
১৯৪৫ সালে লীগ অব নেশনস ব্যর্থ হওয়ার পর মানবতাকে আত্ম-ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল সম্মিলিত নিরাপত্তার জন্য একটি সাহসী পরীক্ষা। আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ রোধ করতে এবং সহিংসতার পরিবর্তে কূটনীতির মাধ্যমে সংঘাত পরিচালনার জন্য এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
তবুও, ৮০ বছর পরে আমরা নিজেদের বিপর্যয়ের প্রান্তে দেখতে পাচ্ছি। বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অতিক্রম করেছে; যা বিজ্ঞানীরা দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণের জন্য বড় বিপৎসীমা হিসেবে দেখেন। প্রতিষ্ঠান এবং গণতন্ত্রের ওপর জনসাধারণের আস্থা অত্যন্ত কমে গেছে এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে। কী হয়েছে?
জাতিসংঘ বিভিন্ন কারণে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। সহিংসতা, সংঘাত এমনকি গণহত্যার মতো ঘটনা এখনো উদ্বেগজনকভাবে ঘটছে। সংস্থাটি গ্লোবাল সাউথের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে সাধারণত অকার্যকর, অতিরিক্ত আমলাতান্ত্রিক এবং অন্যায্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
সমস্যাটি হলো জাতিসংঘ একবিংশ শতাব্দীর মৌলিক সমস্যাগুলোর ওপর বিংশ শতাব্দীর যুক্তি উপস্থাপন করে যাচ্ছে। আজকের সবচেয়ে জরুরি চ্যালেঞ্জগুলো- যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক সংক্রমণ এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত যা কোনো সীমানা মেনে চলে না। তবুও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো ঈর্ষান্বিতভাবে তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী জাতি রাষ্ট্রগুলোর কাঠামোর মধ্যে আটকে আছে। আমাদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল জাতীয় সীমানা সম্পর্কে পদ্ধতিগত সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য তৈরি করা হয়নি। জাতিসংঘ কেবল ধীরগতির নয়, এটি কাঠামোগতভাবেও এই ধরনের সমস্যাগুলো ব্যাপকভাবে মোকাবিলা করতে অক্ষম।
ক্রমবর্ধমান উপজাতীয়তাবাদ এবং জাতীয়তাবাদের মুখে প্রচলিত শাসন কাঠামোও যখন ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে, তখন প্রচলিত শাসনব্যবস্থার যে কোনো প্রস্তাবিত নতুন দৃষ্টান্ত ইউটোপিয়ানরা শুনতে চায় না। সৌভাগ্যবশত, বিশ্বের ইতোমধ্যেই একটি কার্যকর সংস্থা রয়েছে তা হলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সব ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এই ব্লকটি প্রমাণ করেছে যে, জাতীয় ফেডারেশন কাজ করতে পারে। যুদ্ধরত দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে সার্বভৌমত্বকে একত্রিত করার সুযোগ দিয়েছে। এটি তেমন কোনো মৌলিক ধারণাও নয়। ১৯৪৬ সালের গলআপ জরিপে, ৫৪ শতাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করেছিলেন যে, ‘জাতিসংঘকে শক্তিশালী করা উচিত যাতে এটি এমন একটি বিশ্ব সরকারে পরিণত হয় যার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সব জাতির সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে’।
২০২৪ সালে ৫৮ শতাংশ আমেরিকান মনে করতেন, জাতিসংঘ ‘খারাপ কাজ’ করছে। এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় জাতিসংঘকে আরও সাহসী ভূমিকা পালন করা উচিত। দার্শনিক টিমোথি মর্টন বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো বৃহৎ সমস্যাগুলোকে ‘অতি-বস্তু’ বলেছেন। এগুলো ‘এত ক্ষণস্থায়ী এবং স্থানিক মাত্রার সত্তা’ যেগুলোর জন্য মৌলিকভাবে ভিন্ন ধরনের মানবিক যুক্তি প্রয়োজন। এ ধরনের সমস্যাগুলো সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করার জন্য বুদ্ধিগত এবং মানসিক উভয় পরিবর্তনের প্রয়োজন। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন যাকে ‘কল্পিত সম্প্রদায়’ বলেছিলেন।
বুদ্ধিগতভাবে চিন্তা করলে ইহজাগতিক চিন্তাভাবনার জন্য নিজস্ব তাত্ত্বিক কাঠামো প্রয়োজন। এই দাবি নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীতে, জন মেনার্ড কেইনস বিশ্বব্যাপী মুদ্রার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন এবং ডলারকেন্দ্রিক ব্রেটন উডস প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিস্থাপনের জন্য ‘ব্যাংকর’-এর প্রস্তাব করেছিলেন। হান্না আরেন্ডট রাজনীতির বিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকেও এগিয়ে নিয়েছিলেন। পিয়েরে টেলহার্ড ডি চার্ডিন ‘নুস্ফিয়ার’ (সম্মিলিত মানব চেতনা) সম্পর্কে তার ধারণাটি দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক স্কলারশিপে ‘গ্রহের সীমানা’ সম্পর্কে জোহান রকস্ট্রমের কাজ থেকে শুরু করে ব্রুনো লাটোরের পরিবেশগত যুগের বর্ণনা পর্যন্ত- নতুন গ্রহগত দৃষ্টান্তের বৌদ্ধিক উপাদানগুলো একত্রিত হতে শুরু করেছে।
মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমাদের একটি নতুন আখ্যানের প্রয়োজন। ঐতিহাসিক জুবাল নোয়া হারারি যুক্তি দেন যে, মানবসভ্যতা জাতীয়তাবাদ এবং পুঁজিবাদের মতো সাধারণ মিথের ওপর গড়ে উঠেছে। এই পৃথিবীর শাসনব্যবস্থার সুফল পেতে হলে এটিকে নতুনভাবে সাজাতে হবে। সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র সম্পর্কে পুরানো ধারণার বাইরে গিয়ে মানবতার আন্তসংযোগকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
মানুষ যেখানে আছে সেখান থেকে উঠে আসার জন্য উন্নত চিন্তাভাবনার সঙ্গে শক্তিশালী স্থানীয় চিন্তাভাবনাও থাকতে হবে। বার্গগ্রুয়েন ইনস্টিটিউটের জোনাথন ব্লেক এবং নিলস গিলম্যান বলেছেন, আমাদের শাসন কাঠামোর উন্নতির জন্য ‘ওপরে এবং নিচে’ উভয় দিকেই নজর রাখতে হবে। জাতিরাষ্ট্র একটি উপাদান হিসেবে থাকবে। তবে শহর, অঞ্চল ও স্থানীয় নেটওয়ার্কগুলোকে আরও মনোযোগ দিতে হবে এবং কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে একীভূত করা হবে। এই ধরনের নেস্টেড পদ্ধতি অর্থাৎ বসে থাকা জাতি রাষ্ট্রের পুরানো ব্যবস্থার বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে ভাবতে হবে।
২০০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয় থেকে শুরু করে মহামারি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে যে সংকট তৈরি হয়েছে তাতে জাতিসংঘের ব্যর্থতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জাতিসংঘ নিজেই লিগ অব নেশনসের খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন জাতিসংঘকে নতুন করে গড়ে তোলার সময় এসেছে। শাসনব্যবস্থাকে ব্রেটন উডস ব্যবস্থার জাতিরাষ্ট্রভিত্তিক যুক্তি থেকে ব্যাংকরের সংবেদনশীলতার দিকে পরিচালিত করতে হবে। এমনকি যদি জাতিসংঘ বিশ্বের জাতিগুলোকে একত্রিত করতে সফল হয়, তবুও এর বর্তমান নকশা বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন হবে। আমাদের পৃথিবীর বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীভূত নতুন সম্প্রদায়গুলোকে কল্পনা করার সময় এসেছে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন অধ্যয়ন বিভাগ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি সদস্য। আরব নিউজ থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল