
ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাওয়ার মতো ইউরোপের যথেষ্ট আর্থিক ও সামরিক সম্পদ রয়েছে, এমনকি মার্কিন সমর্থন ছাড়াই। তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী বিমান বাহিনী এবং ইউক্রেনের যুদ্ধ-পরীক্ষিত সামরিক বাহিনী প্রশংসাযোগ্য। ইইউ, যুক্তরাজ্য এবং নরওয়ে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ শক্তিশালী।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মধ্যে বিভাজনটা হলো সবচেয়ে বড়। ন্যাটো আর রাশিয়ার পুনর্গঠনবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষা নষ্ট করতে প্রতিশ্রুতিশীল ঐক্যবদ্ধ ব্লক গঠন করে না।
অন্যদিকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন পুতিনের দৃষ্টিভঙ্গির মতো হয়ে গেছে। তারা মনে করে পরাশক্তিদের প্রভাবের ক্ষেত্রগুলোর ওপর কর্তৃত্ব দাবি করার স্বাভাবিক অধিকার তাদের রয়েছে। ছোট ও দুর্বল দেশগুলো তাদের শক্তিশালী প্রতিবেশীদের বশ্যতা স্বীকার করে। এখন ইউরোপে গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব এবং আইনের শাসনের পক্ষে দাঁড়ানো ইউরোপের ওপর নির্ভর করে এবং ইউক্রেনকে রক্ষা করাও তাদের দায়িত্ব।
ইউরোপীয় নেতারা সামনের চ্যালেঞ্জগুলো বুঝতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে। লন্ডনের এক সমাবেশে তারা ইউক্রেনকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং সেখানে যুদ্ধ বন্ধের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। যদি ইউরোপীয় শান্তি পরিকল্পনার সুযোগ তৈরি করতে হয়, তাহলে পুতিনকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে ইউক্রেনের ওপর অব্যাহত আক্রমণের মূল্য রাশিয়ার পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠবে।
সামগ্রিকভাবে, ২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সহায়তা বছরে প্রায় ৮০-৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যার অর্ধেকেরও বেশি ইউরোপ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্য) থেকে আসছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত এক তথ্যে জানা যায়, ২০২২ সাল থেকে প্রায় ৬৭ বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা প্রদানের তালিকা রয়েছে যা প্রতি বছর ২৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই পরিমাণ অর্থ প্রতিস্থাপন করতে ইউরোপের খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয় যা ইউরোপের জিডিপির ০.২% এরও কম।
এই তহবিল নিয়মিত ইইউ বাজেট থেকে আসা সম্ভব না, কারণ এটি খুবই কম (জিডিপির মাত্র ১%) এবং বেশির ভাগ রাজস্ব এক বছর আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। কিন্তু ‘নেক্সট জেনারেশন ইইউ’ মহামারি-পুনরুদ্ধার তহবিলে যথেষ্ট অব্যয়িত অর্থ রয়েছে যা ইউক্রেনের দিকে পুনর্নির্দেশিত হতে পারে।
আরেকটি বিকল্প হতে পারে ইউরোপীয় দেশগুলোর একটি গ্রুপ, যেমন- বৃহৎ ইইউ সদস্য রাষ্ট্র, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্য- একটি নতুন অর্থায়ন বলয় তৈরি করা যা ইউক্রেনের সাহায্যের জন্য ঋণ প্রদান করবে। এই পদ্ধতির একটি স্বতন্ত্র সুবিধা রয়েছে: এর জন্য ইইউ সদস্যদের মধ্যে ঐকমত্যের প্রয়োজন হবে না। তাই ট্রাম্পের মিত্র হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের মতো বা আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ ইইউ সদস্য যেমন অস্ট্রিয়া এবং আয়ারল্যান্ডের মতো দেশের বিরোধিতার মাধ্যমে এর কোনো বাধাগ্রস্ত হবে না।
নিশ্চিতভাবেই কেবল ‘স্থগিত’ মার্কিন সাহায্য প্রতিস্থাপন করা যথেষ্ট হবে না। সর্বোপরি, ইউক্রেন এতদিন পর্যন্ত যে সমর্থন পেয়েছে তা কেবলমাত্র রাশিয়ার অগ্রগতিকে ধীর করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের জোয়ার ঘুরিয়ে দিতে পারেনি। তার পরও, ইউরোপ প্রয়োজনীয় তহবিল নিয়ে আসতে পারে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অর্থায়নের বাইরেও ইউক্রেনের প্রয়োজনীয় বেশির ভাগ সামরিক সরবরাহ যেমন ট্যাংক, বন্দুক এবং গোলাবারুদ সরবরাহ করার জন্য ইউরোপ প্রস্তুত। বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শূন্যস্থান পূরণ করতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে। কারণ ইউক্রেন বর্তমানে মার্কিন-নির্মিত প্যাট্রিয়ট সিস্টেমের ওপর নির্ভর করছে। তার পরও ইউরোপীয় বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন- ফ্রাঙ্কো-ইতালীয় SAMP/T (Sol-Air Moyenne Portée/Terrestre), সেই সঙ্গে নরওয়ের স্বল্প-পাল্লার NASAMS (ন্যাশনাল অ্যাডভান্সড সারফেস-টু-এয়ার মিসাইল সিস্টেম) এবং জার্মানির IRIS-T (ইনফ্রারেড ইমেজিং সিস্টেম টেল/থ্রাস্ট ভেক্টর-নিয়ন্ত্রিত)। এই সিস্টেমগুলো এখন যুদ্ধ-পরীক্ষিত হয়েছে এবং প্যাট্রিয়টের তুলনায় কিছুটা কম ব্যয়বহুল বলে মনে হচ্ছে।
ইউরোপ যে ক্ষেত্রগুলোতে সহজেই আমেরিকার স্থান নিতে পারবে না তা হলো স্যাটেলাইট এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা। এই কারণেই ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগিতে ট্রাম্পের স্থগিতাদেশ দেশটির সেনাবাহিনীকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। কারণ এরা রাশিয়ান সম্পদ লক্ষ্যবস্তু করার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আশা করা যায় যে, ট্রাম্প প্রশাসন শিগগিরই এই ধরনের বিনিময় পুনরায় শুরু করবে- যার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তেমন কোনো মূল্য দিতে হবে না- যেমনটি তারা পরামর্শ দিয়েছে।
সরাসরি সামরিক সাহায্যের বাইরে গিয়েও ইউরোপের উচিত ইউক্রেনীয় ড্রোন উন্নয়ন ও উৎপাদনের জন্য সহায়তা বৃদ্ধি করা। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনের দক্ষতা- ড্রোন ডেভেলপারদের ছোট দলগুলো স্থলভাগে যোদ্ধাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে উদ্ভাবনী, প্রায়শই কম খরচে সমাধান তৈরি করে যুদ্ধক্ষেত্রে এটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
সম্ভবত সবচেয়ে কণ্টকাকীর্ণ প্রশ্ন হলো পুতিন যদি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন, তবে ইউরোপ কি ইউক্রেনকে বিশ্বাসযোগ্য নিরাপত্তা গ্যারান্টি দিতে পারবে? মার্কিন সমর্থন ছাড়া কেবল ইউক্রেন নয়, সমগ্র ন্যাটো ভূখণ্ড রক্ষার জন্য ইউরোপকে লাখ লাখ সৈন্য মোতায়েনের প্রয়োজন হবে।
এই বিষয়টি মাথায় রেখে ইইউ নেতারা সম্প্রতি তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধি করতে সম্মত হয়েছেন। ইইউ মন্ত্রীরা এখন ইউরোপীয় কমিশনের প্রস্তাব বিবেচনা করছেন, যাতে দেশগুলোকে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের জন্য আরও আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায়। প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ইউরো (১৬০ বিলিয়ন ডলার) পর্যন্ত যৌথ ঋণ গ্রহণের অনুমতি দেওয়া যায় যা ইইউ সরকারগুলোকে তাদের সামরিক সক্ষমতা জোরদার করার জন্য ধার দেওয়া হবে।
অনুমান করা যায়, এটিও যথেষ্ট হবে না। সাম্প্রতিক এক অনুমান মতে, ইউরোপীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বার্ষিক ব্যয় কমপক্ষে ২৫০ বিলিয়ন ইউরো বৃদ্ধি করতে হবে- যা জিডিপির প্রায় ১.৫ শতাংশ। তাছাড়া প্রয়োজনীয় কাঠামো এবং যুদ্ধ ইউনিট তৈরি করতে বছরের পর বছর লেগে যাবে।
কিন্তু এই মাত্রায় পুনঃসজ্জিতকরণ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে প্রধান শক্তিতে রূপান্তরিত করবে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর অসাধারণ শক্তি রয়েছে তাদের জন্য এটা পর্যাপ্ত নয়। দেশের নিজস্ব নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ইউক্রেনের অভিজ্ঞ সামরিক বাহিনীর একটি বড় অংশকে একত্রিত রাখার খরচ এমন শক্তিশালী ইউরোপীয় বাহিনী তৈরির তুলনায় অনেক কম হবে। এদিকে, রাশিয়ার হাত থেকে আকাশপথ রক্ষা করার জন্য ইউরোপ সুসজ্জিত। ইউক্রেন মাত্র কয়েক ডজন পুরানো পশ্চিমা যুদ্ধ বিমান দিয়ে রাশিয়ার আকাশপথের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রায় ব্যর্থ করে দিয়েছে। ইউরোপীয় বিমান বাহিনী তাদের শত শত উন্নত যুদ্ধবিমান নিয়ে গর্ব করে।
এই পরিস্থিতিতে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ইউরোপকে যা করতে হবে তা হলো পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। ইউক্রেন যাতে স্থায়ী শক্তিশালী সেনাবাহিনী বজায় রাখতে পারে। স্পষ্ট করে বলা যায় যে, যেকোনো রাশিয়ান আক্রমণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইউক্রেনের ওপর নো-ফ্লাই জোন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে। লাখ লাখ সৈন্য নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় যুদ্ধ বাহিনী তৈরির চেয়ে এটা অনেক দ্রুত করা সম্ভব এবং খরচও কম হবে।
আজ রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে ধরে রাখার এবং ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইউরোপের কাছে যথেষ্ঠ সম্পদ আছে। তাদের অবশ্যই সেগুলো ব্যবহার করতে হবে।
লেখক: জার্মান অর্থনীতিবিদ এবং বোকোনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ইউরোপীয় পলিসি মেকিং (IEP)-এর পরিচালক
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত
অনুবাদ: িসানজিদ সকাল