
একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। ২০০৯ সাল, নিউইয়র্ক বাংলা বইমেলায় যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে গেছি। উঠেছি নিউইয়র্কের জ্যামাইকায়। আর বইমেলা হলো বাঙালিপাড়া বলে খ্যাত জ্যাকশন হাইটে। প্রথমবার নিউইয়র্ক। যার বাসায় উঠেছি, তিনি সাবওয়ের একটি স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে বললেন, পনেরো স্টেশন পার হলেই আপনি নামবেন। ট্রেনে উঠেই দেখলাম পুরো কম্পার্টমেন্ট নীরব, যাত্রীরা যার যার মতো বই পড়ছে, বসে আছে, দাঁড়িয়ে আছে, মোবাইল দেখছে কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্য নেই। আমি নিজেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিন্তু কখন যে ষোলো নম্বর স্টেশন পার হয়ে গেছি টের পাইনি। যাই হোক, সেখানে নেমে একটু ইতস্তত করছি, এমন সময় আমার চিন্তিত রূপ দেখে হঠাৎ করেই আমার সামনে হাজির হলেন সাদা পোশাকধারী একজন জায়েন্ট ফিগারের পুলিশ এবং আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ক্যান আই হেলপ ইউ?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘প্লিজ’। তখন তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথায় যাবে (অবশ্যই ইংরেজিতে)’? আমার স্টেশনের কথা বলতেই, তিনি তাকে অনুসরণ করতে বললেন এবং আমাকে ওপাশে নিয়ে ‘ই’ ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে বললেন, ‘পরের স্টেশনেই তুমি নেমে যাবে’। বললাম, ‘মেনি থ্যাংকস’।
তিনি বললেন, ‘ইউ আর ওয়েলকাম’। ব্যস, আমি পরের স্টেশনে নেমে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলাম, হায়রে প্রিয় দেশ বাংলাদেশ? দেশের গণপরিবহন এবং পরিবহনে আমাদের নিয়ম-কানুন, আচার-আচরণ? ব্যক্তিগতভাবে রাজধানী ঢাকায় আছি প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর। প্রথম জামালপুর থেকে ট্রেনে এসে নেমেছিলাম কমলাপুর স্টেশনে। মনে আছে সেই গাদাগাদি, মানুষের কলরব, দীর্ঘ সময় ধরে অসহ্য গরমের মধ্যে বসে থাকা, তার পর গভীর রাতে বাস ধরে মিরপুরের বাসায় আসা? এর মধ্যে ভয় ছিল ট্রেনের মধ্যে ডাকাতি, বিশেষ করে ময়মনসিংহ পার হলে গফরগাঁও ডাকাত এলাকার ভয় কুরে কুরে খেয়েছে। এখন বাংলাদেশের ট্রেনযাত্রা মোটামুটি স্বস্তির হলেও, অন্যান্য অনেক সমস্যা রয়েছেই।
বিমানে উঠেছি অনেক পরে কিন্তু রাজধানীসহ সারা দেশের শহরগুলোতে গণপরিবহন বলতে ট্রেনের পরেই বাস, এই বাসে চড়েই প্রতিদিন যাতায়াত করি এখান থেকে সেখানে। এই গণপরিবহনে ওঠার নানান দুঃসহ অভিজ্ঞতা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত পাই। বলতে হবে, গণপরিবহনগুলোতে প্রথম সমস্যা যাত্রীদের আচরণ। আপনি বাসে ওঠেন, ট্রেনে ওঠেন, টেম্পোতে ওঠেন, লঞ্চে ওঠেন কিংবা বর্তমান বাংলাদেশে নতুন যুক্ত আধুনিক মেট্রো ট্রেনে ওঠেন- দেখবেন যাত্রীদের আচরণ বদলায়নি? আমরা জানি আচরণ শিক্ষার প্রথম পাঠশালা নিজের পরিবার। পরিবারের অভিভাবকরাই শিখিয়ে দেবেন অথবা বলে দেবেন কোথায় কীভাবে চলতে হবে, কথা বলতে হবে, কাকে বসার সিট ছেড়ে দিতে হবে, কাকে সিটে বসতে আহ্বান জানাতে হবে, চিৎকার করে কথা বলা যাবে না, মোবাইলে উচ্চস্বরে কথা বলা যাবে না, অন্য যাত্রীর সঙ্গে অকারণে খারাপ আচরণ করা যাবে না, বলা যাবে না আমি কে তুই জানিস? বলা যাবে না আমি তোরে দেইখ্যা নেব?
খুব ছোটবেলায়, আমার নানা আমাকে বলেছিলেন, নানাভাই শোনো, তুমি যখন ভবিষ্যতে বাসে অথবা ট্রেনে উঠবে, তখন উঠেই সবাইকে সম্মান করে সম্বোধন করবে, সিট খালি থাকলে আগে নিজে না বসে বড়দের কিংবা মেয়েরা থাকলে তাদের সিটে বসতে আহ্বান জানাবে, কেমন? এই কথাটি নানা বলেছিলেন আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে, আমি এখনো এই কাজটি করি। কিন্তু এখনকার মানুষ বা প্রজন্মের বালক-বালিকারা, তরুণ-তরুণীরা কি তা করছে? সবাই করছে না। কেন করছে না? আমরা তাহলে শিক্ষা-দীক্ষায়, আদর্শে, চেতনায়, মননে, মগজে কতটুকু এগোলাম বা উন্নত হলাম বা দিন দিন নৈতিকভাবে পেছাচ্ছি? আসলে এগোনো বা পেছানো কোনোটাই নয়, বাঙালির আচরণ শুদ্ধ হয়নি বা বলা যায়, একই জায়গায় রয়েছে বা স্থির বা স্থবির হয়ে আছে। কেন বলছি, যেমন ধরুন আপনি মিরপুর থেকে গুলিস্তানে যাবেন, বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছেন, বাস আসতেই আপনি দরোজা দিয়ে উঠতে যাচ্ছেন, ঠেলাঠেলি করে উঠলেন, উঠে ওপরের রড ধরে দাঁড়ালেন, আপনার পাশেই দাঁড়ানো একযাত্রী মোবাইলে উচ্চস্বরে কথা বলছে, ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিকে বলছেন, আমি ফার্মগেটে এসে গেছি, অথচ দেখেন বাসটি তখন মাত্র দশ নম্বর গোলচক্করে, এই যে দেখুন মিথ্যা বলছেন এবং অন্যদিকে উচ্চস্বরে কথা বলে বাসের পরিবেশকে রীতিমতো কুলষিত করছেন। আপনি তাকে কিছু বলবেন, বললে উল্টা আপনাকে শাসাতে পারে।
কিংবা ধরুন সিটে জানালার পাশে বসে আছেন, আপনার পাশে যাত্রীটি খপ করে জানালা দিয়ে থুতু ফেলল, এই থুতুর ছিটা বাতাসে উড়ে এসে আপনার গায়ে লাগল, আপনার কেমন লাগবে? আপনি তখন কী করবেন, কী বলবেন, কিছু কি শেখাতে পারবেন তাকে? সে যদি ভদ্র হয় তাহলে, আপনাকে দুঃখিত বলতে পারে, না হলে নয়! আপনি টিস্যু দিয়ে হয়তো থুতু মুছবেন। অথবা ধরুন, পাশের যাত্রীটি সিগারেট ধরিয়ে গাড়িতে ধোঁয়া ছাড়ছে, তখন আপনি এবং বাসের অনেকেই যারা সিগারেট খান না কিংবা সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এটি কি তাকে বলতে পারবেন, হয়তো পারলেন কিন্তু বলার পর আপনাকে বলল, আমি সিগারেট খাচ্ছি তো আপনার কী? প্রয়োজন হলে আপনি বাস থেকে নেমে যান? এখন আপনি কী করবেন, নেমে যাবেন? আবার ধরুন, একটি মেয়ে (নারী) বা একজন বয়স্ক ব্যক্তি (সিনিয়র সিটিজেন) বাসের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন এবং তাদের কি আপনার বসতে দেওয়া উচিত নয়? ওই আমার নানার কাছেই ফিরে যাই, সম্মান করে বসতে দেওয়াটাই সম্মানের।
আমাদের আচরণ কি উন্নত বা পরিবর্তন করা উচিত নয়? অবশ্যই আচরণ বদলাতে হবে। কারণ আপনার ব্যক্তিগত বা প্রাইভেটে বাহনে যে আচরণ করবেন, গণপরিবহনে একই আচরণ করা যাবে না। দুই ধরনের বাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। আপনি উন্নত জীবন চাইবেন কিন্তু আচরণ সুন্দর করবেন না? আপনি শিক্ষিত হবেন কিন্তু বাসে-ট্রেনে উঠেই উচ্চস্বরে কথা বলবেন, মোবাইল করবেন, ভিডিও দেখবেন, হুট করে ব্যবহার করা টিস্যুটা ফেলে দেবেন, মুরুব্বিদের সম্মান করবেন না- আপনি স্থান-কাল-পাত্র বুঝবেন না, আপনি সুন্দরকে সুন্দর বলবেন না, আপনি নীরবে কথা না বলে- অযথা কোনো বিষয়ে তর্কে জড়িয়ে বা রাজনৈতিক আলোচনায় পুরো বাস বা মেট্রোর কম্পার্টমেন্ট গরম করে তুললেন, বলুন এটি কি শোভন? এটি কি ভালো আচরণ? আমরা মেট্রো রেলের যুগে প্রবেশ করেছি কিন্তু আচার-আচরণে আমরা পিছিয়েই থাকলাম।
আরেকটি বিষয় খেয়াল করবেন, বাসের চালক, লোকটি নিরক্ষর অথবা স্বল্প শিক্ষিত, সে চালকের সিটে বসে কন্ডাক্টরকে দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বেদুমছে টানছে আর গাড়ি চালাচ্ছে, এই সময় আপনি যদি বলেন ড্রাইভার সাহেব সিগারেটটা পরে খান, তখন দুই ধরনের উত্তর পেতে পারেন- এক. আপনার অসুবিধা হলে, গাড়ি থেকে নেমে যান অথবা দুই. সে সিগারেটটি নিভিয়ে ফেলবে। দেখবেন চালকরা সব সময় তাদের মতো করে চালাবে, যাত্রীদের সুবিধার কথা তোয়াক্কাই করবে না! হয়তো বলবে, সিটে বইসা থাকেন, কতা কইবেন না? সবচেয়ে ভয়াবহ যেটি, সেটি হলো দূরপাল্লার বাসে অথবা মহানগরে আসা-যাওয়া বাসগুলোতে এসব গণ্ড ও গুন্ডা গাড়িতে চালকরা যাত্রী মেয়ে বা নারীদের ধর্ষণ করে। প্রায় অহরহ ঘটছে এই ঘটনা।
বাসে ডাকাতি হচ্ছে- শোনা যায়, চালক ও হেল্পার এই ডাকাতির সঙ্গে যোগসাজশ আছে। আমরা কি এই দুঃসহ অবস্থা থেকে উত্তরণ বা নিষ্কৃতি বা নিস্তার পাব? পাব, তবে আগে আমরা নিজেরা এক এক করে পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত হই এবং পরে অন্যকে এই বিষয়ে আহ্বান জানাই। এবং হতে হবেই, না হলে, ভেঙে যাবে ব্যক্তি, ভেঙে যাবে পরিবার, ভেঙে যাবে সমাজ ও চূড়ান্তভাবে ভেঙে যাবে রাষ্ট্রকাঠামো।
লেখক: কবি
[email protected]