
দেশের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবী, চিন্তাশীল ব্যক্তি, লেখক, গবেষক এবং রাজনীতিবিদ দীর্ঘদিন ধরে সমস্বরে একটি কথা বলে আসছেন। তা হলো এই যে, আমাদের দেশে নাকি বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই দেশে অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে বিচারহীনতাই যদি মূল কথা হতো তাহলে ৬৪টি জেলা কারাগার এবং কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রতি রাতে দু-তিনজন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতো না। প্রতিদিন আদালতের রায়ে নানা মেয়াদের কারাদণ্ড কিংবা অর্থদণ্ড হতো না। প্রতিদিন সারা দেশে গড়ে সাড়ে ৪০০টির মতো নতুন মামলা দায়ের হতো না। হাজার বিচারপ্রার্থী ফিরে পেতেন না তার জমির ওপর বিতর্কিত অধিকার, চাকরি, পদোন্নতি, সিলেকশন গ্রেড বা বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত। দুই যানবাহনের ফাঁকে পড়ে অঙ্গ হারানো কোনো বিচারপ্রার্থী লাভ করতেন না ৮০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের চেক।
থানার ভেতর সন্দেহভাজনকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে খুন করে ফেলার অপরাধে ১৪ বছরের দণ্ড কার্যকর হতো না একাধিক পুলিশ কর্মচারীর ওপর।রাজনৈতিক গণ্ডগোলে প্রতিপক্ষকে খুন করার অপরাধে প্রতিরক্ষাবাহিনীর উঁচু পদের কর্মচারীর মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হতো না। ২৬ বছর পর হলেও সগিরা মোর্শেদের হত্যাকারীর চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত হতো না। খোরপোষ বা বিয়ের ক্ষতিপূরণের আদেশ পেতেন না দেশের হাজার হাজার অসহায় নারী। বছরে অন্তত কয়েক শ সরকারি কর্মচারী সরকার বনাম তাদের মামলায় শতকরা ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে তাদের চাকরিসংক্রান্ত জটিলতার অনুকূল রায় পেতে পারতেন না। সম্ভ্রমহারা কিছু সংখ্যক হলেও গ্রামবাংলার প্রান্তিক নারী আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেতেন না। এখন কথা হলো যারা বিচার করেন সেই বিচারকের সংখ্যা এ দেশে ১ হাজার ৭০০।
এ কাজে সহায়তা করতে পারেন এমন সাধারণ উকিল থেকে বিদেশে পাস করা ব্যারিস্টারের সংখ্যা ৯২ হাজার। অন্যদিকে দেশে চলমান বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৪২ লাখ। প্রতিদিন নিষ্পন্ন হওয়ার পরও বছরে দায়েরকৃত মামলা নিয়ে এ সংখ্যা ২-৩ লাখ করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, এ মামলা রাজনৈতিক মামলার সংখ্যার বাইরে। এ মামলার উপজীব্য কী? প্রধানত ভূমির অধিকারসংক্রান্ত দেওয়ানি এবং ক্ষেত্রবিশেষে সীমানা প্রতিষ্ঠা করাজনিত বিবাদ থেকে উদ্ভুত ফৌজদারি মামলা। এ মামলা শতকরা ৯০ ভাগ। বাকি ১০ ভাগ পাওনা অর্থ আদায়, নারী নির্যাতন, খুন ও গুম, মাছ ধরার বিবাদ, পুলিশের গুলিতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, চাকরি ফেরত, সড়ক দুর্ঘটনা, বিতর্কিত কর আদায়, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি ইত্যাদি। বিচারকপ্রতি গড়ে বিচার্য মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৪৭০।
যেকোনো কর্মদিবসে প্রতিটি সহকারী জজ থেকে শুরু করে জেলা জজের পক্ষে তিনটির বেশি মামলার শুনানি গ্রহণ করা অসম্ভব। আর যদি এই কর্মদিবসে কোনো মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারিত থাকে তাহলে সেটির অংশবিশেষ পাঠ করে শোনানোর পর বিচারকের পক্ষে আর কোনো কাজ করার সময় থাকে না। ওই একই দিনে গড়ে আরও সাতটি নতুন মামলা দায়েরের ফলে তার গড় বিচার্য মামলার সংখ্যা প্রতিদিনই বৃদ্ধি পেতে থাকে। থানায় অসাধারণ মামলা জটের কারণে পুলিশ প্রায়ই মামলা নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে আদালত সাধারণত এ মামলা গ্রহণের আদেশ দেন। পুলিশকে তখনই এ মামলাটি লিপিবদ্ধ করতে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো কোনো বিচারকের দায়িত্বভারে তুলনামূলক কম সংখ্যক অর্থাৎ ২ হাজার ৪৭০-এর কম মামলার বিচার করার দায়িত্ব থাকলেও এ কারণে যেসব বিচারকের কাঁধে মামলার সংখ্যা এর চেয়ে বেশি তার কোনো অংশ বিচারের জন্য এখানে প্রেরণ করা সম্ভব নয়।
কারণ আইনি বাধা। একজন বিচারক সম্পূর্ণ আন্তরিক ও দক্ষ হলেও কী গতিতে কতগুলো মামলার বিচারকাজ তিনি পরিচালনা করতে পারেন তার প্রাথমিক ধারণা এখান থেকে করা যাচ্ছে। বিচার কাজে সময় লাগার আরও কিছু কারণ আছে। অভিযুক্তর পলাতক থাকা, অভিযুক্তের বিদেশে পালিয়ে থাকা, ইচ্ছাকৃত সাক্ষী গরহাজির থাকা, বিচারপ্রার্থীর সাক্ষীকে এবং বিচার প্রার্থীকে অসৎ পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক হুকমি দেওয়া, উকিলদের গাফিলতি, দুর্বল চার্জশিট প্রণয়ন, খুন ও ধর্ষণ মামলায় ডাক্তার, ল্যাবরেটরি বিশেষজ্ঞ, অস্ত্র বিশেষজ্ঞ বা ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতি নিশ্চিত করায় অসুবিধা, তদন্তকারী কর্মকর্তার মৃত্যু বা অবসর গ্রহণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া মামলার এ অসাধারণ জটের ফলে কোনো বিচারকের পক্ষেই সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কোনো মামলার প্রথম বা পরবর্তী শুনানির তারিখ স্থির করা অসম্ভব। অসৎ জিআরও (জেনারেল রেজিস্টার অফিসার-পেশকার) এ ক্ষেত্রে বিচার প্রার্থী কিংবা অভিযুক্তের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে এ তারিখকে এগিয়ে বা পিছিয়ে দেওয়ার কাজটি করে থাকেন। ফলে অভিযুক্ত, বিচারপ্রক্রিয়াকে যতদূর সম্ভব পিছিয়ে রাখতে পারেন। এর আইনি সুবিধা রয়েছে। যেমন কোনো অভিযুক্ত ৬০ বছর বয়স অতিক্রান্ত করতে পারলে বিচারক তাকে মৃত্যুদণ্ডের উপযুক্ত হওয়া সত্ত্বেও লঘু দণ্ড দিতে পারেন। যেমন- রহস্যজনক একটি মহলের আদেশে একটি ফৌজদারি মামলার বিচার কাজ ২৬ বছর স্থগিত থাকার ফলে সগিরা মোর্শেদ হত্যা কাণ্ডের আসামি তার বয়স ৬০ বছর পার করে সম্প্রতি মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে শাজনিন সম্ভ্রমহানি ও খুনের মামলায় ১৮ বছর, আহসান উল্লাহ মাস্টার খুনের মামলায় ১২ বছর সময় লাগে দণ্ড কার্যকর করতে। প্রচণ্ড সামাজিক চাপে ওসি প্রদীপ, কিংবা নোয়াখালীর নুসরাত খুনের মামলা একাদিক্রমে আদালত কর্তৃক শুনানি গ্রহণের মাধ্যমে বিচার সম্পন্ন করা হয়েছিল। ফলে ওই দুটি মামলার বিচার দ্রুত গতিতে হয়। কিন্তু এর ফলে আইনের দৃষ্টিতে ‘সবাই সমান’ এবং ‘আগে এলে আগে পাবেন’- বিচারের এই নীতি সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘিত হয় যা অন্যায়। কারণ একাদিক্রমে শুনানি গ্রহণের ফলে ওই দুই বিচারকের আদালতে ওই তারিখগুলোয় নিষ্পন্নের জন্য মামলাগুলোর কোনো শুনানি গ্রহণ না হওয়ায় ওগুলোর রায় পেতে বিচারপ্রার্থীরা অন্যায় বিলম্বের শিকার হন।
বিচারের সময় লাগার আরও গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। বিচার বিভাগ একটি অবকাশকালীন বিভাগ। অন্যান্য বিভাগ থেকে তাদের ছুটির মেয়াদ তিন মাস অতিরিক্ত। ব্রিটিশ আইন প্রণেতারা নানাদিক বিবেচনায় এ বিধান প্রবর্তন করেন। কারণ বিচার কোনো তড়িঘড়ির বিষয় নয়। অনেক মামলাতেই এটি উভয় পক্ষের বাঁচা-মরার বিষয়। তাই এজলাশের বাইরে প্রয়োজনীয় সময় ব্যয় করে বিচারকরা যাতে মামলার সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম বিষয় নির্ভুলভাবে বিশ্লেষণ করে সঠিক দণ্ড বিধান করতে পারেন, সেই সুযোগ দেওয়ার জন্য এই অতিরিক্ত ছুটির বিধান করা হয়েছিল। ২০১১ সালে আমিন বাজারে ঢাকার দুই তরুণ পবিত্র শবেবারাতের রাতে সন্দেহজনক ঘোরাফেরার সময় গ্রামবাসীর পিটুনিতে খুন হন। এ মামলার প্রাথমিক রায় হতে ঠিক ১৩ বছর সময় লেগেছে। কোনো মামলায় গড়ে অভিযুক্ত এবং সাক্ষীর সংখ্যা ৫২ জন করে হয়। পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে এই ৫২ জনের সম্পূর্ণ তথ্য এবং মামলার জন্য প্রয়োজনীয় আলামত, সাক্ষ্য, দণ্ডবিধির ধারা, ঘটনাস্থল, সময়, ঠিকানা, এনআইডি, বাব-মার নাম ইত্যাদি সংবলিত চার্জশিট প্রণয়ন করতে সাধারণত ২ থেকে আড়াই বছর সময় লাগে। এর আরেকটি কারণ এই যে, একই তদন্তকারী কর্মকর্তার কাঁধে অনেক সময় ২০টি পর্যন্ত মামলার তদন্তভার ন্যস্ত থাকে। এসব মিলিয়ে লাখ লাখ সাধারণ মামলার বিচার হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। আসলে এটি দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত নয়, এটিই প্রয়োজনীয় সময়। কারণ বিচারক সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট না হয়ে একটি মামলার দণ্ডবিধান করতে পারেন না।
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচারক নিজেই মামলার স্বার্থের সঙ্গে জড়িত থাকেন। যেমন নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলা। এ মামলার বিচারক এবং বিবাদীপক্ষের উকিল শ্রী পরেশ চন্দ্র মামলাকে সম্পূর্ণ অন্যায় সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যুক্তিতর্কের একপর্যায়ে বাবু পরেশ চন্দ্র সরকারি উকিলকে খুন করে শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। কারণ পিপি মামলাটিকে ঠিক পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ কথা জানাজানি হয়ে গেলে হাই কোর্টের কঠোর হস্তক্ষেপে বিচারপ্রক্রিয়া ঠিক পথে ফিরে মামলার আসামি একজন লে. কর্নেল (অব.) এবং তার সঙ্গীদের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। আইন অনুযায়ী পরবর্তী স্তর হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট ও ডেথ রেফারেন্স ইত্যাদি পার হয়ে রায় কার্যকর হতে গড়ে আরও ৫-৭ বছর সময় লাগে। যেমন ওসি প্রদীপ এবং নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামিদের মৃত্যুদণ্ডের কাজটি যথাক্রমে ৪ ও ৭ বছর ধরে অপেক্ষমাণ। এর প্রধান কারণ উচ্চতর আদালতে বিচারকের সংখ্যা মামলার তুলনায় একান্ত স্বল্প। ফলে শুনানির সুযোগ পেতে বিচারপ্রার্থীদের এ দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়।
বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি কোনো ক্রাশ প্রোগ্রামের অংশ হতে পারে না। কোনো ব্যক্তিকে ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন একজন বিচারক সৃষ্টি করা এক বা দুই দশকের বিষয় নয়। আমরা সুদান, বুরুন্ডি, মাদাগাস্কার বা বুরকিনাফাসো নই যে, অ্যাকশন অ্যাকশন ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ বলে কোনো অপরাধের দণ্ড বিধান করে তখনই তা কার্যকর করে দেব। এত পুরোনো, প্রতিষ্ঠিত এবং অসংখ্য মামলায় রায় দেওয়া প্রধান বিচারপতি ও ছয়জন অন্যান্য বিচারপতিকে কয়েক ঘণ্টার নোটিসে বাংলাদেশ থেকে বিদায় করা হয়েছে। আবার এত বছর ধরে বিচার করা মামলার (২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা) সব আসামি যখন এই যুক্তিতে খালাস পান যে, মামলাটি ঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি, তখনো বোঝা যায় যে, মামলায় আসলে বিলম্ব বলে কোনো শব্দ নেই। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সময় দিতেই হবে। অল্টারনেট ডিসপিউট রেজল্যুশন পদ্ধতিতে যে মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে সেগুলোর উপজীব্য একান্তই অগভীর। তা সামগ্রিক মামলা জটের পরিস্থিতির কোনো উন্নতির সূচক নয়।
জাস্টিস ডিলেইড ইস জাস্টিস ডিনাইড- যুক্তিযুক্ত বলে প্রতিয়মান হলেও ‘জাস্টিস হারিড ইজ জাস্টিস বারিড’-এর সত্যতাও মনে রাখা আবশ্যক। আদালতের সংখ্যা যুক্তিযুক্তভাবে বৃদ্ধি করে এবং জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস করার মাধ্যমে এ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি করা যেতে পারে। তার পরও জনগণের সংস্কৃতিও একটি বিষয়। কারণ সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যা ৬৬ লাখ এবং তাদের মামলার সংখ্যা বছরে ৩০৬টি। সে অনুপাতে আমাদের মামলার সংখ্যা হওয়া উচিত ৮ হাজার ৮০৯টি। অথচ রয়েছে ৪২ লাখ।
বিশেষ করে একই আয়তনে বছরে ২২ লাখ করে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমিসহ নানাবিধ সম্পদ, নারী ও অধিকারের ওপর অনধিকার প্রবেশ বা এনক্রোচমেন্টের সংখ্যা অবশ্যম্ভাবীভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তা নিরসনের জন্য আদালতের প্রতি আস্থা রেখে মানুষ তার দারস্থ হচ্ছেন। এবং আদালতের রায়ে মানুষ সন্তুষ্ট বলেই নতুন মামলা প্রতিদিনই দায়ের হচ্ছে। কাজেই শিরোনামের উক্তিটি বিচার বিভাগের প্রতি একটি অযৌক্তিক মনোভাবের পরিচায়ক। বিচারকরা তাদের জ্ঞান এবং সম্পদ অনুযায়ী বিচারপ্রার্থীদের সেবা করে চলছেন। ক্লায়েন্টের পাহাড়সম চাপ বিবেচনায় তা প্রশংসনীয়।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রজাতন্ত্রের সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল
[email protected]