
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের বাজেট কেবল সংখ্যার খেলা ছিল না, এটি ছিল আমাদের সামাজিক আকাঙ্ক্ষা, অগ্রাধিকার এবং প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলার সমন্বিত উদ্যোগের প্রতিফলন। সদ্যস্বাধীন একটি দেশ, সবকিছু যেন ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে আবার গড়ার অপেক্ষায়। ১৯৭২ সালে প্রথম বাজেট ঘোষণা করা হয়, সেটি ছিল মূলত পুনর্গঠনের বাজেট। সে সময় বাজেটের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল খাদ্যনিরাপত্তা, অবকাঠামো মেরামত, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যে বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন, তা ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার। স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক দশক আমাদের বাজেট ছিল মূলত ত্রাণনির্ভর ও বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। উন্নয়ন ছিল শ্লথ, যা একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পরিপ্রেক্ষিতে অচিন্তনীয় নয়।
শিল্পায়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা থাকলেও বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও দক্ষ জনশক্তি ছিল না। স্বাধীনতার ঠিক পরবর্তী সময়ে দেশ তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত। বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, অর্থনীতি ছিল বিপর্যস্ত এবং জনগণের মধ্যে খাদ্য ও আশ্রয়ের মতো মৌলিক চাহিদার তীব্র অভাব ছিল। তাজউদ্দিন আহমদের বাজেটে জোর দেওয়া হয়েছিল পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং স্বনির্ভরতার ওপর। তিনি দেশীয় সম্পদের ব্যবহার বাড়ানো এবং বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরতা কমানোর কথা বলেছিলেন। এ ছাড়া, রপ্তানি বাড়ানো এবং আমদানি-প্রতিস্থাপন কৌশলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এ সময়ে বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যয় হয়েছিল কৃষি, যোগাযোগ এবং শিল্প খাতের পুনরুদ্ধারে।
নব্বইয়ের দশকে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় ফিরে আসার পর বাজেটের দর্শনে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। অর্থনৈতিক উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ, বাণিজ্য উদারনীতি এসব শব্দ আমাদের বাজেটের ভাষায় ঢুকে পড়ে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কিছু বরাদ্দ বাড়ানো হয়। সেগুলো ছিল মূলত আন্তর্জাতিক দাতাদের চাপের ফল। এ সময় বাজেটের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় দাতাসংস্থা ও বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশ বাস্তবায়ন। আমরা দেখেছি, এই দশকে বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর শর্ত বেশি গুরুত্ব পেত।
১৯৯১ সালের বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া উভয়েই অত্যন্ত চৌকস ব্যক্তি ছিলেন এবং তারা উভয়েই বাজেটে উদার বাণিজ্যনীতি এবং বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধির ওপর জোর দেন। ১৯৯১ সালে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রবর্তন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল, যা আধুনিক করব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। আমরা লক্ষ্য করেছি, এ সময়ে সরকার দারিদ্র্যবিমোচন এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ওপরও গুরুত্ব দেয়। উদাহরণস্বরূপ, বয়স্ক ভাতার মতো কর্মসূচি চালু করা হয়, যা দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি নিরাপত্তা জাল প্রদান করে। এ ছাড়া, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো হয়, বিশেষ করে গ্রামীণ সড়ক নির্মাণে, যা কৃষি ও অ-কৃষি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল।
২০০০ সালের পর থেকে আমাদের বাজেটনীতি কিছুটা বাস্তবভিত্তিক হতে শুরু করে। ডিজিটাল বাংলাদেশ, ভিশন ২০২১ ইত্যাদি রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাজেটে প্রতিফলিত হতে শুরু করে। মাঝে কিছু রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও ২০০০-এর শুরুর দিকের সরকার আগের দুটি সরকারের ধারাবাহিক অগ্রগতি বজায় রাখে এবং ২০০৮ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক মেয়াদে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বাজেটে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। একদিকে যেমন অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ হয়েছে; পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, পরমাণু বিদ্যুৎপ্রকল্প, বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক টার্মিনাল নির্মাণ ইত্যাদি অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে বহু গুণ। আমরা লক্ষ্য করেছি, এ সময় বাজেট শুধুই আর্থিক দলিল না থেকে একটি রাজনৈতিক ঘোষণাপত্রে রূপ নেয়।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটঘাটতি ছিল জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমে যাওয়ার অভিযোগও ওঠে। এ ঘাটতি পরিচালনার ক্ষেত্রে বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা এবং দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত এক দশকে বাজেটের সবচেয়ে দৃশ্যমান অগ্রাধিকার ছিল রেডিমেড গার্মেন্টশিল্প। ৪০ লাখের বেশি মানুষ এ খাতে সরাসরি যুক্ত এবং পরোক্ষভাবে কয়েক কোটি মানুষ গার্মেন্টশিল্পের আয়ের ওপর নির্ভর করে। রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই এখান থেকে আসে। সরকার কর ছাড়, নগদ সহায়তা ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে এ খাতকে উৎসাহিত করে আসছে বহু বছর ধরেই। ২০২৫ সালের ট্রাম্প প্রশাসনের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র যখন ৩৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা দেয়, তখন এই একমুখী নির্ভরতার দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে। তবে আশার কথা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও চায়নার ওপর তাদের আরোপিত শুল্কের হার আরও বেশি।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে আমি যতটা আগ্রহী, ততটাই চিন্তিত। কারণ এ বছর আমরা একাধিক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি। প্রথমত, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সরকারের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কিছু উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র বাজেট সহায়তা দিতে আগ্রহ হারাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ বেড়েছে। গত বছর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে আমাদের প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি দিতে হয়েছে, এবং এই পরিমাণ আরও বাড়বে। আগামী বাজেট হবে এক ধরনের সমন্বয়ের বাজেট, যেখানে একদিকে ঋণ পরিশোধ, অন্যদিকে জনগণের প্রত্যাশা; দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আমি মনে করি আসবে ভর্তুকি ব্যবস্থায়। সরকার ইতোমধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমানোর ঘোষণা দিয়েছে। আগামী বাজেটে হয়তো গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দামে বড় রকমের পরিবর্তন আসবে। এর প্রভাব পড়বে উৎপাদন খরচে, যার চূড়ান্ত ভুক্তভোগী হবে সাধারণ মানুষ।
এবারের বাজেট নিয়ে ব্যবসায়ীদের আশা নির্ভর করছে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের ওপর। কয়েক বছর ধরে চলমান ব্যাংকিং খাতে দুর্বলতা, ঋণখেলাপি সমস্যা, ডলারসংকট ও আমদানি-নির্ভরতা ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। অনেক উদ্যোক্তা বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন নিরাপত্তার অভিযোগে। এবারের বাজেটে যদি বিদেশি বিনিয়োগ টানতে কর সুবিধা ও অবকাঠামোগত সমাধান না থাকে, তাহলে অর্থনীতির গতি মন্থর হবে। যদিও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতেই সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া উচিত; কোভিড-পরবর্তী সময়ে শিক্ষা খাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন পর্যন্ত কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আমরা দেখিনি। উপরন্তু সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে।
বছরের পাঁচ মাস পার হলেও অনেক শিক্ষার্থী এখনো তাদের পাঠ্যপুস্তক বুঝে পায়নি। বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক সংকট, শ্রেণিকক্ষের অভাব, কারিকুলাম সমস্যার সমাধান দরকার। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়লেও সেবার মান বাড়েনি। জেলা হাসপাতালগুলোতে ওষুধ নেই, চিকিৎসক নেই, অথচ বাজেট পাস হয় হাজার হাজার কোটি টাকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই এবারের বাজেটে যেন এসব মৌলিক খাতে নজর দেওয়া হয়, উন্নয়ন যেন হয় নিচ থেকে।
সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে, বাজেটের প্রভাব জনগণের জীবনে সরাসরি অনুভূত হয়। আমরা দেখেছি, গত দশকে সরকারের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সড়ক নির্মাণ, জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে। ২০১৯ সালে এশিয়া ফাউন্ডেশনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে। তবে, বাজেটের স্বচ্ছতা এবং বাস্তবায়নের অভাব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, বড় প্রকল্পগুলোর ব্যয় প্রায়ই পরিকল্পিত বাজেটের চেয়ে বেশি হয়েছে, যা দুর্নীতির অভিযোগকে উসকে দেয়। আশা করব এ বছরের বাজেটে সরকার জনগণের উদ্বেগগুলো বিবেচনায় নেবে এবং স্বচ্ছতা বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নেবে।
বাংলাদেশের বাজেটের ইতিহাস আমাদের জাতির সংগ্রাম ও অগ্রগতির একটি দলিল। আসন্ন বাজেটে সরকারের উচিত হবে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা। এ বাজেট শুধু অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নয়, বরং আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ গঠনের একটি রূপরেখা। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে উচ্চাশা অবান্তর, কিন্তু আপদকালীন পরিস্থিতি সামলানোর দিকনির্দেশনাটুকু যেন অন্তত থাকে।
লেখক: জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ
[email protected]