
যেকোনো নারীর চিরন্তন পরিচয় ‘মা’ এবং মা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম শব্দ। মাতৃত্বের মধ্যদিয়ে বংশানুক্রম ধারা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব বর্তায় মায়ের ওপরই। নারীর জীবনে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলো বিবাহিত নারী একসময় গর্ভধারণ করবে, নির্দিষ্ট সময় পরে প্রসবের মাধ্যমে তার কোলজুড়ে একটি ফুটফুটে সন্তান আসবে। আর নারীর পূর্ণতাও আসে মাতৃত্বে। একথা অনস্বীকার্য যে, একজন মায়ের গর্ভকালীন সুস্থতাই পারে একটি সুন্দর ও সুস্থ শিশু জন্ম দিতে। তাই নিরাপদ মাতৃত্ব প্রতিটি মায়ের অধিকার। বাস্তবে আমাদের দেশে মাতৃত্ব কতটুকু নিরাপদ, তা পর্যালোচনার দাবি রাখে। একটি পরিসংখ্যানে জানা যায়, প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় ২১ কোটি নারী গর্ভবতী হন, ২ কোটিরও বেশি গর্ভজনিত সমস্যায় ভোগেন এবং ৮০ লাখের জীবনাশঙ্কা দেখা দেয়।
আমাদের দেশে জন্মের পরপরই লাখে ১৭২ নবজাতকের মৃত্যু ঘটছে। প্রসবকালীন মোট মাতৃমৃত্যুর ৭৩ শতাংশ ঘটছে প্রসব-পরবর্তী সময়ে। আর প্রথম ২৪ ঘণ্টাতেই মারা যান মোট মাতৃমৃত্যুর ৫৬ শতাংশ। দেশে গর্ভপাতও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য হারে। এখনো বাড়িতে প্রসব হচ্ছে ৫৩ শতাংশ প্রসূতির, প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ১৫ জন প্রসূতি। গরিব, অস্বচ্ছল জনগণের মধ্যে জটিলতায় ভোগার আশঙ্কা বেশি। মূলত গর্ভকালীন জটিলতা, দক্ষ স্বাস্থ্যসেবার অভাব, প্রয়োজনীয় যত্ন ও পুষ্টির অভাব, পরিবারের অসচেতনতা, প্রসব-পরবর্তী সেবাযত্নের অপ্রতুলতা ইত্যাদি একজন মাকে ঠেলে দিচ্ছে সীমাহীন অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগ আর কষ্টের মুখে। সঙ্গে সঙ্গে গর্ভজাত সন্তানটিও পড়ছে ঝুঁকির মধ্যে।
মাতৃত্বকে নিরাপদ করতে ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে ১৯৮৭ সালে কেনিয়ার নাইরোবি কনফারেন্সে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৭ সাল থেকে দেশব্যাপী নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন শুরু হয়। এরপর থেকে নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু হার কমানো ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ২৮ মে বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক নারী স্বাস্থ্য দিবস’ হিসেবে ‘নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। মাতৃস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব ও এর কার্যকারিতা অনুধাবন করে বাংলাদেশেও যথাযথভাবে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করা হয়। প্রতিবারই একটি প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে, যেমন- ‘কমাতে হলে মাতৃমৃত্যু হার, মিডওয়াইফ পাশে থাকা একান্ত দরকার’, ‘প্রতিটি জন্মই হোক পরিকল্পিত, প্রতিটি প্রসব হোক নিরাপদ’, ‘নিরাপদ প্রসব চাই, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চলো যাই’, ‘সকল প্রসূতির জন্য মানসম্মত সেবা আমাদের অঙ্গীকার’, ‘মর্যাদা ও অধিকার, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসূতি সেবায় অঙ্গীকার’।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়: ‘হাসপাতালে সন্তান প্রসব করান, মা ও নবজাতকের জীবন বাঁচান’। মা ও শিশুমৃত্যু রোধ এবং তাদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার বিষয়ে সবাইকে সচেতন করার পাশাপাশি এসব সমস্যা প্রতিরোধসহ মাতৃস্বাস্থ্য, নিরাপদ প্রসব, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান বৃদ্ধি সম্পর্কে মা, পরিবার ও সমাজের সব স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি, শিশুর জন্মদান ও মাতৃত্ব সম্পর্কিত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা ও এগুলোর সুষ্ঠু সমাধানের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা এ দিবসটির অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই সঙ্গে নিরাপদ মাতৃত্বকে নারীর অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার মতো বিষয়গুলো হচ্ছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সর্বশেষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ১ লাখ শিশু জন্ম দিতে গিয়ে ১২৩ জন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে এ হার একই ছিল। বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে শিশুমৃত্যু ও এক মাসের কম বয়সী নবজাতকের মৃত্যুহার বেড়েছে। প্রতি ১ হাজার নবজাতকের মধ্যে ২০ জন মারা যায়। ২০২১ সালে প্রতি হাজার নবজাতকের মধ্যে মারা গেছে ২২ জন। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৬। ২০২৩ সালে প্রতি ১ হাজার জীবিত শিশুর জন্মের পর ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। শিশুমৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় প্রতীয়মান হয়- দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সেবা, প্রসবউত্তর সেবার কার্যক্রম ঠিকভাবে হচ্ছে না। মাতৃমৃত্যুর হারও বেড়েই চলছে; যার কারণ প্রসূতির রক্তপাত, অসংক্রামক রোগসহ উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, অনিরাপদ ডেলিভারি, গর্ভপাত ও অন্যান্য জটিলতা। এ ছাড়া অনেক হাসপাতালে মিডওয়াইফ ও জরুরি ওষুধ নেই, অ্যাম্বুলেন্স নেই, এমনকি চিকিৎসক থাকলেও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব।
সচেতনতার অভাবে গর্ভকালীন কিছু জটিলতার কারণে এখনো মাতৃমৃত্যুর হার আশানুরূপ কমানো সম্ভব হয়নি। প্রসবকালীন নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা, একলাম্পশিয়া, প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গর্ভকালীন জটিলতা, ঝুঁকিপূর্ণ গর্ভাবস্থা ও পরিবারের অবহেলা মাতৃমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। কোনো নারী প্রসূতি হলে আনন্দের পাশাপাশি তার নিরাপদ প্রসব পর্যন্ত নানা ধরনের ঝুঁকি ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগতে থাকেন স্বজনরা। সবাই অপেক্ষায় থাকেন ওই প্রসূতির প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী মাতৃত্বকালীন পুরো পর্ব নিরাপদ হওয়ার। ক্ষেত্রবিশেষে অনেক জটিল রোগের চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রসবপর্বটি। এ জন্যই সবাই খোঁজে নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্যসেবার নাগাল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, গর্ভপাত, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসের প্রভাবে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু যেমন দেশে মাতৃমৃত্যুর বড় কারণ হয়ে উঠেছে, তেমনি এর সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের বিষয়টিও আলোচনায় সামনে চলে আসছে। এ ছাড়া অনেক হাসপাতালে মিডওয়াইফ ও জরুরি ওষুধ নেই, অ্যাম্বুলেন্স নেই, এমনকি চিকিৎসক থাকলেও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। ফলে মাতৃমৃত্যু বেড়েই চলছে। এসব জটিলতা থেকে মাকে অবশ্যই নিরাপদ রাখতে হবে এবং তাতে নিরাপদ থাকবে অনাগত শিশুটিও।
কর্মজীবী মায়েদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা আরও বেশি। অনেক কর্মজীবী নারীর, বিশেষ করে নারীশ্রমিকদের গর্ভাবস্থা নিয়েই অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়। গ্রামগঞ্জে এ বিষয়ে অসচেতনার কারণে অনেকেই সংসারের বিভিন্ন কাজ এমনকি ভারী কাজকর্মও চালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানেও পরিবারের অনেকেই সহযোগিতা করে না। ফলে মা ও অনাগত সন্তানের জীবন পড়ে ঝুঁকির মুখে।
তাছাড়া দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি হাসপাতাল, চিকিৎসা, পর্যাপ্ত ডাক্তার, আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব এখনো প্রকট। মা ও শিশুস্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং বিভিন্ন এনজিও বা সংস্থার মা ও শিশুস্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর দৈন্যদশা, সার্বক্ষণিক ডাক্তারের অভাবে নিরাপদ মাতৃত্বের বিষয়টি হুমকির সম্মুখীন। আমাদের দেশে এখনো অদক্ষ দাই, ধাত্রী দ্বারা প্রসব করানো হয়, যা মাতৃমৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ। দেশে বিচ্ছিন্নভাবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রসূতি চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হলেও এখন পর্যন্ত নারীদের জন্য বিশেষায়িত কোনো হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। আরও নজরদারি বাড়ানোর জন্য পৃথক একটি ইনস্টিটিউট তৈরি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য আলাদাভাবে প্রশিক্ষিত জনবল ব্যবস্থাপনাও এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এখনো দক্ষ প্রসবকর্মীর অনেক ঘাটতি।
দেশে ২২ হাজার মিডওয়াইফের বা ধাত্রী দরকার হলেও সরকারিভাবে আছে মাত্র ১ হাজার ১৪৮ জন।নিরাপদ মাতৃত্বকে নারীর অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে মা ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমিয়ে আনা যায়। একজন গর্ভবতী মহিলা গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসবের জন্য যাবতীয় সেবা এবং প্রসব-পরবর্তী সেবা পাওয়ার সব অধিকার রাখেন এবং তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীই এখনো উপরোক্ত কোনো অধিকারই ভোগ করতে পারেন না। এসব কারণে মাতৃমৃত্যুর হার কমার যে ধীরগতি, তাতে গতি সঞ্চার করা এবং সে লক্ষ্যে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে প্রথম সন্তান প্রসবের পর ৩ থেকে ৪ বছর বিরতি দিয়ে পরবর্তী সন্তান নেওয়া উচিত। গর্ভবতী মায়েদের ভারী কাজ বা ভারী জিনিস বহন না করা, নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া, টিকা নেওয়া, প্রসবপূর্ব বা প্রসব-পরবর্তী সময়েও নিয়মিত ডাক্তার দেখানো, বাড়িতে প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিলে দ্রুত ক্লিনিক ও হাসপাতালে স্থানান্তর করার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এ সময়ে তাদের প্রয়োজন সহানুভূতি, শারীরিক-মানসিক পরিচর্যা, পুষ্টিকর খাবার এবং নিরাপদ প্রসবের নিশ্চয়তা। পরিবারের অন্য সদস্যদের সহানুভূতি ও সহযোগিতাও অত্যন্ত জরুরি এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সবার মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো গেলেই নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হবে এবং সব শ্রেণির মানুষ এ অধিকার পাবে, তাহলেই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন সার্থক হবে। নারীর জন্য নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত হোক এবং সংরক্ষিত হোক নারীর অধিকার। এই হোক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রত্যাশা।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক