
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন এখন বাংলাদেশের রাজনীতির মূল আলোচনা। ইতোমধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সমন্বয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠিত হয়েছে। দল গঠন করেই তারা জনসংযোগের কাজে মাঠে নেমেছে। তাদের বক্তব্য-বিবৃতি শুনে মনে হচ্ছে তারা নির্বাচন বিষয়ে ধীরগতিতে আগাতে চায়। কারণ তাদের উপলব্ধি হচ্ছে নবগঠিত দলের ৩০০ আসনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করা এবং ভোটারদের কাছে তাদের নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে কিছুটা সময় প্রয়োজন। অন্যদিকে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দিকে আগাতে চায়। জামায়াত সংস্কার প্রসঙ্গে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনের অংশ নেওয়ার বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত। জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বিষয়টিও কিছুটা অমীমাংসিত।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বক্তব্যে উঠে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত তারা নেবে। অবশ্য তিনি এও বলেন, নির্বাচনে কে অংশ নেবে, তা নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে। তিনি চলতি বছরের শেষের দিকে নির্বাচন আয়োজনের আশা করছেন। অন্যদিকে সেনাপ্রধান সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি ফেয়ার এবং ইনক্লুসিভ (অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক) নির্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছি’। তিনি আরও বলেন, তার আগে সেসব সংস্কার করা দরকার, অবশ্যই সরকার সেদিকে খেয়াল করবে। নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এখনো পুরোপুরি জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি এবং এ বছর জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হবে।
সদ্য বিদায়ি এই উপদেষ্টা নিজেই অন্তর্বর্তী সরকারে প্রায় সাত মাস দায়িত্বে থেকে জননিরাপত্তা নিয়ে এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করার বিষয়টি অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়নি। নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘গত সাত মাসে আমরা সবাই আশা করেছিলাম, স্বল্পমেয়াদি সংস্কারের মাধ্যমে পুলিশিং ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে। এটা একটা মাত্রায় ঘটেছে, কিন্তু আমাদের প্রত্যাশামতো হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পুলিশিং ব্যবস্থায় আমি মনে করি না, একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে।’ তার এই বক্তব্য সাধারণ জনগণের মনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয় এবং দেশের পরিস্থিতি নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি ও শঙ্কার সৃষ্টি করেছে।
দেশের সাধারণ মানুষের অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে নতুন চেহারা দিতে পারে নতুন গঠিত এনসিপি। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এ দেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বজায় রেখে আসছে। এর পাশাপাশি বেশ কিছু মধ্যমানের দল রয়েছে দেশের রাজনীতিতে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হলো নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া। আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দলই নিজস্ব কৌশল প্রয়োগে ব্যস্ত থাকবে- সেটি স্বাভাবিক। কৌশল প্রয়োগের দিকে সব দলই নিজ নিজ জায়গা থেকে সামনে এগিয়ে যাবে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেরুকরণ ঘটবে- এটি অস্বাভাবিক কিছু না। মূলত নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার জন্য রাজনৈতিক মেরুকরণে পরিবর্তন হতে পারে। কোনো দল যদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজ নির্বাচনি আয়োজনের পক্ষে কাজে লাগানোর সুযোগ পায় অথবা কাজে লাগায় তাহলে যে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সেটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সামনে আসবে। আর নির্বাচন কমিশন প্রভাবিত না হয়ে তাদের দায়িত্ব পালন করলে নির্বাচন ও রাজনীতি দুটিই গ্রহণযোগ্য মাত্রা পাবে। এ কারণেই সব পক্ষকে সমান সুযোগের আওতায় নিয়ে আসার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের।
বাংলাদেশ সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীদের প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ কাজেই নির্বাচন কমিশনই প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। মূলত নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের ভূমিকার ওপরই সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্পর্ক রয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তিনটি চ্যালেঞ্জ দৃশ্যমান হতে পারে।
প্রথমত, সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির মধ্যদিয়ে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান; তৃতীয়ত, ভবিষ্যতে সাধারণ জনগণের ভোটে অংশ নেওয়ার আগ্রহ কিংবা অনাগ্রহের প্রসঙ্গ। কারণ নির্বাচন যদি ভালো হয়, তাহলে নির্বাচনি রাজনীতিতে জনগণের আস্থা তৈরি হবে, আর ভালো না হলে তৈরি হবে স্থায়ী অনাস্থা।
রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই নিজেদের পথের কাঁটা হওয়া থেকে দূরে সরে আসতে হবে। দেশ ও জাতির উন্নয়ন করতে হলে রাষ্ট্রক্ষমতার চাবি হাতে থাকা যেহেতু জরুরি, সেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে ক্ষমতায় যাওয়া। ক্ষমতায় যেতে অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে রাজনৈতিক দলগুলো এখন মরিয়া হয়ে উঠবে- এমনটাই স্বাভাবিক। শিষ্টাচারসম্মত রাজনীতির জন্য জনপ্রতিনিধিদের গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। আমাদের নিজেদের বিবেক এবং চিন্তা যদি পরিশীলিত বা মার্জিত না হয় তাহলে কোনোভাবেই ইতিবাচক প্রত্যাশা সফল হবে না।
আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামোই চয়েস করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন, অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্যদিয়েই একটি গ্রহণযোগ্যমানের উদার নির্বাচনি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। দেশের সাধারণ জনগণ দেশের রাজনীতির একটি গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। আর এ কারণে নতুন রাজনৈতিক দলসহ দেশে বিদ্যমান সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে বলব, আপনারা যদি দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন চান, তাহলে মনে রাখবেন, রাজনীতি মানে উগ্রতা নয়, রাজনীতি মানে শালীনতা, ভদ্রতা এবং সহনশীলতা। আর এসব গুণাবলির মধ্যদিয়ে জনগণের মনে স্থান করে নিতে হবে। রাগ, হিংস্রতা কিংবা প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ দিয়ে রাজনীতি করলে কখনোই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে না। আপনার কাছ থেকে আমরা ভালো এবং নতুন কিছু প্রত্যাশা করি। আসুন, পরিবর্তন শুধু মুখে নয়, আচরণে এবং কার্যক্রমে প্রমাণ করি।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]