
নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। গত ৮ মার্চ ছিল নারী দিবস। তার মাত্র দুই দিন আগে আসিয়া নামক আট বছরের একটি শিশু নির্মমভাবে ধর্ষণের শিকার হলো। সম্প্রতি নারীর প্রতি যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা খুবই উদ্বেগজনক। এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল, কিন্তু তা হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক। অথচ আমরা কী দেখছি? নারীর প্রতি সহিংসতার অনেক ঘটনা ঘটেছে। বলা হচ্ছে, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এখন বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পাস কাটিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। আমরা দেখেছি যে, শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাত্তাই দেয়নি। মাগুরায় গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর আসিয়ার জন্য সাধারণ মানুষ থানা ঘেরাও করল। তখন দেখলাম পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, আমরা তো আসামি গ্রেপ্তার করেছি। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ কেউ করেনি। আশ্চর্য ব্যাপার! সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া, এটা তো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশজুড়ে যা ঘটছে তা দেখে আমরা হতভম্ব।
পুলিশ প্রশাসনকে লালন-পালন করা হয় জনগণের টাকায়, জনগণের ট্যাক্সে। তাদের কি জনগণের প্রতি কোনো দায়-দায়িত্ব নেই ? পরিবার থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হয়নি- এ কথার অর্থ কী? এ কথার পরই পুরো দেশ উত্তাল হয়ে গেল। ক্রমাগত এসব ঘটনা ঘটে চলেছে। আমি নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ জুলাই প্রজন্মকে স্যালুট জানাই। নারী আন্দোলন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে, শহিদ মিনারে দাঁড়িয়ে, অনেক জায়গায় মানুষ সমবেত হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে, অনেক জায়গায় মানববন্ধন হয়েছে, তারপরও টনক নড়ল না। যখন নতুন প্রজন্ম রাজপথে নামল, তারা বজ্রকণ্ঠে স্লোগান তুলল- তুমি কে, আমি কে? আসিয়া, আসিয়া। তার পর মনে হলো যে, সরকারের টনক নড়েছে।
আমাদের মূল্যবোধের বিকাশ কবে হবে?
শুধু সহিংসতা নয়, নারীরা নানা ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে বর্তমান সময় পার করছে। এই যে, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, খুন, রাহাজানি, মেয়েরা রাতের বেলা বের হতে ভয় পায়, এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে। তাহলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি কি নষ্ট হচ্ছে না? এই যে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে, তা বহির্বিশ্বে সাংঘাতিক রকমভাবে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পার পাবেন না তারা। তারা জানেন- এখানে বিদেশিরা থাকে- তারা কি ঘাস খায় নাকি? তারা বোঝে। সবচেয়ে বড় কথা হলো- সাধারণ জনগণ। যারা এত সাপোর্ট দিচ্ছে সরকারকে।
কাজেই মানুষের প্রত্যাশা থাকবেই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে। সেখানে দেখা গেল শেষ পর্যন্ত টনক নড়েছে। উনারা আইন সংশোধন করছেন এবং সেটা অধ্যাদেশ হিসেবে হয়তো আসবে। খুবই ভালো কথা। সাধারণত ধর্ষণ মামলায় দেখা যায়, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় আটকে থাকে। তাই এই প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে থানায় এটাকে তদন্ত করতে হবে। শারীরিকভাবে দেখতে হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এর ফলে ভিকটিমের অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ এবং মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, এটা খুবই জরুরি। মিডিয়া যখন দেখে, আমরা যখন দেখি, যখন কথা বলি- তখন জনগণ আপত্তি করে না। মোট কথা, মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে চোখের সামনে।
তার পরও যখন রাষ্ট্রযন্ত্র নড়াচড়া করে না, তখন খুবই ক্ষুব্ধ হতে হয়। আমরা দেখেছি যে, আগের সরকারকে সাধারণ মানুষ গালিগালাজ করেছে। আমরা এখনো তাদের কঠোর সমালোচনা করি। সেই সময়ে নোয়াখালীতে মাদ্রাসার ঘটনায় অধ্যক্ষকে সব সহায়তা দিয়েছিল স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। কিন্তু সেটাও সরকার হজম করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত সাধারণ জনগণ প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। যেহেতু ঘটনাটা নারীবিষয়ক ছিল। পরে সরকার পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে। অপরাধীদের শাস্তিও হয়েছে। অধিকাংশ সময়ে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো রিপোর্ট করে না। তারা ভাবে থানায় গিয়ে কোনো লাভ নেই। তারা হয়রানির শিকার হবে। ফলে তারা চেপে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের ৭ মাস পার হয়ে গল। বলা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল ফিরিয়ে আনতে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয়ভাবেও নানা ধরনের ইনসেনটিভ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু লাভ কী হচ্ছে- পরিস্থিতির তো বিশেষ কোনো উন্নতি হচ্ছে না। এসব ব্যাপারে মনিটরিং করতে হবে।
মানুষের মূল্যবোধের অভাব, একই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা খুবই উদ্বেগজনক।
মানুষের মধ্য থেকে মানবিকতা চলে গেছে। কিন্তু তাই বলে দায় এড়ানো যাবে না। পরিবারকে এখন আরও বেশি তৎপর হতে হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য পরিবারকে আরও সতর্ক হতে হবে। ঘটনা ঘটে গেলে সেটার দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। সেটা যখন আমরা দেখতে পাই না, তখন আমরা খুবই মর্মাহত হই। মানুষ একটা বড় অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটার জন্য অনেক মানুষের মধ্যে তেমন কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তার পরও মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যেহেতু মানুষ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কথা না বলতে পেরে আক্ষেপ করেছে, জেল-জরিমানা, খুন, সন্ত্রাস ইত্যাদি নিয়ে মানুষ আতঙ্কিত ছিল।
সেখান থেকে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান যখন হলো- তখন মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল এবং সেটাই স্বাভাবিক। সেই প্রত্যাশাটা ঠিকমতো ফল হয়ে আসেনি। ফল পায়নি মানুষ। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে একটা বড় সমস্যা- বাজার দর। অর্থনীতি-রাজনীতি নিয়ে যারা ব্যতিব্যস্ত, যারা পার্টি করছেন- কতজন খবর রাখেন। যেমন বলা যায়- একজন রিকশাওয়ালা তার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাতে পারেন কি না! একজন কৃষিশ্রমিক অথবা গার্মেন্টশ্রমিক তার পরিবারের জন্য ভালো কিছু করতে পারেন কি না! বছরখানেক আগে হয়তো কোনোরকম কষ্টে করতে পারতেন। এখন আগের থেকে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। এই সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা যা ছিল, সেই প্রত্যাশা পূরণে সরকার কতটুকু সফল হয়েছে, সেই আত্মজিজ্ঞাসার জায়গা থেকে তারা নিজেদের প্রশ্ন করুক। জনগণের পাহাড়সমান প্রত্যাশা ছিল। এজন্য মানুষের মধ্যেও হতাশা বিরাজ করছে। যার ফলে নানা ধরনের প্রতিফলন ঘটছে বাস্তবে।
নারীরা কখনো পিছিয়ে থাকে না। তাদের পিছিয়ে রাখা হয়। এই যে পিছিয়ে রাখা হয়- এই জায়গাটায় নারী-পুরুষ, নীতি-নির্ধারক সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। জীবন যাপনের কোনো পর্যায়েই নারীকে পিছিয়ে রাখা যাবে না। ১৪ জুলাইয়ে যদি রোকেয়া হলের মেয়েরা না নামত, তাহলে আরও কতখানি সময় লাগত সেটাও ভেবে দেখা দরকার। ১৪ জুলাইয়ে মেয়েরা নেমেছে রাস্তায়। সেটা একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এই যে জুলাই অভ্যুত্থান। এখানেও নারীর অবদান আমাদের স্বীকার করতে হবে। কিন্তু সমাজের সর্বক্ষেত্রে তাদের সেভাবে দেখছি না।
নতুন প্রজন্মের মাঝেও তেমনটা দেখছি না। এগুলো আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে চলে আসছে। নারীরা আজও শৃঙ্খলবদ্ধ। তার পরও বলব যে, নারীরা বেরিয়ে এসেছে- হিমালয় জয় করেছে। ফুটবল, ক্রিকেটসহ সংস্কৃতি- সবকিছুতে এগিয়ে এসেছে। শিক্ষায় নারীরা পুরুষের চেয়ে অগ্রণী। সে ক্ষেত্রে শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদক, বিশেষ সম্মাননা- এগুলো যথেষ্ট নয়। নিত্যকার জীবনে তাদের মূল্যায়ন করে স্বীকৃতি দিতে হবে।
সর্বশেষ এতটুকু বলতে চাই যে, নারী ইস্যু শুধু নারী ইস্যু নয়। এখন নারীর ইস্যু হচ্ছে সমাজের ইস্যু। সেই জায়গায় পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সবার বাধাগুলো দূর করতে হবে। আমি এখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটা কথা কোড করব। তিনি বলেছেন, ‘পথের বাধা সরিয়ে দাও, এগিয়ে যেতে দিতে হবে’। পথের বাধা তো সরছে না। আমাদের পথের বাধাগুলো সরাতে হবে, একই সঙ্গে এগিয়ে যেতে দিতে হবে। পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রসহ এই দায়িত্ব সবার।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা