ঢাকা ১০ বৈশাখ ১৪৩২, বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫
English
বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ১০ বৈশাখ ১৪৩২

সাহিত্যপাঠের সঙ্গী

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৭:১২ পিএম
সাহিত্যপাঠের সঙ্গী
ড. পবিত্র সরকার

 এবারের ‘ত্রৈলোক্য’তে একটু বিদ্যাজগতের কথা বলি, সাধারণ পাঠকের কাছে মাপ চেয়ে। মাস্টার তো, তাই মাঝে-মধ্যে ওখানে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করে, কিছু খবর দিতে ইচ্ছে করে। সবাই না হলেও, বেশ কিছু লোক এই ধরনের কিছু খবরের জন্য প্রতীক্ষা করি।
ব্যাপারটা একটু গোড়া থেকে বলি। সম্প্রতি স্নেহাস্পদ অধ্যাপক বরুণকুমার চক্রবর্তী তাদের বাংলা বিদ্যা-সমিতির পক্ষ থেকে বাংলা আকাদেমিতে আমাকে (আমাদের প্রয়াত শিক্ষক) অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মারকবক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ করেছিলেন।

বক্তৃতা এমন কিছু আহামরি দিয়েছি বলে আমার মনে হয় না, কিন্তু কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলাম যে, আমাদের মাস্টারমশাইরা যেমন বিশাল বিশাল মহাকাব্যের মতো বই লিখে গেছেন একার চেষ্টায়, এখন সে রকম বিশাল কাজ করার উদ্যোগ দেখি না কেন? মোটা নোটবই হয়তো হয়, কিন্তু মৌলিক কাজ? সাহিত্যের, ইতিহাসের, বা তার কোনো একটা ভাগ- নাটক, কবিতা, উপন্যাস, ইত্যাদির ইতিহাসের? তারা কোনো ডিগ্রি বা পুরস্কারের কথা ভেবে এ কাজ করেননি, চাকরিতে প্রমোশনের জন্যও না- নিছক বিদ্যাভূমিগত তীব্র আকাঙ্ক্ষায় বিপুল অনুসন্ধান আর কঠোর আত্মপীড়দনমূলক পরিশ্রম করে ওই সব মহাগ্রন্থ রচনা করেছেন। 

আমি কেন দেখি না, তার কারণগুলো জানি না, তা নয়, তার কিছু আলোচনাও করলাম।
সেই সভাতেই তারা একজন গবেষককে ‘আচার্য সুকুমার সেন স্মৃতি পুরস্কার’ দিল তার রচিত ‘ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাস’ (এবং মুশায়েরা) বইটির জন্য। এই গবেষক অধ্যাপক উদয়সংকর বর্মা, সরকারি কলেজের অধ্যাপনা থেকে সদ্য অবসর নিয়েছেন। বইটি প্রায় চার শ পৃষ্ঠার, এটিই সম্ভবত বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাস। 

এ বইটির খবর নিয়ে লেখার কথা ভাবলাম কেন? ভাবলাম এই জন্য যে, বাঙালি বহুদিন ধরে ইংরেজিতেই পৃথিবীর নানা সাহিত্য পড়ছে, বাংলা অনুবাদেও কিছু পড়ছে। বাংলা অনুবাদও বেশির ভাগই ইংরেজি থেকে, তাতে মূলের কতটা নষ্ট হয়েছে কে জানে? গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে তবু এক কথা, গল্পের ছাঁচটা ধরা যায়। কবিতার বেলায় সমস্যা হয়, জানা কথা। গল্প-উপন্যাসেও অনুবাদে বা অনুবাদের অনুবাদে লেখকের শৈলী, ভাষার কারিকুরি কতটা বজায় থাকে সন্দেহ। কবিতায় তো শৈলীই বারোআনা কথা বলে।

এর পাশাপাশি, এটাও ঠিক যে, বাঙালি অনেকদিন ধরে বাইরের পৃথিবীর নানা ভাষা শিখছে। ইংরেজি ছাড়া সবচেয়ে জনপ্রিয় বিদেশি ভাষা তার কাছে ছিল ফরাসি, এক সময় রুশ ভাষা ফরাসিকে হারিয়ে দিয়েছিল বোধ হয়, এখন তার জৌলুশ কমেছে। জাপানি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে নানা কারণে। চীনা, স্প্যানিশ ইত্যাদিরও চর্চা প্রচুর হয়। আমাদের বন্ধু তরুণ ঘটক মূল স্প্যানিশ থেকে সেরভেন্তেস-এর ‘দোন কিখোতে’ বা ডন কুইক্সোট অনুবাদ করে আমাদের চমকে দিয়েছেন। চীনা, জাপানি থেকেও অনুবাদ হয়েছে, বন্ধুবর অরুণ সোম রুশ থেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপে অনুবাদ করে চলেছেন। বাংলাদেশেও এই কাজ প্রচুর হচ্ছে জানি, হয়তো পরিমাণে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি হারে। সব খবর যে আমি রাখতে পারি না, তা আমারই ব্যর্থতা।

এটা ঠিক যে, সবাই সাহিত্য পড়ার জন্য অন্য ভাষা শেখে না, শেখে নানা লক্ষ্য থেকে- ভাষার দেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা, অনুবাদক বা দোভাষীর চাকরি, ব্যবসা- এমনকি অন্য ভাষার স্বামী, বধূ বা প্রেমিক-প্রেমিকার তাগিদে। তবে সাহিত্য পড়ার সুযোগ তার একটা বড় পার্শ্বিক লাভ বা উপকার। আর যারা সাহিত্য পড়েন, তারা সে ভাষার উন্নত বা জনপ্রিয় সাহিত্যের অনুবাদ করে নিজেদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতেই পারেন, অনেক বাঙালি যেমন করেছেন। মূল ভাষা থেকে অনুবাদ, ইংরেজি থেকে নয়। 

আমি আগেও লিখেছি যে, ঔপনিবেশিকতা এক সময় আমাদের এমনই আচ্ছন্ন করেছিল যে, আমরা এক সময় ইংরেজিকেই মূল ভাষা ভাবতাম। আমাদের এক বন্ধু বোরিস পাস্তেরনাকের একটা ছোট উপন্যাসের অনুবাদ পড়ে খুব খুশি। বইটির বাংলা নাম ‘শেষ গ্রীষ্ম’- ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সে সেটা নিয়ে কফি হাউসে ঢুকছিল, এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ায় একটু বাহাদুরি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এটা পড়েছিস?’ বন্ধুটি দেখে একটু উন্নাসিকভাবে বলল, ‘ওহ, বাংলা! আমি অরিজিনালটা পড়েছি- দ্য লাস্ট সামার!’ সে বোঝাতে চেয়েছিল, সে ইংরেজিটা পড়েছে। বলা বাহুল্য, মূল রুশটা সে পড়েনি।

যাই হোক, এখন মূল ভাষা থেকে প্রচুর না হলেও বেশ কিছু বই মূল ভাষা থেকে অনুবাদ হচ্ছে। স্মৃতি এখন বিশ্বস্ত নয়, কিন্তু আবছা মনে পড়ছে প্রাচীন গ্রিক থেকে মোহিনী মোহন চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ, জার্মান থেকে কানাইলাল মুখোপাধ্যায় বা সুনীলকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের অনুবাদের কথা। আগে লোকনাথ ভট্টাচার্য করেছেন ফরাসি থেকে, পরে চিন্ময় গুহ করেছেন। আগে ননী ভৌমিক করে গেছেন, আর এখন আমার সহপাঠী বন্ধু অরুণ সোমের নিরলস কাজের কথা তো বলেইছি, বলেছি স্প্যানিশ থেকে তরুণ ঘটকের অনুবাদের কথা। জাপানি থেকে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, নির্মল দাশ অনুবাদে ব্যস্ত আছেন। বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই এই রকম মূল থেকে অনুবাদের একটি বাহিনী গড়ে উঠেছে। সব খবর আমি রাখতেও পারি না।

এবার বাঙালি সাহিত্যপাঠকদের কথায় আসি। তারা পৃথিবীর যেকোনো সাহিত্য বাংলায় পড়ুন বা ইংরেজিতে পড়ুন বা সেই মূল ভাষায় পড়ুন- সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো- এই পড়াটা অনেকটা ফলদায়ক হয় যদি সেই সাহিত্যের একটা ইতিহাস পাশে রেখে সে ভাষার কোনো রচনা পড়তে পারি। তা হলে লেখক সম্বন্ধে, রচনাটা সম্বন্ধে, রচনার গুণাগুণ বা ওই সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় তার অবস্থান সম্বন্ধে অনেক কিছু আমরা জানতে পারি, যাতে রচনাটি পড়ার কাজটা নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। অবশ্যই নিছক বিনোদনসন্ধানী পাঠক হিসেবে আমরা এভাবে কোনো বই বা রচনা পড়ি না, হাতের কাছে পাই বলে পড়ে ফেলি। কিন্তু যদি মননশীল পাঠক হিসেবে নিজেকে নির্মাণ করতে চাই, তা হলে সাহিত্যের ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে বইটি পড়ার বিকল্প আর কিছু নেই। 

এতকাল আমরা সাধারণভাবে ইংরেজি ভাষায় লেখা নানা ভাষার সাহিত্যের ইতিহাসের ওপর এই কাজের জন্য নির্ভর করেছি, যদি মূল ভাষায় আমাদের ততটা প্রবেশ না থাকে। কিন্তু এটাই আনন্দের কথা যে, বাংলাভাষাতেও এখন বিদেশি সাহিত্যের ইতিহাস কিছু রচিত হচ্ছে, যেমন অধ্যাপক বর্মার বইটি। ইংরেজি ও সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস এক সময় সিলেবাসে ছিল বলে একাধিক বেরিয়েছিল, গুরুস্থানীয় শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য প্রভৃতি অনেকেই লিখেছিলেন। বন্ধুবর রামবহাল তেওয়ারী লিখেছিলেন হিন্দি সাহিত্যের ইতিহাস। সহপাঠী অরুণ লিখেছেন রুশ সাহিত্যের ইতিহাস। এবারে আমরা পেলাম ফরাসি সাহিত্যের ইতিহাস। বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই এ ধরনের কাজ প্রচুর হয়েছে।
এই বইগুলো আমাদের সচেতন ও মনস্ক সাহিত্যপাঠের সঙ্গী হোক।

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

জনসংখ্যাধিক্য: মূল সমস্যাগুলোর বড় কারণ

প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২৩ পিএম
জনসংখ্যাধিক্য: মূল সমস্যাগুলোর বড় কারণ
মাসুদ আহমেদ

আমরা আমাদের ব্যক্তিগত, ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত জীবনে প্রতিদিনই কয়েকটি সাধারণ সমস্যার কথা বলে থাকি। যেমন- নদীদূষণ- দুর্গন্ধে ও বর্জ্যে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। উপচে পড়া মানুষের ভিড়ে শহর ও গঞ্জ তো বটেই, এখন গ্রামেও শরীরে শরীরে ধাক্কা দেওয়া ছাড়া চলার পথ নেই। শহরে রাস্তা থাকার কথা আয়তনের ২৫ ভাগ কিন্তু তা কমতে কমতে এখন মাত্র ৬ ভাগে এসে ঠেকেছে। যানজটে সড়কে যান চলাচলের গতি কমতে কমতে ঘণ্টায় গড়ে সাড়ে ৪ কিমিতে এসে ঠেকেছে। গুলশানের লেক, বনশ্রীর লেক কিংবা বুড়িগঙ্গার পানিতে একই দুর্গন্ধ। একজন উপদেষ্টা সেদিন বললেন যে বুড়িগঙ্গার পাশ দিয়ে চলতে হলে কেবল আতর দিলেই হয় না, নাকে রুমালও দিতে হয়। আবার জাতিক এবং আন্তর্জাতিক সংবাদে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যাচ্ছে ঢাকা শহর বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর। এর পেছনে রয়েছে গৃহস্থালি বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্যের স্তূপ, নানাবিধ শব্দদূষণ এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও প্রচণ্ড তাপ উদগীরণের সমাহার। পরিবেশের এই  মান। ফুটপাত ফেরিওয়ালাদের দখলে, ফলে পথচারীরা নেমে আসছেন রাস্তায়। মানুষের ভিড়ে রাস্তায় যানবাহন চলতে পারছে না। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য সুধীজনরা প্রায় প্রতিদিনই সেমিনার করে নানা পরামর্শ ও উপদেশ বিতরণ করছেন। তার একটি বড় উপাদান হলো এই যে সচেতনতার মাধ্যমে নাকি এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। যেমন যানজট দূরীকরণের ব্যাপারে বলা হয় ব্যক্তিগত গাড়ি পরিহার করে গণপরিবহণ বৃদ্ধি করে তাতে চড়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যাও। কথা হলো, মানুষের যদি সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়, তা পরিবার-পরিজন নিয়ে গণপরিবহনের ভিড় ও ধস্তাধস্তির মধ্যে আরোহণ করে প্রকৃত গন্তব্যের অনেক আগেই তা থেকে নেমে যাওয়ার জন্য নয়। যেমন এমআরটি চালু হয়েছে, তবে তা শহরের ২ কোটি ৬৫ লাখ লোকের মধ্যে সাড়ে ৬ লাখ লোকের যাতায়াতের আংশিক সমাধান দিয়েছে।

 তার পরও বাকি রয়েছে গৃহ থেকে দীর্ঘপথ অসুবিধাজনক পন্থায় ভ্রমণ করে এতে আরোহণ এবং অনেক স্টেশনে নেমে একই কষ্টকর হাঁটা কিংবা যানবাহনে চড়ে প্রকৃত গন্তব্যে পৌঁছানো। পরামর্শকরা এটাও বলেন যে উন্নত দেশে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির চেয়ে গণপরিবহনের ওপর বেশি নির্ভরশীল। কথাটায় বড় অসত্য রয়েছে। যেকোনো উন্নত দেশে পরিবারপ্রতি গড়ে ব্যক্তিগত মোটরগাড়ির সংখ্যা ৩.৫টি করে। এর পাশাপাশি তারা গণপরিবহন ব্যবহার করেন বড় দূরত্বগুলো পার হওয়ার জন্য। নদী বেআইনিভাবে শিল্পপতিরা ব্যবহার করার ফলে নদীর গতিপথ এবং পানিপ্রবাহ সংকুচিত হয়ে নৌ চলাচলের এবং মাছ চাষের অসুবিধা সৃষ্টি করছে। এ কথা ঠিক কিন্তু এই বেআইনি কাজকে সমর্থন না করেও বলা যায় যে ওই সব শিল্পপ্রতিষ্ঠানে সারা দেশে যে লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং সীমিত আয়ের লোকদের জন্য পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোর বিকল্প ব্যবস্থা করবার স্থান কোথায়? নদী এবং জলাশয়ে রান্নাঘরের বর্জ্যর একটা বড় অংশ সরাসরি গিয়ে পড়ছে, কারণ এগুলো ফেলার বিকল্প স্থান নেই। 

মানুষের সমৃদ্ধি বাড়ছে, ফলে ভোগও বাড়ছে, ফলে বর্জ্যও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলোর একটি অংশ ক্রমবর্ধমান হারে যে প্রথমত পদপথে, ড্রেনের ওপর এবং শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি ও পানিবাহিত হয়ে আশপাশের নদী এবং জলাশয়ে স্থান লাভ করবে, সে কথা এই পরামর্শকদাতারা বলেন না। মহানগরের অদূরে কাওলা, কাজলাসহ আরও কিছু অঞ্চলে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ শহরের রান্নাঘরের বর্জ্য সরকারিভাবে ফেলার ফলে সেখানে যে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে গবাদি প্রাণী ছাড়া আর কোনো প্রাণী বসবাস করতে পারে না। অথচ ময়লা ফেলার আর কোনো জায়গাও নেই। উল্লেখ্য, ময়লা বৃদ্ধি পাওয়ার সমানুপাতে এর আগে মাতুয়াইল ও গোদনাইলে এই বর্জ্য ফেলার কারণে সেগুলোতে আর কোনো ফাঁকা স্থান এখন অবশিষ্ট নেই। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীও শিল্প এবং গৃহস্থালি বর্জ্যের শেষ আশ্রয়স্থল হওয়ার ফলে সেখানকার কালো পানি দৃষ্টিকটূ এবং গন্ধ মনুষ্য নাসারন্ধ্রের সম্পূর্ণ অনুপযোগী করে তুলেছে। এসব কথা কেবল সংবাদদাতাদের প্রেরিত নয় বরং এলাকাবাসী ও দায়িত্বশীল উপদেষ্টারাও এগুলো জনপ্রিয় করছেন। যানবাহনের গতি বৃদ্ধি করা এবং উপচে পড়া ভিড়  হ্রাস করার লক্ষ্যমাত্রা পিপির ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করে এমআরটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। দৈনিক সাড়ে ৬ লাখ যাত্রী পরিবহন অবশ্যই একটি সফলতার প্রমাণ।

 কিন্তু তার পরেও এই প্রকল্প পূর্ণ উদ্যমে চালু হওয়ার পরেও প্রতিদিন ঢাকা শহরে মাটির ওপর অবস্থিত প্রায় সব সড়কেই যানবাহনের গতি কমতে কমতে এখন ঘণ্টায় সাড়ে ৪ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। সমৃদ্ধি বাড়ছে, ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ছে। সেই গাভি থেকে কালো ধোঁয়া এবং পুনঃ পুনঃ ব্রেক কষে গাড়ি চালানোর ফলে নিঃসরিত তাপ আশপাশে এবং ওপরে দীর্ঘক্ষণ কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকার সুযোগ পাচ্ছে। দ্রুতগতিতে চলে যেতে পারলে এটা অনেক কম হতো। তার মধ্যে প্রতিদিন গাড়িবহরে নতুন সংযোজনের ফলে এই তাপ ও কালো ধোঁয়ার বৃদ্ধি বেদম সংঘটিত হয়ে চলছে। শিল্পকারখানা থেকে উদ্ভূত তরল বর্জ্য আইন প্রয়োগের মাধ্যেমে অনেকটা বা কিছুটা পরিশোধিত করে নির্ধারিত জলাশয়ে ফেলার উদ্যোগ দেখা যায়। কিন্তু তার পরেও নানাবিধ নির্মাণকাজের ফলে সব ধরনের জলাশয়ের আয়তন সংকীর্ণ হয়ে যাওয়ায় এর অন্তর্ভুক্ত পানিপ্রবাহের বিশুদ্ধতা ক্রমশই কমে আসছে। কারণ এটুকু আয়তনের  জলাশয় অতগুলো শিল্পকারখানার শোধনকৃত পানি রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। আরও উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ কোনো শিল্পোন্নত দেশ নয়।

 তার শিল্পের সংখ্যা এখনো হাতে গোনা। তার রপ্তানি আমদানির চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু তার পরেও এই সামান্যসংখ্যক শিল্পের বর্জ্য সারা দেশের জলাশয়গুলোকে প্রবলভাবে দূষিত করে চলছে। তা হলে শিল্পোন্নত দেশ হলে অবস্থা কী হবে, তা অনুমেয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, তিন দশক আগেই যখন অবস্থার এত অবনতি ঘটেনি, তখন এক পানিসম্পদমন্ত্রী সংকল্প প্রকাশ করে বলেছিলেন, যমুনা নদীর পানি দিয়ে বুড়িগঙ্গাকে ধুয়ে পরিষ্কার করব। 

গাছ কেটে নির্মাণকাজ করার ফলে অক্সিজেন কমছে, কার্বন-ডাই অক্সাইড বাড়ছে এবং ছায়া কমে তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার ৩৬, ৪৮ ও ৫৬ তলার ভবন নির্মাণের ফলে সেখানে দিনের বেলাও প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশ করতে না পেরে বৈদ্যুতিক সাজসরঞ্জাম ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে তা নগরের তাপ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। তেমনি রান্নার কাজে ৩৩ লাখ গ্যাসের ও বৈদ্যুতিক চুলা তিনবার জ্বালানোর ফলে নগরীর তাপমাত্রা কমার ফুরসতই পাচ্ছে না। এত মানুষেরে জন্য নিচ থেকে  পানি তোলার ফলেও  ভূগর্ভস্থ  পানির স্তর বছরে ৪ ফুট করে নেমে গিয়ে পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে।  সচেতনতা সৃষ্টি, পরামর্শ প্রদান, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রকৌশলী ও স্থপতিদের গবেষণা কিংবা পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের ফলে ওপরের সমস্যাগুলো যে হ্রাস পাচ্ছে না, তা গত তিন দশকের পরিসংখ্যান একটু দেখলেই বোঝা যাবে। 

প্রতিটি ক্ষেত্রে সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা এর মূল কারণের দিকে না তাকিয়ে উপসর্গগুলো নিয়ে আলোচনা করছি। এর একমাত্র না হলেও মূল কারণ হচ্ছে যে, আয়তনে খুব বেশি হলে ৫০ লাখ মানুষ  বসবাস করতে পারেন যেখানে, সেখানে ঢাকা শহরে ২ কোটি ৬৫ লাখ মানুষ বসবাস করছেন। আবার দেশের যে আয়তনে ৮ কোটি মানুষ বসবাস করতে পারেন, সেখানে বসবাস করছেন প্রায় ১৯ কোটি মানুষ। সবকিছুর একটি সর্বোচ্চ বহনক্ষমতা আছে। আমরা তাকে অতিক্রম করে গেছি অনেক আগেই। ফলে এত মানুষের চলাচল, জীবনযাপন, জীবিকা নির্বাহ, ধর্ম পালন এবং বিনোদনের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে স্থানটুকু ন্যূনতম প্রয়োজন, তা ক্রমশই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে বছরে ২২ লাখ করে মানুষ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে।

 কবরজটেও মানুষ  দিশেহারা। এটিই একমাত্র কারণ নয়, তবে অবশ্যই এটি মূল কারণ। এবং সর্বত্র সবকিছুতেই যে উপচে পড়া ভিড় তার কারণ স্থানের চেয়ে জনসংখ্যা কয়েক গুণ বৃদ্ধি। জনসংখ্যাধিক্য যে দেশের ১ নম্বর সমস্যা, এটিকে এই পরিবর্তনের চমৎকার সময়ে স্বীকৃতি দিয়ে একটি নির্ধারিত তারিখ ঘোষণা করে এক সন্তানবিশিষ্ট পরিবার গঠনের আদেশ দেওয়ার কথাটি এই জনপ্রিয় সরকার বিবেচনা করবে বলে আশা করি।  তাতে ১০ বছর পরে হলেও জনসংখ্যা কমতে শুরু করে সবকিছুর ওপর প্রবল চাপ কমে পরিস্থিতি ভালো হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রজাতন্ত্রের সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল

 

আইপি ও সংগীত: মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন

প্রকাশ: ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০২:১২ পিএম
আইপি ও সংগীত: মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন
মনজুরুর রহমান

বাতাসের মধ্যে ডুবে থেকে আমরা যেমন টের পাই না, বাতাসের মধ্যে ডুবে আছি; তেমনি মেধাসম্পদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের (Intellectual Property-IP) মধ্যে বসবাস করেও এর অস্তিত্ব অনুভব করি না! গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, বর্তমান পৃথিবীর সম্ভ্রান্ত শ্রেণি এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা প্রতিটি মানুষই সকাল থেকে রাত অবধি কোনো না কোনোভাবে এক থেকে দেড় শ আইপি ব্যবহার করছেন! যেমন- একজন সভ্য মানুষ ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করতে হাতে তুলে নেন টুথ ব্রাশ ও পেস্ট। এই দুটো নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীই কারও না কারও আবিষ্কার এবং এদের গায়ে সেঁটে থাকে ট্রেডমার্ক। দাঁত পরিষ্কার করার পর নাশতার টেবিলে এসে মুখোমুখি হন রুটি, পরোটা, প্লেট-কাপ, চা-কফিসহ আনুষঙ্গিক নানা পণ্য বা সামগ্রীর। প্রতিটি বস্তুই কোনো না কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠাজাত, যার প্রত্যেকটিতে রয়েছে ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট বা ডিজাইনের সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ; এর সবই শিল্পজাত মেধাসম্পদের অন্তর্গত।

নাশতার টেবিলে বসে আমরা অনেকে চোখ বুলাই সংবাদপত্রে, কর্ম উপলক্ষে যানবাহনে চড়ে কর্মস্থলের উদ্দেশে ছুটে চলি, যেতে যেতে শুনি কথা ও সুর সংবলিত গান। কেউ বা চোখ বুলাই বইয়ের পাতায়, যাত্রায় বিলম্ব হলে ঘন ঘন দৃষ্টি ফেরাই ঘড়ির দিকে, মোবাইলে বাক্যালাপ করি অহরহ, ছুটির দিনে সিনেমা, নাটক দেখতে যাই, টেলিভিশন দেখি। শহরবাসী তো বটেই, গ্রামের স্বল্প আয়ের মহিলাদের হাতেও অলংকারের মতো শোভা পায় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কথা বলার যন্ত্র মোবাইল ফোন, যাতে যুক্ত আছে মেধাসম্পদের ন্যূনতম চারটি উপাদান। এই যে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে মনের অজান্তে তার সব কিছুতেই এক কথায় ব্যবহৃত হচ্ছে আইপি বা মেধাসম্পদ বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ।

বিশ্ব বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংস্থা (World Intellectual Property Organization) যা WIPO নামে মেধাবিশ্বে পরিচিত, তাদের ভাষ্যমতে- ‘It involves the products of the human mind– the fruits of human creativity and invention. It is with us every day of our lives, from dawn to dusk, while we are at school, while we are hanging out with our friend, and even as we sleep.’

WIPO তাদের অন্য একটি প্রকাশনায় মেধাসম্পদের সংজ্ঞা করেছে নিম্নরূপ:
‘Intellectual Property refers to creation of the mind: inventions, literary and artistic works and symbols, named and images used in commerce.’ আমরা সবাই জানি, মেধাসম্পদ প্রধানত দুটি শাখায় বিভক্ত। এই ভাগ সম্পর্কে WIPO বলছে- ‘There are two categories of Intellectual Property. The first, industrial property, includes inventions (patents), trademarks, copyright and related rights, includes a broad range of literary and artistic works, written, performed, and recorded.’


পৃথিবীব্যাপী জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলোতে আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবস’ বা আইপি ডে। ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল থেকে দিবসটি প্রতিবছর উদযাপিত হয়ে আসছে। সৃষ্টিশীল মানুষের মেধাসম্পদ অধিকার সুরক্ষা ও সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে দিবসটি মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হয়। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, মেধাসম্পদ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে বর্ণিত মানুষের জন্য স্বীকৃত অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম অধিকার। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ধারা ২৭-এ বলা আছে- (ক) প্রত্যেকেরই গোষ্ঠীগত সাংস্কৃতিক জীবনে অবাধে অংশগ্রহণ করা ও শিল্পকলা চর্চা করার অধিকার রয়েছে। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও সুফলগুলোর অংশীদার হওয়ার অধিকার রয়েছে। (খ) বিজ্ঞান, সাহিত্য অথবা শিল্পকলাভিত্তিক সৃজনশীল কাজের থেকে যে নৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থের উদ্ভব হতে পারে, তা রক্ষা করার অধিকার রয়েছে প্রত্যেকের।
বিগত বছরগুলোর মতো এ বছর WIPO বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের প্রতিবাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘IP and music: Feel the beat of IP.’ বাংলায় বললে, ‘আইপি ও সংগীত: মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন’। WIPO তাদের IP পোর্টালে বলেছে- ‘World intellectual property day 2025 highlights creativity and innovation backed by IP rights, keep a vibrant diverse, and thriving music scene that benefits everyone, everywhere.’

সংগীত যেহেতু সাংস্কৃতিক মেধাসম্পদের একটি অনিবার্য অংশ, সে জন্য প্রতিপাদ্যে যাওয়ার আগে আমি সাংস্কৃতিক সম্পদ সম্পর্কে জাপানি মেধাসম্পদ বিশেষজ্ঞ তমোতসু হোজুমির ‘এশিয়ান কপিরাইট হ্যান্ডবুক’ থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করছি। হোজুমি বলছেন, ‘মানুষের বেঁচে থাকার জন্য আহারের দরকার। মানব শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য খাদ্য অত্যন্ত জরুরি। আহার আমাদের পুষ্টি জোগায় এবং বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু আমরা স্তন্যপায়ী প্রাণী, আমাদের শুধু দেহের পুষ্টি সাধনই যথেষ্ট নয়, আমাদের মন ও হৃদয়ের পুষ্টিরও প্রয়োজন আছে।’ 

যদি আপনি সাংস্কৃতিক কর্মকে আমাদের আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তির জন্য আহারের সঙ্গে তুলনা করেন তবে সহজেই সাংস্কৃতিক কর্মের সংজ্ঞা উপলব্ধি করতে পারবেন। এমন একটি জগতের কথা ভাবুন যেখানে আমাদের আত্মার সাংস্কৃতিক কর্মের অস্তিত্ব নেই! উপন্যাস, কবিতা, সংগীত অথবা চিত্রকলাহীন একটি পৃথিবীর কথা ভাবুন। আমাদের হৃদয়কে সমৃদ্ধ করে যেসব সাংস্কৃতিক কর্ম, তা মানব-ইতিহাসে আমাদের জন্য এক মূল্যবান ঐতিহ্য।’


আমরা ইতোমধ্যে অবগত হয়েছি, এবারের আলোচনা সংগীতকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত হবে। আমরা মেধাসম্পদ হিসেবে সংগীত স্রষ্টার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হব। আসলে সংগীত কী? প্রাচ্যের প্রাজ্ঞজনদের দৃষ্টিতে ‘সংগীত হচ্ছে নৃত্য, গীত ও বাদ্যের সমন্বয়।’ অর্থাৎ সংগীত মানবসৃষ্ট একটি যৌথ বা গুচ্ছ নান্দনিক সাংস্কৃতিক কর্ম। সংগীতের প্রাণ, ছন্দ বা বিট মূলত জীবনেরই ছন্দ। মেধাসম্পদের বিশ্বে সংগীত সৃষ্টিকে ‘সংগীত-কর্ম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সংগীত মেধাসম্পদের অন্তর্গত, কপিরাইটসের বিষয়বস্তু। কথাবিহীন সুরও সংগীতের অন্তর্ভুক্ত। কথা ও সুর সংবলিত সংগীত সৃষ্টিতে দুই ধরনের অধিকার জন্ম নেয়। একটি কপিরাইট, অন্যটি রিলেটেড রাইটস। উদাহরণ উপস্থাপন করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। একটি গানের ক্ষেত্রে থাকেন গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। গানের বাণীর রচয়িতা বা গীতিকার এবং যিনি সুর সৃষ্টি করেন, তাদের অধিকার কপিরাইটের ওপর। তারা মূল স্রষ্টা হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু যে কণ্ঠশিল্পী গান রচনা এবং সুর সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখেননি, কেবল কণ্ঠে ধারণ করেছেন, তিনি পারফর্মার- রিলেটেড রাইটস বা আনুষঙ্গিক অধিকারের মালিক। তাদের অধিকারের মেয়াদও ভিন্ন ভিন্ন।


সংগীতের উদ্ভব, বিকাশ ও সম্প্রসারণ মানব সভ্যতার বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে। ভারতীয় পুরাণে ‘ওঙ্কার’ ধ্বনির মধ্যেও পাওয়া যায় সংগীতের রেশ। অরণ্যচারী মানুষ, কৃষিজীবী মানুষ, জীবনকে পরিপূর্ণভাবে যাপন করতে গিয়ে শ্রমবিভাজনের দিকে যেমন দৃষ্টি দিয়েছে, তেমনি কর্মহীন দিনযাপনের সময় মনোযোগী হয়েছে মনের আনন্দে আত্মাকে তৃপ্ত করার বাসনায়। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। প্রাচীন সভ্যতার শুরুতে আদিবাসী মানুষ কালপরিক্রমায় কীভাবে নিজেদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রেখেছে, বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর দিকে তাকালে সেই স্বাতন্ত্র্যের স্পষ্ট ছবি এখনো দেখতে পাব। নেপালের রাজদরবারে প্রাপ্ত চর্যাপদ, মধ্যযুগের গীতিকবিতা, মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি সাহিত্যকর্মে যে সংগীতের অনিবার্য উপাদান বিদ্যমান, আজ তা গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গবেষকগণ লক্ষ করেছেন- চর্যাপদ ও অন্য কাব্যধর্মী সাহিত্যের শিরোদেশে তাল, লয় ও রাগিণীর উল্লেখ রয়েছে।

দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমান বাংলাদেশে শতাব্দীকালের আগে থেকে কপিরাইট আইন বলবৎ থাকার পরও অধিকার হরণের কার্যকর সমাধান সংগীত কর্মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। এর পেছনে স্বত্বাধিকারীদের চরম উদাসীনতা, অধিকার সম্পর্কে অজ্ঞতা ও কার্যকর ভূমিকা পালনে দক্ষতার অভাব মূলত দায়ী! গত দেড় দশকে মেধাসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সদাসয় সরকার তথা কপিরাইট অফিসের সহযোগী মনোভাব ও ইতিবাচক ভূমিকার ফলে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে BLCPS (Bangladesh Lyricists Composers & Performers Society) নামের প্রথম CMO বা Collective Management Organization. প্রতিষ্ঠানটি সংগীত স্রষ্টাগণের অধিকার সংরক্ষণ, সুরক্ষা, দেশে-বিদেশে রয়ালটি আদায় এবং চুক্তিবদ্ধ দেশের সংগীতস্রষ্টাদের স্বার্থে কার্যকর দায়িত্ব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে। আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, যে মহৎ আদর্শ ও উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীব্যাপী CMO কাজ করে, ঠিক একই ধরনের ম্যান্ডেট আমাদের CMO-কে দেওয়ার পরও বহু স্রষ্টাকে এক ছাতার তলে এখনো আনা সম্ভব হয়নি। 


একজন স্রষ্টাকে পরিপূর্ণভাবে সৃষ্টিশীল কর্মে নিয়োজিত করতে হলে তার রুটি-রুজির উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও বৈধ অধিকার অর্জনের পদ্ধতি আবিষ্কার করা অনিবার্য হয়ে পড়ে। পাইরেসিসহ নানা বেআইনি কার্যকলাপের কারণে স্রষ্টারা বারবার প্রতারিত ও বঞ্চিত হচ্ছেন, আইনি ঝামেলায় জড়াচ্ছেন। কখনো কখনো সংগীতকর্মের সঙ্গে যুক্ত রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও বঞ্চিত হোন স্রষ্টারা। আমরা অনেকেই জানি যে, বেসরকারি এফএম রেডিওগুলো এলিফেন্ট রোডের দোকান থেকে স্বল্পমূল্যে সংগীত সংগ্রহ করে সম্প্রচার করছে তাদের মিডিয়ায়! ইউটিউব নামক ভিডিও সম্প্রচার ও অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে কে-কার সংগীত কর্ম আপলোড করছে, তা সব সময় ট্র্যাক করা বা নজর রাখাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ডিজিটাল প্রতারণা ও বঞ্চনার পরিমাণ। ছন্দপতন ঘটছে সৃষ্টিশীলতায়।


সংগীতের দার্শনিক ও বাস্তব গুরুত্ব বিবেচনা করেই WIPO এ বছর সংগীতকে বিষয়বস্তু করেছে। বিশ্ব মেধাসম্পদ দিবসের এই দিনে গভীর বিশ্বাস ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে সব স্টেকহোল্ডারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাই। শিল্পীদের আর্থিক ও নৈতিক বঞ্চনার হাত থেকে বাঁচার জন্য ‘শিল্পী রক্ষা সমিতি’-র পরিবর্তে তারা যেন তাদের সৃষ্টির বিনিময়ে মর্যাদাবান জীবন নিয়ে টিকে থাকতে পারেন, তা নিশ্চিত করা জরুরি। আমরা আর আলাউদ্দিন আলীর মতো গুণী স্রষ্টাদের হারাতে চাই না। আসুন আমাদের মেধাবী স্রষ্টাদের জন্য দৃশ্য-অদৃশ্য সব বাধা দূর করার সমবেত অঙ্গীকার ব্যক্ত করি। তাদের দিই উদ্বেগহীন সৃষ্টিশীলতার আনন্দ। সব স্রষ্টাই যাতে নিবিষ্ট চিত্তে, হাসিমুখে দেশ ও দশের জন্য কল্যাণধর্মী কালজয়ী সৃষ্টি উপহার দিয়ে যেতে পারেন, সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি। 

লেখক: কবি ও সদস্য, কপিরাইট বোর্ড

পণ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা জরুরি

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৩৮ এএম
পণ্য সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা জরুরি
গোলাম রহমান

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী নানারকম অস্থিরতা বিদ্যমান। এর প্রভাবে দেশের মানুষও খুব একটা ভালো আছে বলা যাবে না। করোনা-পরবর্তী সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এর ফলে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ অর্থনীতিতে বড় ধরনের একটা বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। দেশের মানুষ এখনো তা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়নি। অধিকাংশই বিশেষ করে উচ্চবিত্ত বা  উচ্চমধ্যবিত্ত ছাড়া প্রায় সবাই কষ্টে রয়েছে। যারা নির্দিষ্ট আয়ে সংসার চালান অথবা যারা অবসর জীবন যাপন করছেন তারা খুবই সংকটে রয়েছেন। সংসারের ব্যয় কাটছাঁট করতে করতে অবস্থা অনেকটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সঞ্চয় বলতে অবশিষ্ট কিছু নেই। সরকার কিছু গরিব বা নিম্নবিত্ত মানুষকে সহায়তা দানের চেষ্টা করছে। প্রান্তিক জনগণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেটুকু সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আরও অধিক পরিমাণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসতে হবে। বলাবাহুল্য, বিশ্বজুড়ে করোনা-পরবর্তী সময় থেকেই সাধারণ মানুষের আয় কমে গেছে। সে সময় অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছিল।

 সেগুলো আজও চালু করা সম্ভব হয়নি। সে ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে নতুন নতুন কর্মপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করিনি। বর্তমানে যদিও আশা করা যায় সার্বিকভাবে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে। এর ফলে কিছুটা গতি সঞ্চার হয়েছে। তার পরও মানুষের আয় এখনো আগের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যাপক ঘাটতি এখনো আছে। ঘাটতি দূরীকরণে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি জরুরি। সেটা করতে হলে বিনিয়োগের দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। বেকারত্ব দূরীকরণের লক্ষ্যে সরকারকে অবশ্যম্ভাবীভাবেই বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রতি বছর সরকার জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বাড়ায়। এবং এর থেকে সরকার একচেটিয়া ব্যবসা করে। এসব পণ্যকে কৌশলগত পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকার এসব পণ্যের মাধ্যমে ব্যবসা করে থাকে। কারণ, অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য পণ্যগুলোর সরবরাহ পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা দরকার। একই সঙ্গে নিত্যপণ্যের দাম সাশ্রয়ী রাখা দরকার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা বা মানুষকে স্বস্তির মধ্যে জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়ার জন্য ব্যবসা করছে না। অতীতে সরকারকে জ্বালানি তেল ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করতে আমরা দেখেছি। বিগত সময়গুলোতেও আমরা দেখেছি যে, যখন তেলের দাম অনেক বেশি ছিল, তখন সরকার ভর্তুকি দিয়েছে। আমরা একটা কথা বারবারই বলেছি যে, জ্বালানির দাম বাড়ানো কমানো নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এর দামে যে টাকা মুনাফা হচ্ছে, সেটা দিয়ে মূল্য স্থিতিশীল রাখার তহবিল গঠন করা হোক। সেই তহবিলে যে অর্থ জমা হবে, তা দিয়ে যখন দাম বাড়বে, তখন যেন ভর্তুকি দেওয়া হয়। সরকারকে অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি মানুষকে স্বস্তিতে রাখতে হলে নিত্যপণ্যের দাম সহনশীল রাখতে হবে।

দেশের উৎপাদনব্যবস্থায় এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি। দেশজুড়ে চাঁদাবাজিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হয়নি। এ কথা সত্য যে, ব্যবসায়ীরা লাভ করার জন্যই ব্যবসা করে থাকে। সে ক্ষেত্রে সরকারের উচিত ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করা। যাতে কেউ ইচ্ছা করলেও দাম বৃদ্ধি করতে না পারে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক না হলে উৎপাদন ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি অপেক্ষাকৃত কঠিন হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে উৎপাদনের মন্থরগতির কারণে সমাজব্যবস্থাপনায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ নেতিবাচক প্রভাব আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি। এ কারণেও বাজারে নিত্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে নিম্নপর্যায়ে দাম বৃদ্ধিতে একটা ইন্ধন জোগানোর চেষ্টা থাকে সবসময়। এর ফলে যে বিক্রি করে হয়তো তারও খরচ বেড়ে যায়। কিন্তু সুবিধা ভোগ করে কয়েকজন মাত্র অসাধু ব্যবসায়ী। যা কারও জন্যই কাম্য নয়। 

দ্রব্যমূল্যের বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ভোক্তাদের কেবল বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে স্বস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে সাধারণ ব্যবসায়ীরা জিম্মি হয়ে পড়ে। বাজারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে অসাধু ব্যবসায়ী কর্তৃক সৃষ্ট সিন্ডিকেট থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হবে। সে জন্য যেকোনো মূল্যে সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। বাজারে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে। বিগত সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের সংকটে পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ নানা কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে চাহিদা ও জোগানে ব্যাপক তারতম্যের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণে থাকছে না বাজার পরিস্থিতি। অন্যদিকে জনগণের ওপর ভ্যাটের চাপ না বাড়িয়ে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো যেত। এভাবে ভ্যাট বাড়ালে মানুষের জীবনযাত্রা আরও কষ্টকর হয়ে ওঠে। ‘মানুষ যে পরিমাণ ভ্যাট সরকারকে দিচ্ছে সেটা সংগ্রহ ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। তাছাড়া দেশে ভ্যাট আদায়যোগ্য অধিকাংশ ব্যবসায়ী ভ্যাট ফাঁকি দেয়।

 দেশে নতুন সরকার এসেছে। তারা এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়ে  সমাধান করতে পারে। এর ফলে রাজস্ব ও ভর্তুকির সমস্যা সমাধান সম্ভব হতে পারে। সাধারণ মানুষও কিছুটা  স্বস্তি পাবে। বিগত সময়ে ভ্যাট মেশিন বাধ্যতামূলক করা হলেও তা পুরোপুরি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তার আগে এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) একেক সময় একেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা কার্যত ফলপ্রসূ হয়নি। আর যারা ভ্যাট ফাঁকি দেয় তাদের অনাগ্রহের কারণে ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার (ইসিআর) কিংবা ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানোর কর্মসূচি ফলত কোনো কাজে আসেনি। এসবে আরও বেশি জোর দেওয়া উচিত ছিল।

বাজারে অধিকাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম স্থিতিশীল নয়। সরবরাহ সামান্য কমলেই ব্যাপক দামবৃদ্ধি ঘটে। অনিয়ন্ত্রিত মুক্তবাজার অর্থনীতি অনুসরণের ফলে দেশের গুটিকয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিয়েছে। এরা সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে বহুদিন থেকেই বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে চলেছে।  প্রতিযোগিতামূলক বাজারব্যবস্থাপনা  না  থাকায় কতিপয় প্রতিষ্ঠান পণ্যের সরবরাহ ও দাম নির্ধারণে কারসাজির মাধ্যমে অস্বাভাবিক মুনাফা অর্জন করছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উৎপাদক থেকে শুরু করে ভোক্তাশ্রেণিসহ সবাই। মাঝেমধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে কতিপয় মুনাফালোভী ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষের পকেট কাটে। বাজারে আইনের সঠিক প্রয়োগ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ব্যতিত এ কঠিন সমস্যা দূরীকরণ ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমানো সম্ভব নয়। কাজেই বাজারব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারকে গঠনমূলক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

লেখক: সাবেক সচিব এবং সাবেক চেয়ারম্যান, দুর্নীতি দমন কমিশন

ইউরোপ, আমেরিকার ফাটল কাঠামোবদ্ধ রূপ পাচ্ছে

প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৯ এএম
ইউরোপ, আমেরিকার ফাটল কাঠামোবদ্ধ রূপ পাচ্ছে
রায়হান আহমেদ তপাদার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ময়দান থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের শুরু। আত্মপ্রকাশ ঘটে ভূ-রাজনৈতিক ব্লকের। যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ব্লক সোভিয়েত ইউনিয়নের বাড়-বাড়ন্তে উদ্বেগ বাড়তে থাকে ওই ব্লকের। বাড়তে থাকে উত্তেজনা। শুরু হয় একে অপরের মধ্যকার বহুমাত্রিক প্রতিযোগিতা। উভয় ব্লকেরই দাবি ছিল, বিপরীত ব্লক তাদের ভেতরকার ঐক্য ধ্বংস করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদল যেমন পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে অবস্থান নিতে পারত না, তেমনি সোভিয়েত ট্যাংকগুলোও প্রুশিয়ান ময়দানে প্রবেশ করতে পারত না যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করার এই প্রক্রিয়াকে তখন ‘ডিকাপলিং’ বলা হতো।

 উভয় ব্লকের কয়েক দশকের দ্বন্দ্ব যা করতে পারেনি, তা এখন কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই করতে চলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার তিন মাসও হয়নি, এর মধ্যেই তারা বিশ্বজুড়ে রণহুংকার ছাড়ছে। নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছাকৃতভাবে ইউরোপ তথা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে দুর্বল ও বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছে বলে বলা হচ্ছে। চলতি বছরে জার্মানির মিউনিখে সমাপ্ত নিরাপত্তা সম্মেলনে সেই বার্তাই পেয়েছেন ইউরোপীয় নেতারা। তিন দশক আগেই পূর্ব আর পশ্চিমের মধ্য স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়েছে। তবু এখন ইউক্রেন আর গাজা উপত্যকার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বড় অশান্তি তৈরি হয়েছে দুনিয়াজুড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে স্নায়ুযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অবসানের আগেই জার্মানির রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ শান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে নানা উদ্যোগ নিতে শুরু করে। এমনকি তীব্র স্নায়ুযুদ্ধের কালেও ১৯৬৩ সালে রাজনীতিক, গবেষক ও নাগরিক সমাজকে নিয়ে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার বিষয়ে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের উদ্যোগ শুরু হয়।

তবে প্রথম এক দশক সেই সম্মেলন ব্যাপক আন্তর্জাতিক সাড়া জাগাতে পারেনি। শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলোই এতে অংশ নিত। পরবর্তীকালে এর ব্যাপ্তি বেড়েছে। ইউরোপীয়রা আগে যা জানতেন সিগন্যাল অ্যাপ কেলেঙ্কারি সেটাই নিশ্চিত করেছে। ইউরোপের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের অবজ্ঞা গভীর এবং আটলান্টিকের এপার-ওপারের দেশগুলোর মধ্যে ফাটল এখন কাঠামোবদ্ধ রূপ পাচ্ছে। যদিও আশা এখনো জিইয়ে আছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক চূড়ান্ত ধরনের বাজে অবস্থায় যাওয়া ঠেকাতে পারবে ইউরোপ। গ্রিনল্যান্ডে আগ্রাসন, ইউরোপের ন্যাটো সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার অথবা সর্বাত্মক বাণিজ্যযুদ্ধ- সবকিছুই ঠেকানোর আশা করছেন ইউরোপের কোনো কোনো নেতা। এ মুহূর্তে ইউরোপের নেতাদের সবচেয়ে জরুরি মনোযোগের বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে ধাক্কা দিয়ে বাসের নিচে ফেলে চলেও যায়, তাহলে ইউরোপ যেকোনোভাবেই হোক সম্মিলিতভাবে মুক্ত, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ইউক্রেনকে সুরক্ষা দিতে সফল হবে। এখানে কোনো বিভ্রমের অবকাশ নেই যে, ইউরোপীয় নেতারা সেটা করতে চান যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়েই অথবা ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশলগত অনুমোদন নিয়েই। 

সিগন্যাল অ্যাপ কেলেঙ্কারির ঘটনাটি একই সঙ্গে প্রত্যাশিত ও বেদনাদায়ক। এটা প্রত্যাশিত এ কারণে যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে যে ভাষায় কথা বলছেন, তার সঙ্গে সিগন্যাল অ্যাপে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা দলের সদস্যরা তাদের গোপন চ্যাট গ্রুপে যে ভাষায় কথা বলেছেন, দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ফেব্রুয়ারি মাসে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে জেডি ভ্যান্সের বক্তব্য, টাকার কার্লসনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের সাক্ষাৎকার অথবা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরতিহীন ঘোষণা ও তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টগুলো দেখলে তা অনুমান করা সহজ। 

কিন্তু গোপন ও প্রকাশ্য- দুই জায়গাতেই স্মরণ করার মতো ধারাবাহিকতা রয়েছে। ওয়াশিংটন ইউরোপকে বাতিল, অহংকারী ও পরজীবী বলে মনে করে। বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে ক্ষয়িষ্ণু মিত্র হিসেবেও দেখে না, ট্রাম্পের কর্মকর্তারা ইউরোপের মৃত্যুতে অবদান রাখতে চান। লোহিত সাগরে হুতির হুমকি সম্পর্কে যে যা-ই ভাবুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হলো তারা নিজেদের জাতীয় স্বার্থেই ইরানপন্থি সশস্ত্র গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালায়। কিন্তু ভ্যান্স ও পিট হেগসেথ গ্রুপ চ্যাটে পরিষ্কার করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে হুতির ওপর আক্রমণে ইউরোপীয়রাও লাভবান হবে। এটা যেকোনো আক্রমণকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট কারণ। অন্য কথায় ইউরোপীয়দের সাহায্য করার বিষয়টিকে এমন একটা নেতিবাচক বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে, সম্ভাব্য হুমকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি উল্টো দিকে ঘুরে যেতে পারে।

 ইউরোপের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই যে অবজ্ঞা, তার ওপর দাঁড়িয়ে ইউরোপকে এখন তিনটি বড় নীতিগত জায়গায় কাজ করতে হবে। যেমন- বাণিজ্য। এ সপ্তাহে ট্রাম্প বেশ কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে বাণিজ্যযুদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। কোনো ধরনের সহানুভূতি কিংবা ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্যযুদ্ধের মাত্রাকে প্রশমন করতে পারবে না। বরং যুদ্ধের মাত্রাটা তীব্র হবে। যা-ই হোক, ২৭টি সরকারের জন্য একটি বাণিজ্যনীতি পরিচালনা করা ইইউর আইনি দায়িত্ব এবং জোটের একটি সম্মিলিত অর্থনৈতিক ওজন রয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্র উপেক্ষা করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে যন্ত্রণা আসবেই। কিন্তু সংঘাতের ক্ষেত্রে ইটের বদলে পাটকেল থাকতে হবে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইউরোপীয়রা যদি সবাই মিলে কঠোর অবস্থানে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ধরনের লুণ্ঠক আচরণ করতে পারবে না। গ্রিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র থামবে না। ট্রাম্প বারবার করে বলছেন, গ্রিনল্যান্ড তার হবে। 

আর্কটিক দ্বীপে ভ্যান্সের উসকানিমূলক ভ্রমণ এবং কয়েক দশক ধরে গ্রিনল্যান্ডের দেখভালের ক্ষেত্রে ভালো কিছু করছে না বলে ডেনমার্ককে তার তিরস্কার এই ইঙ্গিত দেয় যে, ওয়াশিংটনের জবরদস্তি আরও তীব্র হবে। এখন ইউরোপের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের অবজ্ঞাকে মাথায় রেখে ডেনমার্কের সমর্থনে ইউরোপীয় নেতাদের কথা বলতে হবে। ইউরোপের নেতারা যদি দুর্বল প্রতিক্রিয়া দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে চরম বাজে ধরনের চাপ আসবে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইউক্রেন। ইমানুয়েল মাখোঁ ও কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বে ইউরোপের অন্য সক্ষম ও ইচ্ছুক নেতারা জেলেনস্কিকে সঙ্গে নিয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার একটি পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। কিন্তু এটা ক্রমাগতভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইউরোপীয় নেতাদের সেটা করতে হবে শুধু যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াই নয়, সম্ভবত দেশটির বিরুদ্ধেও। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার ওপর নির্ভর করা যাবে না।

 ইউরোপের সবচেয়ে বড় শক্তিগুলো যেহেতু ইউক্রেনকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে এবং একই সঙ্গে তারা ইউক্রেনীয় বাহিনীগুলোকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেটা তাদের এগিয়ে নিতে হবে এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই যে, তাদের পেছনে আর যুক্তরাষ্ট্র নেই। গোয়েন্দা তথ্য ও লজিস্টিক সমর্থন আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ইউরোপের নেতাদের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ওয়াশিংটন যদি অনাগ্রহী হয় তাহলে ইউরোপ ও ইউক্রেনকে অবশ্যই নতুন পন্থা খুঁজে বের করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়াই কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়। রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে ইউরোপকে সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় সরকারগুলো দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কৃষ্ণসাগরে যুদ্ধবিরতির পূর্বশর্ত হিসেবে কৃষি-খাদ্য খাতে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করার রাশিয়ার দাবি জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবিলায় ইউরোপকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

এমনিতেই বিশ্বব্যাপী ডানপন্থি রাজনীতি ক্রমেই প্রভাব বিস্তার করছে। এর বিস্তার ঘটেছে ইউরোপের নানা দেশেও। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরিতে এখন কট্টরপন্থি দলগুলোর রমরমা। ২০২৪ সালের ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে রক্ষণশীল ও অতি ডানপন্থি দলগুলো বড় সফলতা পেয়েছে। ইউরোপীয় রাজনীতিতে এই ডানপন্থা রাজনীতির সুযোগে তাকে আরও উসকে দিচ্ছেন সদ্য ক্ষমতাসীন মার্কিন রাজনীতিকরা। এই কৌশলের একটি মূল চালিকাশক্তি হলো মার্কিন রাজনীতিতে অর্থনৈতিক অভিজাতদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। আদতে মার্কিন এসব রাজনীতিকের কাছে ন্যায়নীতি, শান্তি বা সৌহার্দ্যের কোনো বার্তা নেই। যা আছে, তা হলো বিদ্বেষ ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির উন্নয়ন। জার্মানি ক্রিশ্চিয়ান গণতান্ত্রিক দলের নেতা এবং সম্ভাব্য আগামী চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস একটি সার্কুলার ই-মেইলে লিখেছেন যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এখন সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি লেখেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে ক্ষমতাসীন হওয়ায় ইউরোপের রাজনৈতিক শৃঙ্খলা এখন হুমকির মুখে।

 এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, আগামীতে আন্তআটলান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফাটল দেখা দিতে পারে। নতুন প্রশাসন আসায় যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে ফাটল ধরবে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে কখনো বদল আসে না। নীতি প্রণয়নে ট্রাম্প অস্থির হলেও গণতান্ত্রিক দেশগুলোর উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে অভিবাসন নীতি ও শুল্ক নিয়ে এশিয়া ও ইউরোপ চাপে পড়তে পারে বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। পশ্চিম শব্দটির মানে এখন স্পষ্ট নয়। বহু বছর ধরে কখনো কখনো ইউরো-আমেরিকান উত্তেজনা সত্ত্বেও, এটি একটি একক কৌশলগত শক্তিকে নির্দেশ করত। উদার গণতন্ত্রের মূল্যবোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল যে অংশটি। এখন আছে ইউরোপ, রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। পশ্চিম ধারণাটি এখন শূন্য হয়ে গেছে। কীভাবে এই শূন্যস্থান পূর্ণ হবে তা স্পষ্ট নয়।

তবে একটি সাধারণ সম্ভাবনা হলো সহিংসতা। এতে বড় শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে পারে। ট্রাম্পকে একজন জাতীয়তাবাদী ও কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখানো হচ্ছে। তার শুল্ক রাজনীতিতে প্রতিদিন পাল্টাচ্ছে বাস্তবতা। লেনদেনের সূত্র ধরে তিনি নিজের বক্তব্য থেকে শুরু করে গতিপথও পাল্টান। ২০১৭ সালে তার প্রথম মেয়াদে পোল্যান্ডে এক সফরে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি আজ ঘোষণা করছি যাতে পৃথিবী শুনতে পায়, পশ্চিম কখনোই ভেঙে যাবে না। আমাদের মূল্যবোধ জয়ী হবে’। এরপর ট্রাম্প নিজেকে গতানুগতিক চিন্তা ও সেই চিন্তাকে সমর্থনকারী প্রথাগত রিপাবলিকান দলের প্রভাব থেকে মুক্ত করেছেন। তিনি এখন একজন স্বাধীন নেতার মতো কাজ করছেন বলেই মনে করছেন অনেকে। ইউরোপের জন্য সমস্যা হলো, ট্রাম্প যা করছেন তা কি কৌশল, নাকি আমেরিকার একনায়কত্বের নতুন রূপরেখা, সেটা বোঝা।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক 
[email protected]

ইউক্রেনে ট্রাম্পের ১০০ দিনের ব্যর্থতা

প্রকাশ: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:৩৭ পিএম
ইউক্রেনে ট্রাম্পের ১০০ দিনের ব্যর্থতা
কার্ল বিল্ডট

ভ্লাদিমির পুতিন এবং তার আলোচকরা স্পষ্টতই তাদের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষদের নেতৃত্ব দিতে সফল হয়েছেন। ইউক্রেনে এমন একটি শান্তি প্রক্রিয়াকে নিন্দা জানিয়েছেন, যা অনুসরণ করার ইচ্ছা নেই। এ ঘটনার এতদিন পরেও, এমনকি সবচেয়ে মূর্খ আলোচকদেরও বুঝতে পারা উচিত ছিল যে কী ঘটছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে আসার প্রায় ১০০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। ইউক্রেনের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। ট্রাম্পের ‘প্রথম দিনে’ যুদ্ধ শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু শান্তির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রশাসন কখন স্বীকার করবে যে, তারা ব্যর্থ হচ্ছে?

ট্রাম্পের প্রাথমিক দাবিগুলো ছিল খুবই সোজাসাপ্টা: যুদ্ধ বন্ধ করুন এবং আলোচনা শুরু করুন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার প্রথম কথোপকথনের পর তিনি ঘোষণা করেছিলেন, যুদ্ধের সম্পূর্ণ অবসান খুবই সন্নিকটে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সেই সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

তার পর থেকে পুতিন এবং ক্রেমলিনে তার ছোট দল ট্রাম্পের অনভিজ্ঞ আলোচক স্টিভ উইটকফকে জটিল শর্ত এবং অযৌক্তিক দাবির জন্য খরগোশের গর্তে টেনে আনতে সফল হয়েছে। এ ঘটনার পরে মূর্খ আলোচকদেরও বুঝতে হবে পুতিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার বা ট্রাম্পের পরিকল্পনা ও সময়সূচি মেনে নেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। 

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণমাত্রার আক্রমণ শুরু করার পর থেকে পুতিন ইউক্রেনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়ার সামরিক শক্তির ওপর নির্ভর করেছেন। প্রায় ২ লাখ সৈন্য ইউক্রেনে প্রবেশ করে। এর পর বড় অঙ্কের আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে আরও ৪ লাখ সৈন্য বাড়ানো হয়। তাদের আক্রমণে ৭ থেকে ৮ লাখ আহত এবং ২ লাখের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটলেও শক্তিশালী রাশিয়ান সেনাবাহিনী তিন বছরে ইউক্রেনের কম অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। 

সামরিক দিক থেকে পুতিনের যুদ্ধটা বিশাল ব্যর্থতা। তিনি সম্ভবত এখনো বিশ্বাস করেন তার বাহিনী আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে পারে এবং কিছু সামরিক সাফল্য অর্জন করতে পারে। কিন্তু পর্যবেক্ষকরা তা ঘটার সম্ভাবনা কম দেখতে পান। রাশিয়ার লোকসংখ্যা ইউক্রেনের চাইতে বেশি কিন্তু তা সম্মুখ সারিতে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে সংগ্রাম করার ইচ্ছা জাগিয়ে তুলতে পারবে না। এর অর্থ হলো পুতিন শেষ পর্যন্ত রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর চেয়ে ট্রাম্পের ওপর বেশি নির্ভরশীল।

এভাবে, পুতিন ট্রাম্পের সঙ্গে খেলার জন্য তার সব সম্পদ ব্যবহার করেছেন। সবাই জানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তোষামোদের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। পুতিন অতিরিক্ত যুক্তি দিয়েছেন ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছিল। ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকলে যুদ্ধ কখনো হতো না। আমরা বিশ্বাস করি ২০২৪ সালে হত্যাচেষ্টার পর তিনি ট্রাম্পের জন্য প্রার্থনা করতে তার ব্যক্তিগত গির্জায় গিয়েছিলেন। এমনকি তিনি ক্রেমলিনের শিল্পীকে উপহার হিসেবে ট্রাম্পের একটি প্রতিকৃতি আঁকতে বাধ্য করেন।

তোষামোদের পাশাপাশি, রাশিয়ানরা ট্রাম্প এবং উইটকফের সামনে লাভজনক ব্যবসায়িক সম্ভাবনাও ঝুলিয়ে রেখেছে। রিয়াদে মার্কিন ও রাশিয়ান আলোচকদের মধ্যে প্রথম সাক্ষাতে পুতিনের দল বহু বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের সুযোগের একটি তালিকা নিয়ে এসেছিল। যা ট্রাম্প ইউক্রেনকে ত্যাগ করলে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করলে পাওয়া যাবে বলে ধারণা দেওয়া হয়। উইটকফের মতে, পুতিনের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক বৈঠকের বেশির ভাগ অংশ এ বিষয়ের ওপর ছিল।

উভয় কৌশলই স্পষ্টভাবে কাজ করেছে। পুতিন তার কাজ জানেন এবং তিনি তার লক্ষ্যও জানেন। এখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি এবং পুতিন যে এতে রাজি হতে প্রস্তুত তারও কোনো লক্ষণ নেই। তিনি ইউক্রেনের শহরগুলোতে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে দায়মুক্তি ছাড়াই আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন।
ক্রেমলিনের গোপন বৈঠকে যে আলোচনায হয় তাতে তাদের দাবির দুটি কথা উল্লেখ করা হয়। প্রথমটি হলো ইউক্রেনকে লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া এবং খেরসন এই চারটি অঞ্চল হস্তান্তর করতে হবে। উইটকফ ইতোমধ্যেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অংশ হিসেবে চারটি অবৈধভাবে দখলকৃত অঞ্চলকে স্বীকৃতি দিতেও প্রস্তুত।

কিন্তু রাশিয়া এই অঞ্চলগুলোকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে না। যুদ্ধপূর্ব ১০ লাখ জনসংখ্যার শহর জাপোরিঝঝিয়া এবং খেরসনের আঞ্চলিক রাজধানীগুলোতে এখনো ইউক্রেনের পতাকা উড়ছে। কিয়েভের কোনো সরকার যদি আত্মসমর্পণ করে তার পরও তারা টিকতে পারবে না। ইউক্রেন স্নায়ু সংঘাত মেনে নিতে পারে, তবে তারা এর চাইতেও অনেক কঠিন। 

দ্বিতীয় দাবি হলো ইউক্রেনের বাকি অংশের ওপর নিরাপত্তা আধিপত্য এবং নিয়ন্ত্রণ করা। পুতিন ভবিষ্যতে পশ্চিমাদের নিরাপত্তা বা সামরিক উপস্থিতি অথবা ইউক্রেনের জন্য সহায়তা বন্ধ করতে চান। ট্রাম্প ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের ভবিষ্যতের ন্যাটো সদস্যপদ প্রশ্নে মাথা নত করেছেন এবং তিনি স্পষ্টভাবে পুতিনকে মার্কিন সহায়তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিতেও প্রস্তুত।

এখানেই ইউরোপীয়দের ভূমিকা। পুতিন বা ট্রাম্প কেউই তাদের আলোচনার টেবিলে রাখতে চাননি। যতক্ষণ পর্যন্ত ইউরোপীয়রা ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিকভাবে সহায়তা অব্যাহত রাখার সংকল্পে অটল থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত পুতিন এবং ট্রাম্প যা খুশি তাই করতে পারেন। বাস্তবে কি হলো এতে তাদের কিছু যায় আসে না। 

তাই ইউরোপের হাতে একটা তুরুপের তাস আছে। যদি তারা রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি জাগাতে পারে, তাহলে তারা ইউক্রেনের জন্য মিউনিখের মতো লজ্জাজনক বিশ্বাসঘাতকতা রোধ করতে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হবে। ইউরোপীয় নেতাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে যে, তারা যেকোনো পরিস্থিতিতেই ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা এবং সার্বভৌমত্বকে সমর্থন করার জন্য তাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাবে।

তত্ত্বগতভাবে, ট্রাম্প নিজেই পুতিনের ওপর গুরুতর চাপ প্রয়োগ করে এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি করে কূটনৈতিক কৌশল পরিবর্তন করতে পারেন। যদি তা ঘটে, তাহলে তিনি যে যুদ্ধবিরতি চান তা অর্জন করতে পারেন। অন্যথায়, তিনি ব্যর্থ হতে থাকবেন, কারণ পুতিন এবং তার বন্ধুরা তার পেছনে তাকে নিয়ে হাসছেন।

লেখক: সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। 
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল