
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনায় সবাই হকচকিত। স্কুলগামী শিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। মানসিকভাবে বিকৃত, রুচিহীন, কুপ্রবৃত্তি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরা ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে এক ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে। ঘর থেকে নারীরা বের হয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবে কি না, সে ব্যাপারে আতঙ্কের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে প্রায় সবাই। মাগুরার আছিয়ার ঘটনায় পুরো দেশ ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যাপারে রাস্তায় নেমে এসেছে জনগণ। ধর্ষণের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ প্রত্যেককে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন। এদের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১টি এবং দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫৭টি, এর মধ্যে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণের পর হত্যার দুটি ঘটনা ঘটেছে। এদের মধ্যে পাঁচজন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারীও রয়েছেন। ফেব্রুয়ারিতে ধর্ষণের শিকার ৫৭ জনের মধ্যে ১৬ জন শিশু, ১৭ জন কিশোরী। অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে তিনজন কিশোরী ও ১৪ জন নারী, ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন দুজন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা ১৯টি, যৌন হয়রানি ২৬টি, শারীরিক নির্যাতনের ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে এই মাসে।
এ ধরনের পরিসংখ্যান অত্যন্ত উদ্বেগের, ভয়াবহ ও সবার জন্য আতঙ্কের। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে; যার সঙ্গে ঘটনাটি ঘটছে কিংবা যাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তারা প্রত্যেকেই ঘটনার পরবর্তীতে ট্রমার মধ্যে চলে যায়। এ ট্রমাটাইজড অবস্থা পর্যায়ক্রমে বিদ্যমান থাকলে ক্ষতিগ্রস্তরা মানসিক পীড়নের মধ্যদিয়ে জীবন যাপন করে। ক্ষতিগ্রস্ততার এ রেশ দীর্ঘমেয়াদি, একজন ভুক্তভোগী সহজে আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। মানসিকভাবে ওই ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়েন। মোদ্দা কথা হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত তথা ভুক্তভোগীকে সহজ, স্বাভাবিক ও নিরাপদ পরিবেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে। তা না হলে ধর্ষিত নারীরা কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন? ধর্ষণের ঘটনা ক্রমান্বয়ে কেন ঘটেই চলবে? ধর্ষণের ঘটনা যে কেবল এখনই ঘটছে বিষয়টা তা নয়, তবে সেটি বর্তমানে মহামারি আকার ধারণ করছে। অপরাধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সমাজ থেকে গৃহীত ব্যবস্থাও কার্যাকরভাবে ফলপ্রসূ হচ্ছে না, যে কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে।
ধর্ষণের ঘটনা কেন ঘটছে এবং কারা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত? এর কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয়ের পাশাপাশি ধর্ষণ প্রতিহতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নীতি-নৈতিকতার অভাব, পারিবারিক শিক্ষার অবক্ষয়, নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে অপারগতা, বিকৃত মানসিকতা, সমাজচ্যুত, বিচ্ছিন্নতা, কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া প্রভূত কারণে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে। পরিবার হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের সর্বোচ্চ শিক্ষাস্থল। পারিবারিক শিক্ষাই মানুষকে বড় করে তোলে, ভালোমন্দের পার্থক্য নিরূপণে সহায়তা করে, সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল ও দায়বদ্ধ হিসেবে গড়ে তোলে। অন্যায়, অনিয়মকে পরিহার করে জীবন পরিচালনার শিক্ষা দেয়। যাদের মধ্যে পারিবারিক শিক্ষা নেই, নৈতিক অবক্ষয়ে শামিল, ধর্মীয় শিক্ষা নেই, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই, রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নেই কেবলমাত্র তাদের দ্বারা ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে। কেননা, কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক ও স্বচ্ছ চিন্তার মানুষের দ্বারা ধর্ষণের মতো নৃশংস ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়।
নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের পরিচিতদের দ্বারা। সাম্প্রতিককালে এ ব্যাপারটি আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করেছে। মাগুরার শিশু ধর্ষণের ঘটনাটিকে যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাবে শিশুটিকে ধর্ষক দীর্ঘদিন ধরেই চেনে ও জানে। শিশুর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ধর্ষক শিশুটিকে চরমভাবে নির্যাতন করে এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় শিশুটির মৃত্যু হয়। এদিকে শিশুর যারা অভিভাবক ছিলেন তারা ক্ষুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেননি তাদের আত্মীয়ের দ্বারা এ ধরনের রোমহর্ষক ঘটনা ঘটবে। বিকৃতমনা তথা পাষণ্ডটি দীর্ঘদিন ধরেই লোলুপ দৃষ্টি ধারণ করে শিশুটিকে ধর্ষণ করার মনোবৃত্তি পোষণ করেছিল।
আর শিশুটি যেহেতু নিজেকে পাষণ্ডের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রতিরোধ গড়তে পারেনি, তাই ধর্ষকের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে শিশুটি সহজ টার্গেট ছিল। এসব কিছুর সংমিশ্রণে ধর্ষক সহজেই তার কুপ্রবৃত্তিকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছে। মাগুরার আছিয়ার ঘটনার মতো অন্যান্য ঘটনাতেও দেখা যায়, ধর্ষিতা ধর্ষকের পূর্ব পরিচিত এবং এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে ধর্ষকরা প্রতিনিয়ত উন্মাদ হয়ে উঠছে। সুতরাং, অপরাধে উদ্বুদ্ধ ব্যক্তি, সহজ লক্ষ্যবস্তু ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি এ তিনের সমন্বয়ে অপরাধের ঘটনা ঘটে, মাগুরার ঘটনাটিতেও এ তিনটি বিষয়বস্তুর সমন্বয় ঘটেছে। এ ব্যাপারগুলোতে সতর্ক হয়ে সব অভিভাবকের সন্তান প্রতিপালন ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।
ধর্ষণের শিকার ক্ষতিগ্রস্তরা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেকেই ট্রমা মেনে নিতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ধর্ষিতার পরিবারকেও নেতিবাচক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। অথচ এ ব্যবস্থায় ধর্ষিতা নারীর পরিবারের পাশে সবাইকে দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। চলমান ধর্ষণ ঘটনার ফলে প্রত্যেক পরিবার ভয়ে সন্ত্রস্ত। উঠতি বয়সী তরুণী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, কিশোরী ও শিশুরাও মাত্রাতিরিক্ত ধর্ষণ ঘটনার কারণে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছেন না। ঘর থেকে বের হওয়াই আতঙ্কের। এহেন পরিস্থিতি কোনোভাবে কাম্য নয়। সাধারণত দেখা যায়, প্রত্যেকেই নিজের সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকে, সেটি থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে নিজের সন্তানের পাশাপাশি অন্যের সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে যদি প্রত্যেকে সোচ্চার হই, তাহলে একটি মানবিক সমাজ কাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব। ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে ওঠে মোকাবিলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। কেননা, সমাজ থেকে ধর্ষণের মতো জঘন্য ও ঘৃণিত কর্মকাণ্ডকে উৎখাত করতে না পারলে যেকোনো পরিবার আক্রান্ত হতে পারে। এ বোধ-বিবেচনার জায়গাটুকু সবার মধ্যে উদিত হওয়া উচিত।
ধর্ষণের ভয়াবহতাকে প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতে দ্রুত ধর্ষকদের গ্রেপ্তার করে স্বল্প সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। দেখা যায়, ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তারকৃত অনেকেই জামিন নিয়ে বের হয়ে পুনরায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ শ্রেণিটিকে অক্ষম করতে তথা নিষ্ক্রিয় করতে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে, যেমন এমন একটি সমাজব্যবস্থা চালু রাখা যেখানে ধর্ষক হয়ে উঠবে না কেউই কিংবা ধর্ষক হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। কর্মক্ষম নাগরিক উপহার দিতে পারলে সমাজ থেকে অনিয়ম ও নৈরাজ্য অচিরেই দূরীভূত হবে। এ ছাড়া ধর্ষকের বিরুদ্ধে প্রচলিত শাস্তির মাত্রা বাড়ানো উচিত। ধর্ষকদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে, একঘরে করে দিতে হবে।
ধর্ষকদের পরিবারের সঙ্গে কেউই আত্মীয়তা করতে পারবে না, কোনোরকম সামাজিক সম্পর্কে জড়ানো যাবে না ধর্ষক পরিবারের সঙ্গে। ধর্মীয় নেতাদের ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আলোচনা জারি রাখতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে (স্কুল, কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান) ধর্ষণের বিরুদ্ধে নিয়মিত সভা, সমাবেশ, সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতন ও সতর্ক করে তুলতে হবে। ধর্ষক পরিবারের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে বয়কটের ঘোষণা অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি ধর্ষকদের চূড়ান্ত শাস্তি ধর্ষণ থেকে ধর্ষকদের বিরত রাখতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি চাকরিতে ধর্ষকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে প্রজ্ঞাপন দিতে হবে। সর্বোপরি ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]