
সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন তখন গুজব ছড়িয়ে বা কোনো না কোনো অজুহাতে দলবদ্ধভাবে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলার মতো সহিংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। যদিও উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে বারবার জনগণকে এ ধরনের সহিংস তথা অমানবিক ঘটনা ঘটানো থেকে বিরত থাকার জন্য হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। তার পরও এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না।
গত বছর আগস্ট মাসের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার এক অভাবিত অভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে স্বৈরাচারী তথা কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের। আওয়ামী সরকারের পতনের পর সর্বসম্মতিক্রমে গঠিত হয় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এবং সেই সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই সর্বক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কার্যক্রম শুরু করা হয়, যা এখনো চলমান।
দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যেও কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ নানা ধরনের দুষ্কর্ম ও অপরাধমূলক কাজের সুযোগ তৈরির কাজে লিপ্ত রয়েছে। সামাজিক স্থিতিশীলতার কথা বিবেচনায় নিয়ে এসব অপরাধপ্রবণ সুযোগসন্ধানীদের নিবৃত্ত করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে ব্যক্তিগতভাবে অথবা দল তৈরি করে কিছু মানুষের নানা ধরনের জনস্বার্থবিরোধী কার্যক্রম চালাতে আমরা দেখছি, যা দেশের সাধারণ জনগণের কষ্ট ও আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে।
‘মব জাস্টিস’ এখন বহুল আলোচিত একটি শব্দ। যখন একজন ব্যক্তিকে অপরাধী বলে সন্দেহ করে একদল লোক যেকোনো সময়ে ভিড়ের মধ্যে মারধর বা হত্যা করে তাকে ‘মব জাস্টিস’ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ঘটনাটি ঘটে ‘মব ভায়োলেন্স-এর আদলে, প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা থেকে। এবং পরে এই অমানবিক তথা বেআইনি ঘটনাকে জাস্টিফাই করার জন্য বলা হয় ‘মব জাস্টিস’। সভ্য সমাজে যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কেন এ ধরনের প্রবণতা সমাজে বেড়ে চলেছে? মানুষ কেনই বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইন তুলে নিচ্ছে নিজের হাতে? এই মুহূর্তে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। যদিও বেশির ভাগ মানুষ এই প্রশ্নের উত্তরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে নানামুখী শৈথিল্যকেই দায়ী করে থাকেন।
কেউ কেউ বলেন, দেশে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সঙ্গে জড়িত হলো পুলিশ বাহিনী। কারণ তারা দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করে। কিন্তু পুলিশ বাহিনী এখনো নানা কারণে একটা ট্রমার মধ্যে আছে, যা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগছে। আসলে তাদের মানসিক জোর ফিরিয়ে আনতে হবে।
এই পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, পুলিশ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে তখন হামলা, হুমকি ও আসামি ছিনতাই ইত্যাদি ঘটনা বাহিনীটিকে নতুন সংকটে ফেলছে। পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার না করে পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে আরও কঠোর হতে হবে।
সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে আইজিপি বাহারুল আলম বলেছেন, নাগরিক সমাজের প্রতি আমার অনুরোধ, পুলিশকে আপনারা আবার কাছে টেনে নিন। পুলিশকে তার কাজ করতে সহায়তা করেন। আমরা চেষ্টা করছি যারা অপরাধী (পুলিশ) তাদের বিচারের আওতায় এনে ও সরিয়ে দিয়ে পুলিশকে আবার সগৌরবে ফিরিয়ে আনতে এবং কর্মক্ষম করে গড়ে তুলে পুনরায় মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে।
তিনি আরও বলেন, এক হাজার শহিদ ও কয়েক সহস্র আহত ছাত্র-জনতা আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেয়, ৫ আগস্টের আগে ১৫ বছর আমরা কীভাবে অসহনীয় পরিস্থিতিতে কাটিয়েছি।
বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে এমন ধরনের ঘটনা সম্পূর্ণটাই আসলে ‘ভায়োলেন্স’। কখনো কখনো ব্যক্তিবিশেষ বা দলবিশেষের সদস্যরা প্রতিপক্ষের কোনো কোনো কাজের প্রতিশোধস্বরূপ এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকে প্রচলিত কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে। এর সঙ্গে সাধারণত যুক্তি বা ন্যায়বিচারের কোনো সম্পর্ক থাকে না। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই মব বা দলবদ্ধ মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাদের পরিচয় সহজে পাওয়া যায় না। বিষয়টা এমনও হতে পারে যে, এসব ব্যক্তি তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং নিজেদের ব্যক্তিগত পরিচিতি আড়াল করে আইনের হাত থেকে নিজেদের মুক্ত রাখার জন্যই এই পথকে বেছে নেয়। এর পাশাপাশি কাজ করে মানুষের সহজাত কিছু মানসিক প্রবণতা। যার মধ্যে রয়েছে আর পাঁচজন চেনা-অচেনা মানুষের চোখে নিজেকে ‘হিরো’ হিসেবে জাহির করার গোপন ইচ্ছা।
এখন প্রশ্ন হলো, এ ধরনের অপরাধমূলক তথা অমানবিক ভয়ংকর কার্যকলাপ বন্ধ করার কী উপায়? আরও গভীরভাবে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে এবং প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কারণ স্বাভাবিকভাবে দেশের সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন এবং সামাজিক ক্ষেত্রে নিরাপত্তার গ্যারান্টি চায়। এখানে আরেকটা ভেবে দেখার বিষয় আছে, সেটি হলো একসঙ্গে বেশ কিছু মানুষ দলবদ্ধভাবে এ ধরনের অপরাধ করার পর দলের মধ্য থেকে কেউ আইনের আওতা এড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইলে সহজেই সে পালিয়ে যেতে পারে। এবং পালিয়ে গিয়ে পরে তার আরও অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য প্রয়োজন সময়মাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা।
সম্প্রতি রাজধানীর তোপখানা রোডে টুরিস্ট পুলিশের সদর দপ্তর পরিদর্শন শেষে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেছেন, মব নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কাজ করলেও সব সময় বাহিনী দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
মব জাস্টিসের মতো ঘটনা কমছে না, তা স্বীকার করে গণমাধ্যমের কাছে তিনি আরও বলেছেন, আমি দ্বিমত করব না, এমন ঘটনা হচ্ছে। তবে যেখানেই হচ্ছে সেখান থেকে সঙ্গে সঙ্গে অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। অন্যদিকে, পুলিশের ওপরেও হামলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করতে হবে। জনগণ এমনভাবে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে গেলে অনেক সময় সমস্যা হয়। তবু ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও একসময় নিজের ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষে হলেও মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাহলে আপনাদেরও ডেভিল (শয়তান) হিসেবে ট্রিট করা হবে।’ এদিকে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গণপিটুনির অন্তত ৩০টি ঘটনায় কমপক্ষে ১৯ জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয়েছেন। এই সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গণপিটুনির ১১৪টি ঘটনায় কমপক্ষে ১১৬ জন নিহত হয়েছেন এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন।
পুলিশের সদর দপ্তর বলেছে, গত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যদের ওপর কমপক্ষে ২২৫টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনাও রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের উপদেষ্টা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বারবার মবের নামে এই ধরনের বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ঘটনা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এত হুঁশিয়ারিতেও তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। বাস্তব অবস্থা এটাই। এ ক্ষেত্রে আর একটা কথা বলা দরকার, সেটা হলো, দেশের বিদ্যমান আইনব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে এ ধরনের অমানবিক তথা বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা একান্ত প্রয়োজন।
বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর থেকে যেভাবে কিছু কিছু মানুষ প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেছে, উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করতে সাধারণ মানুষকে নানাভাবে প্ররোচিত করছে, তাদের দমন করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। তারা কখনো কখনো আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো সাহসও দেখাচ্ছে। তাদের এ ধরনের ধারণা পাল্টে দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, যা বাস্তবায়িত হতে পারে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ তথা বাস্তবায়নের মাধ্যমে।
বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করলে কখনো কখনো মনে হতে পারে, দীর্ঘ ১৫ বছরের একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের কুফল এভাবেই দৃশ্যমান হচ্ছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর সেটা আরও প্রকট হয়েছে।
এসব ঘটনা এবং পরিস্থিতি নিরপেক্ষভাবে মনোযোগসহকারে পর্যবেক্ষণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, বিগত স্বৈরাচারী শাসন আমলে দেশের জনগণের একটা অংশ দিনের পর দিন এক ধরনের বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়ে কীভাবে নানা কারণে অসহিষ্ণুতার একেবারে চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল, যার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল নানাভাবে, বিভিন্ন ঘটনার মধ্যদিয়ে। যেমন- একদিকে ছিল দৈনন্দিন জীবনে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চাপ, অন্যদিকে ছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিরূপ প্রভাব। সবমিলিয়ে একটা পরিবর্তন চাইছিল দেশের সাধারণ মানুষ, যা পরবর্তীকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শরিক হতে তাদের নৈতিক সমর্থন জুগিয়েছিল।
লেখক: শব্দসৈনিক ও বরিশাল বিভাগীয় উপদেষ্টা খবরের কাগজ
[email protected]