
আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ আজ অন্ধকারে তমসাচ্ছন্ন। আমাদের নারী-শিশুরা ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনা সারা দেশকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এ দেশের মানচিত্রে লাল-সবুজের পতাকায় হায়েনার থাবা পড়েছে। মাগুরার ধর্ষিত শিশুটির বয়স হবে আট বছর। এখনো সে গোলাপের কলি, নারীত্বকে বরণ করেনি সে এখনো। শিশুটি ঘুমিয়ে আছে দেহে শকুনের কুড়েকুড়ে খাওয়া আঁচড় নিয়ে। তার আঘাত এতটাই গভীরে যে, এ দেশের প্রতিটি নারী হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে শুরু করেছে। এ দেশের তরুণ-তরুণীরা প্রতিবাদ করতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে।
শিশু ধর্ষণের বিচার কেন ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। শিশুটির ধর্ষণ হয়েছে প্রমাণিত সত্য। তিনটা জলজ্যান্ত অমানুষ তার দেহ ছিঁড়েকেটে ফেলেছে। এর পরও কেন বিলম্ব বিচার প্রক্রিয়া! William E. Gladstone যথার্থই বলেছিলেন, ‘Justice delayed is justice denied.’ অর্থাৎ বিচার বিলম্বিত হওয়াই ন্যায়বিচার অস্বীকৃতি। এ দেশে বিলম্ব বিচারের সংস্কৃতিই পুরো সমাজকে নষ্ট হতে উৎসাহ দিয়ে চলেছে। ধর্ষকরূপী অমানুষ তৈরি হচ্ছে পরিবার ও সমাজে। যারা ধর্ষণকারী, এ কাজে যারা সহায়তা করেছেন তাদের বয়স যে একেবারেই কম তাও নয়। বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যমে ধর্ষকদের ছবি ছাপা হয়েছে। ধর্ষিত নারীর ছবি ব্যবহারে আইনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সয়লাব হয়েছে শিশুটির ছবি। যা খুবই দুঃখজনক। এ দেশে ধর্ষকদের সংখ্যা কেন এত বাড়ছে। বিকৃত যৌনাচার ও বিকৃত মানসিকতায় কীভাবে মানুষগুলো বেড়ে উঠছে সমাজে, এ বিষয়গুলো ভেবে দেখার সময় এসেছে। পরিবার ও সমাজের এ ব্যাপারে যথেষ্ট দায় রয়েছে। শিশুটির বোনের শাশুড়ি, তিনিও তো একজন নারী। তিনি কীভাবে এটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তাই আমরা বলব, এ দায় শুধু পুরুষেরই নয়, নারীর ও রয়েছে।
ধর্ষিত শিশুটি ভঙ্গুর সমাজের একটি অসহায় নির্যাতিতার প্রতীক। তার মতো বহু শিশু আজ এই পরিবার ও সমাজে অসহায়ত্বের ছাপ নিয়ে বোবা কান্না করছে। আবার কেউ-বা চিরতরে হারিয়ে গেছে কারও লালসার বলি হয়ে। কবে আলো ফিরবে, সে আশায় আর কোনো দিন থাকবে না তারা। কলিগুলো ফোটার আগেই ঝরে গেছে জীবন থেকে। বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতনের যে পরিসংখ্যান, তাতে দেখা গেছে, পরিবারের নিকটতম সদস্য ও স্বজনদের কাছ থেকে এ ধরনের নির্যাতন সবচেয়ে বেশি ঘটে থাকে। মাগুরার ঘটনার এক সপ্তাহের কম সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ও শিশু ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। এসব ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ একেবারেই নিকটাত্মীয়-স্বজন, কেউ-বা প্রতিবেশী। অর্থাৎ খুব কাছের বলয়ের মধ্যে থেকে এসব ধর্ষক উঠে আসে। মূলত নিকটাত্মীয়রা শিশুদের বিশ্বাসকে পুঁজি করে তাদের লোলুপ আচরণ ব্যবহার করে এসব জঘন্য কাজ করে থাকে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক নিবন্ধের তথ্য অনুযায়ী, শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা শিশুর পরিচিত হয়, সে হতে পারে আত্মীয়, বন্ধু বা বিশ্বস্ত কেউ।’
ইউনিসেফের তথ্য মতে, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে জীবিত ৩৭ কোটি নারী অর্থাৎ প্রতি আটজনে একজন নারী আঠারো বছর বয়স হওয়ার আগেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ছেলে শিশুরাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বা আশপাশের পরিবেশের কিছু বিকৃত মানুষের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। এ বিষয়গুলো অনেক সময় সংবাদ মাধ্যমে এলেও এ নিয়ে সতর্কতা খুবই কম। যদিও আমাদের দেশে ছেলেশিশু ধর্ষণের ব্যাপারে আইনে কিছু বলা নেই। বাংলাদেশের আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, কেবল ২০২৪ সালেই ছেলেশিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৬টি, আর ধর্ষণচেষ্টা হয়েছে তিনটি।
বিশ্বায়ন পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। যেকোনো ঘটনা ঘটলে সব তথ্য মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক সময় তথ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে নেতিবাচক সংবাদ ইতিবাচক সংবাদকে গিলে ফেলছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে নীল দুনিয়ার সব কার্যকলাপ। অপরাধীর পারিবারিক পরিবেশ বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়, তাদের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, পারিবারিক কলহ-বিবাদ, প্রযুক্তির প্রতি অত্যধিক আসক্তি, বিশেষ করে নীল দুনিয়ার প্রতি আসক্তি, বিভিন্ন ধরনের ক্রাইম-দৃশ্য দেখে ধর্ষণকারীর মনোবৈকল্য তৈরি হয়। নারীরা যারা অবাধ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, এ সমাজে তাদেরও কিছু দায় আছে। তাদের চলাফেরা, পোশাকে শালীনতা, আদবকেতা বজায় রাখা দরকার। নারীরা মায়ের জাতি। এ জাতিকে সম্মান করতে না পারলে পুরো মাতৃজাতিকে অসম্মান করা হবে। পারিবারিক শিক্ষা আজ এতটাই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে যে, সন্তান বাবা-মাকে সম্মান করছে না অথবা বাবা-মা তার সন্তানদের উপযুক্ত পথে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এক সময়ের যৌথ পরিবার প্রথা এখন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে একক পরিবারের ছাউনিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সন্তানরা সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে বড় হচ্ছে। কেউ কোনো কথা, কাজ, খাওয়া-দাওয়া কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারছে না। শুধুই আত্মকেন্দ্রিক মন নিয়ে নিজের জগৎ তৈরি করছে। এটারও সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমাদের কন্যাশিশুদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তাদের এমন কোনো জায়গায় পাঠানো যাবে না, যেখানে তারা একা অরক্ষিত হয়ে যায়। অনেক অভিভাবক একেবারেই তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে ভাবেন না। তার বাচ্চারা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে এগুলো তোয়াক্কাই করেন না। অভিভাবকদের অসচেতনতায় শিশুদের জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে যায়। শিশুদের সচেতন করতে হলে স্পর্শের ভালো-খারাপ বিষয়টি পরিবার থেকে শিক্ষা দিতে হয়। সেটি দিতেও আমরা লজ্জিত। এটি না জানানোর কারণে শিশু নিজে খারাপ স্পর্শ থেকে রেহাই পায় না। এভাবেই দিনে দিনে তাকে যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয় কাছের কোনো মানুষ দ্বারা।
দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থায় অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। জবাবদিহি ও আইনের শাসন না থাকায় শিশুকামী (পেডোফাইল) তৈরি হচ্ছে। কারণ তারা ভাবছে, যা খুশি তাই করলেও তাদের বিচার হবে না। এই অবস্থার সুযোগে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করে নিচ্ছে অপরাধীরা। চারদিকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণে, সেই সঙ্গে অপরাধীর দ্রুত জামিন পাওয়া- এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে কারণে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বা মব ভায়োলেন্স হচ্ছে প্রতিনিয়ত। উদাহরণস্বরূপ, ফরিদপুরে ধর্ষিত শিশুর ধর্ষক সন্দেহে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করতে পারছে। এভাবে প্রতিনিয়ত নারী ও শিশু ধর্ষণ-নিপীড়ন চলতে থাকলে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই আসুন আগামীর জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নারী ও শিশু ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি। ভালো থাকুক আমাদের নারী, ভালো থাকুক আমাদের কোমলমতী শিশুরা।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, খবরের কাগজ
এবং স্থানীয় সরকার গবেষক