ঢাকা ২৫ আষাঢ় ১৪৩২, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
English

জনগণের দুর্ভোগ কমানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৫, ০৩:৫৮ পিএম
জনগণের দুর্ভোগ কমানোই এখন বড় চ্যালেঞ্জ
অরূপ তালুকদার

কিছুদিন ধরে দেশের নানা স্থানে সাধারণ মানুষ পড়েছেন রীতিমতো দুর্ভোগে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়কে যেভাবে একটার পর একটা দাবিদাওয়া নিয়ে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েছে তাতে সড়কপথে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয়েছে, নানাভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক শ্রেণির মানুষের যেমন দৈনন্দিন জীবনের রসদ জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, তেমনি অফিসযাত্রী কিংবা চিকিৎসা নিতে যাওয়া অসুস্থ মানুষ মুখোমুখি হচ্ছেন যানজটে স্থবির হয়ে পড়া চরম ভোগান্তিপূর্ণ সড়কপথের। তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোনো না কোনো যানবাহনে বসে থেকে দীর্ঘ সময় পথেই কেটে যাচ্ছে অসহায় ক্লান্ত যাত্রীদের। 

এর মধ্যে কখনো কখনো আবার আকাশ কালো করে নেমে এসেছে ঝোড়ো বাতাসের সঙ্গে হঠাৎ বৃষ্টি, যা পথচারীদের বাড়তি ভোগান্তির সৃষ্টি করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার দাবিতে দিনের পর দিন উত্তাল হয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং রাজধানীর শাহবাগ এলাকা। 

এর পাশাপাশি বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে কয়েক দিন ধরেই আন্দোলন চলছিল। ফলে মৎস্যভবন ও আশপাশের এলাকায় ইশরাকের সমর্থকদের অবস্থানের কারণে যান চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। পাশাপাশি ঘরবাড়িতে গ্যাসসংকটের কারণে যাত্রাবাড়ী-কাজলা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন স্থানীয় জনগণ। ফলে আশপাশের সাধারণ মানুষ তীব্র যানজটের কবলে পড়ে নাকাল হয়েছেন। 

এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কয়েকজনে মিলে কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে রাস্তা অবরোধ করে হাজার হাজার মানুষের কষ্ট ও দুর্ভোগের কারণ হয়ে ওঠেন। এসব ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে সহজে কাউকে পাওয়া যায় না। ফলে পথচারীর দুর্ভোগও কমে না। এরকম পরিস্থিতিতে নারী ও শিশুরা রাস্তায় বেরিয়ে সাধারণ মানুষের চাইতেও বেশি সংকটে পড়েন। তাদের সংকট নিরসনে যথাসময়ে কাউকে পাওয়া যায় কি? 

এর মধ্যে একদল বিক্ষোভকারী প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ও সচিবালয়ের নিকটবর্তী অঞ্চলে তাদের দাবি জানাতে গেলে সরকার একসময় বাধ্য হয়ে ওই সব স্থানে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু এভাবে শহরজুড়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করে কোনো সমস্যার সমাধান করা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে সবকিছু মিলিয়ে বড় অস্থির সময় পার করছি আমরা। 
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবাই এখন যেন তাদের দাবি নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। তাদের দাবি আদায়ের পথ যদি হয় সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, নগরীর ব্যস্ত সড়ক পথগুলোকে অবরুদ্ধ করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা, এ ধরনের কার্যক্রম সমর্থন করা যায় কি? একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, দেশব্যাপী এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোথাও না কোথাও ঘটে চলেছে। যার ফল ভোগ করছেন নিরীহ সাধারণ মানুষ। 

এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পরিবহনশ্রমিকরা বলছেন, প্রতিদিনের এমন সড়ক অবরোধ আর যানজটের কারণে ইদানীং তারা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। দিনের বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকায় তাদের যেমন নষ্ট হচ্ছে সময়, তেমনি অপচয় হচ্ছে অর্থের। তাতে দেখা যাচ্ছে, সারা দিনের পরিশ্রমের পর তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য যতটুকু অর্থের প্রয়োজন ততটুকু সংগ্রহ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? এ প্রশ্নের উত্তর কার কাছে পাওয়া যাবে? 

ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়ক অবরোধ এবং তার কারণে সৃষ্ট যানজটের পাশাপাশি জনভোগান্তির আরও নানারকম ঘটনা ঘটে চলেছে দেশজুড়ে। এ ধরনের সংকটের মুখোমুখি সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষ।

সড়ক দুর্ঘটনা, যানজটের পাশাপাশি রয়েছে রাস্তা সংস্কারের কাজ। তাতে কোনো কোনো সড়কের অর্ধেকটাই যানবাহন চলাচলের জন্য আর খোলা থাকছে না। তার ফাঁকফোকর দিয়ে অনেকটা জীবনের ঝুঁকি দিয়ে চলাচল করছে সেই অঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ। 
এখন এমন একটা সময় চলছে যখন যেকোনো অফিস, সংস্থা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা ছাত্রছাত্রীরা যেকোনো ধরনের দাবি নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালেই তা পূরণ হয়ে যাবে- এমন একটা ধারণা সবার মধ্যে যেন বদ্ধমূল হয়েছে। এ প্রবণতা যথাশিগগির বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বলেই মনে করেন অভিজ্ঞজনরা। 

গণমাধ্যমের কাছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেছেন, রাষ্ট্র কাঠামোয় দাবিদাওয়া উপস্থাপনের একটা পদ্ধতি আছে। যখন তখন রাস্তা বন্ধ করার কথাও না। স্মরণ করা যেতে পারে, বর্তমান সরকার গঠিত হওয়ার পর কিছু মানুষ নিয়ে কোনো ধরনের আন্দোলন শুরু করলে প্রথম দিকে কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে তারই ধারাবাহিকতায় মানুষ যেন ধরেই নিয়েছে এটাই দাবি আদায়ের পদ্ধতি। প্রকৃতপক্ষে এভাবে নিরীহ জনগণকে জিম্মি করে দাবি আদায় করার পদ্ধতি সঠিক নয়।
বিগত সরকারের আমলে প্রায় সব ঘটনাকেই একটা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হতো। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ত। জুলাই বিপ্লবের পর বর্তমান সরকার ওই ধরনের মানসিকতা থেকে মুক্ত বলেই আমরা জেনেছি। বিভিন্ন সময় কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। 

সাম্প্রতিক সময়ে নানা সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল, অবস্থান ধর্মঘট ইত্যাদি আমরা দেখেছি, যার বেশির ভাগই যেভাবেই হোক বন্ধ হয়েছে। কিছু কিছু সমস্যারও সমাধান হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে প্রতিবাদ মিছিলসহ অন্যান্য কার্যক্রম চলছে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে। 

একটি বিষয় অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাধারণত যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রধানতম শর্ত বলেই ধরে নেওয়া হয়। কারণ কোনো শিক্ষার্থীকে তার বাব-মা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার্জন করতে পাঠান নিশ্চয়ই সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন। বাব-মাসহ পরিবারের সবার আশা থাকে, পরবর্তীকালে সে তাদের সংসারের হাল ধরবে এবং পরিবারের সবার দুঃখ ঘোচাবে। কিন্তু সেই শিক্ষার্থী যখন লাশ হয়ে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসে তখন তাদের দুঃখের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না। তাই এসব ক্ষেত্রে সঙ্গত কারণেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল ভূমিকাই সবাই আশা করে। 

বলা যেতে পারে, ইতোমধ্যে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকারীরা তাদের কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে মোটামুটি ধৈর্য ও সহনশীলতারই পরিচয় দিয়েছে। এখন পর্যন্ত তারা সাম্য হত্যার প্রতিবাদে উপাচার্য ও প্রক্টরের পদত্যাগের দাবির মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এর পরে যাতে প্রতিবাদকারী বিক্ষুব্ধ ছাত্রদলকর্মী এবং শিক্ষার্থীদের আরও বড় কোনো আন্দোলনে যেতে না হয়, যা সাধারণ মানুষদের আরও ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে, সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষর নজর রাখা প্রয়োজন বলেই আমরা মনে করি। সাধারণ মানুষও তাই মনে করে বলে আমাদের বিশ্বাস।

অন্যদিকে, বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের দাবিদাওয়া নিয়ে যারা যখন তখন উন্মুক্ত সড়কপথে নেমে এসে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ হচ্ছেন, তাদের কাছে অনুরোধ, তারা যেন এটুকু মনে রাখেন যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দায়িত্ব পালন করছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের পক্ষে সব সময় সব দাবিদাওয়া মেনে নেওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্বশীলতা, কার্যক্রম এবং কর্মপরিধি ইত্যাদি বিষয় সহানুভূতিশীলতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। 

পাশাপাশি সমস্যা ও সংকট নিরসনের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে আলাপ-আলোচনার পথ এবং সুযোগ। এর বিকল্প কিছু আছে কি? নির্দ্বিধায় বলা যায়, বর্তমান সরকার এখন নানা ধরনের চাপের মধ্যদিয়ে কিছুটা কঠিন সময় পার করছে। তাই এখন সরকারের সব সদস্যকে যথেষ্ট ধৈর্যসহকারে এবং বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে প্রতিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের জনগণের দুর্ভোগ কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সে নিয়েও ভাবতে হবে। কারণ ঠিক এ সময়ে এটাও যেন বর্তমান সরকারের জন্য রীতিমতো একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। 

লেখক: বিভাগীয় উপদেষ্টা, ‘খবরের কাগজ’

বদলে যাচ্ছে সফলতার ধারণা

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ০৬:০৬ পিএম
বদলে যাচ্ছে সফলতার ধারণা

সাফল্য মানেই কি শুধু অনেক টাকা আর বড় চাকরি? আগে হয়তো এমনটাই ভাবা হতো। কিন্তু এখন দুনিয়া বদলাচ্ছে, আর তাই বদলাচ্ছে সফলতার মানেও। বিশ্বায়নের এ যুগে দেশগুলো কাছাকাছি আসছে, ইন্টারনেট সবকিছু সহজ করে দিয়েছে, আর আমাদের পুরোনো ধ্যানধারণাগুলোও পাল্টাচ্ছে। সমাজই আসলে ঠিক করে দেয় কোনটা সাফল্য, কোনটা নয়। আর এ ভাবনাটা একেক জায়গায় একেকরকম। আমাদের বাংলাদেশও এখন অনেক বদলাচ্ছে- অর্থনীতি, মানুষজন, সংস্কৃতি- তাই এখানেও সফলতার ধারণাটা বদলে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে বা আরও অনেক জায়গায় আগে সাফল্য বলতে বোঝাত সংসার চালানো, পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়া আর সমাজে একটু মাথা উঁচু করে বাঁচা। যাদের জমি ছিল, গবাদি পশু ছিল বা সরকারি চাকরি ছিল, তাদেরই লোকে সফল বলত। এগুলো ছিল চোখে দেখা জিনিস, যা দিয়ে জীবন চালানো যেত। পরিবারের বড়দের কথা, ধর্মের নিয়ম আর ছেলেদের বেশি গুরুত্ব দেওয়ার চল- এসবই ঠিক করে দিত কী অর্জন করলে লোকে বাহবা দেবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারি বড় কর্তা হওয়াটা শুধু টাকার জন্যই নয়, সম্মানের জন্যও খুব দরকারি ছিল।

কিন্তু বিশ্বায়ন সবকিছুকে অনেক বড় করে দিয়েছে। এখন টিভি, ইন্টারনেট, ফেসবুক আর বিদেশে যাওয়া-আসা মানুষের সামনে নতুন নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের তরুণরা এখন দুনিয়ার খবর রাখছে, আর তারা দেখছে শুধু টাকা থাকলেই সফল হওয়া যায় না। এখন অনেকেই নিজের শখ পূরণ করা, সমাজে কিছু করা, সবার কাছে পরিচিত হওয়া আর নিজের মতো করে বাঁচার মধ্যেই সফলতা খুঁজে নিচ্ছে।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক- এসব প্ল্যাটফর্ম সাফল্যের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। এখন অনেকেই অনলাইনে জনপ্রিয় হয়ে, ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে বা নতুন টেক কোম্পানি বানিয়ে সফল হচ্ছে। আগে যারা হয়তো সুযোগ পেত না, তারাও এখন এ প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে টাকা কামাচ্ছে আর পরিচিতি পাচ্ছে। তবে এখানেও সমস্যা আছে, অনেক সময় শুধু দেখানোর জন্যই লোকে সফল সাজার চেষ্টা করে, আর রাতারাতি বিখ্যাত হওয়াটা সবসময় টিকে থাকে না।

বাংলাদেশের অর্থনীতিও অনেক বদলেছে। পোশাক কারখানা হয়েছে, বিদেশ থেকে আমাদের লোকেরা টাকা পাঠাচ্ছে, আর অনেকেই ছোটখাটো ব্যবসা বা এনজিওর সাহায্যে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। নারীরা এখন কারখানায় কাজ করছে, গ্রামের অনেক মেয়ে এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে সংসারে সাহায্য করছে। এতে তাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বাড়ছে, আর সাফল্য মানে যে শুধু ঘর সামলানো নয়, এটাও সবাই বুঝতে পারছে।

তবে সবকিছুর পরও বৈষম্য কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, বরং নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে। নতুন ধরনের সাফল্য পাওয়ার সুযোগ সবার জন্য সমান নয়। এটা নির্ভর করে কে কোন পরিবারে জন্মেছে, কোথায় থাকে, ছেলে না মেয়ে এবং কে কতটুকু পড়াশোনা করেছে তার ওপর। গ্রামের ছেলে হয়তো বিদেশে গিয়ে টাকা পাঠানোকেই বড় সাফল্য মনে করে। আবার শহরের ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা হয়তো বিদেশ থেকে পড়ে এসে বড় কোম্পানিতে যোগ দেওয়া বা নতুন ব্যবসা শুরু করাকে সাফল্য ভাবে। তাই একেকজনের কাছে সাফল্যের মানে একেকরকম, আর এর ঝুঁকিও আলাদা।

পড়াশোনাকে এখনো অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু এর মানেও আগের মতো নেই। এখন অনেক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি হয়েছে, কোচিং সেন্টার আর নতুন নতুন কারিকুলাম এসেছে। ভালো রেজাল্ট করার চাপ অনেক বেশি, কিন্তু অনেকেই ভাবছে এত পড়াশোনা করেও ভালো চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক শিক্ষিত তরুণ বেকার থাকছে, আর তাই লোকে ভাবছে শুধু ভালো ডিগ্রি থাকলেই লাভ নেই, দরকারি কিছু শিখতে হবে।

এ পরিবর্তনের কারণে পরিবারেও সমস্যা হচ্ছে। বাবা-মা হয়তো এখনো চান ছেলেমেয়ে সরকারি চাকরি করুক বা তাড়াতাড়ি বিয়ে করুক। কিন্তু নতুন প্রজন্ম হয়তো শিল্পী হতে চায়, অনলাইনে বিখ্যাত হতে চায় বা সমাজের জন্য কিছু করতে চায়। আগের আর এখনকার প্রজন্মের চিন্তাভাবনার এ পার্থক্য সমাজে একটা টানাপোড়েন তৈরি করছে।

ধর্ম আর নীতিবোধ এখনো আমাদের সমাজে সফলতার সংজ্ঞায় প্রভাব ফেলে। কেউ কেউ মনে করে টাকা থাকলেই বুঝি আল্লাহ খুশি থাকেন বা সে খুব ভালো লোক। আবার অনেকে মনে করে শুধু টাকা আর নাম কামানোর পেছনে ছোটাটা ঠিক নয়। ইসলাম ধর্মে বিনয়, সমাজের প্রতি দায়িত্ব আর মনের শান্তিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা পশ্চিমা দেশের শুধু নিজের জন্য সফল হওয়ার ধারণার চেয়ে আলাদা। ধর্মের গুরুরাও এসব নিয়ে কথা বলেন এবং কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, সে বিষয়ে মানুষের ধারণা গড়ে তোলেন।

টিভি, সিনেমা, বিজ্ঞাপন- এগুলোও সাফল্যের গল্প শোনায়। গ্রামের ছেলে শহরে এসে বড় চাকরি পেল, গ্রামের মেয়ে বড় শিল্পী হলো, বা রিকশাওয়ালার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হলো- এমন গল্পগুলো আমাদের দেখায় যে, চেষ্টা করলে আর প্রতিভা থাকলে যে কেউ জীবনে উন্নতি করতে পারে। কিন্তু এর আড়ালে যে কত বাধা আছে, সেটা অনেক সময় দেখানো হয় না।

এখন অনেকেই বিদেশে থাকছে বা দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। তারা শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও নিজেদের প্রমাণ করতে চায়। যারা বিদেশে থাকে, তারা একদিকে দেশের সংস্কৃতি ধরে রাখতে চায়, আবার অন্যদিকে নতুন দেশের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে চায়। যারা কাজের জন্য বিদেশে যায়, তাদের জন্য সাফল্য মানে পরিবারকে টাকা পাঠানো আর নতুন জায়গায় টিকে থাকা।

সরকার আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও সফলতার নতুন নতুন ধারণা তৈরি করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, তরুণদের ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া বা নারীদের স্বাবলম্বী করার প্রকল্পগুলো আসলে সাফল্যের নতুন পথ খুলে দিচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও ক্ষমতায়ন বা উন্নয়নের কথা বলে আমাদের সমাজের লক্ষ্য ঠিক করে দিতে সাহায্য করছে।

যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে, পরিবেশ বাঁচানোর চেষ্টা করছে বা নারী-পুরুষের সমতার জন্য লড়ছে- তারাও নতুন এক ধরনের সাফল্য দেখাচ্ছে। তারা হয়তো অনেক টাকা কামাচ্ছে না, কিন্তু সমাজের ভালোর জন্য তাদের কাজকে লোকে এখন সম্মান জানাচ্ছে। এখানে সাফল্য মাপা হচ্ছে কে কতটা সমাজকে দিতে পারল, পরিবেশের জন্য কী করল বা কতটুকু সৎ থাকতে পারল, তার ওপর ভিত্তি করে।
তবে দামি জিনিস কেনার আর লোক দেখানোর চল এখনো কমেনি। পুঁজিবাদী সমাজে বাজারই সবকিছুর নিয়ম ঠিক করে দেয়, আর সাফল্য মানে অনেক সময় ভালো পোশাক পরা, দামি গাড়ি কেনা বা বড় বাড়িতে থাকা। এতে অনেকেই চাপে পড়ে যায়, অনেক কষ্ট করে হলেও লোকজনকে দেখাতে চায় যে, সে সফল।

সাফল্যের এই বদলে যাওয়া ধারণাগুলো আমাদের মনেও প্রভাব ফেলছে। যখন সমাজ বারবার সফলতার মানদণ্ড বদলায়, তখন সফল হওয়ার চাপও বাড়ে। ব্যর্থ হওয়ার ভয়, পিছিয়ে পড়ার চিন্তা আর অন্যদের কাছে ভালো সাজার আকাঙ্ক্ষা আমাদের অস্থির করে তোলে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ বাড়ছে, যা প্রমাণ করে সফলতার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমাদের কতটা মানসিক ধকল পোহাতে হচ্ছে।

মোটকথা, বিশ্বায়নের যুগে সাফল্যের সামাজিক সংজ্ঞাটা সবসময় বদলাচ্ছে এবং এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এটা একদিকে আমাদের ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মধ্যেকার টানাপোড়েন, অন্যদিকে নিজের ভালো চাওয়া আর সবার ভালোর কথা ভাবার মধ্যেকার পার্থক্য এবং স্থানীয় জীবন আর বিশ্ব দুনিয়ার স্বপ্নের প্রতিফলন। বাংলাদেশে এ সবকিছু ঘটছে এক নতুন শক্তি, সৃষ্টিশীলতা আর আকাঙ্ক্ষার মধ্যদিয়ে। সাফল্য এখন আর একটা নির্দিষ্ট পথ নয়, এটা অনেক সম্ভাবনার সমষ্টি- যা নির্ভর করে কে কোথায় আছে, তার চারপাশের মানুষজন কেমন এবং সে নিজে কী ভাবছে তার ওপর।
সমাজ যত এগোবে, সাফল্যের ধারণাও তত বদলাবে। 

আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে এ ধারণাগুলো সবার জন্য ভালো হয়, মানুষ হিসেবে আমাদের মূল্য দেয় এবং ন্যায্যতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। সবার জন্য একই রকম সফলতার সংজ্ঞা ঠিক না করে, বরং যার যার পথকে সম্মান জানানো উচিত, বিভিন্ন ধরনের অবদানকে মূল্য দেওয়া উচিত এবং এমন পরিবেশ তৈরি করা উচিত যেখানে সবাই নিজের মতো করে, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। এভাবেই বাংলাদেশ এবং পুরো পৃথিবী সফল হওয়ার আরও মানবিক আরও সুন্দর মানে খুঁজে পাবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

রপ্তানি বড় ধরনের চাপে পড়বে

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৮ এএম
রপ্তানি বড় ধরনের চাপে পড়বে
সেলিম রহমান

বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপের যুক্তরাষ্ট্রের একক সিদ্ধান্ত আরোপিত হলে তা হবে আমাদের জন্য চরম অর্থনৈতিক ধাক্কা। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। এর ফলে আগে যেখানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো, সেখানে এখন দ্বিগুণেরও বেশি দিতে হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিষয়টি বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।

এই পারস্পরিক শুল্ক আরোপের যৌক্তিকতাও স্পষ্ট নয়, যা উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। এখনো জানা যায়নি বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ- যেমন ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ওপর কত শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। 

যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দফায় ১৪টি দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত হারই সর্বোচ্চগুলোর একটি। অন্যদের ক্ষেত্রে হার কম হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের প্রতিযোগিতামূলক অসুবিধায় পড়বে। এতে ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি সরবরাহ চেইন-পরিকল্পনাও জটিল হয়ে উঠবে।

পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও গভীর। বাড়তি খরচের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা তুলনামূলকভাবে কম শুল্কের দেশে অর্ডার স্থানান্তর করতে পারেন। তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ, যা মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশ তাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শুল্ক আলোচনা যেভাবে হয়েছে তাতে বাংলাদেশ কোনো সুবিধাজনক অবস্থান আদায় করতে পারেনি। ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিবর্তনশীল পরিবেশে আরও দুর্বল করে তুলবে। তার পরও আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। 

পাশাপাশি বহুমুখী ও কৌশলগত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানি বৈচিত্র্য এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পোশাক খাতের বাইরের শিল্প গড়ে তোলা এখন অত্যাবশ্যক। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। এই বিষয়গুলো অনেক দিন থেকে বলা হলেও কাজ হচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতির মতো অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের মতো দেশের ভালো প্রস্তুতি না থাকলে বড় ধরনের চাপে পড়তে হবে। 

লেখক: সানেমের নির্বাহী পরিচালক

দর-কষাকষি করতে হবে

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৩ এএম
দর-কষাকষি করতে হবে
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারপ্রধান যেহেতু বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, তাই এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে আলোচনা করতে হবে। ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। কাজেই সেই পর্যন্ত দর-কষাকষি করতে হবে। যাতে ভিয়েতনামের কাছাকাছি যাওয়া যায়। ভিয়েতনামও হয়তো দর-কষাকষি করে এই পর্যায়ে এসেছে। তাই আমাদের সরকারকেও সেভাবে এগোতে হবে। তা না হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় ঝুঁকিতে পড়বে দেশ। 

বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ মোট ১৪টি দেশের ওপর নতুন করে শুল্কহার নির্ধারণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। 

হোয়াইট হাউসের ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির সময়সীমা শেষ হতে চলায় ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন। 

এর আগে ৯ জুলাই থেকে শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সেটি পিছিয়ে ১ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজেই এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে।

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো

কতটুকু গিলতে পারব তা দেখার বিষয়

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:২৫ এএম
কতটুকু গিলতে পারব তা দেখার বিষয়
ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক

ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ ঘোষণা করেছেন। কাজেই সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে জোরালোভাবে দর-কষাকষি করতে হবে। তবে দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র কী চায়। তারা এমন জটিল ও কঠিন শর্ত দিল, যা পূরণ করা সম্ভব নয়। যেটা ভিয়েতনামে দেওয়া হয়েছিল। তারা পূরণ করতে পারলেও আমরা সেই কঠিন শর্ত পূরণ করতে পারব না। 

এ ছাড়া চীন, পাকিস্তানসহ যারা প্রতিযোগিতামূলক বাজার দখল করে আছে, তাদেরও দেখতে হবে। অনেক দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বসিয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। প্রতিযোগিতার বাজার স্লো হয়ে যাবে। তারা কী শর্ত উল্লেখ করেছে, সেটাও দেখার বিষয়। এটা যেহেতু জানা যায়নি। তাই বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা কতটুকু গিলতে পারব তা দেখার বিষয়। 

তারা গ্লোবালি (সারা বিশ্বে) শুল্ক আরোপের কথা বলেছে। এতে সবাই চাপে পড়বে। বিভিন্ন দেশে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে ৩৫ শতাংশ। যা ২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। এখনো মাঝে কিছুদিন সময় আছে। এই সময় কাজে লাগাতে হবে। 

ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান      

ক্ষমতার বলয়ে বাংলার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৬:৩৬ পিএম
ক্ষমতার বলয়ে বাংলার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ

মানুষকে ভাষা দিয়ে চেনা যায়, চেনা যায় ক্ষমতা দিয়েও। ভাষা বরঞ্চ অধিক বাঙ্ময়, ক্ষমতার চেয়ে। মুখ খুললেই বক্তার পরিচয় হেসে-খেলে কিংবা রেগে-মেগে বের হয়ে আসে। ভাষা পারে চুম্বকের মতো কাছে টেনে নিতে এবং যন্ত্রের মতো ঠেলে দিতে পারে দূরে। কাছে টেনে নেওয়াটা বিশেষভাবে ঘটে প্রবাসে; প্রবাসে বাঙালি মাত্রই বাঙালির মিত্র, শত্রুতে পরিণত হওয়ার আগে। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনেকেরই রয়েছে, আমারও আছে বলে দাবি করতে পারি। আজ থেকে ৬৭ট্টি বছর আগে আমি বিদেশে গিয়েছিলাম পড়তে। তখন আমরা পাকিস্তানি। সেই পরিচয়েই গিয়েছি ব্রিটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি নিয়ে। উর্দুভাষী যে পাকিস্তানিরা সহযাত্রী ছিল আমার, তাদের কারও কারও সঙ্গে যে বন্ধুত্ব হয়নি তা নয়, হয়েছে। কিন্তু বিদেশে পা দিয়ে বাঙালি মাত্রকেই বন্ধু মনে হয়েছে, সে বাঙালি যে রাষ্ট্রেরই নাগরিক হোক; ভারত-পাকিস্তান তখন শত্রুর সম্পর্ক, কিন্তু সেই শত্রুতা ভারতীয় বাঙালিদের আপনজন ভাবার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়নি।

 পরে, একাত্তর সালে, ভাষার টানের আত্মীয়তাটা আবার দেখেছি, হিন্দু ধর্মের মানুষ মাত্রই কাফের ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে; তবে এমন ঘটনা গল্পে নয় বাস্তবেই ঘটেছে, বিমানবিহারীকে তার নাম শুনে তারা ছেড়ে দিয়েছে, বিহারি ভেবে, কিন্তু তাজুল ইসলামকে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখেছে লোকটা জয় বাংলার মানুষ কি না সেটা জানার জন্য। ১৬ ডিসেম্বরের পরে নিজের চোখে দেখেছি কাপ্তানবাজারের কসাইপাড়ার যে বিহারিরা কসমখাওয়া পাকিস্তানি ছিল, বাঙালি নিধন যাদের ধর্মীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিহারি এবং অবশ্যই হিন্দিভাষী হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যদের কী অসামান্য দোস্তালি। জড়িয়ে ধরছে, গলাগলি করছে, টেনে নিয়ে চা খাওয়াচ্ছে, পাটনা ও মুঙ্গেরের খবর আদান-প্রদান করছে। ধর্ম ও রাষ্ট্র মিথ্যা হয়ে গেছে ভাষার হাতে পড়ে। হ্যাঁ, ভাষা এ ক্ষমতা রাখে বৈকি। রাখতে থাকবে।

তবু অনেক ক্ষেত্রেই ভাষার চেয়ে বেশি জোরদার হয় রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থের শক্তি। সেই শক্তি ক্ষমতা রাখে ভাষাকে জব্দ করার। বাঙালিরা যে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ হয়েছে সেটা ভাষার কারণে নয়, ক্ষমতার কারণে। ক্ষমতা ছিল রাষ্ট্র ও রাজনীতির হাতে, সেই ক্ষমতার বলীয়ান যারা ভূখণ্ডকে তারা দুই টুকরা করে ছেড়েছে। আর বাংলাদেশেও বাঙালিরা যে এক নয়, তার কারণ কারও হাতে ক্ষমতা আছে, কারও হাতে ক্ষমতা নেই। ক্ষমতাবানরা আগে ছিল অবাঙালি, এখন যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা বাঙালি পরিচয়েই এসেছিল বটে, কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে বাংলাভাষা ব্যবহার করছে কম, কথাবার্তায় বাংলা বলে ইংরেজি মিশিয়ে। যার কথায় যত বেশি ইংরেজি শব্দ, বুঝতে হবে সে ব্যক্তি তত অধিক ক্ষমতাবান। অন্য প্রমাণের দরকার পড়ে না, ওই একটি প্রমাণই যথেষ্ট, এ সত্য প্রমাণের জন্য যে ক্ষমতাবানরা বাঙালি থাকছে না, থাকতে চাইছে না, যতই উঠছে ততই বিচ্যুত হচ্ছে তাদের আদি বাঙালিত্ব থেকে। এ ভূখণ্ডের আদিবাসীরা আগের কালে ক্ষমতাবঞ্চিত ছিল, এখনো তাই। বাংলা ভাষা যখন রাষ্ট্রভাষা হয় তখনো তা রাষ্ট্রের ভাষা হয় না। কেননা রাষ্ট্র ও ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। রয়েছে তাদের হাতে, যারা বাংলা বলতে অনাগ্রহী।

ক্ষমতা যে ভাষার চেয়ে জোরদার, সে অভিজ্ঞতা লাভ ওই আমার প্রথম প্রবাসকালেই ঘটেছিল, ঢাকায় ফেরার পথে বাঙালির শহর কলকাতায় থেমে। কলকাতায় এসেছিলাম জল ও স্থলপথে। জাহাজে যে কয়জন বাঙালি ছিল সবার সঙ্গেই খাতির জমেছিল, আমরা তিন বাঙালি তো একই কেবিনে থেকেছি, ২০ দিন। করাচিতে একজন নেমে গেছে, সে জাহাজ ধরবে অস্ট্রেলিয়ার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবব্রত আর আমি বম্বে (মুম্বাই) হয়ে এসেছি কলকাতায়। হাওড়া রেল স্টেশনে পা দিয়েই মনে হলো দেশে ফিরেছি। আমার ছেলেবেলার একটা অংশ কলকাতায় কেটেছে, ১৩ বছর পরে সেখানে এসে আপনজনদের দেখতে পেলাম, যদিও কাউকেই আমি চিনি না, এক দেবব্রতকে ছাড়া।

 বিকেলে পরিচিত রাস্তাঘাটে হাঁটাহাঁটি করেছি, চৌরঙ্গী এলাকায় কোনো সিনেমা হলে পাওয়া না যাওয়ায় ভবানীপুরে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখেছি। সন্ধ্যার পরে দেবব্রতের সঙ্গে ধর্মতলা, গড়ের মাঠ, পদ্মার ধার, এসব জায়গায় পায়চারি করেছি। অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটল পরের দিন সকালে। অতিপ্রত্যুষে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের লোক আমাকে জমা রেখে গেছে গ্র্যান্ড হোটেলে, পরদিন সকালে তাদের ড্রাইভার এসে নিয়ে যাবে দমদম বিমানবন্দরে। বাক্সপেঁটরা নিয়ে নিচে নেমে দেখি হোটেলের কাউন্টারে কাজ করছেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। আমি উৎফুল্ল হয়ে তার কাছ থেকে বিদায় চেয়েছি, যেন আপনজন। তিনি বললেন, ‘বিলের টাকা দিন’। আমি বললাম, ‘সে তো দেবে ব্রিটিশ কাউন্সিল।’ তিনি কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে বলেন, ‘না, তেমন কোনো চিঠি তার টেবিলে নেই।’

গোলমাল আঁচ করে অপেক্ষমাণ ড্রাইভারটি এগিয়ে এসে জানতে চাইল ঘটনা। সে লোক কলকাতার আদিবাসী, কথা বলে বাংলার সঙ্গে উর্দু মিশিয়ে; কাউন্টারের ভদ্রলোককে সে বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই, আমার সত্যবাদিতার বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়ে থাকলে ফোন করে আমার সাহেবের সঙ্গে কথা বললেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’ বলে ফোন নম্বর দিল এবং আশ্বস্ত করল যে, তার সাহেবকে অবশ্যই বাসায় পাওয়া যাবে; এত সকালে যাবেন আর কোথায়, নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছেন। ঘুমন্ত ইংরেজ সাহেবকে জাগানো ঠিক হবে কি না, এ ব্যাপারে হোটেলের বাঙালি কর্মচারীটিকে দ্বিধান্বিত দেখে লোকটি পকেট থেকে তার সচিত্র পরিচয়পত্র বের করে বলল, ‘এই যে আমার নাম-ঠিকানা, সব লিখে নিন, দরকার হলে আমি সই করে দিচ্ছি। কিন্তু আর বিলম্ব করবেন না। করলে প্লেন ধরা যাবে না।’ এতে কাজ হলো। ড্রাইভারটি সই করল, আমি মুক্ত হলাম।

পথিমধ্যে সে তার মিশ্রিত ভাষায় আমাকে জ্ঞানসমৃদ্ধ করল। পার্টিশনের পরে সে ঢাকায় গিয়েছিল, কিন্তু নকরির সুবিধা না দেখে অল্পদিন পরে ওয়াপস চলে এসেছে। সে মুসলমান, সেই হিসেবে আমার নিকটজন, তাই বলেছে কথাটা। কথাটা হলো, আমি মস্তবড় ভুল করেছি কাউন্টারে বাংলা বলে। আমি হচ্ছি ব্রিটিশ কাউন্সিলের গেস্ট, ফিরছি লন্ডন থেকে কিন্তু সেটা বোঝা যাবে কী করে, বাংলা বললে? যদি বাংলায় কথা না বলে ইংরেজিতে দাপট দিতাম, তাহলে দেখা যেত কত সহজে কাজ হচ্ছে। কাউন্টারের ভদ্রলোক এতসব কথা বলতেন না, চোখ তুলে তাকাতেনও না, ঘাড় গুঁজে কুইকুই করে আমাকে বিদায় দিতেন।

 এ আলোচনা আর যাতে না এগোয় সেই লক্ষ্যে আমি ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করি, জানতে চাই ঢাকা তার কাছে কেমন লেগেছে। বলল, না, ঢাকা তার মোটেই ভালো লাগেনি, খুবই গরিব শহর। দেখি বেশ দাপটের সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে, একে তো কলকাতার বাসিন্দা, তদুপরি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। শহর ছেড়ে শহরতলির ভেতর দিয়ে চলছে গাড়ি, চারপাশে মানুষ জেগে উঠছে, তাদের ভাষা বাংলা, কিন্তু তাদের হাতে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা অবাঙালির হাতে। গ্র্যান্ড হোটেলের নিম্নপদস্থ কর্মচারীটিই শুধুই বাঙালি, তার ওপরের সবাই উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয়। ওই অবস্থানে থাকলে আমিও হয়তো অমন আচরণই করতাম, কাউন্টারে বাঙালি ভদ্রলোক যেমনটা করেছেন আমার সঙ্গে।

এটা ১৯৬০ সালের কথা। তার পর অবস্থার যে বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। পশ্চিমবঙ্গে এখন একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়, আরও বড় খবর এই যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিক করেছে অফিস-আদালতে এখন থেকে বাংলা ব্যবহার করা হবে, ইংরেজির পরিবর্তে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, সে ভারতের একটি প্রদেশ মাত্র, সীমানা পার হলেই বাংলাভাষা হারিয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথ পরিণত হন একজন প্রাদেশিক কবিতে। একদিন তার গান ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছিল, কিন্তু সেটা অতীতের ব্যাপার, একালে হলে পেত না। একালে অন্য ক্ষমতা তো বটেই, সাংস্কৃতিক ক্ষমতাও চলে গেছে অন্যদের হাতে। আগের দিনে বাঙালি লেখকরা ইংরেজি ছেড়ে বাংলায় লিখতেন। কেননা, দেশ তখন প্রত্যক্ষরূপে পরাধীন ছিল এবং পরাধীনতাকে তারা পরাধীনতা বলেই জানতেন। আজকের দিনের পরাধীনতাটা অপ্রত্যক্ষ, যে জন্য পরাধীনতাকে স্বাধীনতা বলে মনে করা সম্ভব হচ্ছে। 

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মাইকেল পরিচয় ফেলে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মধুসূদন হতে চেয়েছিলেন, আজকের দিনের কোনো মাইকেল অমনটি করবেন না। তিনি বরঞ্চ তার মধুসূদনত্বকেই বর্জন করতে চাইবেন। মাইকেল সত্তাকে উচ্চে তুলে ধরবেন; লিখবেন ইংরেজিতেই কেননা, ওই ভাষার ক্ষমতা বেশি, বাজারের কারণে। কোনো গ্লানি নেই।
বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গে প্রাদেশিক ভাষাই থাকবে, যতই উচ্চে উঠুক না কেন। প্রাদেশিক ভাষা হবে, সরকারি হবে না। 

তাছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষমতাও তো বাঙালির হাতে নেই, যে হোটেলের মালিক অবাঙালি, তার বাঙালি কর্মচারীটির সাধ্য কি সেই মালিকানায় পরিবর্তন আনে, সে বেচারা বাঙালি গ্রাহক দেখলে বরঞ্চ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, ভাবে ঠকাবে, নয়তো পালাবে বিল বাকি রেখে। বড় দোকানেও এমনই ঘটনা। কর্মচারীটি বাঙালি, ক্যাশবাক্স নিয়ে বসে রয়েছে অবাঙালি। বাঙালি কর্মচারী অবাঙালি ক্রেতা পেলে খুশি হয়, বাঙালি আগন্তুক দেখলে ধরে নেয় নাড়াচাড়া করবে, কিনবে না। সব মিলিয়ে সত্যটা এই যে, দপ্তরে যাই হোক, ক্ষমতার বলয়ে বাংলার প্রবেশাধিকার মোটামুটি নিষিদ্ধ।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়