
আগামী ২৪ মার্চ বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। বাংলাদেশে যক্ষ্মা এখনো একটি বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যক্ষ্মা রোগী রয়েছে এমন ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। যক্ষ্মা একটি প্রতিরোধযোগ্য এবং সহজে সারিয়ে তোলা যায় এমন একটি রোগ। তবুও ২০২২ সালে করোনাভাইরাসের পরে দ্বিতীয় রোগ যার দ্বারা সর্বাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, সেটা হচ্ছে যক্ষ্মা। যক্ষ্মায় বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা এইচআইভি/এইডস-এ মৃত্যুর সংখ্যার দ্বিগুণ। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১ কোটির বেশি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়। জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব সদস্য রাষ্ট্র ২০৩০ সাল নাগাদ যক্ষ্মার মহামারি শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে, যার জন্য জরুরিভাবে কাজে নেমে পড়া দরকার।
যক্ষ্মা একটি বায়ুবাহিত রোগ। জীবাণুর নাম মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারক্যুলোসিস। যক্ষ্মায় আক্রান্ত মানুষের কাশি থেকে বায়ুতে যক্ষ্মা ছড়ায়। যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশের পরে দুই বছরের মধ্যে যক্ষ্মায় ভোগার সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে (মোটামুটি ৫ ভাগ)। এর পরে ঝুঁকি অনেক কমে যায়। যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশের পরও কেউ কেউ সংক্রমণকে পরাজিত করতে পারেন। যত মানুষ যক্ষ্মায় ভোগেন, তাদের ৯০ ভাগ পূর্ণ বয়স্ক। নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে যক্ষ্মা রোগী বেশি পাওয়া যায়। পৃথিবীর আনুমানিক এক-চতুর্থাংশ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়।
যক্ষ্মার লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অবিরাম কাশি, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা, জ্বর, রাতের বেলা ঘেমে যাওয়া। যদি চিকিৎসা না হয়, তবে এতে মৃত্যুও হতে পারে। যক্ষ্মা সাধারণতঃ ফুসফুসকে আক্রান্ত করে, তবে শরীরের অন্যান্য অংশও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যক্ষ্মা শনাক্তে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার ভালো উন্নতি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যক্ষ্মা শনাক্তের জন্য কতকগুলো রেপিড মলিকিউলার পরীক্ষা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন করেছে। এসব পরীক্ষা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মাকেও একই সঙ্গে শনাক্ত করতে পারে। এ ধরনের পরীক্ষা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে করা যেতে পারে। রোগী যখন চিকিৎসাকেন্দ্রে আসেন তখনই তার প্রশ্রাব নিয়ে লেটারাল ফ্লো পরীক্ষা করে যক্ষ্মা শনাক্ত করা যেতে পারে। এ পরীক্ষাটিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন করে। এ পরীক্ষার প্রধান ব্যবহার হচ্ছে গুরুতর এইচআইভি রোগীর যক্ষ্মা শনাক্তে। রেপিড মলিকিউলার পরীক্ষার সঙ্গে এটিও পরীক্ষা করা হয়। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে এখনো মাইক্রোস্কোপে থুতু পরীক্ষা করে যক্ষ্মা শনাক্ত করা হয়। এ পরীক্ষাটি ১০০ বছরেরও আগে আবিষ্কৃত হয়েছিল। তবে দ্রুত হারে এ পরীক্ষার বদলে এখন রেপিড পরীক্ষা চালু হচ্ছে। যক্ষ্মা শনাক্তের জন্য কালচার পরীক্ষা হচ্ছে আদর্শ পদ্ধতি। তবে যক্ষ্মা শনাক্তের পর তার চিকিৎসায় অগ্রগতি হচ্ছে কি না তা জানার জন্য কালচার বা থুতু পরীক্ষা করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে যক্ষ্মার প্রকোপ কতটুকু সেটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর আগে বৈজ্ঞানিক অনুমান করে বের করত। এ দেশে যক্ষ্মার প্রথম জাতীয়ভিত্তিক জরিপ হয় ২০১৫-১৬ সালে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কারিগরি সহায়তায় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এ জরিপ পরিচালনা করে। আমি এ জরিপ কর্মের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলাম। প্রধান অনুসন্ধানকারী ছিলেন আইইডিসিআর-এর তৎকালীন পরিচালক প্রফেসর ডা. মাহমুদুর রহমান।
এ জরিপের লক্ষ্য ছিল মাইকোব্যাকটেরিয়ম টিউবারকুলোসিস (যক্ষ্মার ব্যাকটেরিয়া) দ্বারা সংক্রমিত রোগের বিস্তার ভালোভাবে বোঝা এবং বাংলাদেশে যক্ষ্মানিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম আরও উন্নত করার উপায় বের করা। উদ্দেশ্য ছিল: (ক) ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী মানুষের মাঝে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় (কালচার জিনএক্সপার্ট অথবা রিফামপিসিন সংবেনশীল) নিশ্চিত হওয়া ফুসফুসের যক্ষ্মা রোগীর ব্যাপকতা (প্রিভ্যালেন্স) পরিমাপ করা; (খ) ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী মানুষের মাঝে ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া রোগীদের মাঝে থুতু পরীক্ষায় শনাক্ত যক্ষ্মা রোগীদের ব্যাপকতা পরিমাপ করা; (গ) লক্ষণ দেখে অনুমান করা যক্ষ্মা রোগীদের ব্যাপকতা পরিমাপ করা।
জরিপটি প্রস্থচ্ছেদ নকশা (ক্রসসেকশনাল ডিজাইন) অনুসরণ করেছে। নমুনার আকার হিসাব করা হয়েছিল ১ লাখ মানুষ। আকারের সমানুপাতিক সম্ভাবনা (প্রোব্যাবিলিটি প্রোপোরশনালিটি টু সাইজ) সূত্র ব্যবহার করে ১২৫টি গুচ্ছকে শহর অঞ্চলে ৪৬টি এবং গ্রামাঞ্চলে ৭৯টি গুচ্ছ (ক্লাস্টার) বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গুচ্ছে ৮০০ জন মানুষকে জরিপের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হয়। গ্রামাঞ্চলে একটা ইউনিয়নকে প্রাথমিক নমুনা একক (প্রাইমারি স্যাম্পল ইউনিট) হিসেবে ধরা হয়, অনুরূপভাবে শহরাঞ্চলে একটা ওয়ার্ডকে প্রাথমিক নমুনা একক ধরা হয়। গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রতিজনকে যক্ষ্মার লক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় ও তার বুকের এক্স-রে করা হয়। যাদের লক্ষণ অথবা অস্বাভাবিক এক্স-রে দ্বারা যক্ষ্মা সন্দেহ করা হয়েছে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে থুতু দিতে বলা হয়েছে ল্যাবরেটরি পরীক্ষার জন্য। তাদের পরদিন সকালেও থুতু দিতে বলা হয়েছে। এ থুতু জাতীয় যক্ষ্মা রেফারেন্স ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা, কালচার ও জিনএক্সপার্ট/ রিপামপিসিন সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করা হয়েছে। বুকের এক্স-রে কেন্দ্রীয় রেডিওলজিস্টরাও পর্যালোচনা করেছেন।
একটি কেন্দ্রীয় বিশেষজ্ঞ দল যক্ষ্মার লক্ষণ বাছাই ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষার ফলাফল, কালচার ও জিনএক্সপার্ট/ রিফামপিসিন পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করে জরিপে অংশ নেওয়া মানুষের জরিপের সংজ্ঞা অনুযায়ী শ্রেণিবদ্ধ করেছেন।
অংশগ্রহণকারীদের মাঝে ১৯,০৫৮ (১৯.৩ ভাগ) ছিলেন ধূমপায়ী। নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে যক্ষ্মায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি পাওয়া গেছে। যত বয়স বেশি তত বেশি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি দেখা গেছে। যাদের বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি তাদের মধ্যে যক্ষ্মার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। গ্রামাঞ্চলের চাইতে শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে যক্ষ্মার ঝুঁকি বেশি পাওয়া গেছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তার বেশি বয়সী প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ২৬০ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত। সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে অনুমিত হয় যে, প্রতি বছর প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ২২১ জন নতুন করে (ইনসিডেন্স) যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। আরও হিসাব করে দেখা গেছে যে, যতজন মানুষ যক্ষ্মা রোগী বলে স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে প্রজ্ঞাপিত (নোটিফিকেশন) হয়েছেন, যক্ষ্মা রোগীর ব্যাপকতা (প্রিভ্যালেন্স) তার চেয়ে ২.৮ গুণ। অর্থাৎ সব বয়সী যক্ষ্মা রোগীর অর্ধেকেরও বেশি শনাক্তের বাইরে থাকেন। পঁয়ষট্টি বছর বা তার বেশি বয়সী রোগীদের মাঝে এ হার অনেক বেশি, ৪.৩ গুণ। এ জরিপ হয়েছে প্রায় ১০ বছর হয়ে গেছে। নতুন আর একটি জাতীয়ভিত্তিক জরিপের সময় হয়েছে। গত জরিপের ফলাফল এবং অভিজ্ঞতা নতুন জরিপের সময় বিবেচনায় নিতে হবে।
বাংলাদেশে যক্ষ্মার উচ্চ হারের জন্য কতকগুলো কারণকে দায়ী করা যেতে পারে। (১) দেরি করে চিকিৎসা নেওয়া; (২) হাতুড়ে চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া: (৩) সচেতনতার ঘাটতি। সরকার বিনামূল্যে ডটস কর্মসূচির মাধ্যমে যক্ষ্মার ওষুধ দিয়ে থাকে, এটা অনেক মানুষ জানেন না; (৪) দারিদ্র্য।
যক্ষ্মার জন্য যে বিসিজি টিকা আছে, সেটা আবিষ্কার হয়েছিল ১৯২১ সালে। এটা নবজাতক শিশুকে দেওয়া হয়। এরপ আর কোনো নতুন উন্নত টিকা আবিষ্কৃত হয়নি, যদিও যক্ষ্মা পৃথিবীর অন্যতম একটি মরণব্যাধি। এ টিকা শিশুদের মাঝে টিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ জোগায়, কিন্তু বয়স যত বাড়ে তত এর প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। তাই নতুন আরও উন্নত টিকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
একটি নতুন যক্ষ্মার টিকা এম৭২/এএস০১ই-এর তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হতে যাচ্ছে। জিএসকে বায়োফার্মা কোম্পানি প্রথম এ টিকা প্রস্তুত করেছিল। বয়োসন্ধি ও পূর্ণ বয়স্ক মানুষ যারা সুপ্ত যক্ষ্মায় (ল্যাটেন্ট টিবি) আক্রান্ত তারা এ টিকা থেকে যক্ষ্মা প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করবেন। বাংলাদেশের মতো যেসব দেশে যক্ষ্মা সংক্রমণের উচ্চহার, সেখানে প্রচুর মানুষের মধ্যে সুপ্ত যক্ষ্মা রয়েছে। যাদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে, দেহে সুপ্ত যক্ষ্মা থাকলেও তারা সাধারণতঃ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন না।
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে নিজের দেশকে প্রত্যাহার করে সব চাঁদা বন্ধ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া ইউএসএআইডির সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন, এবং এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যক্ষ্মা, এইচআইভ/এইডসসহ বিভিন্ন জরুরি স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ বাংলাদেশেও প্রভাব ফেলবে, বিশেষ করে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের কার্যকলাপে। এর ফলে যক্ষ্মাজনিত মৃতুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যেতে পারে।
তবে বাংলাদেশ এত দরিদ্র নয়। আমরা কয়েক বছরের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছি। দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করা দেশের সম্পদ দিয়েই সম্ভব। দরকার শুধু অগ্রাধিকার নির্ণয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর কার্যকরী পরিষদ সদস্য
[email protected]