অপরাধের ধরন, অপরাধীর মনস্তত্ত্ব, অপরাধের কার্যকারণ, অপরাধী শনাক্তকরণ, অপরাধের ফলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব, অপরাধ প্রতিকারে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যবহার, অপরাধ প্রতিরোধে পরিবেশগত কৌশল, অপরাধীদের সংশোধন, বিচার ব্যবস্থাপনা প্রভূত বিষয়ে অপরাধবিজ্ঞানে পাঠদান করানো হয়। এ ছাড়া পুলিশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, পুলিশের নিয়োগপ্রক্রিয়া, পুলিশের বিভিন্ন উইং ও ব্র্যাঞ্চের কার্যক্রম, দেশে-বিদেশে প্রচলিত পুলিশের নানাবিধ স্টাইল তথা পদ্ধতি, পুলিশের বিচক্ষণতা, পুলিশ তদন্ত, তদন্তে ফরেনসিকের ব্যবহার, পুলিশের এথিকস, পুলিশের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুলিশিংয়ে প্রচলিত মডেল প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
এ ছাড়া বিচারিক কার্যক্রমে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রোবেশন, প্যারোল, বিকল্প উপায়ে বিরোধ নিষ্পত্তি, ভিলেজ কোর্ট, জুভেনাল কোর্ট, শিশু আইন, কিশোর সংশোধন কেন্দ্র, কারাগার ও শাস্তি পরিচালনা বিদ্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত পাঠদান করা হয় শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া বিশেষায়িত ডিসিপ্লিন হিসেবে সন্ত্রাসবাদ, অর্গানাইজড ক্রাইম, ট্রাফিকিং, এনভায়রনমেন্টাল ক্রাইম, গ্রিন ক্রিমিনোলজি, গ্লোবাল ক্রাইম অ্যান্ড জাস্টিস, মানবাধিকার প্রভূত বিষয়ে সার্বিক ধারণা প্রদানের উদ্দেশ্যে বিভাগটি বাংলাদেশে চালু হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মূল কাজই হচ্ছে তত্ত্বীয় জ্ঞানের পঠন-পাঠনের পাশাপাশি গবেষণাভিত্তিক জ্ঞান সৃজন ও বিতরণ। তুলনামূলক নতুন ও সমসাময়িক ডিসিপ্লিন হিসেবে এ বিভাগের পঠিত বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। মৌলিক কনসেপ্ট ও মেথডোলজি থাকায় ডিসিপ্লিনটির বিষয়ভিত্তিক গবেষণার সুযোগ রয়েছে। রিসার্চ মেথডলজি নিয়ে বিস্তর পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে বিভাগটিতে এবং এর পাশাপাশি রিসার্চে ব্যবহার করার জন্য পরিসংখ্যানিক টুলস নিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়।
গবেষণা তথ্য সংগ্রহের লক্ষ্যে তথ্যদাতার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের কৌশল, ডেটা কোডিং ও ডেটা এনালাইসিসে প্রয়োজনীয় কৌশল শিক্ষার্থীদের রপ্ত করানোর কার্যাক্রম সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রচলিত বিধি, নিয়ম-কানুন ও জুরিসপ্রুডেন্স, পেনাল কোড-১৮৬০, ক্রিমিনাল ল অ্যান্ড প্রসিডিউর-১৮৯৮, ইভিডেন্স অ্যাক্ট-১৮৭২, পুলিশ অ্যাক্ট-১৮৬১, পুলিশ রেজুলেশন অব বেঙ্গল-১৯৪৩, চিলড্রেন অ্যাক্ট-২০১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, আন্তর্জাতিক আইন, কনভেনশন, ট্রিটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হয়।
ডিসিপ্লিনটিতে মৌলিক গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে, বিশেষ করে অপরাধের কার্যকারণ নির্ণয়ে ব্যাপকতর ও সমসাময়িক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে বিভাগের শিক্ষার্থীদের পক্ষে সত্যিকারের অপরাধীদের খুঁজে বের করার উপায় ও কৌশল নির্ধারণ করা সহজতর হয়েছে। অপরাধীদের মটিভ ও অ্যাকশন বুঝে অপরাধ প্রতিকার ও প্রতিরোধের নানাবিধ কৌশল উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে।
অধিকন্তু রিপোর্টেড ক্রাইম ও আন-রিপোর্টেড ক্রাইমের বহুমাত্রিক পার্থক্যের বাস্তবতার নিরিখে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের মৌলিক জ্ঞানের ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নিরাপত্তাব্যবস্থাকে জোরদারের জন্য অপরাধ প্রতিরোধের ডিজাইনগুলো নিয়ে কাজ করার উপায় উদ্ভাবন হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ফিল্ড ট্যুরের মাধ্যমে হাতে-কলমে শিক্ষাদানের উদ্যোগও গৃহীত হয়েছে।
সমসাময়িক সৃষ্ট সমস্যাগুলো নিয়ে গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কৌশল উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। সাইবার অপরাধ ও সাইবার অপরাধীদের শনাক্তকরণে বিভাগের শিক্ষার্থীদের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান কার্যকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ-সংক্রান্তে শিক্ষার্থীদের গবেষণাকর্ম সম্পাদিত হয়েছে।
কম্পিউটার ব্যবহারের মধ্যদিয়ে কিশোর-কিশেীরারা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। সঙ্গদোষে কিশোররা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনাবিমুখ হয়ে উঠছে, স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে, মাদকাসক্ত হয়ে উঠছে- প্রভূত বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক নতুন তত্ত্ব তৈরির প্রয়াস সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তত্ত্ব প্রায়োগিকভাবে কতটুকু কার্যকর সে ব্যাপারে যাচাই-বাছাই ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে তথা গবেষণার ফলাফলকে বাস্তবে প্রয়োগের মাধ্যমে।
অপরাধবিজ্ঞান পাঠে পুলিশিং ব্যবস্থাপনায় পুলিশের বিভিন্ন স্টাইল ও পদক্ষেপ ব্যবহার করার কৌশল সম্পর্কে জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক সৃষ্টির কৌশল ও পরস্পরের পরস্পরের প্রতি আস্থা সৃষ্টির অভিনব বিষয়াদি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো হয়। পুলিশের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিতে কর্মকৌশল প্রণয়নেও শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। বিভিন্ন দেশের পুলিশিং মডেল বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল করার পথ উত্থাপিত হয়েছে। কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে ক্রিয়াশীল করতে বিভাগের শিক্ষার্থীদের অগ্রণী ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। জনগণের কাছ থেকে সমস্যা জানার কৌশল ও জনগণের ইচ্ছানুযায়ী পুলিশিং কার্যক্রম পরিচালনার উপায়ও উন্মুক্ত করা হয়েছে পাঠ্যক্রমে।
অপরাধকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মূল্যায়নের জন্য তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত জরুরি। বাস্তবতার মিশেলে তত্ত্ব কতটুকু প্রয়োগ করা যায় কিংবা তত্ত্ব কি আদৌ প্রয়োগযোগ্য সে ব্যাপারটিও যাচাই-বাছাই তথা মূল্যায়নের জন্য তত্ত্বীয় জ্ঞান একজন গবেষককে সঠিক জ্ঞান বোঝার সুযোগের পাশাপাশি ভবিষ্যতের একটি রূপরেখা প্রণয়নে সহযোগিতা করতে পারে। তত্ত্বকে প্রায়োগিকভাবে ব্যবহারের কৌশল পদ্ধতির পাশাপাশি তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন জ্ঞান আহরণে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করে থাকে। কল্যাণকর রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগানোর সুযোগ গ্রহণ করতে পারে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে নিরাপদ ও উত্তম পরিবেশ তৈরিতে এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের অগ্রণী ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদ্যোগটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে।
এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার অবারিত সুযোগ রয়েছে পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। ইতোমধ্যে এ বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা পৃথিবীর প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে অধ্যয়ন করছেন। অনেকেই ডিগ্রি শেষ করে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত রয়েছেন। বাংলাদেশে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান করানো হয়। বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান পুলিশ স্টাফ কলেজ বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রফেশনাল মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া ডিসিপ্লিনের গুরুত্ব অনুধাবন করে অনেক ডিসিপ্লিনে ১০০ নম্বরের অপরাধববিজ্ঞান কোর্স সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বিশেষ করে অপরাধের হার, ঋতুভিত্তিক অপরাধের ধরন, সমতল অঞ্চলের অপরাধ, পাহাড়ি অঞ্চলের অপরাধ, হোয়াইট কালার ক্রাইম, ব্লু কলার ক্রাইম, অর্গানাইজড ক্রাইম প্রভৃতি বিষয় সম্বন্ধে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানার্জনের জন্য অপরাধবিজ্ঞান পাঠ অত্যাবশ্যকীয়। সংশ্লিষ্ট অপরাধগুলো নিয়ে সরকারের পলিসি লেভেলে নীতি প্রণয়নে অপরাধবিজ্ঞানীদের গবেষণা জ্ঞানের যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারের ব্যাপক নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে।
এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা পাস করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সব সেক্টরে কাজ করে যাচ্ছে। বেসরকারি সেক্টরেও এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। বেসরকারি পর্যায়ে বিশেষ করে গবেষণাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে বিভাগের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, ব্র্যাক, আইন ও সালিশকেন্দ্র, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি, ব্লাস্ট, নাগরিক উদ্যোগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যোগদান করছেন পাস করা শিক্ষার্থীরা। জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ইউএনডিপি, কেয়ার, ইউএসএইড, অ্যাকশন এইডসহ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসেবে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা চাকরি করছে। গণমাধ্যমেও এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানে তদন্ত বিভাগের দায়িত্বে দীর্ঘদিন ধরে এ বিভাগের শিক্ষার্থীদের সুনাম ও গৌরব চোখে পড়ার মতো। এ ছাড়া বিভাগের শিক্ষার্থীদের গবেষণাকর্ম পৃথিবীর নামকরা জার্নাল ও প্রকাশনা হাউস থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, এ ব্যাপারটি পঠন-পাঠনের অন্যতম স্বীকৃতি।
বাংলাদেশ পুলিশ পরিচালিত গবেষণায় এ বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন। কাজেই বিভাগটির পঠন-পাঠনের গ্রহণযোগ্যতা ও কর্মস্বীকৃতি বিশদ আকারে পরিচিতি পেয়েছে। বিভাগটির স্বতন্ত্র কার্যক্রম আরও বেগবান ও মৌলিকত্ব পাবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে। বিশেষ করে সরকারের যেসব ইউনিট ও প্রতিষ্ঠান সরাসরি আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত, মানবাধিকার সংগঠন তথাপি ইন্টেলিজেন্সি উইংয়ে অপরাধবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ দিলে দেশ ও জাতি ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে এবং মেধাবীরা পছন্দের ডিসিপ্লিন হিসেবে অপরাধবিজ্ঞান পাঠে আগ্রহী ও উৎসুকপ্রবণ হয়ে উঠবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]