যারা সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর, যাদের ওপর দেশগঠনেরও ভার, প্রকাশ্যে তাদের ওপর পুলিশ নির্মমভাবে লাঠি চালাচ্ছে, পেটে লাথি মারছে, বাংলার মানুষকে এমন দৃশ্যও দেখতে হলো রাজ্য সরকার ও তাদের পুলিশ বাহিনীর সৌজন্যে। এই নির্মমতা কি চাকরিহারা শিক্ষকরা প্রশ্ন তুলছেন বলে কেবল তাদের ওপর আক্রোশ, নাকি শিক্ষাকেই মেরে হটিয়ে দেওয়ার জন্য এ বর্বরতা?...
‘কর্ম শেষে নববর্ষে বাবু ঘরে আসে। হাতে মিষ্টি, এসেন্স শিশি আর পাঁজি পাশে।’ এককালে এই ছড়াটি এপার বাংলায় খুব প্রচলিত ছিল। গ্রাম মফস্বল থেকে অনেকেই চাকরি বা রোজগারের জন্য কলকাতায় আসতেন, থাকতেনও। ছুটিছাঁটায় বাড়ি ফিরতেন সংসারের খুঁটিনাটি সামগ্রী কিনে নিয়ে। কিন্তু বছর শেষে বাঙালি বাবুটি যখন বাড়ি ফিরতেন তখন নতুন বছরের উপহার হিসেবে যাই কিনুন না কেন ভুলতেন না একটি পাঁজি কেনার কথা। গৃহিণী ছাড়াও কাকিমা, পিসিমাদের অমাবস্যা, পূর্ণিমা, একাদশী তো বটেই, তাছাড়া অন্য অনেক তিথি-ক্ষণ মনে রাখতে হতো তাদের।
পঞ্জিকা ছাড়া আর কেই-বা তাদের সেসব মনে করাতে পারে। কেবল কি তাই, কবে কখন যাত্রা করলে নির্বাঞ্ঝাট হবে, সদর আদালতের মামলার শুভক্ষণের খবর তো পঞ্জিকাতেই মিলবে। এমনকি বাতের ব্যথা হঠাৎ বাড়ল কেন, সামনে কি অমাবস্যা কিংবা পূর্ণিমা? চট করে কুলুঙ্গি থেকে পাঁজিটা নামিয়ে চোখ বুলানোই ছিল রীতি। যেন পঞ্জিকাই বদ্যির বিধান আবার অভিভাবকও বটে। অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ে, বাড়িতে নতুন অতিথির আগমন থেকে গৃহপ্রবেশ- সবকিছুরই তো একটি শুভদিন চাই, সেই শুভ দিনটির হদিশ পাঁজি ছাড়া আর কে দিতে পারে?
মুদ্রিত আকারে বাংলা পঞ্জিকা প্রকাশের বয়স প্রায় ২০০ বছর। দু-এক বছর কম বেশি হতে পারে। বয়স যাই হোক কালের পরিক্রমায় বাঙালির অতীত ঐতিহ্যের মধ্যে যে কটি বিষয় এখনো টিকে আছে, অবশ্যই পঞ্জিকা তার মধ্যে অন্যতম একটি। নতুন বাংলা বছরের শুরুতে বাঙালি এখনো পঞ্জিকা কেনার জন্য ব্যস্ত হয়, পুরোনো বছর ফুরিয়ে আসতেই তার জন্য তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। কেউ একথা বলতেই পারেন যে, পঞ্জিকা তো বোঝাই করা কুসংস্কার আর অচল রীতিনীতির একত্রবাস। যদি তাই হয়, তবু বলতে হবে সেই পঞ্জিকা যে বাঙালির সামাজিক ইতিহাসের একটি বিরাট দর্পণ।
সেই পঞ্জিকা হিসেবে ১৪৩১ পার করে ১৪৩২-এ পা দিয়েছে। নতুন বাংলা বছরের শুরুতেই পশ্চিম বাংলা এবং ভারতে দুটি ঘোরতর ‘অমঙ্গল’ ঘটে গেছে। বিদেশি প্রবচন বলে, দিনের শুরুটা দেখলেই বোঝা যায় বাকি দিনটা কেমন যাবে। তাই বছরের শুরুতেই সিঁদুরে মেঘ দেখছে এপার বাংলার মানুষ।
দেশের শীর্ষ আদালতের একটি রায়ে গোটা বাংলায় আজ অন্ধকার নেমে এসেছে, বিপন্ন বোধ করছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বস্তরের মানুষ। কারণ, আদালত ২০১৬ সালের এসএসসির গোটা প্যানেল বাতিল করায় ২৫ হাজার ৭৫৩ শিক্ষক তাদের চাকরি হারিয়েছেন। তার জেরে চাকরিহারাদের পরিবারগুলো যে পথে এসে দাঁড়িয়েছে, সে কথা বলাই বাহুল্য। রাজ্যের চারপাশে প্রতিদিন যা ঘটছে তাতে রাজ্যবাসী আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যারা সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর, যাদের ওপর দেশগঠনেরও ভার, প্রকাশ্যে তাদের ওপর পুলিশ নির্মমভাবে লাঠি চালাচ্ছে, পেটে লাথি মারছে, বাংলার মানুষকে এমন দৃশ্যও দেখতে হলো রাজ্য সরকার ও তাদের পুলিশ বাহিনীর সৌজন্যে। এই নির্মমতা কি চাকরিহারা শিক্ষকরা প্রশ্ন তুলছেন বলে কেবল তাদের ওপর আক্রোশ, নাকি শিক্ষাকেই মেরে হটিয়ে দেওয়ার জন্য এ বর্বরতা?
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নেতাজি ইনডোরে সভা ডেকে চাকরিহারাদের আশ্বস্ত হতে বলেছেন।
তিনি এই বলেও আশ্বাস দিয়েছেন যে, যোগ্যদের চাকরি যাবে না। যদিও তার কথায় মোটেও ভরসা রাখতে পারেননি সদ্য চাকরিহারারা। কারণ তিনি যাদের সমস্যার সমাধান করবেন বলে ডেকে এনেছেন তাদের কোনো কথা না শুনে একতরফা কথা বলেছেন। অন্যদিকে, চাকরিহারারা ডিআই অফিসে তাদের দাবি নিয়ে অভিযান করলে পুলিশ প্রকাশ্যে লাঠি আর লাথি দিয়ে শিক্ষকদের ওপর বর্বরতার জঘন্যতম নিদর্শন স্থাপন করে। অথচ মজার ব্যাপার হলো এই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের নেপথ্য কারিগররা যারা, তারা চুরি-জোচ্চুরি-চিটিংবাজি এবং ঘুষের মতো অন্যায়-অপরাধের পরও কোনো শাস্তি ছাড়াই বহাল তবিয়তে আছেন। তারা শিক্ষক নিয়োগে লাগামহীন দুর্নীতি করার জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে লাভবান হয়েছেন। অথচ তাদের ওপর কোনো আঘাত নেমে এল না। তারা এই বিপর্যয় থেকে অনায়াসেই রেহাই পেয়ে গেলেন।
যদিও বা তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই অতি স্বল্প সংখ্যককে দোষী চিহ্নিত করতে পেরেছে কিন্তু বড় অংশটাই প্রমাণ অভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েও স্বচ্ছন্দেই বিরাজ করছে। তাহলে যোগ্যদের চাকরিহারা হওয়া এবং তাদের দুর্ভোগের দায় কাদের?
ওএমআর শিট নষ্ট করা এবং সেগুলোর মিরর ইমেজ সংরক্ষণ না করার অভিযোগে বিদ্ধ এসএসসিও দায় নিতে নারাজ। এদিকে মমতা সরকার কথায় কথায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে টেনে আনছে। কেন বারবার বিরোধীদের দিকে আঙুল উঠছে, কেন বিজেপি, সিপিএম প্রসঙ্গ টেনে আনা হচ্ছে। এরা কেউই তো নিয়োগপ্রক্রিয়ার ধারেকাছে নেই। নিয়োগ তো করেছিল সরকার, যার মাথায় মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, এসএসসি। অতএব, ২৬ হাজার চাকরিহারা হওয়ার জন্য বিরোধীরা কেন, যা কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি, অন্যায়-অপরাধ এবং দুর্নীতি সব কলঙ্কের বোঝা রয়েছে রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রীর মাথায়। অথচ এই জটিল এবং ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে যাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না, সেই যথার্থ মেধাসম্পন্ন শিক্ষকদের ঘাড়ে চরম শাস্তির খাঁড়া নেমে আসার পরও যখন তাদের ওপর পুলিশের লাঠির আঘাত এবং শিকক্ষকদের পুলিশের লাথি সহ্য করতে হয়, তার পরও কারও কণ্ঠে অনুশোচনার লেশমাত্র তো দূরের কথা, কেউ কেউ শিক্ষকদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
একথা অনেকদিন আগেই স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, যোগ্য শিক্ষকদের এই পরিণতির জন্য দায়ী মূলত নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই বঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন, তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত রাজ্য সরকার এবং তাদের দালাল চক্র। এমন নয় যে, এই সাংঘাতিক ঘটনা অজান্তে বা অসাবধানতাবশত হওয়া ভুল, বরং এটি একটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং সংগঠিত দুর্নীতি, যার মধ্যে সরকার থেকে প্রশাসন এবং কমিশন থেকে বড়-মেজো-ছোট তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীরা বেশ ভালোভাবেই যুক্ত এবং এই প্রক্রিয়ায় কয়েক শ কোটি টাকা অবৈধভাবে লেনদেন হয়েছে।
রাজ্য সরকার সে কারণেই শুরু থেকে বিষয়টিকে চেপে দিতে এবং ঘেঁটে দিতে অতিরিক্ত তৎপরতা দেখিয়েছে, তাদের কুরুচিকর আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি শিক্ষক থেকে শুরু করে কেউই। কিন্তু কেন এসব? কারণ নিজেদের জঘন্যতম অপরাধকে ঢাকার চেষ্টা, চুরি-ঘুষকে অন্য পথে চালিত করার চেষ্টা ইত্যাদি। লক্ষ্যণীয়, শিক্ষকদের ডিআই অফিস অভিযানে সরকারের যে পুলিশবাহিনীকে আমরা লাঠি চালাতে দেখলাম, প্যান্ট-টিশার্ট এবং হেলমেট পরা এরা কারা? এদের পরিচয় নিশ্চয় কলকাতা পুলিশ নয়, তাহলে? এরা রাজ্য সরকারের ঠ্যাঙারে বাহিনী, পয়সা দিয়ে যাদের লেলিয়ে দিয়ে সরকার ন্যায্য দাবিকে দাবিয়ে দেওয়া বা দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
চাকরিহারারা বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী কেন বারবার বিরোধীদের দিকে আঙুল তুলছেন, কেন তিনি বিজেপি, সিপিএম প্রসঙ্গ টেনে আনছেন? নিয়োগ তো করেছিল তার সরকার, তার শিক্ষামন্ত্রী, এসএসসি এবং এই সবগুলোরই মাথায় ছিলেন তিনি। অতএব, ২৬ হাজার চাকরিহারা হওয়ার জন্য বিরোধিরা নয়, যা কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি, অন্যায়-অপরাধ এবং দুর্নীতি সব কলঙ্কের বোঝা রয়েছে তার মাথায়। তার উচিত ছিল, নতমস্তকে সব দলকে ডেকে সর্বদলীয় বৈঠক করা।
সমাধানের উপায় খোঁজা। তা না করে তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছেন, দায় এড়াতে চাইছেন, চাকরিহারাদের কোনো কথা না শুনেই একা কথা বলে চলে গেলেন। তাছাড়া এদিন মুখ্যমন্ত্রী চাকরিহারা শিক্ষিকাদের ভলান্টারি সার্ভিস দিতে বলছেন। এর মানে দাঁড়ায় এতদিন ধরে যারা পড়াশোনা করলেন মুখ্যমন্ত্রী কি তাদের সিভিক টিচার করতে চাইছেন? তিনি আশ্বাস দিয়েছেন দুই মাসের মধ্যে যোগ্যদের জন্য ব্যবস্থা করবেন। প্রশ্ন- মুখ্যমন্ত্রী যে স্বেচ্ছায় কাজ করার পারমর্শ দিলেন, কাজ করলেও তারা কি বেতন পাবেন? আসলে মুখ্যমন্ত্রীকে দুর্নীতি ঢাকতে হবে, তিনি যোগ্যদের চাকরি সসম্মানে ফেরত দিতে পারবেন না। তাই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে কেউ কেউ আশ্বস্ত হলেও বেশির ভাগই বিভ্রান্ত।
এই মামলায় আদালত এসএসসিকে যোগ্য এবং অযোগ্যদের তালিকা জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু সেই তালিকা জমা দেওয়া হয়নি। উল্টে পুড়িয়ে দেওয়া হয় ওএমআর শিট। শিক্ষা আন্দোলনের সব ক্ষেত্র থেকেই যোগ্য এবং অযোগ্য কারা, তা বাছাই করে আদালতে রিপোর্ট জমা দেওয়ার দাবি তুলেছিল। যাতে যোগ্যদের চাকরি না যায়। কিন্তু রাজ্য সরকার সে সময় সম্পূর্ণ নীরব থেকেছে। সে তালিকা যদি আদালতের কাছে জমা পড়ত তবে আর যোগ্য চাকরি প্রার্থীদের চাকরি যেত না। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন অযোগ্য প্রমাণ হলে তার কিছু করার থাকবে না।
কিন্তু সবাই জানেন যে, তার দলেরই নেতা-মন্ত্রীরা টাকা নিয়ে চাকরি বিক্রি করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনোদিনই একবারের জন্য সেসব ঘুষখোর, তোলাবাজ দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-মন্ত্রীদের কিচ্ছু বলেননি। এমনকি এদিনও যারা দোষী-অপরাধী তাদের কোনোভাবে তিরস্কার করলেন না। উল্টো তার হাবভাব যেন কিছুই হয়নি। তার এই আচরণ প্রমাণ করে দেয় তিনি দুর্নীতির পক্ষে এবং তাকে সমর্থন করেন। তাই দুর্নীতি ঢাকতেই তিনি চাকরিহারাদের ললিপপ খাওয়ানোর চেষ্টা করলেন।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক