
কিছুদিন ধরে দেশের নানা স্থানে সাধারণ মানুষ পড়েছেন রীতিমতো দুর্ভোগে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যেভাবে একটার পর একটা দাবিদাওয়া নিয়ে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে তাতে সড়কপথে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়েছে, নানাভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণির মানুষের যেমন দৈনন্দিন জীবনের রসদ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তেমনি অফিসযাত্রী কিংবা চিকিৎসা নিতে যাওয়া অসুস্থ মানুষ মুখোমুখি হচ্ছেন যানজটে স্থবির হয়ে পড়া চরম ভোগান্তিপূর্ণ সড়কপথের। তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোনো না কোনো যানবাহনে বসে থেকে দীর্ঘ সময় পথেই কেটে যাচ্ছে অসহায় ক্লান্ত যাত্রীদের।
এর মধ্যে কখনো কখনো আবার আকাশ কালো করে নেমে এসেছে ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে হঠাৎ বৃষ্টি, যা পথচারীদের বাড়তি ভোগান্তির সৃষ্টি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে দিনের পর দিন উত্তাল হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং রাজধানীর শাহবাগ এলাকা।
এর পাশাপাশি বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে কয়েক দিন ধরেই আন্দোলন চলছিল। ফলে মৎস্যভবন ও আশপাশের এলাকায় ইশরাকের সমর্থকদের অবস্থানের কারণে যান চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। পাশাপাশি ঘরবাড়িতে গ্যাসসংকটের কারণে যাত্রাবাড়ী-কাজলা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন স্থানীয় জনগণ। ফলে আশপাশের সাধারণ মানুষ তীব্র যানজটের কবলে পড়ে নাকাল হয়েছেন।
এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কয়েকজনে মিলে কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তা অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগের কারণ হয়ে ওঠেন। এসব ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে সহজে কাউকে পাওয়া যায় না। ফলে পথচারীর দুর্ভোগও কমে না। এরকম পরিস্থিতিতে নারী ও শিশুরা রাস্তায় বেরিয়ে সাধারণ মানুষের চাইতেও বেশি সংকটে পড়েন। তাদের সংকট নিরসনে যথাসময়ে কাউকে পাওয়া যায় কি?
এর মধ্যে একদল বিক্ষোভকারী প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ও সচিবালয়ের নিকটবর্তী অঞ্চলে তাদের দাবি জানাতে গেলে সরকার একসময় বাধ্য হয়ে ওই সব স্থানে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু এভাবে শহরজুড়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কোনো সমস্যার সমাধান করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে সবকিছু মিলিয়ে বড় অস্থির সময় পার করছি আমরা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবাই এখন যেন তাদের দাবি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। তাদের দাবি আদায়ের পথ যদি হয় সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, নগরীর ব্যস্ত সড়ক পথগুলোকে অবরুদ্ধ করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা, এ ধরনের কার্যক্রম সমর্থন করা যায় কি? একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, দেশব্যাপী এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোথাও না কোথাও ঘটে চলেছে। যার ফল ভোগ করছেন নিরীহ সাধারণ মানুষ।
এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পরিবহনশ্রমিকরা বলছেন, প্রতিদিনের এমন সড়ক অবরোধ আর যানজটের কারণে ইদানীং তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। দিনের বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকায় তাদের যেমন নষ্ট হচ্ছে সময়, তেমনি অপচয় হচ্ছে অর্থের। তাতে দেখা যাচ্ছে, সারা দিনের পরিশ্রমের পর তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য যতটুকু অর্থের প্রয়োজন ততটুকু সংগ্রহ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? এ প্রশ্নের উত্তর কার কাছে পাওয়া যাবে?
ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়ক অবরোধ এবং তার কারণে সৃষ্ট যানজটের পাশাপাশি জনভোগান্তির আরও নানারকম ঘটনা ঘটে চলেছে দেশজুড়ে। এ ধরনের সংকটের মুখোমুখি সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষ।
সড়ক দুর্ঘটনা, যানজটের পাশাপাশি রয়েছে রাস্তা সংস্কারের কাজ। তাতে কোনো কোনো সড়কের অর্ধেকটাই যানবাহন চলাচলের জন্য আর খোলা থাকছে না। তার ফাঁকফোকর দিয়ে অনেকটা জীবনের ঝুঁকি দিয়ে চলাচল করছে সেই অঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ।
এখন এমন একটা সময় চলছে যখন যেকোনো অফিস, সংস্থা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা ছাত্রছাত্রীরা যেকোনো ধরনের দাবি নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেই তা পূরণ হয়ে যাবে- এমন একটা ধারণা সবার মধ্যে যেন বদ্ধমূল হয়েছে। এ প্রবণতা যথাশিগগির বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বলেই মনে করেন অভিজ্ঞজনরা।
গণমাধ্যমের কাছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেছেন, রাষ্ট্র কাঠামোয় দাবিদাওয়া উপস্থাপনের একটা পদ্ধতি আছে। যখন তখন রাস্তা বন্ধ করার কথাও না। স্মরণ করা যেতে পারে, বর্তমান সরকার গঠিত হওয়ার পর কিছু মানুষ নিয়ে কোনো ধরনের আন্দোলন শুরু করলে প্রথম দিকে কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে তারই ধারাবাহিকতায় মানুষ যেন ধরেই নিয়েছে এটাই দাবি আদায়ের পদ্ধতি। প্রকৃতপক্ষে এভাবে নিরীহ জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায় করার পদ্ধতি সঠিক নয়।
বিগত সরকারের আমলে প্রায় সব ঘটনাকেই একটা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হতো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ত। জুলাই বিপ্লবের পর বর্তমান সরকার ওই ধরনের মানসিকতা থেকে মুক্ত বলেই আমরা জেনেছি। বিভিন্ন সময় কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি।
সাম্প্রতিক সময়ে নানা সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল, অবস্থান ধর্মঘট ইত্যাদি আমরা দেখেছি, যার বেশির ভাগই যেভাবেই হোক বন্ধ হয়েছে। কিছু কিছু সমস্যারও সমাধান হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে প্রতিবাদ মিছিলসহ অন্যান্য কার্যক্রম চলছে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে।
একটি বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাধারণত যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রধানতম শর্ত বলেই ধরে নেওয়া হয়। কারণ কোনো শিক্ষার্থীকে তার বাব-মা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার্জন করতে পাঠান নিশ্চয়ই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন। বাব-মাসহ পরিবারের সবার আশা থাকে, পরবর্তীকালে সে তাদের সংসারের হাল ধরবে এবং পরিবারের সবার দুঃখ ঘোচাবে। কিন্তু সেই শিক্ষার্থী যখন লাশ হয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসে তখন তাদের দুঃখের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না। তাই এসব ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল ভূমিকাই সবাই আশা করে।
বলা যেতে পারে, ইতোমধ্যে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকারীরা তাদের কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে মোটামুটি ধৈর্য ও সহনশীলতারই পরিচয় দিয়েছে। এখন পর্যন্ত তারা সাম্য হত্যার প্রতিবাদে উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগের দাবির মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এর পরে যাতে প্রতিবাদকারী বিক্ষুব্ধ ছাত্রদলকর্মী এবং শিক্ষার্থীদের আরও বড় কোনো আন্দোলনে যেতে না হয়, যা সাধারণ মানুষদের আরও ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে, সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষর নজর রাখা প্রয়োজন বলেই আমরা মনে করি। সাধারণ মানুষও তাই মনে করে বলে আমাদের বিশ্বাস।
অন্যদিকে, বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের দাবিদাওয়া নিয়ে যারা যখন তখন উন্মুক্ত সড়কপথে নেমে এসে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ হচ্ছেন, তাদের কাছে অনুরোধ, তারা যেন এটুকু মনে রাখেন যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের পক্ষে সব সময় সব দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বশীলতা, কার্যক্রম এবং কর্মপরিধি ইত্যাদি বিষয় সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত।
পাশাপাশি সমস্যা ও সংকট নিরসনের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে আলাপ-আলোচনার পথ এবং সুযোগ। এর বিকল্প কিছু আছে কি? নির্দ্বিধায় বলা যায়, বর্তমান সরকার এখন নানা ধরনের চাপের মধ্যদিয়ে কিছুটা কঠিন সময় পার করছে। তাই এখন সরকারের সব সদস্যকে যথেষ্ট ধৈর্যসহকারে এবং বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের জনগণের দুর্ভোগ কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে নিয়েও ভাবতে হবে। কারণ ঠিক এ সময়ে এটাও যেন বর্তমান সরকারের জন্য রীতিমতো একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
লেখক: বিভাগীয় উপদেষ্টা, ‘খবরের কাগজ’