ঢাকা ১০ বৈশাখ ১৪৩২, বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫
English
বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২

দৈনন্দিন সমস্যার সহনশীল সমাধান জরুরি

প্রকাশ: ১২ মার্চ ২০২৫, ০৫:৪৮ পিএম
দৈনন্দিন সমস্যার সহনশীল সমাধান জরুরি
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান

দেশের অর্থনীতি মূলত বহমান থাকে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। তারা সক্রিয় হবে কি না, তা নির্ভর করবে তাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে কি না, তার ওপরে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খোলামেলা এনগেজমেন্ট কোথায়? ব্যবসায়ী মানে শুধু এফবিসিসিআই নয়। সাধারণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের উদ্যোগ তো দেখছি না। সংকট সামাল দেওয়া একটা প্রায়োগিক কাজ। এটা তাদের করতে হবে। অর্থনীতির মূল কাজ আস্থা তৈরি ও ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি। বিবেচনা করতে হবে সরকার কাজটি করছে কি না। দেশের মানুষ নতুন বাংলাদেশ তৈরি করতে চাইছে। তাদের নিয়ে আমরা কীভাবে এগোব, সেই কার্যকর উদ্যোগ দরকার ছিল। 

উপদেষ্টাদের মাঠে-ময়দানে বেশি করে যাওয়া উচিত ছিল। কারণ সাধারণ মানুষ তাদের দেখতে পেলে বুঝতে পারবে, সরকার কাজ করছে। প্রকৃতপক্ষে সেটা দেখা যাচ্ছে না। 
এখন মূল সমস্যা হচ্ছে, এই সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার স্টাইলে। সবার আগে সরকারের নিজেকেই একটা বড় ঝাঁকুনি দিতে হবে। অনেকটা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে। জনগণের কাছে যাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এটা সাধারণ মানুষের বড় উদ্বেগ। কোটা সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান; কিন্তু কর্মসংস্থানের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করলে আমরা কী উত্তর দেব জানি না। এ ব্যাপারে মনোযোগ কোথায়, উদ্যোগ কোথায়? সরকারকে অনেক দ্রুততার সঙ্গে কাজটি করতে হবে। বন্যার পর সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আমলাতান্ত্রিকভাবে এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে গেলে দুই বছর বসে থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের এখনই কৃষকদের বীজ, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ দিয়ে দিতে হবে। আমাদের দেরি করার সময় নেই। 

দুর্নীতি ও নিষ্ঠুরতা, মানুষের প্রতি অত্যাচার, সীমাহীন পর্যায়ে গিয়েছিল। তিনটি আকাঙ্ক্ষা এখানে সর্বজনীন। প্রথমত, দৈনন্দিন সমস্যার সহনীয় সমাধান ও সমাধানের দৃশ্যমান ও কার্যকর চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, স্থিতিশীল পরিবেশ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অন বোর্ড রাখতে কার্যকর বয়ান নির্মাণ। তৃতীয়ত, টেকসই ও নৈতিকতার ছাপ আছে এমন রাজনৈতিক উত্তরণের রোডম্যাপ তৈরি। অন্তর্বর্তী সরকার আলাদা আলাদা অনেক উদ্যোগ নিচ্ছে; কিন্তু এসব উদ্যোগ সামগ্রিক কোনো আস্থার পরিবেশ তৈরি করছে বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের স্টাইল দৃশ্যত আমলা, বিশেষজ্ঞ ও ছাত্রদের ওপর অতি নির্ভরশীলতার ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে। শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির রিপোর্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি; কিন্তু অনেক ছোটখাটো দুর্নীতির বিষয় নিয়ে সরকারকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।

বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র-জনতার বিপ্লব এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এই বিপ্লব প্রত্যাশিত, একই সঙ্গে আকস্মিক বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছরের ইতিহাসে শেখ হাসিনার শাসনামলকে নজিরবিহীন স্বৈরতন্ত্র চর্চার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। বিশেষ করে বিগত সরকারের শাসনামল মৌলিকভাবে বিপরীত দিকে চলে গিয়েছিল। গুম, খুন, হত্যা, গায়েবি হামলা, নির্যাতন প্রতিদিনের বাস্তবতায় পরিণত হয়েছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সর্বত্র নানারকম অত্যাচার হয়েছে। মানুষকে ন্যায়নীতিহীন দুঃসহ যাতনা বয়ে বেড়াতে হয়েছে। কোথাও কোনো নিয়ম-নীতি ছিল না। দেশের সাধারণ মানুষ মুখ বুজে সহ্য করছিল। কিন্তু আর নিতে পারছিল না। অনেকদিন থেকেই সাধারণ মানুষের মনের কথা ছিল যে, মানুষ পরিবর্তন চায়। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নানারকম আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও রাজনৈতিক দলগুলো যথাযথ আন্দোলন সংগঠিত করতে পারছিল না। রাজনৈতিক দলগুলো যা দেখাতে পারেনি, ছাত্ররা তা করে দেখিয়েছে। তারা বেপরোয়া সাহস দেখিয়ে মানুষকে সাহসী করে তুলেছিল। সে কারণে জনগণ তাদের সঙ্গে মাঠে নেমে এসেছিল। একপেশে পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভর করে এত দিন শেখ হাসিনার শাসন টিকে ছিল। সেই স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে ভেঙে পড়ায় দ্রুত সরকারের পতন হয়। 

আবু সাঈদ এবং অন্য অনেকের আত্মত্যাগ ও সাহস সেই ভয়কে ভেঙে দেয়। ভয় ভেঙে যাওয়ার এই মনস্তাত্ত্বিক উত্তরণ সরকারের পতন ঘটায়। ছাত্রদের আন্দোলনে যুক্ত হয় জনতা। সরকার এতদিন তাসের ঘরের মধ্যে ছিল। শুরুতে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে সরকারকে যেতে হয়েছে। এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে জনমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল। একই সঙ্গে তা কার্যকরভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল। গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকারের প্রধান কাজ ছিল মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় নিয়ে দেশকে সুসংহত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া।

 সরকারের উচিত ছিল মানুষের সঙ্গে কথা বলা। জনগণের কাছে যাওয়া। তাদের কথা শোনা অর্থাৎ ব্যাপকভাবে জনবান্ধবমূলক উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। জনগণের আস্থাভাজন হতে এই কাজগুলো করা দরকার ছিল। এটা একটা রাজনৈতিক কাজ। একথা সত্যি যে, এই সরকার প্রচলিতভাবে রাজনৈতিক সরকার না হলেও তাদের কাজটা রাজনৈতিক। যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই পরিবর্তন নেতারা আনেনি। এই পরিবর্তন দেশের আমজনতা এনেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ জরুরি ছিল। 

পতিত স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে আমলাতন্ত্র- সবখানেই তাদের সহচর রয়ে গেছে। তাদের পাল্টা আঘাত হানা এবং বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করা আমরা দেখেছি। কাজেই সেটি মোকাবিলা করাও একটি বড় কাজ ছিল; যা সরকার মোকাবিলা করেছে। কিন্তু গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগানোর বৃহত্তর কাজটি হলো কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য ফেরানো একটি জরুরি কাজ হলেও বৃহত্তর কাজ হচ্ছে অর্থনীতির চাকাকে আরও চাঙা অবস্থায় ফেরানো। যাতে কর্মসংস্থান ত্বরান্বিত হতে পারে।  বিনিয়োগ বাড়তে পারে। দ্রব্যমূল্য সহনীয় করার জন্য বাজারব্যবস্থাপনার উন্নতি হতে পারে। আইএমএফের কয়েক বিলিয়ন ডলারের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ শত শত বিলিয়নের সম্ভাবনার দিকেই নজর দিতে হবে। তা দিতে হবে কার্যকরভাবে শুধু ঘোষণা ও আমলাতান্ত্রিক আশ্বাসের মধ্য দিয়ে নয়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি থেকে সহায়তা পাওয়া অবশ্যই স্বস্তির জায়গা। বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রকট দুর্বলতাগুলো কাটাতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয়।
  
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে কীভাবে সংশোধন করবে, বাংলাদেশকে নিজের জন্য একটি মানসিক রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। এই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম বার্তা হচ্ছে- বাংলাদেশ যেকোনো ধরনের আধিপত্যবাদী চাপ বরদাশত করবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক আর আধিপত্যবাদী চাপকে রুখে দাঁড়ানো- এ দুটি আলাদা বিষয়। আমরা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অবশ্যই সুসম্পর্ক রক্ষা করব এবং একই সঙ্গে কোনো আধিপত্যবাদী মনোভাবকে মেনে নেব না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে ধরা এবং এ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

 আমাদের ঠিক করতে হবে বাংলাদেশকে আমরা কোথায় নিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতীকে পরিণত হওয়া কোনো অলীক কল্পনা নয়। তৃতীয়ত, আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সংকীর্ণ মাইন্ডসেটআপে আবদ্ধ রয়েছি। এই মানসিক পরিসর বাড়ানো জরুরি। বাংলাদেশের মানসিক শক্তির যে বিকাশ ঘটেছে, এখন থেকে বৈশ্বিক দক্ষিণকেও আমাদের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং ধাপে ধাপে বৈশ্বিক দক্ষিণের অন্যতম জাতি রাষ্ট্রে উন্নীত করতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের মনে অনেক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে সুযোগও তৈরি হয়েছে। সরকার যাতে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালোমতো সেই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারে। আমাদের সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে চেষ্টা করে যেতে হবে। 

পণ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা জরুরি

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৮ এএম
পণ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা জরুরি
গোলাম রহমান

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী নানারকম অস্থিরতা বিদ্যমান। এর প্রভাবে দেশের মানুষও খুব একটা ভালো আছে বলা যাবে না। করোনা-পরবর্তী সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এর ফলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ অর্থনীতিতে বড় ধরনের একটা বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। দেশের মানুষ এখনো তা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। অধিকাংশই বিশেষ করে উচ্চবিত্ত বা  উচ্চমধ্যবিত্ত ছাড়া প্রায় সবাই কষ্টে রয়েছে। যারা নির্দিষ্ট আয়ে সংসার চালান অথবা যারা অবসর জীবন যাপন করছেন তারা খুবই সংকটে রয়েছেন। সংসারের ব্যয় কাটছাঁট করতে করতে অবস্থা অনেকটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সঞ্চয় বলতে অবশিষ্ট কিছু নেই। সরকার কিছু গরিব বা নিম্নবিত্ত মানুষকে সহায়তা দানের চেষ্টা করছে। প্রান্তিক জনগণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেটুকু সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আরও অধিক পরিমাণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসতে হবে। বলাবাহুল্য, বিশ্বজুড়ে করোনা-পরবর্তী সময় থেকেই সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে। সে সময় অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছিল।

 সেগুলো আজও চালু করা সম্ভব হয়নি। সে ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে নতুন নতুন কর্মপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি। বর্তমানে যদিও আশা করা যায় সার্বিকভাবে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। এর ফলে কিছুটা গতি সঞ্চার হয়েছে। তার পরও মানুষের আয় এখনো আগের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যাপক ঘাটতি এখনো আছে। ঘাটতি দূরীকরণে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি জরুরি। সেটা করতে হলে বিনিয়োগের দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে সরকারকে অবশ্যম্ভাবীভাবেই বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রতি বছর সরকার জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ায়। এবং এর থেকে সরকার একচেটিয়া ব্যবসা করে। এসব পণ্যকে কৌশলগত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকার এসব পণ্যের মাধ্যমে ব্যবসা করে থাকে। কারণ, অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য পণ্যগুলোর সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা দরকার। একই সঙ্গে নিত্যপণ্যের দাম সাশ্রয়ী রাখা দরকার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা বা মানুষকে স্বস্তির মধ্যে জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়ার জন্য ব্যবসা করছে না। অতীতে সরকারকে জ্বালানি তেল ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করতে আমরা দেখেছি। বিগত সময়গুলোতেও আমরা দেখেছি যে, যখন তেলের দাম অনেক বেশি ছিল, তখন সরকার ভর্তুকি দিয়েছে। আমরা একটা কথা বারবারই বলেছি যে, জ্বালানির দাম বাড়ানো কমানো নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এর দামে যে টাকা মুনাফা হচ্ছে, সেটা দিয়ে মূল্য স্থিতিশীল রাখার তহবিল গঠন করা হোক। সেই তহবিলে যে অর্থ জমা হবে, তা দিয়ে যখন দাম বাড়বে, তখন যেন ভর্তুকি দেওয়া হয়। সরকারকে অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে হলে নিত্যপণ্যের দাম সহনশীল রাখতে হবে।

দেশের উৎপাদনব্যবস্থায় এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। দেশজুড়ে চাঁদাবাজিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। এ কথা সত্য যে, ব্যবসায়ীরা লাভ করার জন্যই ব্যবসা করে থাকে। সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করা। যাতে কেউ ইচ্ছা করলেও দাম বৃদ্ধি করতে না পারে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক না হলে উৎপাদন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে উৎপাদনের মন্থরগতির কারণে সমাজব্যবস্থাপনায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ নেতিবাচক প্রভাব আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি। এ কারণেও বাজারে নিত্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে নিম্নপর্যায়ে দাম বৃদ্ধিতে একটা ইন্ধন জোগানোর চেষ্টা থাকে সবসময়। এর ফলে যে বিক্রি করে হয়তো তারও খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু সুবিধা ভোগ করে কয়েকজন মাত্র অসাধু ব্যবসায়ী। যা কারও জন্যই কাম্য নয়। 

দ্রব্যমূল্যের বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ভোক্তাদের কেবল বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে স্বস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে সাধারণ ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে পড়ে। বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক সৃষ্ট সিন্ডিকেট থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে। সে জন্য যেকোনো মূল্যে সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। বাজারে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে। বিগত সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের সংকটে পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে চাহিদা ও জোগানে ব্যাপক তারতম্যের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না বাজার পরিস্থিতি। অন্যদিকে জনগণের ওপর ভ্যাটের চাপ না বাড়িয়ে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো যেত। এভাবে ভ্যাট বাড়ালে মানুষের জীবনযাত্রা আরও কষ্টকর হয়ে ওঠে। ‘মানুষ যে পরিমাণ ভ্যাট সরকারকে দিচ্ছে সেটা সংগ্রহ ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। তাছাড়া দেশে ভ্যাট আদায়যোগ্য অধিকাংশ ব্যবসায়ী ভ্যাট ফাঁকি দেয়।

 দেশে নতুন সরকার এসেছে। তারা এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে  সমাধান করতে পারে। এর ফলে রাজস্ব ও ভর্তুকির সমস্যা সমাধান সম্ভব হতে পারে। সাধারণ মানুষও কিছুটা  স্বস্তি পাবে। বিগত সময়ে ভ্যাট মেশিন বাধ্যতামূলক করা হলেও তা পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তার আগে এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) একেক সময় একেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা কার্যত ফলপ্রসূ হয়নি। আর যারা ভ্যাট ফাঁকি দেয় তাদের অনাগ্রহের কারণে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) কিংবা ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর কর্মসূচি ফলত কোনো কাজে আসেনি। এসবে আরও বেশি জোর দেওয়া উচিত ছিল।

বাজারে অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল নয়। সরবরাহ সামান্য কমলেই ব্যাপক দামবৃদ্ধি ঘটে। অনিয়ন্ত্রিত মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণের ফলে দেশের গুটিকয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিয়েছে। এরা সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বহুদিন থেকেই বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছে।  প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থাপনা  না  থাকায় কতিপয় প্রতিষ্ঠান পণ্যের সরবরাহ ও দাম নির্ধারণে কারসাজির মাধ্যমে অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তাশ্রেণিসহ সবাই। মাঝেমধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে কতিপয় মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষের পকেট কাটে। বাজারে আইনের সঠিক প্রয়োগ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ব্যতিত এ কঠিন সমস্যা দূরীকরণ ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমানো সম্ভব নয়। কাজেই বাজারব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারকে গঠনমূলক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

লেখক: সাবেক সচিব এবং সাবেক চেয়ারম্যান, দুর্নীতি দমন কমিশন

ইউরোপ, আমেরিকার ফাটল কাঠামোবদ্ধ রূপ পাচ্ছে

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৯ এএম
ইউরোপ, আমেরিকার ফাটল কাঠামোবদ্ধ রূপ পাচ্ছে
রায়হান আহমেদ তপাদার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ময়দান থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের শুরু। আত্মপ্রকাশ ঘটে ভূ-রাজনৈতিক ব্লকের। যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ব্লক সোভিয়েত ইউনিয়নের বাড়-বাড়ন্তে উদ্বেগ বাড়তে থাকে ওই ব্লকের। বাড়তে থাকে উত্তেজনা। শুরু হয় একে অপরের মধ্যকার বহুমাত্রিক প্রতিযোগিতা। উভয় ব্লকেরই দাবি ছিল, বিপরীত ব্লক তাদের ভেতরকার ঐক্য ধ্বংস করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদল যেমন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে অবস্থান নিতে পারত না, তেমনি সোভিয়েত ট্যাংকগুলোও প্রুশিয়ান ময়দানে প্রবেশ করতে পারত না যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করার এই প্রক্রিয়াকে তখন ‘ডিকাপলিং’ বলা হতো।

 উভয় ব্লকের কয়েক দশকের দ্বন্দ্ব যা করতে পারেনি, তা এখন কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই করতে চলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার তিন মাসও হয়নি, এর মধ্যেই তারা বিশ্বজুড়ে রণহুংকার ছাড়ছে। নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দুর্বল ও বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে বলে বলা হচ্ছে। চলতি বছরে জার্মানির মিউনিখে সমাপ্ত নিরাপত্তা সম্মেলনে সেই বার্তাই পেয়েছেন ইউরোপীয় নেতারা। তিন দশক আগেই পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্য স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়েছে। তবু এখন ইউক্রেন আর গাজা উপত্যকার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বড় অশান্তি তৈরি হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানের আগেই জার্মানির রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করে। এমনকি তীব্র স্নায়ুযুদ্ধের কালেও ১৯৬৩ সালে রাজনীতিক, গবেষক ও নাগরিক সমাজকে নিয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার বিষয়ে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের উদ্যোগ শুরু হয়।

তবে প্রথম এক দশক সেই সম্মেলন ব্যাপক আন্তর্জাতিক সাড়া জাগাতে পারেনি। শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোই এতে অংশ নিত। পরবর্তীকালে এর ব্যাপ্তি বেড়েছে। ইউরোপীয়রা আগে যা জানতেন সিগন্যাল অ্যাপ কেলেঙ্কারি সেটাই নিশ্চিত করেছে। ইউরোপের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের অবজ্ঞা গভীর এবং আটলান্টিকের এপার-ওপারের দেশগুলোর মধ্যে ফাটল এখন কাঠামোবদ্ধ রূপ পাচ্ছে। যদিও আশা এখনো জিইয়ে আছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক চূড়ান্ত ধরনের বাজে অবস্থায় যাওয়া ঠেকাতে পারবে ইউরোপ। গ্রিনল্যান্ডে আগ্রাসন, ইউরোপের ন্যাটো সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার অথবা সর্বাত্মক বাণিজ্যযুদ্ধ- সবকিছুই ঠেকানোর আশা করছেন ইউরোপের কোনো কোনো নেতা। এ মুহূর্তে ইউরোপের নেতাদের সবচেয়ে জরুরি মনোযোগের বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে ধাক্কা দিয়ে বাসের নিচে ফেলে চলেও যায়, তাহলে ইউরোপ যেকোনোভাবেই হোক সম্মিলিতভাবে মুক্ত, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ইউক্রেনকে সুরক্ষা দিতে সফল হবে। এখানে কোনো বিভ্রমের অবকাশ নেই যে, ইউরোপীয় নেতারা সেটা করতে চান যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়েই অথবা ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশলগত অনুমোদন নিয়েই। 

সিগন্যাল অ্যাপ কেলেঙ্কারির ঘটনাটি একই সঙ্গে প্রত্যাশিত ও বেদনাদায়ক। এটা প্রত্যাশিত এ কারণে যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে যে ভাষায় কথা বলছেন, তার সঙ্গে সিগন্যাল অ্যাপে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা দলের সদস্যরা তাদের গোপন চ্যাট গ্রুপে যে ভাষায় কথা বলেছেন, দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ফেব্রুয়ারি মাসে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে জেডি ভ্যান্সের বক্তব্য, টাকার কার্লসনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সাক্ষাৎকার অথবা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরতিহীন ঘোষণা ও তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টগুলো দেখলে তা অনুমান করা সহজ। 

কিন্তু গোপন ও প্রকাশ্য- দুই জায়গাতেই স্মরণ করার মতো ধারাবাহিকতা রয়েছে। ওয়াশিংটন ইউরোপকে বাতিল, অহংকারী ও পরজীবী বলে মনে করে। বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে ক্ষয়িষ্ণু মিত্র হিসেবেও দেখে না, ট্রাম্পের কর্মকর্তারা ইউরোপের মৃত্যুতে অবদান রাখতে চান। লোহিত সাগরে হুতির হুমকি সম্পর্কে যে যা-ই ভাবুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো তারা নিজেদের জাতীয় স্বার্থেই ইরানপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালায়। কিন্তু ভ্যান্স ও পিট হেগসেথ গ্রুপ চ্যাটে পরিষ্কার করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে হুতির ওপর আক্রমণে ইউরোপীয়রাও লাভবান হবে। এটা যেকোনো আক্রমণকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট কারণ। অন্য কথায় ইউরোপীয়দের সাহায্য করার বিষয়টিকে এমন একটা নেতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে, সম্ভাব্য হুমকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি উল্টো দিকে ঘুরে যেতে পারে।

 ইউরোপের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই যে অবজ্ঞা, তার ওপর দাঁড়িয়ে ইউরোপকে এখন তিনটি বড় নীতিগত জায়গায় কাজ করতে হবে। যেমন- বাণিজ্য। এ সপ্তাহে ট্রাম্প বেশ কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। কোনো ধরনের সহানুভূতি কিংবা ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্যযুদ্ধের মাত্রাকে প্রশমন করতে পারবে না। বরং যুদ্ধের মাত্রাটা তীব্র হবে। যা-ই হোক, ২৭টি সরকারের জন্য একটি বাণিজ্যনীতি পরিচালনা করা ইইউর আইনি দায়িত্ব এবং জোটের একটি সম্মিলিত অর্থনৈতিক ওজন রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র উপেক্ষা করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যন্ত্রণা আসবেই। কিন্তু সংঘাতের ক্ষেত্রে ইটের বদলে পাটকেল থাকতে হবে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয়রা যদি সবাই মিলে কঠোর অবস্থানে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের লুণ্ঠক আচরণ করতে পারবে না। গ্রিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থামবে না। ট্রাম্প বারবার করে বলছেন, গ্রিনল্যান্ড তার হবে। 

আর্কটিক দ্বীপে ভ্যান্সের উসকানিমূলক ভ্রমণ এবং কয়েক দশক ধরে গ্রিনল্যান্ডের দেখভালের ক্ষেত্রে ভালো কিছু করছে না বলে ডেনমার্ককে তার তিরস্কার এই ইঙ্গিত দেয় যে, ওয়াশিংটনের জবরদস্তি আরও তীব্র হবে। এখন ইউরোপের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের অবজ্ঞাকে মাথায় রেখে ডেনমার্কের সমর্থনে ইউরোপীয় নেতাদের কথা বলতে হবে। ইউরোপের নেতারা যদি দুর্বল প্রতিক্রিয়া দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে চরম বাজে ধরনের চাপ আসবে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইউক্রেন। ইমানুয়েল মাখোঁ ও কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বে ইউরোপের অন্য সক্ষম ও ইচ্ছুক নেতারা জেলেনস্কিকে সঙ্গে নিয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। কিন্তু এটা ক্রমাগতভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইউরোপীয় নেতাদের সেটা করতে হবে শুধু যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াই নয়, সম্ভবত দেশটির বিরুদ্ধেও। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভর করা যাবে না।

 ইউরোপের সবচেয়ে বড় শক্তিগুলো যেহেতু ইউক্রেনকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে এবং একই সঙ্গে তারা ইউক্রেনীয় বাহিনীগুলোকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেটা তাদের এগিয়ে নিতে হবে এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই যে, তাদের পেছনে আর যুক্তরাষ্ট্র নেই। গোয়েন্দা তথ্য ও লজিস্টিক সমর্থন আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ইউরোপের নেতাদের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ওয়াশিংটন যদি অনাগ্রহী হয় তাহলে ইউরোপ ও ইউক্রেনকে অবশ্যই নতুন পন্থা খুঁজে বের করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়াই কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়। রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ইউরোপকে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় সরকারগুলো দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধবিরতির পূর্বশর্ত হিসেবে কৃষি-খাদ্য খাতে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করার রাশিয়ার দাবি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবিলায় ইউরোপকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

এমনিতেই বিশ্বব্যাপী ডানপন্থি রাজনীতি ক্রমেই প্রভাব বিস্তার করছে। এর বিস্তার ঘটেছে ইউরোপের নানা দেশেও। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরিতে এখন কট্টরপন্থি দলগুলোর রমরমা। ২০২৪ সালের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে রক্ষণশীল ও অতি ডানপন্থি দলগুলো বড় সফলতা পেয়েছে। ইউরোপীয় রাজনীতিতে এই ডানপন্থা রাজনীতির সুযোগে তাকে আরও উসকে দিচ্ছেন সদ্য ক্ষমতাসীন মার্কিন রাজনীতিকরা। এই কৌশলের একটি মূল চালিকাশক্তি হলো মার্কিন রাজনীতিতে অর্থনৈতিক অভিজাতদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। আদতে মার্কিন এসব রাজনীতিকের কাছে ন্যায়নীতি, শান্তি বা সৌহার্দ্যের কোনো বার্তা নেই। যা আছে, তা হলো বিদ্বেষ ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির উন্নয়ন। জার্মানি ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দলের নেতা এবং সম্ভাব্য আগামী চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস একটি সার্কুলার ই-মেইলে লিখেছেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এখন সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি লেখেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ক্ষমতাসীন হওয়ায় ইউরোপের রাজনৈতিক শৃঙ্খলা এখন হুমকির মুখে।

 এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, আগামীতে আন্তআটলান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফাটল দেখা দিতে পারে। নতুন প্রশাসন আসায় যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে ফাটল ধরবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কখনো বদল আসে না। নীতি প্রণয়নে ট্রাম্প অস্থির হলেও গণতান্ত্রিক দেশগুলোর উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে অভিবাসন নীতি ও শুল্ক নিয়ে এশিয়া ও ইউরোপ চাপে পড়তে পারে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। পশ্চিম শব্দটির মানে এখন স্পষ্ট নয়। বহু বছর ধরে কখনো কখনো ইউরো-আমেরিকান উত্তেজনা সত্ত্বেও, এটি একটি একক কৌশলগত শক্তিকে নির্দেশ করত। উদার গণতন্ত্রের মূল্যবোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল যে অংশটি। এখন আছে ইউরোপ, রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিম ধারণাটি এখন শূন্য হয়ে গেছে। কীভাবে এই শূন্যস্থান পূর্ণ হবে তা স্পষ্ট নয়।

তবে একটি সাধারণ সম্ভাবনা হলো সহিংসতা। এতে বড় শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। ট্রাম্পকে একজন জাতীয়তাবাদী ও কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তার শুল্ক রাজনীতিতে প্রতিদিন পাল্টাচ্ছে বাস্তবতা। লেনদেনের সূত্র ধরে তিনি নিজের বক্তব্য থেকে শুরু করে গতিপথও পাল্টান। ২০১৭ সালে তার প্রথম মেয়াদে পোল্যান্ডে এক সফরে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি আজ ঘোষণা করছি যাতে পৃথিবী শুনতে পায়, পশ্চিম কখনোই ভেঙে যাবে না। আমাদের মূল্যবোধ জয়ী হবে’। এরপর ট্রাম্প নিজেকে গতানুগতিক চিন্তা ও সেই চিন্তাকে সমর্থনকারী প্রথাগত রিপাবলিকান দলের প্রভাব থেকে মুক্ত করেছেন। তিনি এখন একজন স্বাধীন নেতার মতো কাজ করছেন বলেই মনে করছেন অনেকে। ইউরোপের জন্য সমস্যা হলো, ট্রাম্প যা করছেন তা কি কৌশল, নাকি আমেরিকার একনায়কত্বের নতুন রূপরেখা, সেটা বোঝা।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
[email protected]

ইউক্রেনে ট্রাম্পের ১০০ দিনের ব্যর্থতা

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩৭ পিএম
ইউক্রেনে ট্রাম্পের ১০০ দিনের ব্যর্থতা
কার্ল বিল্ডট

ভ্লাদিমির পুতিন এবং তার আলোচকরা স্পষ্টতই তাদের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষদের নেতৃত্ব দিতে সফল হয়েছেন। ইউক্রেনে এমন একটি শান্তি প্রক্রিয়াকে নিন্দা জানিয়েছেন, যা অনুসরণ করার ইচ্ছা নেই। এ ঘটনার এতদিন পরেও, এমনকি সবচেয়ে মূর্খ আলোচকদেরও বুঝতে পারা উচিত ছিল যে কী ঘটছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে আসার প্রায় ১০০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। ট্রাম্পের ‘প্রথম দিনে’ যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু শান্তির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রশাসন কখন স্বীকার করবে যে, তারা ব্যর্থ হচ্ছে?

ট্রাম্পের প্রাথমিক দাবিগুলো ছিল খুবই সোজাসাপ্টা: যুদ্ধ বন্ধ করুন এবং আলোচনা শুরু করুন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার প্রথম কথোপকথনের পর তিনি ঘোষণা করেছিলেন, যুদ্ধের সম্পূর্ণ অবসান খুবই সন্নিকটে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সেই সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

তার পর থেকে পুতিন এবং ক্রেমলিনে তার ছোট দল ট্রাম্পের অনভিজ্ঞ আলোচক স্টিভ উইটকফকে জটিল শর্ত এবং অযৌক্তিক দাবির জন্য খরগোশের গর্তে টেনে আনতে সফল হয়েছে। এ ঘটনার পরে মূর্খ আলোচকদেরও বুঝতে হবে পুতিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার বা ট্রাম্পের পরিকল্পনা ও সময়সূচি মেনে নেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। 

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু করার পর থেকে পুতিন ইউক্রেনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়ার সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেছেন। প্রায় ২ লাখ সৈন্য ইউক্রেনে প্রবেশ করে। এর পর বড় অঙ্কের আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে আরও ৪ লাখ সৈন্য বাড়ানো হয়। তাদের আক্রমণে ৭ থেকে ৮ লাখ আহত এবং ২ লাখের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটলেও শক্তিশালী রাশিয়ান সেনাবাহিনী তিন বছরে ইউক্রেনের কম অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। 

সামরিক দিক থেকে পুতিনের যুদ্ধটা বিশাল ব্যর্থতা। তিনি সম্ভবত এখনো বিশ্বাস করেন তার বাহিনী আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে পারে এবং কিছু সামরিক সাফল্য অর্জন করতে পারে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা তা ঘটার সম্ভাবনা কম দেখতে পান। রাশিয়ার লোকসংখ্যা ইউক্রেনের চাইতে বেশি কিন্তু তা সম্মুখ সারিতে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে সংগ্রাম করার ইচ্ছা জাগিয়ে তুলতে পারবে না। এর অর্থ হলো পুতিন শেষ পর্যন্ত রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর চেয়ে ট্রাম্পের ওপর বেশি নির্ভরশীল।

এভাবে, পুতিন ট্রাম্পের সঙ্গে খেলার জন্য তার সব সম্পদ ব্যবহার করেছেন। সবাই জানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তোষামোদের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। পুতিন অতিরিক্ত যুক্তি দিয়েছেন ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছিল। ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকলে যুদ্ধ কখনো হতো না। আমরা বিশ্বাস করি ২০২৪ সালে হত্যাচেষ্টার পর তিনি ট্রাম্পের জন্য প্রার্থনা করতে তার ব্যক্তিগত গির্জায় গিয়েছিলেন। এমনকি তিনি ক্রেমলিনের শিল্পীকে উপহার হিসেবে ট্রাম্পের একটি প্রতিকৃতি আঁকতে বাধ্য করেন।

তোষামোদের পাশাপাশি, রাশিয়ানরা ট্রাম্প এবং উইটকফের সামনে লাভজনক ব্যবসায়িক সম্ভাবনাও ঝুলিয়ে রেখেছে। রিয়াদে মার্কিন ও রাশিয়ান আলোচকদের মধ্যে প্রথম সাক্ষাতে পুতিনের দল বহু বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের সুযোগের একটি তালিকা নিয়ে এসেছিল। যা ট্রাম্প ইউক্রেনকে ত্যাগ করলে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে পাওয়া যাবে বলে ধারণা দেওয়া হয়। উইটকফের মতে, পুতিনের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক বৈঠকের বেশির ভাগ অংশ এ বিষয়ের ওপর ছিল।

উভয় কৌশলই স্পষ্টভাবে কাজ করেছে। পুতিন তার কাজ জানেন এবং তিনি তার লক্ষ্যও জানেন। এখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি এবং পুতিন যে এতে রাজি হতে প্রস্তুত তারও কোনো লক্ষণ নেই। তিনি ইউক্রেনের শহরগুলোতে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে দায়মুক্তি ছাড়াই আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ক্রেমলিনের গোপন বৈঠকে যে আলোচনায হয় তাতে তাদের দাবির দুটি কথা উল্লেখ করা হয়। প্রথমটি হলো ইউক্রেনকে লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া এবং খেরসন এই চারটি অঞ্চল হস্তান্তর করতে হবে। উইটকফ ইতোমধ্যেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অংশ হিসেবে চারটি অবৈধভাবে দখলকৃত অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিতেও প্রস্তুত।

কিন্তু রাশিয়া এই অঞ্চলগুলোকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে না। যুদ্ধপূর্ব ১০ লাখ জনসংখ্যার শহর জাপোরিঝঝিয়া এবং খেরসনের আঞ্চলিক রাজধানীগুলোতে এখনো ইউক্রেনের পতাকা উড়ছে। কিয়েভের কোনো সরকার যদি আত্মসমর্পণ করে তার পরও তারা টিকতে পারবে না। ইউক্রেন স্নায়ু সংঘাত মেনে নিতে পারে, তবে তারা এর চাইতেও অনেক কঠিন। 

দ্বিতীয় দাবি হলো ইউক্রেনের বাকি অংশের ওপর নিরাপত্তা আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ করা। পুতিন ভবিষ্যতে পশ্চিমাদের নিরাপত্তা বা সামরিক উপস্থিতি অথবা ইউক্রেনের জন্য সহায়তা বন্ধ করতে চান। ট্রাম্প ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের ভবিষ্যতের ন্যাটো সদস্যপদ প্রশ্নে মাথা নত করেছেন এবং তিনি স্পষ্টভাবে পুতিনকে মার্কিন সহায়তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিতেও প্রস্তুত।

এখানেই ইউরোপীয়দের ভূমিকা। পুতিন বা ট্রাম্প কেউই তাদের আলোচনার টেবিলে রাখতে চাননি। যতক্ষণ পর্যন্ত ইউরোপীয়রা ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিকভাবে সহায়তা অব্যাহত রাখার সংকল্পে অটল থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত পুতিন এবং ট্রাম্প যা খুশি তাই করতে পারেন। বাস্তবে কি হলো এতে তাদের কিছু যায় আসে না। 

তাই ইউরোপের হাতে একটা তুরুপের তাস আছে। যদি তারা রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি জাগাতে পারে, তাহলে তারা ইউক্রেনের জন্য মিউনিখের মতো লজ্জাজনক বিশ্বাসঘাতকতা রোধ করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হবে। ইউরোপীয় নেতাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে যে, তারা যেকোনো পরিস্থিতিতেই ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা এবং সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করার জন্য তাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাবে।

তত্ত্বগতভাবে, ট্রাম্প নিজেই পুতিনের ওপর গুরুতর চাপ প্রয়োগ করে এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করে কূটনৈতিক কৌশল পরিবর্তন করতে পারেন। যদি তা ঘটে, তাহলে তিনি যে যুদ্ধবিরতি চান তা অর্জন করতে পারেন। অন্যথায়, তিনি ব্যর্থ হতে থাকবেন, কারণ পুতিন এবং তার বন্ধুরা তার পেছনে তাকে নিয়ে হাসছেন।

লেখক: সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। 
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

সড়কে নিরাপত্তাসংকট ও পরিত্রাণের উপায়

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:২৯ পিএম
সড়কে নিরাপত্তাসংকট ও পরিত্রাণের উপায়
ড. মতিউর রহমান

বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা গভীর উদ্বেগজনক সংকটে রূপ নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও আহতের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২৫ সালের মার্চে সারা দেশে ৫৮৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬০৪ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ২৩১। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুসারে, এ সংখ্যা সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাওয়া একটি জাতির ভয়াবহ চিত্র। ট্র্যাফিক-সংশ্লিষ্ট কারণে জীবন, সম্পদ ও উৎপাদনশীলতার ক্রমবর্ধমান ক্ষতি কেবল পরিবহন নীতির বিষয় নয়, এটি জাতীয় জরুরি অবস্থা, যার আশু ও ব্যাপক পদক্ষেপ প্রয়োজন।

মার্চ মাসের তথ্য বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সর্বাধিক প্রাণহানি ঘটেছে, যেখানে ২৩৩ জন নিহত, যা ওই মাসের মোট মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশের বেশি। মৃতের মধ্যে ৮৯ জন নারী ও ৯৭ জন শিশুও রয়েছে, যা স্পষ্ট করে সড়ক দুর্ঘটনা কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সবার ওপর প্রভাব ফেলে। পথচারী ও চালকরাও এর বাইরে নন; ওই মাসে ১০৯ জন পথচারী এবং ৯৮ জন চালক বা তাদের সহকারী নিহত হয়েছেন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে ছয়টি নৌপথ দুর্ঘটনা ও ১৬টি রেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির তথ্যও উঠে এসেছে, যা বাংলাদেশে পরিবহন ঝুঁকির বহুমাত্রিকতা নির্দেশ করে।
২০২৫ সালের শুরুতে সড়ক দুর্ঘটনার এই তীব্র বৃদ্ধি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিলক্ষিত বৃহত্তর প্রবণতার অংশ। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকের তথ্য ২০২৪ সালের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ এবং মৃতের সংখ্যায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

 ২০২৪ সালে মোট ৬ হাজার ৯২৭টি দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২৯৪ জন নিহত ও ১২ হাজার ১৯ জন আহত হয়েছিলেন। এটি ২০২৩ সালের তুলনায় প্রাণহানির সংখ্যায় ১২ শতাংশ এবং আহতের সংখ্যায় ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি নির্দেশ করে, যা জনসচেতনতামূলক প্রচারণা ও নীতিগত অঙ্গীকার সত্ত্বেও সংকটের অবনতি প্রমাণ করে।

দুর্ঘটনাগুলোর ধরন ও কারণ গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে বাংলাদেশের সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার গভীরে প্রোথিত সমস্যাগুলো স্পষ্ট হয়। চিহ্নিত প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, নিয়ন্ত্রণ হারানো ও মুখোমুখি সংঘর্ষ। ২০২৫ সালের মার্চে, ২৫৮টি দুর্ঘটনা ঘটেছে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে এবং ১৫৩টি মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে। সড়কের প্রকারভেদের দিক থেকে বিবেচনা করলে, জাতীয় মহাসড়কে ২২৮টি, আঞ্চলিক সড়কে ২৫৬টি, গ্রামীণ সড়কে ৭২টি এবং শহরের রাস্তায় ৩১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই পরিসংখ্যানগুলো ইঙ্গিত দেয় সমস্যাটি পদ্ধতিগত এবং এটি দেশজুড়ে সব ধরনের সড়কের ক্ষেত্রেই বিদ্যমান।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মতে, দুর্ঘটনার উচ্চহারের জন্য বিভিন্ন কারণ সম্মিলিতভাবে দায়ী। এর মধ্যে রয়েছে ত্রুটিপূর্ণ বা খারাপভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা যানবাহনের আধিক্য, অদক্ষ বা অযোগ্য চালক, ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অসচেতনতা, দুর্বল ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা এবং চাঁদাবাজির মতো অভ্যাস, যা অযোগ্য যানবাহন বা চালকদের চলাচল করতে সুযোগ করে দেয়। বিদ্যমান আইনের দুর্বল প্রয়োগ, অপর্যাপ্ত সড়ক অবকাঠামো এবং দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এই পদ্ধতিগত সমস্যাগুলোকে আরও জটিল করে তোলে।

উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর অন্যতম হলো মোটরসাইকেল-সংশ্লিষ্ট দুর্ঘটনার বিপুল সংখ্যা। ২০২৪ সালে মোট ২ হাজার ৭৬১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৬০৯ জন নিহত হয়েছিলেন, যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৩৬ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৭৫ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে, যা ইঙ্গিত দেয় জনসংখ্যার অর্থনৈতিকভাবে উৎপাদনশীল অংশ রাস্তায় প্রাণ হারাচ্ছে। বেশির ভাগ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সঙ্গেই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানো, বাস ও পণ্যবাহী ট্রাকের মতো ভারী যানবাহনের সঙ্গে সংঘর্ষ অথবা মুখোমুখি সংঘর্ষের সম্পর্ক রয়েছে। তরুণদের মধ্যে মোটরসাইকেলের ব্যাপক ব্যবহার এবং তাদের প্রায়শই ঝুঁকিপূর্ণ ড্রাইভিং আচরণ, আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও দুর্বল চালক প্রশিক্ষণের সমন্বয়ে মোটরসাইকেল দেশের অন্যতম বিপজ্জনক পরিবহন মাধ্যমে পরিণত হয়েছে।

পথচারীরাও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন, যারা ২০২৪ সালে মোট মৃত্যুর ২১ শতাংশের বেশি। রাজধানী ঢাকায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১ শতাংশের বেশি মৃত্যুর ঘটনা পথচারীদের। এর কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পথচারী পারাপারের অভাব, ভাঙা ফুটপাত, চালকদের বেপরোয়া আচরণ ও ট্রাফিক নিয়মের দুর্বল প্রয়োগ। অনেক এলাকায় পথচারীদের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো অনুপস্থিত, নয়তো অপর্যাপ্ত, ফলে মানুষ দ্রুতগতির যানবাহনের কাছাকাছি বিপজ্জনকভাবে হাঁটতে বাধ্য হয়।

ঢাকার পরিস্থিতি বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে। ২০২৪ সালে রাজধানীতে ৩৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এতে ২৪৬ জন নিহত ও ৪৮২ জন আহত হয়েছেন। এই মৃত্যুর মধ্যে ৭৬ শতাংশ পুরুষ, ১৩ শতাংশ মহিলা ও ১০ শতাংশ শিশু। একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হলো দুর্ঘটনাগুলোর ৪০ শতাংশের বেশি ঘটেছে রাতে। বাইপাস সড়কের অভাবে ভারী পণ্যবাহী ট্রাকগুলো গভীর রাতে শহরের রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হয়, প্রায়শই যানজট এড়াতে দ্রুত গতিতে চলে এবং মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হয়। তাছাড়া, শহরে দীর্ঘ যানজট চালকদের ক্লান্তি ও রাস্তায় ক্রোধের জন্ম দেয়, যা দুর্ঘটনার সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে তোলে।

রেল ও নৌপথ দুর্ঘটনাও এখন বড় সমস্যা। ২০২৪ সালে ১১৮টি নৌপথ দুর্ঘটনায় ১৫২ জন নিহত ও ১৬১ জন আহত হন, যেখানে ৩৪৭টি রেল দুর্ঘটনায় ৩২৪ জন নিহত ও ২৭৭ জন আহত হন। সড়ক দুর্ঘটনার তুলনায় এ ঘটনাগুলোর সংখ্যা কম হলেও, এগুলো বাংলাদেশের পরিবহনব্যবস্থার বৃহত্তর নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে। এই দুর্ঘটনাগুলো প্রায়শই একই ধরনের কারণ থেকে হয়- তদারকির অভাব, দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ, অবহেলা ও দুর্নীতি।

এ দুর্ঘটনাগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষতি ব্যাপক। শুধু ২০২৪ সালেই সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আনুমানিক অর্থনৈতিক ক্ষতি ২১,৮৮৬ দশমিক ৩২ কোটি টাকা, যা বাংলাদেশের জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। এই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়, উৎপাদনশীলতা হ্রাস, সম্পত্তির ক্ষতি ও মানবসম্পদের অপচয়। আর্থিক প্রভাব থেকে স্পষ্ট হয় সড়ক নিরাপত্তা কেবল মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক বোঝাও বটে।

সড়ক নিরাপত্তাসংকটের জন্য একাধিক পক্ষ দায়ী। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ড্রাইভিং লাইসেন্স, যানবাহনের ফিটনেস ও রাস্তার যোগ্যতা নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ এর কার্যক্রম দুর্বল করে। ট্রাফিক পুলিশ সড়ক আইন প্রয়োগের দায়িত্বে থাকলেও তাদের দৃশ্যমানতা সীমিত এবং প্রয়োগ অসঙ্গত। স্থানীয় সরকার সংস্থা, নগর পরিকল্পনাবিদ ও মহাসড়ক কর্তৃপক্ষের রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপদ পরিবহন অবকাঠামো নিশ্চিত করার ভূমিকা থাকলেও তাদের মধ্যে সমন্বয় দুর্বল।

যানবাহন মালিক ও পরিবহন কোম্পানিগুলোও তাদের দায় এড়াতে পারে না, যারা প্রায়শই নিরাপত্তার চেয়ে লাভকে অগ্রাধিকার দেয়। অনেক চালক অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করেন, দুর্বল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং কারও কারও লাইসেন্সও থাকে না। অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই করা, দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো ও ট্রাফিক নিয়ম উপেক্ষা করা সাধারণ ঘটনা। যাত্রী ও পথচারীদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে, বিশেষ করে যখন তারা ট্র্যাফিক সংকেত উপেক্ষা করে বা অনিরাপদ পরিস্থিতিতে চলাচল করে, যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার তুলনায় তাদের ভূমিকা নগণ্য।

এই গভীর সংকট মোকাবিলায় ট্র্যাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, বাধ্যতামূলক চালক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্সিং, সব যানবাহনের নিয়মিত ফিটনেস পরীক্ষা এবং উন্নত সাইনবোর্ড, পথচারী পারাপার ও আলোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য রাস্তার অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। বুদ্ধিমান ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা চালু করা ও নজরদারি ক্যামেরার ব্যবহার বৃদ্ধি করা নিয়ম লঙ্ঘনকারীদের চিহ্নিত করতে ও তাৎক্ষণিকভাবে জরিমানা কার্যকর করতে সাহায্য করতে পারে।

সড়কে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চালক ও সাধারণ জনগণ উভয়ের জন্যই সচেতনতামূলক প্রচারণা অপরিহার্য। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের পাঠ্যক্রমের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তাশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সংঘর্ষ কমাতে সরকারের উচিত বাইপাস সড়ক ও বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের জন্য পৃথক লেন নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া। উপরন্তু, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যা ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের রাস্তায় চলাচল করতে সুযোগ করে দেয়।

পরিশেষে, সড়ক নিরাপত্তাকে একটি শীর্ষস্তরের নীতিগত বিষয় হিসেবে বিবেচনা করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জাতীয় অঙ্গীকার থাকতে হবে। সাময়িক কঠোর ব্যবস্থা বা সচেতনতা সপ্তাহের মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশের একটি দীর্ঘমেয়াদি, তথ্যনির্ভর সড়ক নিরাপত্তা কৌশল প্রয়োজন, যা কঠোরভাবে প্রয়োগযোগ্য আইন দ্বারা সমর্থিত এবং নিরাপদ পরিবহন অবকাঠামোয় বিনিয়োগ দ্বারা বাস্তবায়িত হবে। সুইডেনের ভিশন জিরো উদ্যোগের মতো আন্তর্জাতিক মডেলগুলোকে স্থানীয় প্রেক্ষাপটে অভিযোজিত করে প্রাণহানির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা যেতে পারে।

বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তাসংকট গভীর কাঠামোগত ও প্রশাসনিক সমস্যা প্রতিফলিত করে। বিশেষ করে যুবক, নারী এবং শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর উচ্চ সংখ্যা কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি মানব জীবনের মূল্যের একটি হৃদয়বিদারক সূচক।। যতক্ষণ না সব অংশীদার, সরকারি সংস্থা, বেসরকারি অপারেটর ও নাগরিকরা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে একত্রিত না হয় এবং দৃঢ় পদক্ষেপ না নেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাস্তাগুলো নিরাপদ যাতায়াতের পরিবর্তে ট্র্যাজেডির স্থান হয়েই থাকবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী পরিবর্তন প্রয়োজন

প্রকাশ: ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:১৮ পিএম
দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী পরিবর্তন প্রয়োজন
রাশেদা কে চৌধূরী

শিক্ষাক্রম বিশ্বব্যাপী চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। মানুষের চাহিদা এবং যুগের প্রয়োজনে এটি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা উচিত। একই সঙ্গে আমি মনে করি, পরিবার থেকে শিক্ষার্থীদের বিকাশ শুরু করতে হবে। মা-বাবাকে তার সন্তানদের দিকে নজর দিতে হবে। সেই নজর দেওয়া বলতে তাদের মেধা সুস্থভাবে বিকাশ হচ্ছে কি না প্রথমেই সেদিকটা দেখতে হবে। তার পরের দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। আমাদের দেশে শিক্ষকরা শিক্ষাদানে যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষ নয়। বিশ্বমানের শিক্ষার্থী তৈরি করতে শিক্ষকদের দক্ষ করে তৈরি করা দরকার।...

দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী এবং তা হতে হবে সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ন্যূনতম কতগুলো বিষয়ে অবশ্যই পড়ালেখা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রত্যেক শ্রেণির ক্ষেত্রে পড়ালেখার পাশাপাশি দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাক্রমে কোনো বিভাজন থাকা উচিত নয়। বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভাজন করেই শিক্ষার্থীদের আমরা আরেকটি জালের ভেতর ফেলে দিয়েছি। আজকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মানবিকে যায় না। মানবিকের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের ধারে কাছে যেতে চায় না। আমি মনে করি, বিভাজনের কোনো দরকার নেই। শিক্ষাক্রম বিশ্বব্যাপী চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। মানুষের চাহিদা এবং যুগের প্রয়োজনে এটি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা উচিত।

 একই সঙ্গে আমি মনে করি, পরিবার থেকে শিক্ষার্থীদের বিকাশ শুরু করতে হবে। মা-বাবাকে তার সন্তানদের দিকে নজর দিতে হবে। সেই নজর দেওয়া বলতে তাদের মেধা সুস্থভাবে বিকাশ হচ্ছে কি না প্রথমেই সেদিকটা দেখতে হবে। তার পরের দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। আমাদের দেশে শিক্ষকরা শিক্ষাদানে যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষ নয়। বিশ্বমানের শিক্ষার্থী তৈরি করতে শিক্ষকদের দক্ষ করে তৈরি করা দরকার। আমরা দেখেছি শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেও শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণের বাস্তবায়ন করেননি। এই হলো শ্রেণিকক্ষের ভেতরে শিক্ষকদের দক্ষতার প্রমাণ। পুঁথিগত বিদ্যা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে শিক্ষার্থীদের সরে আসতে হবে। আমরা যদি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারি, তাহলে আমাদের বাচ্চারা আরও পিছিয়ে যাবে। 

আমাদের দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার হয়নি। বরঞ্চ দিনের পর দিন একইভাবে চলতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। সোজা কথায়, ক্রমপরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে আমরা বদলাইনি। ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে পাঠ না দিয়ে, পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোচিং বাণিজ্যের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাইড বইনির্ভর একটি সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে। যেটি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ আছে যেখানে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীর মান নির্ধারণ হয় না কিংবা দক্ষতা যাচাই হয় না। শ্রেণিকক্ষভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়নের মধ্যদিয়ে অর্থাৎ নিয়মিত মূল্যায়ন-প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে দক্ষতা যাচাই হয়। কাজেই গতানুগতিক শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পুরো শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে সেটি হতে হবে সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে আমি অবশ্যই মনে করি, শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ধারাকে বিরোধিতা না করে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সেটিকে স্বাগত জানানো উচিত। 

আমরা জানি, শিক্ষার মূল ভিত্তিটুকু গড়ে ওঠে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। কাজেই শিক্ষায় পরিবর্তনও প্রাথমিক পর্যায় থেকে সূত্রপাত হতে হবে। সেই সময়টুকু শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার ভিত্তিটুকু শক্ত করতে হলে আমাদের প্রধানত তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। দক্ষ শিক্ষক, সক্ষম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিয়মিত মনিটরিং ইত্যাদি। সে ক্ষেত্রে যথার্থ বিনিয়োগ প্রয়োজন। এমনিতেই শিক্ষা সরঞ্জামের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি। এর আগে কলম উৎপাদনে ভ্যাট বসানো হয়েছিল। বিদেশি সফটওয়্যারে ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে আবার ১৫ শতাংশ ভ্যাটও বসবে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের নানারকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। পরিবারকে শিক্ষা সরঞ্জামগুলোর ব্যয়ভার বহনে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। 


আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত বাজেট দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নিম্নতম। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো সেদিক থেকে অনেক বেশি অগ্রগামী। এখন পর্যন্ত শিক্ষায় আমাদের বিনিয়োগ জাতীয় আয়ের খুবই সামান্য অংশ, যা অবশ্যই কয়েক গুণ বাড়ানো দরকার। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাস্তব বিষয়গুলো আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থাপনায় আমাদের বড় বড় মেগা প্রকল্প দরকার। আমরা যদি মানবসম্পদ বিনির্মাণে বিনিয়োগ না করি, তাহলে বড় বড় গার্মেন্টসের মতো স্ট্রাকচারগুলো চালু করার জন্য বিদেশ থেকে আমাদের জনশক্তি আমদানি করতে হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনসংকট প্রকট। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসনসংকট রয়েছে। অধিকাংশ হোস্টেলে ৬৫ শতাংশ মেয়েরা এক রুমে তিন-চারজন করে থাকে। ছেলেরা অপেক্ষাকৃত একটু আরামেই থাকে। এই জায়গায় জেন্ডারবৈষম্য আছে বলে মনে করছি। কারিগরি শিক্ষায় কর্মসংস্থান বাড়াতে বৈষম্য কমানোর জন্য প্রযুক্তি এবং কারিগরি শিক্ষাকে আরও এগিয়ে নিয়ে আসা দরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা বিশেষ প্রকল্পই আছে এটার জন্য। বিশেষ করে শিক্ষা গবেষণা উন্নয়নে আমরা সঠিক মাত্রায় বিনিয়োগ দেখি না। বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা না করে ঠিকাদারদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা মতানৈক্য আগে প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ করে কত বড় সাফল্য দেখিয়েছে। শিক্ষা গবেষণায় বিনিয়োগটা খুব দরকার বলে মনে হয়। 

আমরা আশাবাদী মানুষ। আমাদের কিছু হতাশাও আছে। আশার কথা, সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন-পরিমার্জন হচ্ছে এবং অবশ্যই তা হতে হবে। দেশে যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, নীতিনির্ধারক যারা আছেন, তারা প্রতিনিয়তই চেষ্টা করছেন। এখনো পুরোপুরি না হলেও ইতোমধ্যে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন এসেছে। ধীরে ধীরে সব শ্রেণিতেই সেটি সম্ভব হবে বলে আশা করি। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি এত সহজ কাজ নয় যে, চাওয়ামাত্রই সেটি দ্রুত বাস্তবায়িত করে ফেলা সম্ভব। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। সে জন্য আমাদের সময় দিতে হবে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ডিজিটাল বৈষম্য দূরীকরণের জন্য প্রযুক্তিগত কাঠামো উন্নয়ন।

 এখানে ব্যাপকভাবে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। প্রযুক্তি সবার জন্য। বিশ্বব্যাপী নারীরা এই প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে আছে। ইউনেস্কোর রিপোর্ট সেটা বলছে। যেখানে ছেলেদের অংশগ্রহণ ৬০ শতাংশের ওপর, সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ ৩০ শতাংশেরও কম। নারী-পুরুষ ও ধনী-দরিদ্রের একটা বৈষম্য আমরা দেখেছি। আমরা তরুণ প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে চাই এবং সেটা অবশ্যই আমাদের করে দেখাতে হবে। শিক্ষায় আরও মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি যারা মিথ্যাচার করে, জনমনে হতাশা ছড়ায়, তাদের বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। সে লক্ষ্যে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এবং আমি বিশ্বাস করি, পরিবর্তন আসবেই। 

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা