বাতাসের মধ্যে ডুবে থেকে আমরা যেমন টের পাই না, বাতাসের মধ্যে ডুবে আছি; তেমনি মেধাসম্পদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের (Intellectual Property-IP) মধ্যে বসবাস করেও এর অস্তিত্ব অনুভব করি না! গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, বর্তমান পৃথিবীর সম্ভ্রান্ত শ্রেণি এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা প্রতিটি মানুষই সকাল থেকে রাত অবধি কোনো না কোনোভাবে এক থেকে দেড় শ আইপি ব্যবহার করছেন! যেমন- একজন সভ্য মানুষ ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে হাতে তুলে নেন টুথ ব্রাশ ও পেস্ট। এই দুটো নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীই কারও না কারও আবিষ্কার এবং এদের গায়ে সেঁটে থাকে ট্রেডমার্ক। দাঁত পরিষ্কার করার পর নাশতার টেবিলে এসে মুখোমুখি হন রুটি, পরোটা, প্লেট-কাপ, চা-কফিসহ আনুষঙ্গিক নানা পণ্য বা সামগ্রীর। প্রতিটি বস্তুই কোনো না কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠাজাত, যার প্রত্যেকটিতে রয়েছে ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট বা ডিজাইনের সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ; এর সবই শিল্পজাত মেধাসম্পদের অন্তর্গত।
নাশতার টেবিলে বসে আমরা অনেকে চোখ বুলাই সংবাদপত্রে, কর্ম উপলক্ষে যানবাহনে চড়ে কর্মস্থলের উদ্দেশে ছুটে চলি, যেতে যেতে শুনি কথা ও সুর সংবলিত গান। কেউ বা চোখ বুলাই বইয়ের পাতায়, যাত্রায় বিলম্ব হলে ঘন ঘন দৃষ্টি ফেরাই ঘড়ির দিকে, মোবাইলে বাক্যালাপ করি অহরহ, ছুটির দিনে সিনেমা, নাটক দেখতে যাই, টেলিভিশন দেখি। শহরবাসী তো বটেই, গ্রামের স্বল্প আয়ের মহিলাদের হাতেও অলংকারের মতো শোভা পায় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা বলার যন্ত্র মোবাইল ফোন, যাতে যুক্ত আছে মেধাসম্পদের ন্যূনতম চারটি উপাদান। এই যে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে মনের অজান্তে তার সব কিছুতেই এক কথায় ব্যবহৃত হচ্ছে আইপি বা মেধাসম্পদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ।
বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংস্থা (World Intellectual Property Organization) যা WIPO নামে মেধাবিশ্বে পরিচিত, তাদের ভাষ্যমতে- ‘It involves the products of the human mind– the fruits of human creativity and invention. It is with us every day of our lives, from dawn to dusk, while we are at school, while we are hanging out with our friend, and even as we sleep.’
WIPO তাদের অন্য একটি প্রকাশনায় মেধাসম্পদের সংজ্ঞা করেছে নিম্নরূপ:
‘Intellectual Property refers to creation of the mind: inventions, literary and artistic works and symbols, named and images used in commerce.’ আমরা সবাই জানি, মেধাসম্পদ প্রধানত দুটি শাখায় বিভক্ত। এই ভাগ সম্পর্কে WIPO বলছে- ‘There are two categories of Intellectual Property. The first, industrial property, includes inventions (patents), trademarks, copyright and related rights, includes a broad range of literary and artistic works, written, performed, and recorded.’
২
পৃথিবীব্যাপী জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোতে আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস’ বা আইপি ডে। ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল থেকে দিবসটি প্রতিবছর উদযাপিত হয়ে আসছে। সৃষ্টিশীল মানুষের মেধাসম্পদ অধিকার সুরক্ষা ও সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে দিবসটি মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, মেধাসম্পদ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে বর্ণিত মানুষের জন্য স্বীকৃত অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম অধিকার। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ২৭-এ বলা আছে- (ক) প্রত্যেকেরই গোষ্ঠীগত সাংস্কৃতিক জীবনে অবাধে অংশগ্রহণ করা ও শিল্পকলা চর্চা করার অধিকার রয়েছে। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সুফলগুলোর অংশীদার হওয়ার অধিকার রয়েছে। (খ) বিজ্ঞান, সাহিত্য অথবা শিল্পকলাভিত্তিক সৃজনশীল কাজের থেকে যে নৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থের উদ্ভব হতে পারে, তা রক্ষা করার অধিকার রয়েছে প্রত্যেকের।
বিগত বছরগুলোর মতো এ বছর WIPO বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের প্রতিবাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘IP and music: Feel the beat of IP.’ বাংলায় বললে, ‘আইপি ও সংগীত: মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন’। WIPO তাদের IP পোর্টালে বলেছে- ‘World intellectual property day 2025 highlights creativity and innovation backed by IP rights, keep a vibrant diverse, and thriving music scene that benefits everyone, everywhere.’
সংগীত যেহেতু সাংস্কৃতিক মেধাসম্পদের একটি অনিবার্য অংশ, সে জন্য প্রতিপাদ্যে যাওয়ার আগে আমি সাংস্কৃতিক সম্পদ সম্পর্কে জাপানি মেধাসম্পদ বিশেষজ্ঞ তমোতসু হোজুমির ‘এশিয়ান কপিরাইট হ্যান্ডবুক’ থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করছি। হোজুমি বলছেন, ‘মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আহারের দরকার। মানব শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খাদ্য অত্যন্ত জরুরি। আহার আমাদের পুষ্টি জোগায় এবং বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু আমরা স্তন্যপায়ী প্রাণী, আমাদের শুধু দেহের পুষ্টি সাধনই যথেষ্ট নয়, আমাদের মন ও হৃদয়ের পুষ্টিরও প্রয়োজন আছে।’
যদি আপনি সাংস্কৃতিক কর্মকে আমাদের আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তির জন্য আহারের সঙ্গে তুলনা করেন তবে সহজেই সাংস্কৃতিক কর্মের সংজ্ঞা উপলব্ধি করতে পারবেন। এমন একটি জগতের কথা ভাবুন যেখানে আমাদের আত্মার সাংস্কৃতিক কর্মের অস্তিত্ব নেই! উপন্যাস, কবিতা, সংগীত অথবা চিত্রকলাহীন একটি পৃথিবীর কথা ভাবুন। আমাদের হৃদয়কে সমৃদ্ধ করে যেসব সাংস্কৃতিক কর্ম, তা মানব-ইতিহাসে আমাদের জন্য এক মূল্যবান ঐতিহ্য।’
৩
আমরা ইতোমধ্যে অবগত হয়েছি, এবারের আলোচনা সংগীতকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত হবে। আমরা মেধাসম্পদ হিসেবে সংগীত স্রষ্টার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হব। আসলে সংগীত কী? প্রাচ্যের প্রাজ্ঞজনদের দৃষ্টিতে ‘সংগীত হচ্ছে নৃত্য, গীত ও বাদ্যের সমন্বয়।’ অর্থাৎ সংগীত মানবসৃষ্ট একটি যৌথ বা গুচ্ছ নান্দনিক সাংস্কৃতিক কর্ম। সংগীতের প্রাণ, ছন্দ বা বিট মূলত জীবনেরই ছন্দ। মেধাসম্পদের বিশ্বে সংগীত সৃষ্টিকে ‘সংগীত-কর্ম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংগীত মেধাসম্পদের অন্তর্গত, কপিরাইটসের বিষয়বস্তু। কথাবিহীন সুরও সংগীতের অন্তর্ভুক্ত। কথা ও সুর সংবলিত সংগীত সৃষ্টিতে দুই ধরনের অধিকার জন্ম নেয়। একটি কপিরাইট, অন্যটি রিলেটেড রাইটস। উদাহরণ উপস্থাপন করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। একটি গানের ক্ষেত্রে থাকেন গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। গানের বাণীর রচয়িতা বা গীতিকার এবং যিনি সুর সৃষ্টি করেন, তাদের অধিকার কপিরাইটের ওপর। তারা মূল স্রষ্টা হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু যে কণ্ঠশিল্পী গান রচনা এবং সুর সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখেননি, কেবল কণ্ঠে ধারণ করেছেন, তিনি পারফর্মার- রিলেটেড রাইটস বা আনুষঙ্গিক অধিকারের মালিক। তাদের অধিকারের মেয়াদও ভিন্ন ভিন্ন।
৪
সংগীতের উদ্ভব, বিকাশ ও সম্প্রসারণ মানব সভ্যতার বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে। ভারতীয় পুরাণে ‘ওঙ্কার’ ধ্বনির মধ্যেও পাওয়া যায় সংগীতের রেশ। অরণ্যচারী মানুষ, কৃষিজীবী মানুষ, জীবনকে পরিপূর্ণভাবে যাপন করতে গিয়ে শ্রমবিভাজনের দিকে যেমন দৃষ্টি দিয়েছে, তেমনি কর্মহীন দিনযাপনের সময় মনোযোগী হয়েছে মনের আনন্দে আত্মাকে তৃপ্ত করার বাসনায়। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। প্রাচীন সভ্যতার শুরুতে আদিবাসী মানুষ কালপরিক্রমায় কীভাবে নিজেদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রেখেছে, বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালে সেই স্বাতন্ত্র্যের স্পষ্ট ছবি এখনো দেখতে পাব। নেপালের রাজদরবারে প্রাপ্ত চর্যাপদ, মধ্যযুগের গীতিকবিতা, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি সাহিত্যকর্মে যে সংগীতের অনিবার্য উপাদান বিদ্যমান, আজ তা গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গবেষকগণ লক্ষ করেছেন- চর্যাপদ ও অন্য কাব্যধর্মী সাহিত্যের শিরোদেশে তাল, লয় ও রাগিণীর উল্লেখ রয়েছে।
দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমান বাংলাদেশে শতাব্দীকালের আগে থেকে কপিরাইট আইন বলবৎ থাকার পরও অধিকার হরণের কার্যকর সমাধান সংগীত কর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর পেছনে স্বত্বাধিকারীদের চরম উদাসীনতা, অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা ও কার্যকর ভূমিকা পালনে দক্ষতার অভাব মূলত দায়ী! গত দেড় দশকে মেধাসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সদাসয় সরকার তথা কপিরাইট অফিসের সহযোগী মনোভাব ও ইতিবাচক ভূমিকার ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে BLCPS (Bangladesh Lyricists Composers & Performers Society) নামের প্রথম CMO বা Collective Management Organization. প্রতিষ্ঠানটি সংগীত স্রষ্টাগণের অধিকার সংরক্ষণ, সুরক্ষা, দেশে-বিদেশে রয়ালটি আদায় এবং চুক্তিবদ্ধ দেশের সংগীতস্রষ্টাদের স্বার্থে কার্যকর দায়িত্ব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে। আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে মহৎ আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীব্যাপী CMO কাজ করে, ঠিক একই ধরনের ম্যান্ডেট আমাদের CMO-কে দেওয়ার পরও বহু স্রষ্টাকে এক ছাতার তলে এখনো আনা সম্ভব হয়নি।
৫
একজন স্রষ্টাকে পরিপূর্ণভাবে সৃষ্টিশীল কর্মে নিয়োজিত করতে হলে তার রুটি-রুজির উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও বৈধ অধিকার অর্জনের পদ্ধতি আবিষ্কার করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। পাইরেসিসহ নানা বেআইনি কার্যকলাপের কারণে স্রষ্টারা বারবার প্রতারিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন, আইনি ঝামেলায় জড়াচ্ছেন। কখনো কখনো সংগীতকর্মের সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও বঞ্চিত হোন স্রষ্টারা। আমরা অনেকেই জানি যে, বেসরকারি এফএম রেডিওগুলো এলিফেন্ট রোডের দোকান থেকে স্বল্পমূল্যে সংগীত সংগ্রহ করে সম্প্রচার করছে তাদের মিডিয়ায়! ইউটিউব নামক ভিডিও সম্প্রচার ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে কে-কার সংগীত কর্ম আপলোড করছে, তা সব সময় ট্র্যাক করা বা নজর রাখাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ডিজিটাল প্রতারণা ও বঞ্চনার পরিমাণ। ছন্দপতন ঘটছে সৃষ্টিশীলতায়।
৬
সংগীতের দার্শনিক ও বাস্তব গুরুত্ব বিবেচনা করেই WIPO এ বছর সংগীতকে বিষয়বস্তু করেছে। বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের এই দিনে গভীর বিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে সব স্টেকহোল্ডারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাই। শিল্পীদের আর্থিক ও নৈতিক বঞ্চনার হাত থেকে বাঁচার জন্য ‘শিল্পী রক্ষা সমিতি’-র পরিবর্তে তারা যেন তাদের সৃষ্টির বিনিময়ে মর্যাদাবান জীবন নিয়ে টিকে থাকতে পারেন, তা নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা আর আলাউদ্দিন আলীর মতো গুণী স্রষ্টাদের হারাতে চাই না। আসুন আমাদের মেধাবী স্রষ্টাদের জন্য দৃশ্য-অদৃশ্য সব বাধা দূর করার সমবেত অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। তাদের দিই উদ্বেগহীন সৃষ্টিশীলতার আনন্দ। সব স্রষ্টাই যাতে নিবিষ্ট চিত্তে, হাসিমুখে দেশ ও দশের জন্য কল্যাণধর্মী কালজয়ী সৃষ্টি উপহার দিয়ে যেতে পারেন, সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি।
লেখক: কবি ও সদস্য, কপিরাইট বোর্ড