
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা বঙ্গেশ্বরী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃতীয় মেয়াদের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় টুঁ শব্দও করেননি। মমতার সাম্প্রতিক আন্দোলন কর্মসূচি ভোটার তালিকায় কমিশনের কারচুপি রোখাকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন ঠিক না ভুল এ প্রসঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলেন। এসব ইঙ্গিত দেখে ওয়াকিবহাল মহলের স্পষ্ট ধারণা, নতুন দলের দিকেই পদক্ষেপ রাখছেন তিনি। ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগেই এই দল ঘোষিত হবে। সেই দলের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে বিজেপি। সে ক্ষেত্রে আগামী দিনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে নেমে পড়বেন ভাইপো অভিষেক। সেই লক্ষ্যে তিনি নাকি ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে নিজের নামে একটি নতুন দল নথিভুক্ত করেছেন।
আহ্বান নেই, বিসর্জনও নেই। যা রাজ্য রাজনীতি তো বটেই, তৃণমূলের মধ্যেও নতুন করে কৌতূহল বাড়িয়েছে। এ-ও কৌতূহল যে, দিদিই অভিষেককে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাতে বারণ করে দিয়েছেন, নাকি অভিষেক নিজে থেকেই নীরব। বরং বিধানসভায় বাজেট পেশ হওয়ায় দেখা গেল, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সেবার আশ্রয়েই রয়েছেন। তার নির্বাচন কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারে বিপুল মানুষকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পরিষেবা দেওয়ার জন্য অভিষেক যে স্বল্প মেয়াদের শিবির গড়েছেন, তার সাফল্যতেই মজে রয়েছেন সাংসদ। সেবাশ্রয় শিবিরে নথিভুক্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ছুঁতে চলেছে। বাংলায় যা বেনজির বইকি। বিস্ময় শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নেই। আবাস যোজনায় কেন্দ্র বরাদ্দ বন্ধ করার পর পাল্টা জেদ দেখিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই।
সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষমেশ সবটাই তার অগ্রাধিকার, তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে, তারই সিদ্ধান্ত। কিন্তু গত বছর একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেই প্রথমে বলতে শোনা গিয়েছিল যে, আবাস যোজনায় কেন্দ্র বরাদ্দ বন্ধ করলেও পরোয়া নেই, তৃণমূল সরকার রাজ্যের কোষাগার থেকেই বাংলার মানুষকে বাড়ি বানানোর জন্য টাকা দেবে। এবং তা দেওয়া হবে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে। দেখা গিয়াছিল, সেই ডেডলাইন ফেল করেনি সরকার। ৩১ ডিসেম্বরের আগেই ১২ লাখ পরিবারকে প্রথম কিস্তির ৬০ হাজার টাকা সরাসরি উপভোক্তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতে শুরু করেছিল নবান্ন। শুধু তা নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডিসেম্বরে এ-ও ঘোষণা করেন যে, আরও ১৬ লাখ পরিবারকে আগামী অর্থবর্ষে বাড়ি বানানোর টাকা দেওয়া হবে। অনেকের মতে, সেদিক থেকে এদিনের বাজেট এক প্রকার উদ্যাপন করার কথা ছিল অভিষেকের। কারণ, তার মুখরক্ষা হয়েছে। একুশের মঞ্চে তিনি যে ঘোষণা করেছিলেন, তাকে ছাপিয়ে সরকার বৃহত্তর লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে চাইছে। কিন্তু তার পরও দেখা গেল, অভিষেক কোনো শব্দই খরচ করলেন না বাজেট নিয়ে। সংবাদমাধ্যমে সরাসরি কোনো বিবৃতি তিনি দেননি। সোশ্যাল মিডিয়াতেও কোনো পোস্ট করেননি। অথচ ২০২৪ সালে রাজ্য বাজেটের দিন তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন অভিষেক। বাজেটে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে ভাতা বাড়ানোর ঘোষণা হয়েছিল। তা নিয়েই সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
অভিষেক অঙ্গীকার করেছিলেন যে, উত্তরবঙ্গের ধূপগুড়ি এলাকা মহকুমা হবে। সরকার যেদিন সেই মর্মে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে, সেদিন এক্স হ্যান্ডেলে বড় পোস্ট করেছিলেন অভিষেক। আবার কদিন আগে নির্মলা সীতারামন সাধারণ বাজেট পেশ করার পর তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। কিন্তু তৃণমূল সরকারের বাজেট নিয়ে দলের অলিখিত নম্বর টু তথা সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক যে কিছু বললেন না, তা অনেকেরই নজর কেড়ে নিল। অনেকেরই মনে হলো, এক নম্বর ও দুই নম্বরের মধ্যে কোথাও একটা মতান্তর হচ্ছে। কোথাও একটা আড়ষ্টতা তৈরি হয়েছে।
দলীয় কর্মীদের বক্তব্য, বিষয়টা এখন আর আড়ষ্টতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন স্পষ্ট দূরত্বই তৈরি হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। সেই দূরত্ব এখন আর ঘোচানো সম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো ঠিক কখন নতুন দল তৈরি করবেন অভিষেক। ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, পুজোর আগেই নতুন দলের কথা ঘোষণা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মমতা কি আবার নতুন করে দলীয় সংগঠন গোছাবেন? নাকি এখন থেকেই সেই লক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছেন।
২০২৬-এর লক্ষ্যে অবিলম্বে মাঠে নামতে চাইছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দল ছেড়ে নতুন দল গঠন করে তিনি যে আগামী দিনে নির্বাচনে লড়বেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই লক্ষ্যে তলায় তলায় বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তার বৈঠকও শুরু হয়েছে। তার দলের সঙ্গে সরাসরি আঁতাত হতে পারে বিজেপির। সে ক্ষেত্রে অভিষেককেই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে নতুন করে রাজ্যে এনডিএ জোট গঠিত হতে পারে। এই জোট গঠনের প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তিনি। বিজেপির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে পশ্চিমবঙ্গের সব দায়িত্ব অমিত শাহর ওপরই অর্পিত। তিনি দোলের পরেই পশ্চিমবঙ্গ সফরে আসছেন। সেই সময় দুই পক্ষের মধ্যে গোপন বৈঠক হতে পারে।
অমিত শাহর এক নম্বর পছন্দের নেতা হলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তার সঙ্গে ইতোমধ্যে অমিত শাহর কথা হয়েছে। সম্ভবত সেই কারণে ইদানীং শুভেন্দু কোনো সভাতেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলছেন না। সম্প্রতি তিনি সন্দেশখালীতে বিজেপির একটি দলীয় সভায় যোগ দেন। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। তাৎপর্যপূর্ণভাবে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি নিয়েও মুখ খুলছেন না অভিষেক। আগে তিনি রাজ্য বিজেপিকে তুলাধোনা করতে ছাড়তেন না। ইদানীং কিন্তু তিনি কেন্দ্রীয় বিষয় নিয়েই বেশি ব্যস্ত।
জেলা সফরের লক্ষ্যে অভিষেক প্রথমে নিজের জেলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা দিয়েই শুরু করতে চান। এই জেলায় চারটি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৩১টি বিধানসভা কেন্দ্র আছে। দক্ষিণবঙ্গের রাজনীতিতে এই জেলার গুরুত্ব অসীম। তাই নিজের ডায়মন্ডহারবার লোকসভা কেন্দ্রে যে সেবাশ্রয় প্রকল্প করে জনগণকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া শুরু করেছেন অভিষেক তা জেলার প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে দিতে চান। তিনি বোঝাতে চান, তাকে ক্ষমতায় আনলে আগামী দিনে জনগণের প্রকৃত কল্যাণ হয় এমন নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জেলা সফর ও কনভেনশনের পর অভিষেক নজর দেবেন পশ্চিম মেদিনীপুরের দিকে। এই জেলার ১৫টি বিধানসভা আসন তার পরবর্তী লক্ষ্য। পশ্চিম মেদিনীপুরের দিকে নজর দেওয়ার কারণ ঘাটাল কেন্দ্রের লোকসভা সাংসদদের সঙ্গে অভিষেকের সুসম্পর্ক এবং সার্বিকভাবে জেলার তৃণমূল নেতাদের দুর্নীতির ব্যাপারে মানুষের ক্ষোভ।
জানা গেছে, ২১ জুলাইয়ের আগে চার মাসে তিনি রাজ্যের সব জেলা চষে বেড়াতে চান। তার পর ২১ জুলাইয়ের আশপাশের দিন দেখে নতুন দল করার কথা ঘোষণা হতে পারে। শহিদ দিবসকে বেছে নেওয়ার একমাত্র কারণ ওই দিনের জমায়েতকে ফ্লপ শোয়ে পরিণত করা। বিশেষ করে মঞ্চে বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার দিকেই তার অন্যতম লক্ষ্য। তার জন্য এই বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সময়মতো যোগাযোগ করা হবে।
এদিকে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রস্তুতি শুরু করেছে গেরুয়া শিবির। বাংলায় নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে এখন থেকেই বিভিন্ন পরিকল্পনা করে নিতে চাইছে তারা। চলতি মাসেই কলকাতা সফরে আসছেন অমিত শাহ। তিনি রণকৌশল নিয়ে কথা বলতে পারেন বঙ্গ বিজেপির সঙ্গে। হয়তো এই বৈঠকগুলোতেই অভিষেক সম্পর্কে দলের কী পদক্ষেপ হবে তা ব্যাখ্যা করা হতে পারে। জনসমক্ষে এই কৌশল ব্যক্ত না করে আপাতত নেতাদের মধ্যে তা গোপন রাখা হবে। নেতারা সুকৌশলে পরবর্তী স্তরের কার্যকর্তাদের যা নির্দেশ দেওয়ার দেবেন।
গত বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় পদ্ম ফোটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল বিজেপি। একাধিক নেতা, মন্ত্রী রাজ্যে এসেছেন। আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন কর্মী-সমর্থকরা। প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার বাংলায় এসে তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাতে খুব একটা লাভ হয়নি এবং ২০২১ সালে তৃণমূল ১১৪ আসন পেয়ে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসে। গেরুয়া ঝড় উঠলেও তার প্রতিফলন ভোটের রেজাল্টে দেখা যায়নি। তাই ২০২৬ সালের নির্বাচনে তৃণমূলকে এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে প্রস্তুত নয় বিজেপি নেতৃত্ব। চলতি মাসেই কলকাতায় আসছেন অমিত শাহ। সফরের নির্দিষ্ট দিন এখনো জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছে, এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
প্রশ্ন উঠেছে, দলের ভিতর অভিষেকের সঙ্গে আঁতাত কি সদস্য-সমর্থকরা মেনে নেবেন? তাদের বোঝানো গেলেও শুভেন্দু অধিকারী নিজে কী অবস্থান নেবেন? গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারের সামনের সারিতে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরাই ছিলেন। তা সত্ত্বেও ভোটারদের কাছে বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল যে, জিতলে শুভেন্দু অধিকারীই হবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বিশেষ করে নন্দীগ্রামে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাস্ত করে তিনি তার ক্ষমতা দেখানোর পর পরবর্তীকালেও রাজ্যের এক নম্বর নেতা হিসেবে তার নামই উঠে এসেছে।
বিজেপির একাংশ আবার চান, মিঠুন চক্রবর্তীকে কোনো একটি কেন্দ্রে দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে এনে মুখ্যমন্ত্রী করতে। রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অশোক লাহিড়ীকেও অনেকে সামনের সারিতে রেখেছেন। তাদের কাছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল কি আদৌ গ্রহণযোগ্য হবে? কেন্দ্রীয় নেতারা অবশ্য বোঝাচ্ছেন রাজ্যের ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটকে ভাগ করার এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। এই ভোট ভাগ না করলে বিজেপির এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসা মুশকিল। তাদের আশা, দলীয় নেতারা এই যুক্তি মানবেন।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক