ঢাকা ৫ বৈশাখ ১৪৩২, শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫
English
শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৫ বৈশাখ ১৪৩২

বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বদলানো এখন সময়ের দাবি

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ০৩:৪২ পিএম
বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা বদলানো এখন সময়ের দাবি
আনু মুহাম্মদ

বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির জন্য পুরো ব্যবস্থার বদল দরকার। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বৈষম্যের ভিত তৈরি করে। শিক্ষা হতে হবে সব নাগরিকের অধিকার এবং তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। অভিন্ন এবং উন্নত মানের শিক্ষা শ্রেণি, জাতি, লিঙ্গ, ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে একই সঙ্গে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য অভিভাবকদের আর্থিক দুশ্চিন্তা বা সংকটের সমাধান করতে হবে।...

দেশে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান শিক্ষাবঞ্চিত অথবা শ্রমিক। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় অনেকেই লেখাপড়ার পরিবেশ থেকে দূরে সরে গেছে। এই অভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবার এবং আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই নেওয়ার কথা। তা এখনো অগোছালো অবস্থায় রয়েছে। ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়ের কারণে সংখ্যালঘু অনেক মানুষ নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে দিন-রাত কাটাচ্ছেন এখনো। বহু কারখানা অচল হয়ে বর্তমানে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার। বহু শ্রমিককে বকেয়া মজুরির জন্য এখনো পথে নামতে হচ্ছে। বেশির ভাগ জিনিসপত্রের দাম এখনো সেই ক্রয়ক্ষমতার ওপরেই আছে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ এখনো বিশ্বের মধ্যে নিকৃষ্ট। যানজট, দুর্ঘটনা বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত আছে।  
যেসব প্রকল্প ও চুক্তি বাংলাদেশের জনগণের জন্য বিপজ্জনক, বাংলাদেশের প্রাণপ্রকৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ এবং যা বড় আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে- এসব প্রকল্প এবং চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন দরকার।

 যেগুলো খুবই ক্ষতিকর, সেগুলো বাতিল করা দরকার। সেজন্য এগুলোর বোঝা থেকে কীভাবে বাংলাদেশ ও মানুষকে রক্ষা করা যায়- সেটা নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া শুরু করা এই সরকারেরই দায়িত্ব। অন্যদিকে বৈষম্যবাদী রাজনীতির নড়াচড়া ক্রমেই বাড়ছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে খাটো বা অস্বীকার করে এই জনপদের মানুষের লড়াইয়ের ঐতিহ্যকে খারিজ করা, সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে মহিমান্বিত করার প্রবণতা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। জোরজবরদস্তি, ট্যাগিং, মব ভায়োলেন্স ও নারীবিদ্বেষী তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন মাত্রায়। বলাই বাহুল্য, গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গেলে এসবের পরিবর্তন হতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে সরকারের সরব ও সক্রিয় হওয়াই প্রধান পদক্ষেপ হতে পারে। এখন পর্যন্ত সরকারের ভূমিকা খুবই দুর্বল বলতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, যাদের এই সরকারের না চেনার কথা নয়। এ ছাড়া আবার শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি, যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে কাজ করে এবং এগুলো বহুদিন ধরেই চলছে। এই যে কতিপয় গোষ্ঠীর বাজার নিয়ন্ত্রণ, এটা আগের সরকার ভাঙার বদলে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। বর্তমান সরকারও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এতে সরকারের বিশেষ আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। 


বাংলাদেশ ব্যাংককে একটা কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানো, যেসব ব্যাংক রাজনৈতিক ও কতিপয় গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল সেগুলোকে পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেওয়া, মূল্যস্ফীতি ঠেকানোর জন্য প্রয়োজনীয় মুদ্রানীতি প্রণয়ন এগুলো করার জন্য কমিশনের সংস্কার কর্মসূচি বা কমিশনের রিপোর্টের অপেক্ষার দরকার নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার যদি ঠিকমতো হয়, ব্যাংকিং ক্ষেত্রে অনিয়মগুলো যদি দূর হয়, বাজারে মুদ্রাব্যবস্থা যদি সুস্থ অবস্থায় আসে, ডলার এক্সচেঞ্জ রেট স্বাভাবিক অবস্থায় আসে, এসবই মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এগুলো নিয়ে আগেই সক্রিয় ভূমিকা দরকার ছিল। সে ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভাষ্য বা কার্যকর উদ্যোগ এখনো আমরা দেখতে পাইনি।

সরকারকে আস্থা তৈরি করতে হবে। অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার হঠাৎ করে গত সরকারের স্টাইলে মানুষের ওপর ভ্যাট ও করের বোঝা চাপিয়ে দিল তা ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আস্থা কমাবে, আরও কঠিন অবস্থা তৈরি করবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য। শেখ হাসিনা সরকারের পতন পর্যন্ত অর্থনীতির যে গতি বা ধারা ছিল, সেখানে অচিন্তনীয় মাত্রায় কতিপয় গোষ্ঠীর লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল। ফলে দীর্ঘমেয়াদি অনেক ক্ষতি হয়েছে। এতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যেতে থাকে। অতি ব্যয়ে করা ঋণনির্ভর প্রকল্পগুলোর জন্য ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়তে থাকে। মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় ব্যাপকভাবে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার উঁচু দেখালেও তা কর্মসংস্থানের সমস্যা কমাতে পারেনি। অন্যান্য জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বাড়ে। এর সঙ্গে সম্পদ কেন্দ্রীভবন, বৈষম্য বৃদ্ধি- এগুলো যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে, তাতে হাসিনা সরকারের পতন না ঘটলে, এই সংকটগুলো আরও বেশি ঘনীভূত হতো। এসব ঋণ শোধের চাপ সামনে আরও বাড়বে। 

তবে জনগণের নামে একটা ভূমিকা নিতে পারে সরকার। বলতে পারে, এগুলো যেহেতু অনির্বাচিত সরকার জনসম্মতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেরা কমিশন পাওয়ার জন্য এবং কিছু গোষ্ঠী থেকে সুবিধা নেওয়ার জন্য নিয়েছে, যেহেতু দুর্নীতি, লুটপাট ও পাচার হয়েছে এর বড় অংশ, সেহেতু এর দায়িত্ব আমরা কেন নেব? এই প্রশ্ন তুলতে হবে। দরকষাকষি করে সময় বাড়াতে হবে, সুদ এবং আসল কমাতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না বরং পূর্ণমাত্রায় সচল রাখতে হবে। এরকম একটি দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে সরকারকে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের দায়িত্ব সরকারের কোনো কোনো প্রতিনিধিকে নিতে হবে। 

শিক্ষা নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। তবে তা যেন নতুন সমস্যা তৈরি না করে সেদিকে নজর রাখতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে যেকোনো রাজনৈতিক দলের দাপট দূর করা উচিত। তবে রাজনৈতিক সচেতনতা, সুস্থ বিতর্ক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই থাকতে হবে। বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা তৈরির জন্য পুরো ব্যবস্থার বদল দরকার। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের বৈষম্যের ভিত তৈরি করে। শিক্ষা হতে হবে সব নাগরিকের অধিকার এবং তা নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই। অভিন্ন এবং উন্নত মানের শিক্ষা শ্রেণি, জাতি, লিঙ্গ, ধর্মনির্বিশেষে সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে একই সঙ্গে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য অভিভাবকদের আর্থিক দুশ্চিন্তা বা সংকটের সমাধান করতে হবে। 

অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে মৌলিক কিছু পার্থক্যের সূচনা করতে হবে সরকারকে। আগের সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পুলিশকে অনেক বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। কতিপয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক খাত। বিপরীতে যারা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য ও চাপের সম্মুখীন হয়েছেন তার মধ্যে প্রধানত হচ্ছে সর্বজনের জন্য প্রয়োজনীয় খাতগুলো। যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ, নিয়োগ, অবহেলার কারণে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি শ্রমিকদের কথাও আমরা বলতে পারি। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে গেলে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দের বর্তমান চিত্র পরিবর্তন করে তা আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে আসতে হবে। জিডিপির শতকরা কমপক্ষে ছয় ভাগ বরাদ্দের ধারা তৈরি করলে ব্যয় বাড়বে বর্তমানের তিন থেকে পাঁচ গুণ। তার যথাযথ ব্যবহারের জন্য এই দুটি খাতে বড় ধরনের পুনর্বিন্যাস দরকার আছে। পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে প্রয়োজনীয় সব খাতেই সংস্কারের কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার।

লেখক: শিক্ষাবিদ

ট্রাম্প কি চীন ও ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন?

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:২৪ পিএম
ট্রাম্প কি চীন ও ইউরোপকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবেন?
ন্যান্সি কিয়ান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করাটা অনেক ব্যয়বহুল। ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে বাণিজ্যে শক্তিশালী প্রেরণা তৈরি করেছেন। ইউক্রেনের যুদ্ধের মতো বিষয়গুলোয় তাদের বিরোধপূর্ণ অবস্থান থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে এখন এক রকমের ভিত্তি তৈরি হয়েছে। 

অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক যুক্তি ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ কিছু শুল্ক চালু করেছেন। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি অর্থনীতির ওপর সেগুলো আরোপ করেছেন। শুল্ক আরোপ এমনই থাকবে বলে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি একটি ছাড়া সব দেশের জন্য নতুন ‘পারস্পরিক’ শুল্ক স্থগিত করেছেন। বাকিদের জন্য সার্বিকভাবে ১০ শতাংশ শুল্ক বহাল রাখেন। চীনের জন্য ট্রাম্প ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে দুটিতে ১০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি এবং তার ‘স্বাধীনতা দিবসে’ আরোপিত ৩৪ শতাংশ ‘পারস্পরিক’ শুল্কের ওপরে ৫০ শতাংশ শুল্ক যোগ করেন (যা তিনি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ৮৪ শতাংশে বৃদ্ধি করেন)। ফলাফল? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী সব চীনা পণ্যের ওপর কার্যকর সর্বনিম্ন ১৪৫ শতাংশ শুল্ক হার ধার্য করা হয়। 

চীন প্রাথমিকভাবে দুটি পণ্যে ১০ শতাংশ বৃদ্ধির সমানুপাতিক শুল্ক দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছিল এবং ট্রাম্পের সঙ্গে একটি চুক্তির আশা করেছিল। এর মধ্যদিয়ে তারা সামঞ্জস্যপূর্ণ বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ফলে মার্কিন আমদানিতে সামগ্রিক শুল্ক ১২৫ শতাংশে পৌঁছেছে। ট্রাম্প প্রশাসন বাজি ধরছে যে, মার্কিন বাণিজ্যে তীব্র হ্রাসের ফলে চীন সরকার অর্থনৈতিক ক্ষতি সহ্য করতে পারবে না। চীনের জিডিপির মাত্র ২০ শতাংশেরও কম আসে রপ্তানি থেকে এবং এর রপ্তানির প্রায় ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে যায়। ২০২৪ সালে চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এই রপ্তানির ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ চীনা সংস্থা, কর্মী এবং পরিবারের ওপর অনেক বড় ক্ষতি বয়ে আনবে। এমন এক সময়ে এই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে যখন চীন তাদের স্থবির অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছে। 

কিন্তু ট্রাম্পের অদ্ভুত এবং আক্রমণাত্মক শুল্ক আরোপের ফলে চীন সরকার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সুবিধা পেয়েছে। অভ্যন্তরীণ নীতির কারণে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে। লেসোথোর মতো ছোট ও দরিদ্র দেশ বা কেবল পেঙ্গুইন অধ্যুষিত দ্বীপপুঞ্জের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের নির্লজ্জ ও নির্বিচারে শাস্তিমূলক শুল্ক আরোপের ফলে বেশির ভাগ সাধারণ চীনা অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়েছে। তারা ‘মার্কিন বর্বরতা’কে দায়ী করছে। চীনা সরকার বারবার বাণিজ্যের পারস্পরিক সুবিধার ওপর গুরুত্ব দেয়। বাণিজ্য যুদ্ধে ‘কেউ জিতবে না’ এমন নীতির ওপর তারা জোর দেয়। এই সময়ে চীন জাতীয় সংহতির আহ্বান জানিয়েছে। আমেরিকা যত কম যুক্তিসংগত আচরণ করবে, চীনা সরকার তত বেশি অভ্যন্তরীণ সমর্থন পাবে। 
তাছাড়া, চীন একা নয়। বাইডেন প্রশাসন চীনকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য তার মিত্রদের সঙ্গে অক্লান্ত পরিশ্রম করলেও ট্রাম্প চীন এবং ঐতিহ্যবাহী মার্কিন মিত্রদের একই দিকে রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ, তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের আমদানির ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি করেছেন। ইইউ, চীনের মতো ট্রাম্পের আগে প্রতিশোধমূলক শুল্ক ঘোষণা করেছে যখন শেয়ারবাজারের পতন এবং ট্রেজারি স্থবির হয়ে পড়ে।
চীনের ওপর আমেরিকার সাম্প্রতিক মনোযোগকে ইউরোপ এবং অন্য দেশগুলোকে চীনের বিরুদ্ধে পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হতে পারে।

 এটি কিছুটা হলেও কাজ করতে পারে। মেক্সিকো ইতোমধ্যেই চীনের ওপর মার্কিন শুল্কের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন স্বার্থের ওপর স্বপ্রণোদিত ক্ষতির বেশির ভাগই ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। এমনকি যদি ইইউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক নিয়ে সফলভাবে আলোচনা করে, তবুও ইউক্রেন এবং গ্রিনল্যান্ড যারা অর্থনৈতিক অংশীদার তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমেরিকার প্রতি ইউরোপীয়দের বিশ্বাসে কিছুটা ঘাটতি পড়বে। 

আমেরিকার প্রতি হতাশা হঠাৎ করে ইউরোপকে চীনের মিত্র করে তুলবে না। চীনের বিরুদ্ধে ইইউর প্রচুর অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বৈদ্যুতিক যানবাহন রপ্তানি এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধে সমর্থন করার জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যকে আরও ব্যয়বহুল এবং সবার জন্য অপ্রত্যাশিত করে তুলেছে। ট্রাম্প ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার জন্য শক্তিশালী প্রেরণা তৈরি করেছেন।

তাছাড়া, ট্রাম্প যখন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিলেন, তখন ইউরোপ এবং চীন উভয়ই বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপের প্রয়োজনীয় অনুভব করে। বৈদ্যুতিক যানবাহন এবং সৌর-প্যানেল উৎপাদনে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি চীন সবুজায়নে শক্তি প্রযুক্তি এবং পারমাণবিক শক্তির দ্রুততম বিকাশকারী শক্তি বিকল্প যা ইউরোপে নতুন করে আগ্রহ অর্জন করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইউরোপীয় উৎপাদকদের ওপর চীনা রপ্তানির প্রভাব নিঃসন্দেহে একটি জটিল বিষয়। তবে আমেরিকান বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে তাদের অর্থনীতিকে চাঙা করতে উভয় পক্ষকেই আপস করতে অনুপ্রাণিত করবে। 

চুক্তি কেমন হবে তা বলা কঠিন। তবে অনেক বিকল্প পথ রয়েছে। চীন তার ইউরোপীয় আমদানি বৃদ্ধি, ইউরোপে রপ্তানির সীমা নির্ধারণ এবং তার মুদ্রার মান বৃদ্ধি করতে পারে। এটি AI, EV ব্যাটারি এবং বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিশনের মতো ইউরোপীয় শিল্পগুলোকে শক্তিশালী করতে প্রযুক্তিকে ভাগ করে নিতে পারে। এই খাতে চীনা সরকারের ভর্তুকি যা ইউরোপীয়রা চীনকে অন্যায্য সুবিধা প্রদানকারী হিসেবে দেখে থাকে। এটি ইউরোপীয় উৎপাদক এবং ভোক্তাদের জন্য সুবিধায় পরিণত হবে। ইউরোপ তার পক্ষ থেকে আরও বিশ্বব্যাপী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় চীনা অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতে পারে, যা চীনা নেতারা দীর্ঘদিন ধরে চেয়ে আসছেন।

যদিও চীন রাশিয়াকে পরিত্যাগ করার সম্ভাবনা কম, তবুও চীনা স্বার্থের ক্ষেত্রে তারা বাস্তববাদী মনোভাব দেখিয়েছে। ইউরোপীয়দের প্রতি সদিচ্ছা দেখাতে চাইলে তারা আমেরিকান কৃষি আমদানির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইউক্রেনীয় খাদ্যপণ্যের আমদানি বাড়াতে পারে। ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের সহায়তা করতে পারে। ইউক্রেন পুনর্গঠনে সহায়তা করার জন্য বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণে তার দক্ষতা ব্যবহার করতে পারে এবং চীনা ভাড়াটে সৈন্যদের রাশিয়ায় যোগদান থেকে বিরত রাখতে পারে।

 স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের সাম্প্রতিক বেইজিং সফর এবং জুলাই মাসে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং যে ইইউ নেতাদের সঙ্গে পরিকল্পিত বৈঠকের আয়োজন করবেন তা স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, বিশ্বের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলো বর্ধিত সহযোগিতার সুবিধা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত। যদি তারা সফলভাবে এটি অনুসরণ করে, তাহলে বাণিজ্য যুদ্ধ চীনের জন্য খারাপ নাও হতে পারে। অর্থনৈতিক সংকট বলে মনে হচ্ছে তা একটি ভূ-রাজনৈতিক সুযোগও হতে পারে।

লেখক: চীনা আমেরিকান অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র 
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

পানির সংকট: পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ ও বিশ্ব

প্রকাশ: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:১৯ পিএম
পানির সংকট: পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ ও বিশ্ব

পৃথিবীর জন্মপূর্ব ও পরে সব অবস্থায় প্রাণীর জীবনবাহিত হয় পানির সঙ্গে। চিরায়ত বাঙালি প্রবাদ-পানির অপর নাম জীবন। প্রাণীমাত্রই দৈহিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পানির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি অব্যবস্থাপনার জন্য মানুষের জীবনে এর প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে দিন দিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে প্রকাশ, ১৯৬০ সালে পৃথিবীতে যে পরিমাণ পানির চাহিদা ছিল, ২০২৪ সালে তার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে মানুষের প্রাত্যহিক পানির চাহিদা ও বিশুদ্ধ পানির বড় সংকট দেখা দিয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান পরিদপ্তর বলছে, গত ৩৮ বছরে দেশে পানির স্তর দুই-তৃতীয়াংশ নিচে নেমে গেছে। দিন দিন এর মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের হিসাব মতো বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ পানি পায়। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পান করে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টির ওপর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে মত দিয়েছে, বিশ্বের অন্যতম পানি ঝুঁকিপ্রবণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান বেশ সংকটাপন্ন অবস্থায়। 

বাংলাদেশে সুপেয় পানির উৎসগুলো প্রাকৃতিক ও মানুষের কারণে বড্ড দূষিত হচ্ছে। দেশের মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহারের সংকটের দিকে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ভেতরে মানুষ নানা উৎস হতে পানি সংগ্রহ করে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যমতে, ১৯ দশমিক ৩৪ ভাগ মানুষ পানির সরবরাহ করে পাইপলাইন দিয়ে। ৭৬ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক পানি গ্রহণ করে গভীর ও অগভীর নলকূপ থেকে। আর বাকি ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ ভাগ মানুষ অন্যান্য উৎস থেকে পানি পেয়ে থাকে। এ হিসাবের বাইরে ‘শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ পানি বোতলজাত। শূন্য দশমিক ৬৮ শতাংশ পানি নদী বা পুকুরের। শূন্য দশমিক ৩৭ শতাংশ পাতকুয়ার। শূন্য দশমিক ১ শতাংশ পানি ঝরনার। শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ পানি বৃষ্টির এবং ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ পানি অন্যান্য উৎস থেকে সংগ্রহ করে।’ 
দেশের পানি প্রাপ্তির পরিসংখ্যান থেকে বিশ্বের দিকে তাকালে সেখানে জীবন বাঁচানো এ উপকরণের আন্তর্জাতিক সংকটের স্বরূপ নজরে পড়ে। বর্তমানে বিশ্বের ২২০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানিসুবিধা থেকে বঞ্চিত। একই সঙ্গে ৩৫০ কোটি মানুষের নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবহারেরও সুযোগ নেই। অবশ্য মানুষ তার এই অসুবিধার জন্য নিজেই দায়ী। কারণ নিরাপদ পানি প্রাপ্তির সংকটের জন্য মানুষ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইউনিসেফ জানায়, ২০০১ থেকে ২০১৮ সালে সংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ৭৪ শতাংশ পানি-সম্পর্কিত ছিল। পানিদূষণের কারণে বয়স্কদের থেকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। প্রতিদিন বিশ্বের পানিবাহিত রোগে ১ হাজার শিশুর মধ্যে পাঁচজন শিশু মৃত্যুবরণ করে। 

বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়ে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) সবার জন্য পানি ও পয়োনিষ্কাশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করাকে ষষ্ঠ লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। পানির দেশ হয়েও বাংলাদেশে সুপেয় পানির সংকট কম নয়। বর্তমানে এ দেশের তিন কোটি মানুষ সুপেয় পানি গ্রহণ হতে বঞ্চিত। আর এ সংকটের অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন। দেশের দক্ষিণে সমুদ্র উপকূল পানিতে সয়লাব। কিন্তু পান করার জন্য মিষ্টি পানির সেখানে বড় অভাব। অন্যদিকে গ্রীষ্মের মৌসুমে বরেন্দ্র অঞ্চলে দেখা দেয় পানির জন্য হাহাকার। ইউনিসেফের এক গবেষণা বলছে, ‘নদী ও পানির দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে সুপেয় পানি পাচ্ছেন না প্রায় তিন কোটি মানুষ। পাকিস্তানে ১ কোটি ৬০ লাখ। চীনে ১০ কোটি ৮০ লাখ, ভারতে ৯ কোটি ৯০ লাখ ও নাইজেরিয়ায় ৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ সুপেয় পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত।’ 

বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির অভাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ বছরের কম প্রায় ৫ হাজার শিশু মারা যায়। পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ুর প্রভাব এবং সভ্যতার উত্তরণের সঙ্গে তাল মিলে বাড়ছে পানির চাহিদা। প্রাচীন ও মধ্যযুগে যেখানে মানুষের পানির ব্যবহার ছিল সীমিত। আধুনিক যুগে উন্নত জীবনযাপনের প্রয়োজনে বেড়েছে মাথাপিছু পানির চাহিদা। সংগত কারণেই বিশ্বমানবের বাঁচার অপরিহার্য  এ উপাদানটির ওপর চলছে বিস্তর গবেষণা। গবেষণার পথে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও এশীয়া প্রশান্ত পানি ফোরাম ‘দ্য এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০২৩’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখানো হয়েছে, ‘এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পানিসংকট ভয়াবহ।

 এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলের ৪৯টি দেশের মধ্যে ৩৭টি দেশে পানির সংকট রয়েছে। এর মধ্যে সংকট ভয়াবহ রূপ পেতে চলেছে বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ায়।’ বিশুদ্ধ পানি ছাড়াও বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলের পানিতে রয়েছে আর্সেনিক সমস্যা। দেশে আর্সেনিক ঝুঁকিতেও আছে ২ কোটি মানুষ। এ সমস্যা পানিবাহিত রোগের কারণ মাত্র। কিন্তু দিন দিন যদি পানির না পাওয়ার সংকট তীব্র হয়, বিপর্যয় ঘটবে সেখানে। কেননা সম্প্রতি দেশের উত্তরাঞ্চলে এর মধ্যে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ অনুযায়ী প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে দেশের ৪১ জেলার ১৯২ উপজেলায় তীব্র পানিসংকট দেখা দেয়। 

ফলে দেশের অধিকাংশ এলাকায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অথচ শস্য-শ্যামল বাংলা টিকে থাকার জন্য পর্যাপ্ত পানির অতীব প্রয়োজন। মোদ্দাকথা পানির অপর নাম জীবন। বাঁচার অধিকার মানে পানির অধিকার। পানি থাকলে জীবন, না থাকলে জীবের অস্তিত্ব কল্পনাহীন। এখন সব থেকে বড় কথা, এ সংকট থেকে উদ্ধারের পথ বের করা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবে এবং বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে হবে। একই সঙ্গে পানির উৎস তৈরি করতে হবে। করতে হবে পানির অপচয় রোধ। মায়াভরা প্রিয় জন্মভূমিকে রক্ষা ও বেঁচে থাকার জন্য পানি ব্যবহারের প্রতি আমাদের সবাইকে যত্নবান হতে হবে। সেই সঙ্গে আমাদের কর্মকাণ্ডে যেন প্রকৃতি বিরূপ না হয়, সেদিকে সতর্ক খেয়াল রাখতে হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক 
স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বগুড়া
[email protected]

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২৪ পিএম
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বলতে আমি যা বুঝি, এখানে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আমাদের দেশে সম্প্রতি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বেশ কিছুটা কমে গেছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ- প্রত্যেকেই বাংলাদেশের ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যে প্রবৃদ্ধির স্টেটমেন্ট দিয়েছে, সেটাও ৪ শতাংশের মতো। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি তো ১০ শতাংশের কাছে অনেক দিন ধরেই আছে। সম্প্রতি তা ১০ শতাংশের বেশি হয়েছে। এই বিষয়গুলো সামনে রেখে আমাদের নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এখন প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে আমাদের অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

 বিশেষ করে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত অনেক কম। এক দশক ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু করণীয় আছে। প্রথমত; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবশ্যই ভালো করতে হবে। দ্বিতীয়ত; অবকাঠামো, ট্রান্সপোর্টসহ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নানা রকমের সমস্যা আছে। তৃতীয়ত, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস যে সূচকে আছে, সেই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। এর মধ্যে বেশ কিছু সাব-ইন্ডিকেটরস আছে। সেগুলোর উন্নতি হওয়া দরকার। 

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়। এই বিষয়গুলো যদি আমরা সমন্বয় করতে পারি, তাহলে আশা করা যায় যে, দেশের  অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং দেশে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ ফিরে আসবে।

বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চমূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। করোনা-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি স্থিতিশীল হওয়ার আগেই শুরু হয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফিড) পলিসি রেট বৃদ্ধি করাসহ নানা ধরনের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। 

একই সঙ্গে আরও নানাবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করে উচ্চমূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকও বেশ কয়েকবার মুদ্রানীতি পরিবর্তন করেছে। যদিও বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চমূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য মুদ্রানীতিও রাজস্ব নীতির সমন্বয় সাধন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মূল্য বৃদ্ধি করে পণ্যের চাহিদা হয়তো কমানো যাবে। কিন্তু পণ্যের জোগান যদি একই সঙ্গে বৃদ্ধি না পায়, তাহলে মূল্যস্ফীতি কমবে না। ব্যাংকঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পেলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যায়। বিনিয়োগ কমে গেলে উৎপাদন কমে যাবে। আর উৎপাদন কমে গেলে কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আর সবার জন্য উপযুক্ততা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না গেলে দেশে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম কোনোভাবেই কাজে আসবে না। কাজেই মূল্যস্ফীতির অভিঘাত রক্ষার পাশাপাশি আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের রপ্তানি বাড়াতে হবে।

মূল্যস্ফীতি বাড়লে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলো খুবই অসুবিধার মধ্যে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মজুরি বৃদ্ধির হার সেভাবে বাড়ছে না। মূল্যস্ফীতি আর মজুরি বৃদ্ধির এই পার্থক্যের কারণে সাধারণ মানুষ সংসারের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক পরিবার তাদের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। কেউবা তুলনামূলক কম পুষ্টিসম্পন্ন খাবার গ্রহণ করছে। অধিকাংশ দরিদ্র মানুষই এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কশাঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। 

দেশের সাধারণ জনগণ প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছে। উচ্চমধ্যবিত্তের মানুষ হয়তো তাদের সঞ্চয় ভেঙে জীবনযাত্রার মানটা রক্ষা করতে পারে। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তো কোনো সঞ্চয় নেই। আমরা দেখছি, এই মানুষগুলোর জীবনমান ক্রমশই নিম্নমুখী হচ্ছে। এখানে আমাদের যা করতে হবে; সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় যেসব প্রকল্প আছে, তা যেন সুষ্ঠুভাবে কার্যকর করা যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ভিডিপি, ভিডিএফ, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা- এদের অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম অভিযোগ আছে। প্রকৃতপক্ষে যারা পাওয়ার যোগ্য তারা পায় না। যারা পাওয়ার যোগ্য নয়, তারা পায়। অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি কারচুপি হয়। এমনও দেখা যায় যে, খাদ্যসহায়তার কাজ কোনো কোনো মেম্বারের বাড়িতে হয়। সেখানে গুদামে রক্ষিত মালামাল অনেক সময় ধরাও পড়ে। এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে। যারা এ ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের জীবনমানের ওপর যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে দ্রুতই জনবান্ধবমূলক কর্মসূচি বা পদক্ষেপ নিতে হবে।

দেশের পুঁজিবাজার সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার নিশ্চয়ই কাজ করছে। আমি মনে করি, সাধারণ মানুষকে অর্থাৎ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের শেয়ারবাজার সম্পর্কে সঠিকভাবে জেনেবুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। তাদের বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। তাদের ভালো কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করতে হবে। এখানেও যারা দুর্নীতি করবে অথবা আগে যারা দুর্নীতি করেছে তাদের জরিমানাসহ আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ক্ষতিগ্রস্তরা সাবধানি না হয়ে নানা রকম অপপ্রচার করে সব সময়। বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে থাকে। সেগুলো বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সবচেয়ে বেশি কেলেঙ্কারি হয়েছে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা আর শেয়ারবাজার নিয়ে। আমাদের সেগুলো বন্ধ করতে হবে। নিয়মানুযায়ী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বুঝেশুনে বিনিয়োগ করা, বেশি মুনাফার আশায় ভুল শেয়ার না কেনা অর্থাৎ যেগুলোর মূলত কোনো অস্তিত্ব নেই, সে ধরনের শেয়ার কেনা কখনো উচিত নয়। সর্বোপরি শেয়ারবাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়নের পুঁজিবাজারে কঠোরভাবে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। 

দেশের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার এবং শক্তি, তাতে ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে অন্তত ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিনিয়োগ হতে হবে। এই বিনিয়োগ হতে হবে ব্যক্তি খাতে। আমার মতে, বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণে প্রত্যাশিত মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাচ্ছে না। বর্তমানে রপ্তানি খাতে সংকোচন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। পণ্য রপ্তানি খাত সংকুচিত হলে তা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর একরকম চাপ সৃষ্টি করে। রপ্তানি আয় কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার বা মান কমে যেতে পারে। স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে সেটা আবার মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে। কাজেই রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে রপ্তানি খাতকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নে আরও অধিকমাত্রায় গতিশীলতা বৃদ্ধি করা দরকার। 

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

বাংলা নববর্ষ ১৪৩২: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২০ পিএম
বাংলা নববর্ষ ১৪৩২: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
ড. মতিউর রহমান

বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতিসত্তার এক অসাধারণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যার মূলমন্ত্র হলো নবজাগরণ, নবচেতনা এবং পুরাতনকে বিদায় জানিয়ে নতুনকে বরণ করা। সময়ের ক্যালেন্ডার ঘুরে আবার এসেছে পয়লা বৈশাখ, বাংলা ১৪৩২। এই দিনটি বাঙালির হৃদয়ে জাগায় এক অভাবনীয় আবেগ, ঐতিহ্য আর মিলনের আহ্বান। এ যেন রবীন্দ্রনাথের গানের সেই চিরন্তন ডাক- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’। বৈশাখের এই আগমনী বার্তা কেবল ঋতুর পালাবদলের নয়, এটি জীবনের রূপান্তরের প্রতীক।
পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন মানে কেবল নতুন বছরকে বরণ করা নয়, বরং এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, অতীত স্মৃতি, বর্তমান চেতনা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনার সম্মিলন। সেই সঙ্গে এটি একটি নৈতিক ও সাংস্কৃতিক শুদ্ধিকরণও, যার মর্মবাণী আমরা পাই রবীন্দ্রনাথেরই অমর পঙ্ক্তিতে- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। 

বাংলা সনের সূচনা হয়েছিল মুঘল সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকে। তার শাসনামলে ১৫৮৪ সালে চন্দ্র ও সৌর পঞ্জিকার সমন্বয়ে প্রবর্তন হয় ফসলি সন, যার গণনা শুরু হয় ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের কাছ থেকে সময়মতো খাজনা আদায় এবং কৃষিজীবী সমাজের হিসাব সহজ করা। পরবর্তীতে এটি হয়ে ওঠে বাঙালির নিজস্ব বর্ষপঞ্জি- বাংলা সন। আর এই সনের প্রথম দিন, অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে উৎসব ও মিলনের প্রতীক।

প্রথমদিকে এই দিনটি ছিল মূলত অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যবসায়িক বার্ষিক হিসাবের সূচনা দিন। হালখাতা, নতুন খাতা খোলা, পুরানো দেনা মুছে ফেলা- এসবই ছিল পয়লা বৈশাখের প্রধান অনুষঙ্গ। কৃষিপ্রধান বাংলায় এই দিনটি কৃষকদের জন্য ছিল নতুন আশার সূচনা, জমিদারদের জন্য ছিল প্রশাসনিক গুরুত্ব, এবং ব্যবসায়ীদের জন্য ছিল শুভ সূচনা।

কিন্তু সময়ের স্রোতে এই দিনটি শুধু লেনদেনের দিন থেকে পরিণত হয়েছে জাতিসত্তার চেতনার উৎসবে। বাংলার মানুষ নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পেয়েছে এই দিনটিতে।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতায় নববর্ষকে আহ্বান করেছেন এক ধ্বংস ও সৃজনের অনুপম সংলগ্নতায়। তার গান ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ শুধু একটি গান নয়, এটি এক সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক। এই আহ্বানে আছে পুরানো গ্লানি, অচলায়তন ও অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভাষা। নববর্ষ আসে শুধু সময়ের পরিবর্তন নিয়ে নয়, এটি আসে মনের মধ্যে, সমাজের মধ্যে, জাতির মধ্যে এক শুদ্ধি আনতে।

এই শুদ্ধির বার্তা আসে আরও তীব্রভাবে রবীন্দ্রনাথের সেই পঙ্ক্তিতে- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’। এ যেন এক প্রতীকী আগুনে অশুভকে দহন করে শুভকে আহ্বান করার আহ্বান। বৈশাখের খরতাপে শুধু প্রকৃতি নয়, আমাদের চেতনা, মনন ও সমাজ যেন শুদ্ধ হয়ে ওঠে। তাই নববর্ষ মানে কেবল উল্লাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধির এক সাংস্কৃতিক উদ্যাপন।
বাংলা ১৪৩২ এসেছে এমন এক সময়, যখন বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি প্রবল এক উত্তেজনা ও পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন, সামাজিক মাধ্যমে সাংস্কৃতিক চর্চা- সব মিলিয়ে পয়লা বৈশাখ এখন আগের চেয়ে ভিন্ন এক বাস্তবতায় উদ্যাপিত হচ্ছে।

ঢাকায় ছায়ানটের রমনা বটমূলে বর্যবরণ অনুষ্ঠান, চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা, শহরজুড়ে বিভিন্ন বৈশাখী মেলা, রেস্তোরাঁয় বৈশাখী মেনু, গ্রামে-গঞ্জে পান্তা-ইলিশ খাওয়া- এসবকিছু এখন নববর্ষের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এর পাশাপাশি আছে নিরাপত্তার কড়াকড়ি, নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ, করপোরেট বাণিজ্যের আধিক্য এবং প্রান্তিক জনগণের অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা।
তবু আশার কথা-নতুন প্রজন্ম এখনো পয়লা বৈশাখকে নিজেদের বলে মনে করে। তারা এদিনে বাংলায় কথা বলে, বাংলা পোশাক পরে, বাংলা গান গায়, বাংলা কবিতা পড়ে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে তারা নববর্ষকে পৌঁছে দিচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে।

গ্রামে এখনো নববর্ষ মানে হালখাতা, মেলা, গান, নাটক, পুতুলনাচ, লাঠিখেলা। গ্রামের মাঠে-মাঠে হয় বৈশাখী গান, স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় উঠে আসে মাটির কথা, মানুষের কথা, প্রকৃতির কথা। যদিও প্রযুক্তির আধিপত্যে ও আর্থিকসংকটে অনেক জায়গায় ঐতিহ্যবাহী মেলা হারিয়ে যাচ্ছে, তবু কিছু কিছু অঞ্চলে একঝাঁক সৃষ্টিশীল মানুষ এখনো ধরে রেখেছে শতবর্ষের সংস্কৃতি।

প্রবাসে বসবাসরত বাঙালিদের জন্য পয়লা বৈশাখ এক ভিন্ন আবেগের দিন। দেশছাড়া বাঙালিরা এই দিনটিতে যেন ফিরে যেতে চান শেকড়ে। নিউইয়র্ক, টরন্টো, লন্ডন, সিডনি, কুয়ালালামপুর, রোম কিংবা মেলবোর্ন- যেখানেই বাঙালিরা আছেন, সেখানেই বসে বৈশাখী মেলা, কবিতা পাঠ, নাটক, সংগীতানুষ্ঠান, নৃত্য এবং প্রাচ্যধর্মী খাদ্য উৎসব। এটি তাদের সংস্কৃতির পুনঃসংযোগ এবং পরিচয়ের পুনর্নির্মাণ।

বাংলা নববর্ষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বর্তমান প্রজন্মের চর্চা ও সমাজের মূল্যবোধের ওপর। যদি আমরা নববর্ষকে কেবল বিনোদনের মাধ্যমে, করপোরেট বাণিজ্যে কিংবা ফ্যাশন শোতে সীমাবদ্ধ রাখি, তবে এর অন্তর্নিহিত চেতনা হারিয়ে যাবে। তাই আমাদের প্রয়োজন নববর্ষের চেতনার মূল- বাঙালিত্ব, শেকড়, ঐতিহ্য এবং শুদ্ধির বার্তাকে ধরে রাখা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় নববর্ষ ঘিরে সাংস্কৃতিক চর্চার প্রসার, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করা, বাংলা পঞ্জিকার আধুনিকায়ন এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা বাংলা নববর্ষকে করে তুলতে পারি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সৃজনশীল।

পরিবেশগত দিক থেকেও আমাদের সচেতন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যদি বৈশাখী পরিবেশ বিপন্ন হয়, তবে তার প্রভাব পড়বে আমাদের সংস্কৃতিতেও। তাই নববর্ষ উদ্যাপনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের বার্তাও যেন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ কেবল একটি নতুন ক্যালেন্ডার বছরের সূচনা নয়, এটি একটি চেতনার নবজাগরণ। রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের নতুন আলোয়, নতুন প্রাণে আহ্বান জানায়- ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’, আর আমাদের মনে জাগায় সেই মহৎ আকাঙ্ক্ষা- ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’।

এই নববর্ষ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বাঙালি জাতি তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানবিক চেতনাকে ধারণ করেই এগিয়ে যাবে ভবিষ্যতের পথে। সময়ের ঝড়, রাজনীতির ধোঁয়াশা, বৈশ্বিক আগ্রাসন- সবকিছু উপেক্ষা করেই বাংলা নববর্ষ থাকবে আমাদের হৃদয়ের গভীরে। অতীতের গৌরব, বর্তমানের সংগ্রাম আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় বাংলা ১৪৩২ হোক শুদ্ধির, সংহতির এবং স্বপ্নের বার্তাবাহী এক নবদিগন্ত।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

উৎসব হোক যুগে যুগে

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৭ পিএম
উৎসব হোক যুগে যুগে
আবুল কাসেম ফজলুল হক

লোক-ঐতিহ্যর ভেতর থেকেই আমরা পয়লা বৈশাখ পেয়েছি। লোক বলতে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দিক্ষা অর্জন করেননি। এদের মধ্যেও অনেক বুদ্ধিমান লোক আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করলেই মানুষ শিক্ষিত হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও দেশে অনেক লোক আছেন যারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝেন। তাদের মধ্য থেকেও আমরা পয়লা বৈশাখের ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই। একটা সময় যারা গ্রাম থেকে শহরে আসত, তারা পয়লা বৈশাখকে গ্রাম্যতা বলত। গ্রাম্যতা ছেড়ে শহুরে হওয়ার প্রবণতা পঞ্চাশের দশকেও ছিল। সেসব বিবেচনা করে জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং অতীতের ভালো দৃষ্টান্তগুলো আলোচনা করে আমরা উন্নত ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে আমাদের ঐতিহ্য তুলে ধরতে চাই।...


পয়লা বৈশাখ জাতীয় চেতনার উৎসব। তার পরও পয়লা বৈশাখ নিয়ে বিতর্ক দেখা যায়। কিছু রাজনৈতিক সংগঠন আছে যারা পয়লা বৈশাখ উদযাপনকে বাংলাদেশের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা স্বীকার করতে চায় না। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার পর থেকে পয়লা বৈশাখ উদযাপনকে বাতিল করার জন্য অনেক বুদ্ধিজীবী চেষ্টা করেছেন। সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের অনেক বুদ্ধিজীবী মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানা কিছু সামনে এনেছেন, যা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারত না। পয়লা বৈশাখ নিয়ে আওয়ামী লীগের চিন্তাভাবনা ছিল অন্যরকম। তাই পয়লা বৈশাখ উদযাপনের জন্য ভাতা দিয়েছেন। পয়লা বৈশাখ নিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার এত খারাপ কাজ করেছে, যার ভেতর থেকে আমরা বের হতে পারিনি। যারা বিতর্ক সৃষ্টি করছে তাদের জিজ্ঞেস করা দরকার, তারা কী করছে। এসব লোকের আত্মশুদ্ধি দরকার। বৈশাখ নিয়ে মারদাঙ্গা বক্তব্য দেওয়া চরম অন্যায়। 

বাংলাদেশ জন্মের ৫৪ বছর পার হতে 
চলেছে। এই সময়ের মধ্যেও পয়লা বৈশাখকে আমরা বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে পারিনি। পয়লা বৈশাখ আনন্দের সঙ্গে উদযাপিত হোক, এটাই আমরা চাই। বাংলাদেশের মানুষ একই সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করুক এটাই চাই। 

বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার আগে পয়লা বৈশাখ ছিল একটা আন্দোলন। পাকিস্তান ছিল খুব অস্বাভাবিক রাষ্ট্র। ব্রিটিশরা যখন দেশ শাসন করেছে তখন তারা হিন্দু ও মুসলমানদের ভেতরে সবসময় বিভেদ লাগিয়ে রাখত। শেরেবাংলা ফজলুল হকের বক্তব্যে শুনেছি যে, হিন্দু-মুসলমানদের বিরোধে গত ২৫ বছরে ভারতবর্ষে প্রায় ১ কোটি লোক নিহত হয়েছে। ভালো কথাগুলো আমরা কখনো মনে রাখি না। অনেক কর্তৃত্ব দেখানোর জন্য যারা কাজ করে তারা অনেক সময় জাতিকে দুর্বল অবস্থায় রাখে। একদলীয় জাতীয় ঐক্য থাকা দরকার। যত দল তত মত, তত ধর্ম। সবার জন্য কাজ করতে জাতীয় ঐক্য থাকা দরকার। পয়লা বৈশাখের ব্যাপারেও এমন হওয়া উচিত। গোটা পৃথিবীর সব কাজকর্মই খ্রিষ্টানদের দিয়ে চলে। তবে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হবে। 

পয়লা বৈশাখ নিয়ে আমাদের একটা সন ও তারিখ ছিল যেটা আমাদের অনেক গর্বের বিষয়। আগামী বছরগুলো কীভাবে কাটাব তা নিয়ে সুদূরপ্রসারীভাবে ভাবতে হবে। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

পয়লা বৈশাখ নিয়ে অনেক সময় সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক বিষয়গুলও সামনে উঠে আসে। এসব শব্দ ব্যবহারে আমি মোটেই আগ্রহী নই। ইংরেজরা এই ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ব্যবহার করে অনেক দেশ ভাগ করে গেছেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখায় সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি নেই। কাজী নজরুলের লেখায় হিন্দু-মুসলিম বিরোধ এই কথাটি তেমন নেই। ভারতবর্ষে তেমনভাবে  সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি ছিল না। ইংরেজরা কমিউনালিজমের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি নিয়ে আসে। কবি জসিম উদ্দিন, আবুল ফজল, কাজী নজরুল এবং কাজী মোতাহার হোসেন চোধুরীর মতো জ্ঞানী মানুষের কথা শোনা উচিত। ইংরেজরা একসময় শক্তিশালী ছিল, কিন্তু এখন দুর্বল হয়ে গেছে। ইংরেজরা নানা কায়দায় আমাদের দখল করেছিল। সেই ইংরেজদের কথা আমাদের সাদরে গ্রহণ করা ঠিক না। বাংলাদেশে যে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ ও মন্দির ভাঙা  হচ্ছে তা কি বিরোধের কারণে হচ্ছে? আমাদের জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করার জন্যই এমনটা করা হচ্ছে। 

পয়লা বৈশাখ উদযাপনের ধারণা তো অনেকটা বদলে যাচ্ছে। তবে এটা খারাপ না। পশ্চাৎপদ ধারণা থেকে যদি আমরা অগ্রসর হতে পারি তাহলে খারাপ না। অনেক কিছু বদলে যেতে পারে। যারা দেশে মন্দির ভাঙা ও হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করেছে তারা অবশ্যই ক্রিমিনাল। সেই মুজিব সরকার থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনাকে ক্রিমিনাল কেস হিসেবে  নিতে হবে। এসব কাজ যারা করছে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাঙালি আদি সময় থেকে সেন আমল, মুঘল, পাঠান ও মুসলিম শাসন এবং ইংরেজ আমলে বাঙালির যে ঐতিহ্য তা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা আগামী বছর এবং ভবিষ্যতে কী করব তার একটা দিক-নির্দেশনা থাকতে হবে। এমন কোনো কিছু করা যাবে না যাতে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়। এমন কাজ করা যাবে না, যারা এই কাজ করে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং যারা করে না তাদেরও ক্ষতিসাধন হয়। এদের থেকে জাতীয় স্বার্থেই সাবধান থাকতে হবে। 

লোক-ঐতিহ্যর ভেতর থেকেই আমরা পয়লা বৈশাখ পেয়েছি। লোক বলতে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দিক্ষা অর্জন করেননি। এদের মধ্যেও অনেক বুদ্ধিমান লোক আছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করলেই মানুষ শিক্ষিত হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও দেশে অনেক লোক আছেন যারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝেন। তাদের মধ্য থেকেও আমরা পয়লা বৈশাখের ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই। একটা সময় যারা গ্রাম থেকে শহরে আসত, তারা পয়লা বৈশাখকে গ্রাম্যতা বলত। গ্রাম্যতা ছেড়ে শহুরে হওয়ার প্রবণতা পঞ্চাশের দশকেও ছিল। সেসব বিবেচনা করে জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং অতীতের ভালো দৃষ্টান্তগুলো আলোচনা করে আমরা উন্নত ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে আমাদের ঐতিহ্য তুলে ধরতে চাই। 

মানুষের জীবন এখন শুধু আনন্দ চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আনন্দ অবশ্য আছে, সেই সঙ্গে অনেক দুঃখ-কষ্টও রয়েছে। ফসলের উৎপাদন ও কারখানার উৎপাদন বাড়াতে হবে। শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের মতো সৃষ্টিশীলতা বাড়াতে হবে। 

এবার মঙ্গল শোভাযাত্রার নামেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। সবকিছুতেই জাতীয় চিন্তাচেতনা, বিচার-বিবেচনা করতে হবে। তবে পয়লা বৈশাখের মতো জাতীয় উৎসব শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের হাতে দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হয়নি। বেগম সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে অনেক বুদ্ধিজীবী পয়লা বৈশাখের সঙ্গে জড়িত। আগের দিনের পত্রিকা দেখলেও বোঝা যাবে যে, কারা পয়লা বৈশাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সাধারণ মানুষ যারা কম শিক্ষিত ও দরিদ্র তারা পয়লা বৈশাখের বর্তমান বিষয়গুলো মেনে নিতে পারেননি। চারুকলা ইনস্টিটিউট পয়লা বৈশাখের ব্যাপারটা জনগণকে বুঝিয়ে বলতে পারেনি। চারুকলা ইনস্টিটিউটের ডিনসহ শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাবোধ আছে। কিন্তু পয়লা বৈশাখের ব্যাপারটি নিয়ে তারা যেভাবে অগ্রসর হয়েছে সেটা ততটা শোভন ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য দেশবাসীকে বোঝাতে পারেনি। ভুল তো মানুষেরই হয়। অনেক সময় একটা জাতিরও  অনেক ভুল হয়। পয়লা বৈশাখের ব্যাপারটায় শুধু চারুকলা নয়, সরকারেরও ভূমিকা থাকা দরকার। সাধারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবে।

পয়লা বৈশাখ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে তা হয়ে ওঠেনি। যখন পাকিস্তান ছিল তখন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বাঙালি সংস্কৃতি চেয়েছি। পূর্ব বাংলার জাতীয়তাবাদ চেয়েছি। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে পয়লা বৈশাখ পালন একটা বড় আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। তখন পয়লা বৈশাখের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। তখন পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ছায়ানট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আগের দিনে গ্রামে পয়লা বৈশাখ পালিত হতো। তার পর শহরেও বৈশাখ পালিত হতে থাকে।

মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় পয়লা বৈশাখ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৯৭২ সাল থেকেই উচ্চশ্রেণির লোকেরা পয়লা বৈশাখ তাদের করে নেওয়ার চেষ্টা করে। পান্তাভাত খাওয়া কি পয়লা বৈশাখের ঐতিহ্য? পান্তাভাত গরিব মানুষ অভাবের জন্য খেত। অতীতে এগুলো খেলেও আজকের দিনে তা খাওয়া উচিত না। আজকের দিনে আমরা কেমন আছি এবং ভবিষ্যতে কেমন হতে চাই তা ভাবতে হবে। আমাদের অতীতে ভালোমন্দ কী ছিল তা জানতে। অতীত বর্তমানকে শিখিয়ে দেবে কী করতে হবে। মানুষের মন পরিবর্তন করার জন্য সবাইকে সদিচ্ছা নিয়ে কাজ করতে হবে।    

লেখক: বাংলা একাডেমির সভাপতি ও রাষ্ট্রচিন্তক