ঢাকা ৪ বৈশাখ ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ৪ বৈশাখ ১৪৩২

ইউরোপ সহজেই ইউক্রেনকে সুরক্ষিত করতে পারবে

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০২:২২ পিএম
ইউরোপ সহজেই ইউক্রেনকে সুরক্ষিত করতে পারবে
ড্যানিয়েল গ্রোস

ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাওয়ার মতো ইউরোপের যথেষ্ট আর্থিক ও সামরিক সম্পদ রয়েছে, এমনকি মার্কিন সমর্থন ছাড়াই। তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী বিমান বাহিনী এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ-পরীক্ষিত সামরিক বাহিনী প্রশংসাযোগ্য। ইইউ, যুক্তরাজ্য এবং নরওয়ে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ শক্তিশালী। 

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মধ্যে বিভাজনটা হলো সবচেয়ে বড়। ন্যাটো আর রাশিয়ার পুনর্গঠনবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা নষ্ট করতে প্রতিশ্রুতিশীল ঐক্যবদ্ধ ব্লক গঠন করে না।

অন্যদিকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির মতো হয়ে গেছে। তারা মনে করে পরাশক্তিদের প্রভাবের ক্ষেত্রগুলোর ওপর কর্তৃত্ব দাবি করার স্বাভাবিক অধিকার তাদের রয়েছে। ছোট ও দুর্বল দেশগুলো তাদের শক্তিশালী প্রতিবেশীদের বশ্যতা স্বীকার করে। এখন ইউরোপে গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব এবং আইনের শাসনের পক্ষে দাঁড়ানো ইউরোপের ওপর নির্ভর করে এবং ইউক্রেনকে রক্ষা করাও তাদের দায়িত্ব।

ইউরোপীয় নেতারা সামনের চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে। লন্ডনের এক সমাবেশে তারা ইউক্রেনকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং সেখানে যুদ্ধ বন্ধের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। যদি ইউরোপীয় শান্তি পরিকল্পনার সুযোগ তৈরি করতে হয়, তাহলে পুতিনকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে ইউক্রেনের ওপর অব্যাহত আক্রমণের মূল্য রাশিয়ার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠবে।
সামগ্রিকভাবে, ২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সহায়তা বছরে প্রায় ৮০-৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার অর্ধেকেরও বেশি ইউরোপ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য) থেকে আসছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, ২০২২ সাল থেকে প্রায় ৬৭ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা প্রদানের তালিকা রয়েছে যা প্রতি বছর ২৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই পরিমাণ অর্থ প্রতিস্থাপন করতে ইউরোপের খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয় যা ইউরোপের জিডিপির ০.২% এরও কম।

এই তহবিল নিয়মিত ইইউ বাজেট থেকে আসা সম্ভব না, কারণ এটি খুবই কম (জিডিপির মাত্র ১%) এবং বেশির ভাগ রাজস্ব এক বছর আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। কিন্তু ‘নেক্সট জেনারেশন ইইউ’ মহামারি-পুনরুদ্ধার তহবিলে যথেষ্ট অব্যয়িত অর্থ রয়েছে যা ইউক্রেনের দিকে পুনর্নির্দেশিত হতে পারে।
আরেকটি বিকল্প হতে পারে ইউরোপীয় দেশগুলোর একটি গ্রুপ, যেমন- বৃহৎ ইইউ সদস্য রাষ্ট্র, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্য- একটি নতুন অর্থায়ন বলয় তৈরি করা যা ইউক্রেনের সাহায্যের জন্য ঋণ প্রদান করবে। এই পদ্ধতির একটি স্বতন্ত্র সুবিধা রয়েছে: এর জন্য ইইউ সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে না। তাই ট্রাম্পের মিত্র হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের মতো বা আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ ইইউ সদস্য যেমন অস্ট্রিয়া এবং আয়ারল্যান্ডের মতো দেশের বিরোধিতার মাধ্যমে এর কোনো বাধাগ্রস্ত হবে না।
নিশ্চিতভাবেই কেবল ‘স্থগিত’ মার্কিন সাহায্য প্রতিস্থাপন করা যথেষ্ট হবে না। সর্বোপরি, ইউক্রেন এতদিন পর্যন্ত যে সমর্থন পেয়েছে তা কেবলমাত্র রাশিয়ার অগ্রগতিকে ধীর করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের জোয়ার ঘুরিয়ে দিতে পারেনি। তার পরও, ইউরোপ প্রয়োজনীয় তহবিল নিয়ে আসতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

অর্থায়নের বাইরেও ইউক্রেনের প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ সামরিক সরবরাহ যেমন ট্যাংক, বন্দুক এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করার জন্য ইউরোপ প্রস্তুত। বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শূন্যস্থান পূরণ করতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। কারণ ইউক্রেন বর্তমানে মার্কিন-নির্মিত প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের ওপর নির্ভর করছে। তার পরও ইউরোপীয় বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন- ফ্রাঙ্কো-ইতালীয় SAMP/T (Sol-Air Moyenne Portée/Terrestre), সেই সঙ্গে নরওয়ের স্বল্প-পাল্লার NASAMS (ন্যাশনাল অ্যাডভান্সড সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম) এবং জার্মানির IRIS-T (ইনফ্রারেড ইমেজিং সিস্টেম টেল/থ্রাস্ট ভেক্টর-নিয়ন্ত্রিত)। এই সিস্টেমগুলো এখন যুদ্ধ-পরীক্ষিত হয়েছে এবং প্যাট্রিয়টের তুলনায় কিছুটা কম ব্যয়বহুল বলে মনে হচ্ছে।

ইউরোপ যে ক্ষেত্রগুলোতে সহজেই আমেরিকার স্থান নিতে পারবে না তা হলো স্যাটেলাইট এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা। এই কারণেই ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগিতে ট্রাম্পের স্থগিতাদেশ দেশটির সেনাবাহিনীকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কারণ এরা রাশিয়ান সম্পদ লক্ষ্যবস্তু করার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আশা করা যায় যে, ট্রাম্প প্রশাসন শিগগিরই এই ধরনের বিনিময় পুনরায় শুরু করবে- যার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তেমন কোনো মূল্য দিতে হবে না- যেমনটি তারা পরামর্শ দিয়েছে।

সরাসরি সামরিক সাহায্যের বাইরে গিয়েও ইউরোপের উচিত ইউক্রেনীয় ড্রোন উন্নয়ন ও উৎপাদনের জন্য সহায়তা বৃদ্ধি করা। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনের দক্ষতা- ড্রোন ডেভেলপারদের ছোট দলগুলো স্থলভাগে যোদ্ধাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে উদ্ভাবনী, প্রায়শই কম খরচে সমাধান তৈরি করে যুদ্ধক্ষেত্রে এটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

সম্ভবত সবচেয়ে কণ্টকাকীর্ণ প্রশ্ন হলো পুতিন যদি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন, তবে ইউরোপ কি ইউক্রেনকে বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে পারবে? মার্কিন সমর্থন ছাড়া কেবল ইউক্রেন নয়, সমগ্র ন্যাটো ভূখণ্ড রক্ষার জন্য ইউরোপকে লাখ লাখ সৈন্য মোতায়েনের প্রয়োজন হবে।

এই বিষয়টি মাথায় রেখে ইইউ নেতারা সম্প্রতি তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছেন। ইইউ মন্ত্রীরা এখন ইউরোপীয় কমিশনের প্রস্তাব বিবেচনা করছেন, যাতে দেশগুলোকে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের জন্য আরও আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায়। প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ইউরো (১৬০ বিলিয়ন ডলার) পর্যন্ত যৌথ ঋণ গ্রহণের অনুমতি দেওয়া যায় যা ইইউ সরকারগুলোকে তাদের সামরিক সক্ষমতা জোরদার করার জন্য ধার দেওয়া হবে।

অনুমান করা যায়, এটিও যথেষ্ট হবে না। সাম্প্রতিক এক অনুমান মতে, ইউরোপীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বার্ষিক ব্যয় কমপক্ষে ২৫০ বিলিয়ন ইউরো বৃদ্ধি করতে হবে- যা জিডিপির প্রায় ১.৫ শতাংশ। তাছাড়া প্রয়োজনীয় কাঠামো এবং যুদ্ধ ইউনিট তৈরি করতে বছরের পর বছর লেগে যাবে।
কিন্তু এই মাত্রায় পুনঃসজ্জিতকরণ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রধান শক্তিতে রূপান্তরিত করবে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর অসাধারণ শক্তি রয়েছে তাদের জন্য এটা পর্যাপ্ত নয়। দেশের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ইউক্রেনের অভিজ্ঞ সামরিক বাহিনীর একটি বড় অংশকে একত্রিত রাখার খরচ এমন শক্তিশালী ইউরোপীয় বাহিনী তৈরির তুলনায় অনেক কম হবে। এদিকে, রাশিয়ার হাত থেকে আকাশপথ রক্ষা করার জন্য ইউরোপ সুসজ্জিত। ইউক্রেন মাত্র কয়েক ডজন পুরানো পশ্চিমা যুদ্ধ বিমান দিয়ে রাশিয়ার আকাশপথের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রায় ব্যর্থ করে দিয়েছে। ইউরোপীয় বিমান বাহিনী তাদের শত শত উন্নত যুদ্ধবিমান নিয়ে গর্ব করে।

এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ইউরোপকে যা করতে হবে তা হলো পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। ইউক্রেন যাতে স্থায়ী শক্তিশালী সেনাবাহিনী বজায় রাখতে পারে। স্পষ্ট করে বলা যায় যে, যেকোনো রাশিয়ান আক্রমণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইউক্রেনের ওপর নো-ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে। লাখ লাখ সৈন্য নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় যুদ্ধ বাহিনী তৈরির চেয়ে এটা অনেক দ্রুত করা সম্ভব এবং খরচও কম হবে। 

আজ রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে ধরে রাখার এবং ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইউরোপের কাছে যথেষ্ঠ সম্পদ আছে। তাদের অবশ্যই সেগুলো ব্যবহার করতে হবে।

লেখক: জার্মান অর্থনীতিবিদ এবং বোকোনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপীয় পলিসি মেকিং (IEP)-এর পরিচালক
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত 
অনুবাদ: িসানজিদ সকাল

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২৪ পিএম
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বলতে আমি যা বুঝি, এখানে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আমাদের দেশে সম্প্রতি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বেশ কিছুটা কমে গেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ- প্রত্যেকেই বাংলাদেশের ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যে প্রবৃদ্ধির স্টেটমেন্ট দিয়েছে, সেটাও ৪ শতাংশের মতো। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি তো ১০ শতাংশের কাছে অনেক দিন ধরেই আছে। সম্প্রতি তা ১০ শতাংশের বেশি হয়েছে। এই বিষয়গুলো সামনে রেখে আমাদের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এখন প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে আমাদের অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

 বিশেষ করে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত অনেক কম। এক দশক ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু করণীয় আছে। প্রথমত; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবশ্যই ভালো করতে হবে। দ্বিতীয়ত; অবকাঠামো, ট্রান্সপোর্টসহ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নানা রকমের সমস্যা আছে। তৃতীয়ত, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস যে সূচকে আছে, সেই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। এর মধ্যে বেশ কিছু সাব-ইন্ডিকেটরস আছে। সেগুলোর উন্নতি হওয়া দরকার। 

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়। এই বিষয়গুলো যদি আমরা সমন্বয় করতে পারি, তাহলে আশা করা যায় যে, দেশের  অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং দেশে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ ফিরে আসবে।

বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চমূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি স্থিতিশীল হওয়ার আগেই শুরু হয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফিড) পলিসি রেট বৃদ্ধি করাসহ নানা ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। 

একই সঙ্গে আরও নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে উচ্চমূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও বেশ কয়েকবার মুদ্রানীতি পরিবর্তন করেছে। যদিও বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য মুদ্রানীতিও রাজস্ব নীতির সমন্বয় সাধন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মূল্য বৃদ্ধি করে পণ্যের চাহিদা হয়তো কমানো যাবে। কিন্তু পণ্যের জোগান যদি একই সঙ্গে বৃদ্ধি না পায়, তাহলে মূল্যস্ফীতি কমবে না। ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পেলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যায়। বিনিয়োগ কমে গেলে উৎপাদন কমে যাবে। আর উৎপাদন কমে গেলে কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আর সবার জন্য উপযুক্ততা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না গেলে দেশে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম কোনোভাবেই কাজে আসবে না। কাজেই মূল্যস্ফীতির অভিঘাত রক্ষার পাশাপাশি আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের রপ্তানি বাড়াতে হবে।

মূল্যস্ফীতি বাড়লে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলো খুবই অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মজুরি বৃদ্ধির হার সেভাবে বাড়ছে না। মূল্যস্ফীতি আর মজুরি বৃদ্ধির এই পার্থক্যের কারণে সাধারণ মানুষ সংসারের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক পরিবার তাদের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। কেউবা তুলনামূলক কম পুষ্টিসম্পন্ন খাবার গ্রহণ করছে। অধিকাংশ দরিদ্র মানুষই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। 

দেশের সাধারণ জনগণ প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে। উচ্চমধ্যবিত্তের মানুষ হয়তো তাদের সঞ্চয় ভেঙে জীবনযাত্রার মানটা রক্ষা করতে পারে। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তো কোনো সঞ্চয় নেই। আমরা দেখছি, এই মানুষগুলোর জীবনমান ক্রমশই নিম্নমুখী হচ্ছে। এখানে আমাদের যা করতে হবে; সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় যেসব প্রকল্প আছে, তা যেন সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ভিডিপি, ভিডিএফ, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা- এদের অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম অভিযোগ আছে। প্রকৃতপক্ষে যারা পাওয়ার যোগ্য তারা পায় না। যারা পাওয়ার যোগ্য নয়, তারা পায়। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি কারচুপি হয়। এমনও দেখা যায় যে, খাদ্যসহায়তার কাজ কোনো কোনো মেম্বারের বাড়িতে হয়। সেখানে গুদামে রক্ষিত মালামাল অনেক সময় ধরাও পড়ে। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে। যারা এ ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে দ্রুতই জনবান্ধবমূলক কর্মসূচি বা পদক্ষেপ নিতে হবে।

দেশের পুঁজিবাজার সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই কাজ করছে। আমি মনে করি, সাধারণ মানুষকে অর্থাৎ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজার সম্পর্কে সঠিকভাবে জেনেবুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। তাদের বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। তাদের ভালো কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করতে হবে। এখানেও যারা দুর্নীতি করবে অথবা আগে যারা দুর্নীতি করেছে তাদের জরিমানাসহ আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তরা সাবধানি না হয়ে নানা রকম অপপ্রচার করে সব সময়। বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে থাকে। সেগুলো বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সবচেয়ে বেশি কেলেঙ্কারি হয়েছে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা আর শেয়ারবাজার নিয়ে। আমাদের সেগুলো বন্ধ করতে হবে। নিয়মানুযায়ী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বুঝেশুনে বিনিয়োগ করা, বেশি মুনাফার আশায় ভুল শেয়ার না কেনা অর্থাৎ যেগুলোর মূলত কোনো অস্তিত্ব নেই, সে ধরনের শেয়ার কেনা কখনো উচিত নয়। সর্বোপরি শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়নের পুঁজিবাজারে কঠোরভাবে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। 

দেশের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার এবং শক্তি, তাতে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে অন্তত ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিনিয়োগ হতে হবে। এই বিনিয়োগ হতে হবে ব্যক্তি খাতে। আমার মতে, বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণে প্রত্যাশিত মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাচ্ছে না। বর্তমানে রপ্তানি খাতে সংকোচন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। পণ্য রপ্তানি খাত সংকুচিত হলে তা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর একরকম চাপ সৃষ্টি করে। রপ্তানি আয় কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার বা মান কমে যেতে পারে। স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে সেটা আবার মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে। কাজেই রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে রপ্তানি খাতকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও অধিকমাত্রায় গতিশীলতা বৃদ্ধি করা দরকার। 

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

বাংলা নববর্ষ ১৪৩২: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২০ পিএম
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
ড. মতিউর রহমান

বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতিসত্তার এক অসাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যার মূলমন্ত্র হলো নবজাগরণ, নবচেতনা এবং পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ করা। সময়ের ক্যালেন্ডার ঘুরে আবার এসেছে পয়লা বৈশাখ, বাংলা ১৪৩২। এই দিনটি বাঙালির হৃদয়ে জাগায় এক অভাবনীয় আবেগ, ঐতিহ্য আর মিলনের আহ্বান। এ যেন রবীন্দ্রনাথের গানের সেই চিরন্তন ডাক- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। বৈশাখের এই আগমনী বার্তা কেবল ঋতুর পালাবদলের নয়, এটি জীবনের রূপান্তরের প্রতীক।
পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন মানে কেবল নতুন বছরকে বরণ করা নয়, বরং এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, অতীত স্মৃতি, বর্তমান চেতনা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার সম্মিলন। সেই সঙ্গে এটি একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শুদ্ধিকরণও, যার মর্মবাণী আমরা পাই রবীন্দ্রনাথেরই অমর পঙ্ক্তিতে- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। 

বাংলা সনের সূচনা হয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকে। তার শাসনামলে ১৫৮৪ সালে চন্দ্র ও সৌর পঞ্জিকার সমন্বয়ে প্রবর্তন হয় ফসলি সন, যার গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের কাছ থেকে সময়মতো খাজনা আদায় এবং কৃষিজীবী সমাজের হিসাব সহজ করা। পরবর্তীতে এটি হয়ে ওঠে বাঙালির নিজস্ব বর্ষপঞ্জি- বাংলা সন। আর এই সনের প্রথম দিন, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে উৎসব ও মিলনের প্রতীক।

প্রথমদিকে এই দিনটি ছিল মূলত অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যবসায়িক বার্ষিক হিসাবের সূচনা দিন। হালখাতা, নতুন খাতা খোলা, পুরানো দেনা মুছে ফেলা- এসবই ছিল পয়লা বৈশাখের প্রধান অনুষঙ্গ। কৃষিপ্রধান বাংলায় এই দিনটি কৃষকদের জন্য ছিল নতুন আশার সূচনা, জমিদারদের জন্য ছিল প্রশাসনিক গুরুত্ব, এবং ব্যবসায়ীদের জন্য ছিল শুভ সূচনা।

কিন্তু সময়ের স্রোতে এই দিনটি শুধু লেনদেনের দিন থেকে পরিণত হয়েছে জাতিসত্তার চেতনার উৎসবে। বাংলার মানুষ নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পেয়েছে এই দিনটিতে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় নববর্ষকে আহ্বান করেছেন এক ধ্বংস ও সৃজনের অনুপম সংলগ্নতায়। তার গান ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ শুধু একটি গান নয়, এটি এক সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক। এই আহ্বানে আছে পুরানো গ্লানি, অচলায়তন ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভাষা। নববর্ষ আসে শুধু সময়ের পরিবর্তন নিয়ে নয়, এটি আসে মনের মধ্যে, সমাজের মধ্যে, জাতির মধ্যে এক শুদ্ধি আনতে।

এই শুদ্ধির বার্তা আসে আরও তীব্রভাবে রবীন্দ্রনাথের সেই পঙ্ক্তিতে- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। এ যেন এক প্রতীকী আগুনে অশুভকে দহন করে শুভকে আহ্বান করার আহ্বান। বৈশাখের খরতাপে শুধু প্রকৃতি নয়, আমাদের চেতনা, মনন ও সমাজ যেন শুদ্ধ হয়ে ওঠে। তাই নববর্ষ মানে কেবল উল্লাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধির এক সাংস্কৃতিক উদ্যাপন।
বাংলা ১৪৩২ এসেছে এমন এক সময়, যখন বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি প্রবল এক উত্তেজনা ও পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন, সামাজিক মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চর্চা- সব মিলিয়ে পয়লা বৈশাখ এখন আগের চেয়ে ভিন্ন এক বাস্তবতায় উদ্যাপিত হচ্ছে।

ঢাকায় ছায়ানটের রমনা বটমূলে বর্যবরণ অনুষ্ঠান, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, শহরজুড়ে বিভিন্ন বৈশাখী মেলা, রেস্তোরাঁয় বৈশাখী মেনু, গ্রামে-গঞ্জে পান্তা-ইলিশ খাওয়া- এসবকিছু এখন নববর্ষের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এর পাশাপাশি আছে নিরাপত্তার কড়াকড়ি, নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, করপোরেট বাণিজ্যের আধিক্য এবং প্রান্তিক জনগণের অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা।
তবু আশার কথা-নতুন প্রজন্ম এখনো পয়লা বৈশাখকে নিজেদের বলে মনে করে। তারা এদিনে বাংলায় কথা বলে, বাংলা পোশাক পরে, বাংলা গান গায়, বাংলা কবিতা পড়ে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে তারা নববর্ষকে পৌঁছে দিচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে।

গ্রামে এখনো নববর্ষ মানে হালখাতা, মেলা, গান, নাটক, পুতুলনাচ, লাঠিখেলা। গ্রামের মাঠে-মাঠে হয় বৈশাখী গান, স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় উঠে আসে মাটির কথা, মানুষের কথা, প্রকৃতির কথা। যদিও প্রযুক্তির আধিপত্যে ও আর্থিকসংকটে অনেক জায়গায় ঐতিহ্যবাহী মেলা হারিয়ে যাচ্ছে, তবু কিছু কিছু অঞ্চলে একঝাঁক সৃষ্টিশীল মানুষ এখনো ধরে রেখেছে শতবর্ষের সংস্কৃতি।

প্রবাসে বসবাসরত বাঙালিদের জন্য পয়লা বৈশাখ এক ভিন্ন আবেগের দিন। দেশছাড়া বাঙালিরা এই দিনটিতে যেন ফিরে যেতে চান শেকড়ে। নিউইয়র্ক, টরন্টো, লন্ডন, সিডনি, কুয়ালালামপুর, রোম কিংবা মেলবোর্ন- যেখানেই বাঙালিরা আছেন, সেখানেই বসে বৈশাখী মেলা, কবিতা পাঠ, নাটক, সংগীতানুষ্ঠান, নৃত্য এবং প্রাচ্যধর্মী খাদ্য উৎসব। এটি তাদের সংস্কৃতির পুনঃসংযোগ এবং পরিচয়ের পুনর্নির্মাণ।

বাংলা নববর্ষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বর্তমান প্রজন্মের চর্চা ও সমাজের মূল্যবোধের ওপর। যদি আমরা নববর্ষকে কেবল বিনোদনের মাধ্যমে, করপোরেট বাণিজ্যে কিংবা ফ্যাশন শোতে সীমাবদ্ধ রাখি, তবে এর অন্তর্নিহিত চেতনা হারিয়ে যাবে। তাই আমাদের প্রয়োজন নববর্ষের চেতনার মূল- বাঙালিত্ব, শেকড়, ঐতিহ্য এবং শুদ্ধির বার্তাকে ধরে রাখা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নববর্ষ ঘিরে সাংস্কৃতিক চর্চার প্রসার, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা, বাংলা পঞ্জিকার আধুনিকায়ন এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা বাংলা নববর্ষকে করে তুলতে পারি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সৃজনশীল।

পরিবেশগত দিক থেকেও আমাদের সচেতন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যদি বৈশাখী পরিবেশ বিপন্ন হয়, তবে তার প্রভাব পড়বে আমাদের সংস্কৃতিতেও। তাই নববর্ষ উদ্যাপনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের বার্তাও যেন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ কেবল একটি নতুন ক্যালেন্ডার বছরের সূচনা নয়, এটি একটি চেতনার নবজাগরণ। রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের নতুন আলোয়, নতুন প্রাণে আহ্বান জানায়- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’, আর আমাদের মনে জাগায় সেই মহৎ আকাঙ্ক্ষা- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’।

এই নববর্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাঙালি জাতি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানবিক চেতনাকে ধারণ করেই এগিয়ে যাবে ভবিষ্যতের পথে। সময়ের ঝড়, রাজনীতির ধোঁয়াশা, বৈশ্বিক আগ্রাসন- সবকিছু উপেক্ষা করেই বাংলা নববর্ষ থাকবে আমাদের হৃদয়ের গভীরে। অতীতের গৌরব, বর্তমানের সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় বাংলা ১৪৩২ হোক শুদ্ধির, সংহতির এবং স্বপ্নের বার্তাবাহী এক নবদিগন্ত।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

উৎসব হোক যুগে যুগে

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৭ পিএম
উৎসব হোক যুগে যুগে
আবুল কাসেম ফজলুল হক

লোক-ঐতিহ্যর ভেতর থেকেই আমরা পয়লা বৈশাখ পেয়েছি। লোক বলতে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দিক্ষা অর্জন করেননি। এদের মধ্যেও অনেক বুদ্ধিমান লোক আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করলেই মানুষ শিক্ষিত হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও দেশে অনেক লোক আছেন যারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝেন। তাদের মধ্য থেকেও আমরা পয়লা বৈশাখের ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই। একটা সময় যারা গ্রাম থেকে শহরে আসত, তারা পয়লা বৈশাখকে গ্রাম্যতা বলত। গ্রাম্যতা ছেড়ে শহুরে হওয়ার প্রবণতা পঞ্চাশের দশকেও ছিল। সেসব বিবেচনা করে জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং অতীতের ভালো দৃষ্টান্তগুলো আলোচনা করে আমরা উন্নত ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে আমাদের ঐতিহ্য তুলে ধরতে চাই।...


পয়লা বৈশাখ জাতীয় চেতনার উৎসব। তার পরও পয়লা বৈশাখ নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। কিছু রাজনৈতিক সংগঠন আছে যারা পয়লা বৈশাখ উদযাপনকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা স্বীকার করতে চায় না। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর থেকে পয়লা বৈশাখ উদযাপনকে বাতিল করার জন্য অনেক বুদ্ধিজীবী চেষ্টা করেছেন। সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের অনেক বুদ্ধিজীবী মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানা কিছু সামনে এনেছেন, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারত না। পয়লা বৈশাখ নিয়ে আওয়ামী লীগের চিন্তাভাবনা ছিল অন্যরকম। তাই পয়লা বৈশাখ উদযাপনের জন্য ভাতা দিয়েছেন। পয়লা বৈশাখ নিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এত খারাপ কাজ করেছে, যার ভেতর থেকে আমরা বের হতে পারিনি। যারা বিতর্ক সৃষ্টি করছে তাদের জিজ্ঞেস করা দরকার, তারা কী করছে। এসব লোকের আত্মশুদ্ধি দরকার। বৈশাখ নিয়ে মারদাঙ্গা বক্তব্য দেওয়া চরম অন্যায়। 

বাংলাদেশ জন্মের ৫৪ বছর পার হতে 
চলেছে। এই সময়ের মধ্যেও পয়লা বৈশাখকে আমরা বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে পারিনি। পয়লা বৈশাখ আনন্দের সঙ্গে উদযাপিত হোক, এটাই আমরা চাই। বাংলাদেশের মানুষ একই সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করুক এটাই চাই। 

বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার আগে পয়লা বৈশাখ ছিল একটা আন্দোলন। পাকিস্তান ছিল খুব অস্বাভাবিক রাষ্ট্র। ব্রিটিশরা যখন দেশ শাসন করেছে তখন তারা হিন্দু ও মুসলমানদের ভেতরে সবসময় বিভেদ লাগিয়ে রাখত। শেরেবাংলা ফজলুল হকের বক্তব্যে শুনেছি যে, হিন্দু-মুসলমানদের বিরোধে গত ২৫ বছরে ভারতবর্ষে প্রায় ১ কোটি লোক নিহত হয়েছে। ভালো কথাগুলো আমরা কখনো মনে রাখি না। অনেক কর্তৃত্ব দেখানোর জন্য যারা কাজ করে তারা অনেক সময় জাতিকে দুর্বল অবস্থায় রাখে। একদলীয় জাতীয় ঐক্য থাকা দরকার। যত দল তত মত, তত ধর্ম। সবার জন্য কাজ করতে জাতীয় ঐক্য থাকা দরকার। পয়লা বৈশাখের ব্যাপারেও এমন হওয়া উচিত। গোটা পৃথিবীর সব কাজকর্মই খ্রিষ্টানদের দিয়ে চলে। তবে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হবে। 

পয়লা বৈশাখ নিয়ে আমাদের একটা সন ও তারিখ ছিল যেটা আমাদের অনেক গর্বের বিষয়। আগামী বছরগুলো কীভাবে কাটাব তা নিয়ে সুদূরপ্রসারীভাবে ভাবতে হবে। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

পয়লা বৈশাখ নিয়ে অনেক সময় সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক বিষয়গুলও সামনে উঠে আসে। এসব শব্দ ব্যবহারে আমি মোটেই আগ্রহী নই। ইংরেজরা এই ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার করে অনেক দেশ ভাগ করে গেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখায় সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি নেই। কাজী নজরুলের লেখায় হিন্দু-মুসলিম বিরোধ এই কথাটি তেমন নেই। ভারতবর্ষে তেমনভাবে  সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি ছিল না। ইংরেজরা কমিউনালিজমের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি নিয়ে আসে। কবি জসিম উদ্দিন, আবুল ফজল, কাজী নজরুল এবং কাজী মোতাহার হোসেন চোধুরীর মতো জ্ঞানী মানুষের কথা শোনা উচিত। ইংরেজরা একসময় শক্তিশালী ছিল, কিন্তু এখন দুর্বল হয়ে গেছে। ইংরেজরা নানা কায়দায় আমাদের দখল করেছিল। সেই ইংরেজদের কথা আমাদের সাদরে গ্রহণ করা ঠিক না। বাংলাদেশে যে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ ও মন্দির ভাঙা  হচ্ছে তা কি বিরোধের কারণে হচ্ছে? আমাদের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করার জন্যই এমনটা করা হচ্ছে। 

পয়লা বৈশাখ উদযাপনের ধারণা তো অনেকটা বদলে যাচ্ছে। তবে এটা খারাপ না। পশ্চাৎপদ ধারণা থেকে যদি আমরা অগ্রসর হতে পারি তাহলে খারাপ না। অনেক কিছু বদলে যেতে পারে। যারা দেশে মন্দির ভাঙা ও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করেছে তারা অবশ্যই ক্রিমিনাল। সেই মুজিব সরকার থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনাকে ক্রিমিনাল কেস হিসেবে  নিতে হবে। এসব কাজ যারা করছে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাঙালি আদি সময় থেকে সেন আমল, মুঘল, পাঠান ও মুসলিম শাসন এবং ইংরেজ আমলে বাঙালির যে ঐতিহ্য তা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আগামী বছর এবং ভবিষ্যতে কী করব তার একটা দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে। এমন কোনো কিছু করা যাবে না যাতে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়। এমন কাজ করা যাবে না, যারা এই কাজ করে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং যারা করে না তাদেরও ক্ষতিসাধন হয়। এদের থেকে জাতীয় স্বার্থেই সাবধান থাকতে হবে। 

লোক-ঐতিহ্যর ভেতর থেকেই আমরা পয়লা বৈশাখ পেয়েছি। লোক বলতে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দিক্ষা অর্জন করেননি। এদের মধ্যেও অনেক বুদ্ধিমান লোক আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করলেই মানুষ শিক্ষিত হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও দেশে অনেক লোক আছেন যারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝেন। তাদের মধ্য থেকেও আমরা পয়লা বৈশাখের ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই। একটা সময় যারা গ্রাম থেকে শহরে আসত, তারা পয়লা বৈশাখকে গ্রাম্যতা বলত। গ্রাম্যতা ছেড়ে শহুরে হওয়ার প্রবণতা পঞ্চাশের দশকেও ছিল। সেসব বিবেচনা করে জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং অতীতের ভালো দৃষ্টান্তগুলো আলোচনা করে আমরা উন্নত ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে আমাদের ঐতিহ্য তুলে ধরতে চাই। 

মানুষের জীবন এখন শুধু আনন্দ চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আনন্দ অবশ্য আছে, সেই সঙ্গে অনেক দুঃখ-কষ্টও রয়েছে। ফসলের উৎপাদন ও কারখানার উৎপাদন বাড়াতে হবে। শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের মতো সৃষ্টিশীলতা বাড়াতে হবে। 

এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার নামেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। সবকিছুতেই জাতীয় চিন্তাচেতনা, বিচার-বিবেচনা করতে হবে। তবে পয়লা বৈশাখের মতো জাতীয় উৎসব শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের হাতে দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হয়নি। বেগম সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে অনেক বুদ্ধিজীবী পয়লা বৈশাখের সঙ্গে জড়িত। আগের দিনের পত্রিকা দেখলেও বোঝা যাবে যে, কারা পয়লা বৈশাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সাধারণ মানুষ যারা কম শিক্ষিত ও দরিদ্র তারা পয়লা বৈশাখের বর্তমান বিষয়গুলো মেনে নিতে পারেননি। চারুকলা ইনস্টিটিউট পয়লা বৈশাখের ব্যাপারটা জনগণকে বুঝিয়ে বলতে পারেনি। চারুকলা ইনস্টিটিউটের ডিনসহ শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাবোধ আছে। কিন্তু পয়লা বৈশাখের ব্যাপারটি নিয়ে তারা যেভাবে অগ্রসর হয়েছে সেটা ততটা শোভন ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য দেশবাসীকে বোঝাতে পারেনি। ভুল তো মানুষেরই হয়। অনেক সময় একটা জাতিরও  অনেক ভুল হয়। পয়লা বৈশাখের ব্যাপারটায় শুধু চারুকলা নয়, সরকারেরও ভূমিকা থাকা দরকার। সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে।

পয়লা বৈশাখ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তা হয়ে ওঠেনি। যখন পাকিস্তান ছিল তখন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বাঙালি সংস্কৃতি চেয়েছি। পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদ চেয়েছি। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে পয়লা বৈশাখ পালন একটা বড় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। তখন পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। তখন পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ছায়ানট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আগের দিনে গ্রামে পয়লা বৈশাখ পালিত হতো। তার পর শহরেও বৈশাখ পালিত হতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় পয়লা বৈশাখ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৭২ সাল থেকেই উচ্চশ্রেণির লোকেরা পয়লা বৈশাখ তাদের করে নেওয়ার চেষ্টা করে। পান্তাভাত খাওয়া কি পয়লা বৈশাখের ঐতিহ্য? পান্তাভাত গরিব মানুষ অভাবের জন্য খেত। অতীতে এগুলো খেলেও আজকের দিনে তা খাওয়া উচিত না। আজকের দিনে আমরা কেমন আছি এবং ভবিষ্যতে কেমন হতে চাই তা ভাবতে হবে। আমাদের অতীতে ভালোমন্দ কী ছিল তা জানতে। অতীত বর্তমানকে শিখিয়ে দেবে কী করতে হবে। মানুষের মন পরিবর্তন করার জন্য সবাইকে সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করতে হবে।    

লেখক: বাংলা একাডেমির সভাপতি ও রাষ্ট্রচিন্তক  

বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির প্রেরণার উৎস

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১১:৪৩ এএম
বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির প্রেরণার উৎস
নেছার আহমদ

যে জাতি তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, কায়দাকানুন ও চালচলন প্রভৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে দেয়, সে জাতি তার অস্তিত্ব নিয়ে কোনো দিনই ঠিকে থাকতে পারে না। সব ধরনের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মানুষের ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য কামনা করে নতুন বাংলা বর্ষকে 
স্বাগতম জানাই।...

আবহমান বাংলার হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাংলার সাংস্কৃতিক সভ্যতার ধারাবাহিকতা। এ ধারাবাহিকতায় তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সর্বদা তারা ছিল অগ্রগণ্য, মহান সংগ্রামী তিতুমীর, সুবেদার রজব আলী, মাস্টারদা সূর্য্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ক্ষুদিরাম থেকে শুরু করে সবাই ছিলেন বাঙালির গর্বে গৌরবান্বিত মহান সৈনিক। মীর মদন, মোহন লালের আদর্শেই উজ্জীবিত বাঙালিরা তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাঙালিত্ব ও বাঙালি সংস্কৃতিকে রক্ষা করে এসেছেন। একপর্যায়ে ১৯৪৭ সালে ধূর্ত ব্রিটিশ রাজত্বের কপাট ভেঙে বাঙালিরা স্বাধীনতা পেয়েছিল, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে হাজার বছরের ঘুম ভেঙে বাঙালি জেগে উঠেছিল হিন্দু কিংবা মুসলমান পরিচয়ে নয়, বাঙালি জাতি হিসেবে। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬২, ১৯৬৯, পরিশেষে ১৯৭০-এর নির্বাচনে বাঙালিত্বের জয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা সেটিও হতে দিল না। ফলে ১৯৭১-এ জেগে ওঠা বাঙালি জাতি ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করে বিশ্বের কাছে চমক দেখিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে।

বর্ষ বা সন গণনার ইতিহাস: সন, তারিখ দুটি আরবি শব্দ, সন অর্থ বর্ষ, ফার্সিতে সাল আর তারিখ অর্থ ইতিহাস, আমরা বাংলায় বলি দিন। দিনের সমষ্টির নাম কাল, সপ্তাহ, মাস বা বর্ষ। তেমনি কোনো একটি বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয় এক-একটি অব্দ। সর্বপ্রথম কখন এই অব্দের সূত্রপাত হয়েছিল তা সঠিকভাবে কোনো গবেষক নির্ধারণ করতে পারেনি। এনিয়ে নানা মুনির নানা মত প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, মিসরীয়রা তারকার সাহায্যে বর্ষ গণনা শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে কৃষিকাজের সুবিধার্থে বর্ষপঞ্জিকার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। দীর্ঘদিনের গবেষণায় তারা দেখতে পেয়েছিলেন ৩৬৫ দিন পর পর লুব্ধক নামক নক্ষত্রটি সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বক্ষণে আকাশে দৃশ্যমান থাকে। এটি একমাত্র তারকা যা দৃষ্টিগোচর হয়। এ লুব্ধককে কেন্দ্র করেই মিসরে শুরু হয় বর্ষ গণনা। খ্রিষ্টপূর্ব ২৩০ অব্দে মিসরে নববর্ষের প্রচলন হয় শরৎ ঋতুতে। এ ধরনের আরও অনেক বর্ষ ও সনের উল্লেখ ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায়। 
বাংলা সনের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ: ৫০০ বছর আগে আমাদের এই বাংলা সনের জন্ম। জন্মস্থান বর্তমান ভারতের দিল্লি নগরীতে। এ সনের জন্মদাতা ছিলেন একজন অবাঙালি গবেষক। জন্মলগ্ন  থেকে এ সনের পরিচিতি ছিল ফসলি সন হিসেবে। মোগলদের রাজকার্যে সুবিধা অনুযায়ী ৪৪৬ হিজরি কমরি বা চান্দ্র বছরের হিসাব অনুযায়ী পরিচালিত হতো। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের দিনক্ষণ পূর্ব থেকেই সঠিকভাবে চান্দ্র মাসের হিসাবে নির্ধারণ করা সম্ভবপর ছিল না।

 এই অসংগতি ও অসুবিধা দূর করার মানসে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে পণ্ডিত ফতেউল্লাহ সিরাজির দীর্ঘ গবেষণার ফসল এই বাংলা বর্ষ। প্রথমে সম্রাট আকবরের ইচ্ছে ছিল তার সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম ‘দীন-ই-ইলাহি’ ধর্মের স্মরণে ইলাহি সন চালু করবে। কিন্তু তা সর্বসাধারণের কাছে সমাদরে গৃহীত না হওয়ার কারণে নতুন সৌর ফসলি সনই সবার কাছে গৃহীত হয়েছিল। পণ্ডিত ফতেউল্লাহ সিরাজি দীর্ঘ গবেষণা করে ১১ এপ্রিল ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ২৭ বা ২৮ রবিউসসানি ৯৬৩ হিজরি কমরি সন থেকে নতুন এ সৌর ফসলি সনের প্রচলন করেন। ১ মহরম ছিল ১৬ জুলাই, তাই হিজরি সন গণনা শুরু হলো এই ১৬ জুলাই  থেকে। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) হিজরি কমরি সনের ব্যবহার শুরু করেছিলেন। ৯৬৩ হিজরি কমরি সনের রবিউসসানি পর্যন্ত যে চান্দ্র হিসাবটি চালু ছিল তাতে সৌর হিসাব যুক্ত হয়ে ফসলি সনের যাত্রা শুরু হয়। এই ফসলি সন হিজরি সনেরই চান্দ্র ও সৌর হিসেবের মিলিত রূপ।
 ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পরবর্তীকালে এই সনটি উপেক্ষিত হওয়ায় শুধু বাংলার মাটিতে এটি গৃহীত হয়েছে বলে আজ এর নাম বাংলা সন। ভারত সরকার ১৩৬৪ সালে অর্থাৎ ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মার্চ বাংলা সন পরিত্যাগ করে কনিষ্ক প্রবর্তিত শকাব্দ সনের প্রবর্তন করেন। ওই সময় ছিল ১৮৮০ শকাব্দ। ভারত সরকার ১৩৬৩ সালের ৮ চৈত্র তারিখে ১৮৭৯ শকাব্দের ১ চৈত্রকে নববর্ষের প্রথমদিন ধার্য করে। যখন থেকে এ ফসলি সন বা বাংলা সন বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবহার হতে থাকে তখন  থেকে এর বিভিন্ন সমস্যা পরিলক্ষিত হয় এবং এ বাংলা সনে মাসের ও দিনের সংখ্যা নির্দিষ্ট থাকে না বলে পরবর্তীতে সবাইকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। যার কারণে এ বিষয়টিকে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার জন্য তৎকালীন সরকার বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করে।

 এ কমিটি ১৯৬৬ সালে একটি সুপারিশ প্রণয়ন করে। সে সুপারিশ মোতাবেক একাডেমি ১৩৭৩ সালে অর্থাৎ ১৯৬৮ ইংরেজি সন  থেকে একটি সংশোধিত দিনপঞ্জি চালু করে। এতে বছরের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ  থেকে ভাদ্র) ৩১ দিনে আর বাকি সাত মাস ৩০ দিনে গণনার হিসাব ধরা হয়েছিল। ৪ দ্বারা যে বছর বিভাজ্য হবে তাকে অতিবর্ষ গণ্য করে ইংরেজি সনের অনুরূপ চৈত্র মাসকে ৩১ দিন ধরে গণনা করার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু ড. শহীদুল্লাহর সুপারিশ অনুযায়ী আজও আমাদের দেশে কোনো সন চালু হয়েছে কি না আমার জানা নেই।

 বর্তমানে পুরানো দিনের হিসাব অনুযায়ী হিন্দু সম্প্রদায়ের চুলচেরা দিন মাস তিথি নির্ধারণের প্রয়োজনেই পূর্ববর্তী হিসাবে আজও পঞ্জিকাসমূহে প্রচলিত হয়ে আসছে। এ বাংলা সনের ১২ মাসের নামসমূহের একটি ইতিবৃত্ত রয়েছে। জ্যোতিষশাস্ত্র বিশারদরা নক্ষত্রের হিসাব অনুযায়ী ৩৬০ দিন বছর গণনা করে থাকেন। ২৭টি তারকার অবস্থানকে কেন্দ্র করে নক্ষত্র বছর আবর্তিত হয়। এ ২৭টি তারকা ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র মতে অশ্বিনী, ভরণী, কৃত্তিকা, রোহিনী, মৃগশ্চিরা, আদ্রা, পুনর্বসু, পূজা, অন্বেষা, মঘা, পূর্বাফাণ্ডুনী, উত্তর ফাণ্ডুনী, হস্তা, চিত্রা, স্বাতী, বিশাখা, অনুরাধা, জ্যৈষ্ঠা, মুনা, পূর্বষাঢ়া, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভীষা, পূর্বাভাদ্রপদ, উত্তর ভাদ্রপদ এবং রেবতী। উপর্যুক্ত তারকাগুলোর সোয়া দুই পাদ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক একটি মাস। যেমন: অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা  থেকে কার্তিক, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফাণ্ডুনী থেকে ফাগুন, চৈতা থেকে চৈত্র, বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাড়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র মাসের নামকরণ করা হয়েছে। অনুরূপ মৃগশ্চিরা থেকে হয়েছে মার্গশীর্ষ মাস, পরবর্তীকালে এ মাসের নাম রাখা হয় অগ্রহায়ণ মাস।

যে জাতি তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, কায়দাকানুন ও চালচলন প্রভৃতিকে বিজাতীয় সংস্কৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে দেয়, সে জাতি তার অস্তিত্ব নিয়ে কোনো দিনই ঠিকে থাকতে পারে না। সব ধরনের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার মানুষের ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য কামনা করে নতুন বাংলা বর্ষকে স্বাগতম জানাই।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
[email protected]

বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ চিরায়ত উৎসবের সূতিকাগার

প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:০১ এএম
পয়লা বৈশাখ চিরায়ত উৎসবের সূতিকাগার
বদিউর রহমান

পয়লা বৈশাখ বাঙালির চিরন্তন ও সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান; কোনো সন্দেহ নাই। পয়লা বৈশাখ আমাদের চিরায়ত উৎসবের সূতিকাগার; যেখানে সব ধর্মের মানুষ অংশ নেন। 

এ দেশের সংস্কৃতিকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা হয়েছে। সংস্কৃতিকে ধর্মের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন অনেকে। কিন্তু একটি দেশে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা বসবাস করেন। তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো সংস্কৃতির অঙ্গ। সংস্কৃতি নয়, ধর্মই সংস্কৃতির অঙ্গ। সংস্কৃতি হলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহ।

যাই হোক, পয়লা বৈশাখকে কে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চেয়েছেন তা নিয়ে আমাদের ভাবনা নেই। উদীচী পয়লা বৈশাখের সর্বজনীনতাকে ধারণ করে। আমরা মনে করি বর্তমান পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধভাবে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করা উচিত। আমরা সবাই ভোরবেলা ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজনে যাব, উৎসবে শামিল হব। 

পয়লা বৈশাখ উদযাপনে অনেকে অন্য একটি দেশের রাজনীতি খোঁজেন। কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখের বিস্তর তফাত রয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলা একাডেমিতে বর্ষপঞ্জি সংশোধন করা হয়। এরপর আমাদের পয়লা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল, পশ্চিমবঙ্গে ১৫ এপ্রিল। আর পয়লা বৈশাখে এই যে সরকারি ছুটি কিংবা উৎসব ভাতা দেওয়া হয়, তাতেই তো আমাদের সংস্কৃতির স্বীকৃতি মেলে। বৈশাখী মেলার আয়োজন করা, হালখাতা করা- সবেতে তো আমাদের নিজস্ব বাঙালি অর্থনীতিই সম্পৃক্ত। এ বৈশাখের সঙ্গে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। 

আমরা বাঙালিরা যে সংস্কৃতি ধারণ করি তা অসাম্প্রদায়িক। আমরা পয়লা বৈশাখে সুখী-সুন্দর সমাজব্যবস্থার প্রত্যাশা করি। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই পয়লা বৈশাখ হয়ে উঠুক সবার অনুষ্ঠান। সবাই মিলে সমস্বরে গাইব দেশের গান। এ উদযাপনে কোনো রাজনীতি আর বাইরের কোনো দেশের প্রভাব খোঁজার প্রচেষ্টা বৃথা। 

অধ্যাপক বদিউর রহমান, সভাপতি বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী