পণ্যের দামের একটা ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যায়। এবারও কিন্তু সরকারি লোকজন বলছে- পণ্যের দাম সেভাবে বাড়েনি। টিসিবি একটা মূল্য তালিকা প্রতিবারই প্রকাশ করে থাকে। একথা সন্দেহাতীতভাবেই সত্য যে, রমজানে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী থাকে।
১৫ রমজানের পর পণ্যের দাম কিছুটা কমে আসে। এর আগে জিনিসপত্রের দাম নিম্নমুখী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। ভোক্তাদের কাছে আমার দুটো পরামর্শ আছে। তাহলো- প্রথমত, একসঙ্গে এক মাসের বাজার করা থেকে বিরত থাকা। সাধারণত অন্য সময় যেভাবে বাজার করে সেভাবেই বাজার করা উচিত। এখন ঢাকা শহরে অসংখ্য বহুতল ভবন নির্মাণ হয়েছে। যেখানে ১০ থেকে ২০টি পরিবার একসঙ্গে বসবাস করে। তারা যদি সবাই একই পণ্য এক কেজি করে ক্রয় করে, তাহলে ২০টি পরিবারের জন্য কত পরিমাণ পণ্য লাগতে পারে, তার একটা হিসাব করা যায়। যদি সবার চাহিদা যোগ করে পাইকারি বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করা হয়, তাহলে ১৫-২০ ভাগ মূল্য সাশ্রয় হয়। একসঙ্গে কিনে সবাই যদি ভাগ করে নিতে পারে তাহলে খরচ কিছুটা কমবে। এতে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা সাশ্রয় করা সম্ভব।
কারওয়ান বাজার, যেখানে পাইকারি বিক্রয় হয়, সেখানে যে দাম, আর যেখানে খুচরা বিক্রয় হয়, সেখানে যে দাম- এই দুই জায়গার দামের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। ১০-এর ওপরে চলে গিয়েছিল মূল্যস্ফীতি- এখন ১০-এর নিচে বা কাছাকাছি আছে মূল্যস্ফীতি। এটা আগামী ৫-৬ মাসে আরও কমবে। ৭-৮ শতাংশের নিচে মূল্যস্ফীতি আগামী এক বছরের মধ্যে কমার সম্ভাবনা খুবই কম। উৎপাদন ব্যবস্থায় এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। তার পর চাঁদাবাজি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। ব্যবসায়ীরা লাভ করার জন্যই ব্যবসা করে। আমাদের উচিত ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করা। যাতে কেউ ইচ্ছা করলেও দাম বৃদ্ধি করতে না পারে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক না হলে বিনিয়োগ বাড়বে না, উৎপাদনও বাড়বে না। উৎপাদনের মন্থরগতির কারণে সমাজে তার প্রভাব পড়বে। আগে এক কাপ চায়ের দাম ছিল পাঁচ টাকা। একসময় ছিল তিন টাকা বা দুই টাকা। এখন হয়ে গেছে ১০ টাকা। কারণ পাঁচ টাকার নোট বাজারে নেই। দুই টাকার নোটও বাজারে নেই। এই যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতা, নতুন নোট বাজারে ছাড়ার ক্ষেত্রে গরিমসি। এ কারণেও বাজারে দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন পর্যায়ে দাম বৃদ্ধিতে একটা ইন্ধন কাজ করে। যে বিক্রি করে হয়তো তারও খরচ বেড়েছে। চিনির দাম বাড়ছে, চায়ের দাম দুই টাকা বাড়ছে- সে জন্য দোকানি একসঙ্গে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। এটা যে শুধু চায়ের ক্ষেত্রে হচ্ছে তা নয়। এটা সব ক্ষেত্রে হচ্ছে।
বাজারে ছোট নোট নেই বললেই চলে। এখন এক টাকা দেওয়ার কোনো অবস্থা নেই। দুই টাকা দেওয়ারও অবস্থা নেই। পাঁচ টাকাও নেই। তাহলে দিতে হবে ১০ টাকা। কয়দিন পরে হয়তো ১০ টাকার নোটও থাকবে না। তখন দিতে হবে ২০ টাকা। যখন ২০ টাকার নোট থাকবে না তখন ৫০ টাকা। এই যে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নোট সরবরাহে ব্যর্থতা, এটা খুচরা পর্যায়ে মূল্য বৃদ্ধিতে একটা ভূমিকা রাখে। এগুলো কঠোর হাতে রুখতে হবে।
দ্রব্যমূল্যের আগুনে দাহ হওয়া ভোক্তাদের কেবল বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে স্বস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি মানুষের জীবনকে দূর্বিষহ করে তুলেছে। কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে সেটা কি সিন্ডিকেট নয়? বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক সৃষ্ট এই সিন্ডিকেট থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে। প্রতিনিয়ত বাজারে দাম বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের। বিগত সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের সংকটে পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা কারণে বাজার ছিল অস্থিতিশীল। সেটা কিছুটা সামাল দেওয়া গেলেও চাহিদা ও জোগানে তারতম্যের কারণে নিয়ন্ত্রণে থাকছে না বাজার পরিস্থিতি।
বাজারে গ্রাহক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতে করপোরেট মনিটরিং সেল গঠন করা দরকার। যার মূল লক্ষ্য দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার মনিটরিং করা। জনগণের ওপর ভ্যাটের চাপ না বাড়িয়ে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো যেত। এভাবে ভ্যাট বাড়ালে মানুষের জীবনযাত্রা আরও কষ্টকর হবে। মানুষ যে পরিমাণ ভ্যাট সরকারকে দিচ্ছে সেটা সংগ্রহ ঠিকমতো হয় না। সেটাতে আরও জোর দেওয়া উচিত। দেশের এমন ছোট ছোট ভ্যাট আদায়যোগ্য অধিকাংশ ব্যবসায়ী ভ্যাট ফাঁকি দিচ্ছে। এখন দেশে নতুন সরকার জনকল্যাণে কাজ করছে। তারা এ বিষয়টি সমাধানে গুরুত্ব দিতে পারে। এর ফলে যেমন রাজস্ব ও ভর্তুকির সমস্যা সমাধান হতো, মানুষও স্বস্তি পেত। গত দেড় দশক ধরে ভ্যাট মেশিন বাধ্যতামূলক করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো মেশিন বসেনি। এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) একেক সময় একেক ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়। আর যারা ভ্যাট ফাঁকি দেয় তাদের অনাগ্রহের কারণে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) কিংবা ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর কর্মসূচি এখনো সাফল্যের মুখ দেখেনি।
এসবে আরও বেশি জোর দেওয়া উচিত। এর ফলে যেমন সংগ্রহ বাড়ত একদিকে, অন্যদিকে মন্দ প্রতিষ্ঠানের কারসাজি বন্ধ করা সম্ভব হতো। সুষ্ঠু ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বাড়ত। সরকার কী পরিপ্রেক্ষিতে ভ্যাট বাড়াল? সরকার চালাতে অর্থের দরকার, এটা ঠিক। সে ক্ষেত্রে দুটি উপায় আছে। একটি মানুষের কাছে এভাবে শুল্ক-কর নেওয়া। অরেকটি ঋণ নেওয়া। সে ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিলে তারা টাকা ছাপিয়ে দেয়। তাতে আবার মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। যেটা গত সরকারের আমলে হয়েছিল।
এখন ট্যাক্স কিছুটা বাড়িয়ে টাকা ছাপিয়েও একটি সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। এতে ভ্যাট বাড়লে মূল্যস্ফীতির মধ্যে মানুষের কষ্ট অনেক বেশি হবে। এরই মধ্যে কিছু কিছু পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। যেটা খুব কষ্টকর। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ওষুধ। এটি জীবনরক্ষাকারী পণ্য। এটা সরকারের বিবেচনা করা দরকার। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর ভ্যাট বাড়ানো কতটা যুক্তিযুক্ত, আগামী বাজেটে সেটাও সরকারকে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে।
লেখক: সভাপতি, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)