
দেশের অর্থনীতি মূলত বহমান থাকে বেসরকারি খাতের মাধ্যমে। তারা সক্রিয় হবে কি না, তা নির্ভর করবে তাদের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে কি না, তার ওপরে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খোলামেলা এনগেজমেন্ট কোথায়? ব্যবসায়ী মানে শুধু এফবিসিসিআই নয়। সাধারণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের উদ্যোগ তো দেখছি না। সংকট সামাল দেওয়া একটা প্রায়োগিক কাজ। এটা তাদের করতে হবে। অর্থনীতির মূল কাজ আস্থা তৈরি ও ব্যবসার পরিবেশের উন্নতি। বিবেচনা করতে হবে সরকার কাজটি করছে কি না। দেশের মানুষ নতুন বাংলাদেশ তৈরি করতে চাইছে। তাদের নিয়ে আমরা কীভাবে এগোব, সেই কার্যকর উদ্যোগ দরকার ছিল।
উপদেষ্টাদের মাঠে-ময়দানে বেশি করে যাওয়া উচিত ছিল। কারণ সাধারণ মানুষ তাদের দেখতে পেলে বুঝতে পারবে, সরকার কাজ করছে। প্রকৃতপক্ষে সেটা দেখা যাচ্ছে না।
এখন মূল সমস্যা হচ্ছে, এই সরকারের রাষ্ট্র পরিচালনার স্টাইলে। সবার আগে সরকারের নিজেকেই একটা বড় ঝাঁকুনি দিতে হবে। অনেকটা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে। জনগণের কাছে যাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এটা সাধারণ মানুষের বড় উদ্বেগ। কোটা সংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল কর্মসংস্থান; কিন্তু কর্মসংস্থানের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন করলে আমরা কী উত্তর দেব জানি না। এ ব্যাপারে মনোযোগ কোথায়, উদ্যোগ কোথায়? সরকারকে অনেক দ্রুততার সঙ্গে কাজটি করতে হবে। বন্যার পর সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আমলাতান্ত্রিকভাবে এ সমস্যার সমাধান খুঁজতে গেলে দুই বছর বসে থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের এখনই কৃষকদের বীজ, সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ দিয়ে দিতে হবে। আমাদের দেরি করার সময় নেই।
দুর্নীতি ও নিষ্ঠুরতা, মানুষের প্রতি অত্যাচার, সীমাহীন পর্যায়ে গিয়েছিল। তিনটি আকাঙ্ক্ষা এখানে সর্বজনীন। প্রথমত, দৈনন্দিন সমস্যার সহনীয় সমাধান ও সমাধানের দৃশ্যমান ও কার্যকর চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, স্থিতিশীল পরিবেশ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অন বোর্ড রাখতে কার্যকর বয়ান নির্মাণ। তৃতীয়ত, টেকসই ও নৈতিকতার ছাপ আছে এমন রাজনৈতিক উত্তরণের রোডম্যাপ তৈরি। অন্তর্বর্তী সরকার আলাদা আলাদা অনেক উদ্যোগ নিচ্ছে; কিন্তু এসব উদ্যোগ সামগ্রিক কোনো আস্থার পরিবেশ তৈরি করছে বলে মনে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের স্টাইল দৃশ্যত আমলা, বিশেষজ্ঞ ও ছাত্রদের ওপর অতি নির্ভরশীলতার ঘেরাটোপে ঘুরপাক খাচ্ছে। শেয়ারমার্কেট কেলেঙ্কারি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির রিপোর্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি; কিন্তু অনেক ছোটখাটো দুর্নীতির বিষয় নিয়ে সরকারকে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র-জনতার বিপ্লব এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এই বিপ্লব প্রত্যাশিত, একই সঙ্গে আকস্মিক বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছরের ইতিহাসে শেখ হাসিনার শাসনামলকে নজিরবিহীন স্বৈরতন্ত্র চর্চার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়। বিশেষ করে বিগত সরকারের শাসনামল মৌলিকভাবে বিপরীত দিকে চলে গিয়েছিল। গুম, খুন, হত্যা, গায়েবি হামলা, নির্যাতন প্রতিদিনের বাস্তবতায় পরিণত হয়েছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সর্বত্র নানারকম অত্যাচার হয়েছে। মানুষকে ন্যায়নীতিহীন দুঃসহ যাতনা বয়ে বেড়াতে হয়েছে। কোথাও কোনো নিয়ম-নীতি ছিল না। দেশের সাধারণ মানুষ মুখ বুজে সহ্য করছিল। কিন্তু আর নিতে পারছিল না। অনেকদিন থেকেই সাধারণ মানুষের মনের কথা ছিল যে, মানুষ পরিবর্তন চায়। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নানারকম আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও রাজনৈতিক দলগুলো যথাযথ আন্দোলন সংগঠিত করতে পারছিল না। রাজনৈতিক দলগুলো যা দেখাতে পারেনি, ছাত্ররা তা করে দেখিয়েছে। তারা বেপরোয়া সাহস দেখিয়ে মানুষকে সাহসী করে তুলেছিল। সে কারণে জনগণ তাদের সঙ্গে মাঠে নেমে এসেছিল। একপেশে পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভর করে এত দিন শেখ হাসিনার শাসন টিকে ছিল। সেই স্তম্ভ নড়বড়ে হয়ে ভেঙে পড়ায় দ্রুত সরকারের পতন হয়।
আবু সাঈদ এবং অন্য অনেকের আত্মত্যাগ ও সাহস সেই ভয়কে ভেঙে দেয়। ভয় ভেঙে যাওয়ার এই মনস্তাত্ত্বিক উত্তরণ সরকারের পতন ঘটায়। ছাত্রদের আন্দোলনে যুক্ত হয় জনতা। সরকার এতদিন তাসের ঘরের মধ্যে ছিল। শুরুতে একটি বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্য দিয়ে সরকারকে যেতে হয়েছে। এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। স্বৈরাচারী সরকার পতনের পর বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে জনমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল। একই সঙ্গে তা কার্যকরভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল। গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকারের প্রধান কাজ ছিল মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনায় নিয়ে দেশকে সুসংহত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া।
সরকারের উচিত ছিল মানুষের সঙ্গে কথা বলা। জনগণের কাছে যাওয়া। তাদের কথা শোনা অর্থাৎ ব্যাপকভাবে জনবান্ধবমূলক উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল। জনগণের আস্থাভাজন হতে এই কাজগুলো করা দরকার ছিল। এটা একটা রাজনৈতিক কাজ। একথা সত্যি যে, এই সরকার প্রচলিতভাবে রাজনৈতিক সরকার না হলেও তাদের কাজটা রাজনৈতিক। যে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই পরিবর্তন নেতারা আনেনি। এই পরিবর্তন দেশের আমজনতা এনেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ জরুরি ছিল।
পতিত স্বৈরাচার সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে আমলাতন্ত্র- সবখানেই তাদের সহচর রয়ে গেছে। তাদের পাল্টা আঘাত হানা এবং বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করা আমরা দেখেছি। কাজেই সেটি মোকাবিলা করাও একটি বড় কাজ ছিল; যা সরকার মোকাবিলা করেছে। কিন্তু গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে কাজে লাগানোর বৃহত্তর কাজটি হলো কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য ফেরানো একটি জরুরি কাজ হলেও বৃহত্তর কাজ হচ্ছে অর্থনীতির চাকাকে আরও চাঙা অবস্থায় ফেরানো। যাতে কর্মসংস্থান ত্বরান্বিত হতে পারে। বিনিয়োগ বাড়তে পারে। দ্রব্যমূল্য সহনীয় করার জন্য বাজারব্যবস্থাপনার উন্নতি হতে পারে। আইএমএফের কয়েক বিলিয়ন ডলারের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগ শত শত বিলিয়নের সম্ভাবনার দিকেই নজর দিতে হবে। তা দিতে হবে কার্যকরভাবে শুধু ঘোষণা ও আমলাতান্ত্রিক আশ্বাসের মধ্য দিয়ে নয়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি থেকে সহায়তা পাওয়া অবশ্যই স্বস্তির জায়গা। বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রকট দুর্বলতাগুলো কাটাতে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে হয়।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে কীভাবে সংশোধন করবে, বাংলাদেশকে নিজের জন্য একটি মানসিক রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। এই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম বার্তা হচ্ছে- বাংলাদেশ যেকোনো ধরনের আধিপত্যবাদী চাপ বরদাশত করবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক আর আধিপত্যবাদী চাপকে রুখে দাঁড়ানো- এ দুটি আলাদা বিষয়। আমরা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অবশ্যই সুসম্পর্ক রক্ষা করব এবং একই সঙ্গে কোনো আধিপত্যবাদী মনোভাবকে মেনে নেব না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পর্যায়ে তুলে ধরা এবং এ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
আমাদের ঠিক করতে হবে বাংলাদেশকে আমরা কোথায় নিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশের আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার প্রতীকে পরিণত হওয়া কোনো অলীক কল্পনা নয়। তৃতীয়ত, আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সংকীর্ণ মাইন্ডসেটআপে আবদ্ধ রয়েছি। এই মানসিক পরিসর বাড়ানো জরুরি। বাংলাদেশের মানসিক শক্তির যে বিকাশ ঘটেছে, এখন থেকে বৈশ্বিক দক্ষিণকেও আমাদের অন্যতম বিচরণক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং ধাপে ধাপে বৈশ্বিক দক্ষিণের অন্যতম জাতি রাষ্ট্রে উন্নীত করতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের মনে অনেক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে সুযোগও তৈরি হয়েছে। সরকার যাতে জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালোমতো সেই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারে। আমাদের সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে চেষ্টা করে যেতে হবে।