ঢাকা ২৫ আষাঢ় ১৪৩২, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫
English

অর্থবছর পরিবর্তন করতে হবে

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৫, ০১:৪১ পিএম
অর্থবছর পরিবর্তন করতে হবে
আনু মুহাম্মদ

প্রথমে বলতে চাই- অর্থবছর পরিবর্তন করতে হবে। আমরা জানি, ব্রিটিশ আমল থেকে অর্থবছর জুলাই-জুন হিসেবেই আছে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়াসহ হাতে গোনা কয়েকটা দেশ এখনো অর্থবছর হিসেবে জুলাই-জুন ব্যবহার করে। বাকি সবাই তাদের নিজ দেশের পরিস্থিতি, কিংবা নিজ দেশের প্রয়োজন বা আবহাওয়া সবকিছু মিলিয়ে এটা পরিবর্তন করে। সেই হিসেবে কোথাও কোথাও জানুয়ারি-ডিসেম্বর, কোথাও কোথাও এপ্রিল-মার্চ, আবার কোথাও কোথাও মার্চ-ফেব্রুয়ারি আছে। বাংলাদেশে হতে পারে বাংলা বছর বৈশাখ-চৈত্র, ১৪ এপ্রিল-১৩ এপ্রিল অথবা হতে পারে জানুয়ারি-ডিসেম্বর। জুলাই-জুন অর্থবছরের বড় সমস্যা হলো আগের বছর যখন শেষ হয় তখন প্রচুর ঝড়বৃষ্টি থাকে। সে সময় দুর্নীতি-অনিয়মের সুযোগ বেড়ে যায়। অর্থের অপচয় হয় এবং কাজগুলো ঠিকমতো শেষও করা যায় না। সেই কারণে এটা মনে হয় পরিবর্তন হচ্ছে না। এ সরকার দায়িত্ব নিতে পারে। 

দ্বিতীয়ত, সরকারের বড় দায়িত্ব হচ্ছে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উদ্যোগ নিয়ে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের গতিপথ তৈরি করা। আমরা জানি এ সরকার অন্তর্বর্তী সরকার, এ সরকার দীর্ঘদিন থাকবে না। ফলে, তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব নয়। কিন্তু কিছু উদ্যোগ সরকার সহজেই নিতে পারে। যেমন- শিক্ষা ও চিকিৎসা খাত। এই দুই খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি একটা বহু বছরের দাবি। অথচ এখনো সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ একেবারে নিচের দিকে। যেখানে হওয়ার কথা জিডিপির ৫-৬ শতাংশ সেখানে আছে ১-২ ভাগ। অর্থাৎ যথাযথ উদ্যোগ নিলে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ বাড়বে কয়েক গুণ। 
বর্তমানে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ খুব কম আবার তার মধ্যেও প্রচুর দুর্নীতি এবং অনিয়ম হয়।

 অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল বিদেশ সফর, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প আছে। এগুলো বাদ দিতে হবে, স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রত্যেকটা বাজেট, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তার বরাদ্দ বিস্তারিত ওয়েবসাইটে থাকতে হবে। মানুষ দেখবে- কোনটা আসল, কোনটা অপচয় বা দুর্নীতি। একটা উদাহরণ দিই- না চাইলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ করে উন্নয়ন বাবদ বরাদ্দ এল ১৫০০ কোটি টাকা। পেছনে পেছনে হাজির হলো কিছু ঠিকাদার, স্থপতি, চাঁদাবাজ। একের পর এক ভবন নির্মাণ শুরু হয়ে গেল, অপরিকল্পিত যথেচ্ছাচার। ঠিকাদাররাই সব ঠিক করছে তখন। 

আমরা মাস্টার প্ল্যান করার কথা বলছি কিন্তু ওপর থেকে আশীর্বাদ পাওয়া প্রশাসন কোনোকিছুই কানে তুলছে না। পুরো ক্যাম্পাসের বড় ক্ষতি হলো। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একই রকমভাবে অপচয় ও দুর্নীতির উৎসব চলেছে। এ ধরনের বরাদ্দ থেকে বাজেটে দেখাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ল! চিকিৎসা খাতেও এরকম অনেক কেনাকাটা হচ্ছে। মেশিনপত্র পড়ে আছে, ব্যবহার নেই। দামি যন্ত্র কেনা হয়েছে, লোক নিয়োগ করা হয়নি। ভবন নির্মাণ হয়েছে, হাসপাতাল ভবন, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এগুলোর ক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে। 

পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একটা সংস্কার খুব সহজ ছিল এ সরকারের জন্য। তা হচ্ছে- এটা ঘোষণা করা যে- প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সব উপদেষ্টা, বিশেষ সহকারী, রিপ্রেজেনটেটিভ, সরকারি আমলা, সবাই তাদের চিকিৎসা বাংলাদেশের পাবলিক হাসপাতালে গ্রহণ করবেন। এটা করলে পাবলিক হাসপাতালে জাদুর বাক্সের মতো পরিবর্তন হয়ে যেত। এবং সেই সঙ্গে যদি তারা সিদ্ধান্ত জানাতেন যে, তাদের সন্তানরা বাংলাদেশের পাবলিক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তাহলে দেখতে পেতেন এগুলোর চেহারাও পরিবর্তন হয়ে যেত। এ সূচনাটা তারা সহজেই করতে পারতেন। কিন্তু এর কোনো লক্ষণ নয় মাসেও আমরা দেখতে পাইনি। বাজেটের আগে এ ধরনের ঘোষণা হলে বরাদ্দের যে গুণগত দিক, তারও একটা পরিবর্তন হওয়া খুবই সহজ হতো।

আরেকটা কাজ হচ্ছে- জাতীয় সক্ষমতা। জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রশিক্ষণ, গবেষণা। জাতীয় সক্ষমতার ভিত্তিতে একটা দেশ যদি অগ্রসর না হয় তাহলে কোনো টেকসই পরিবর্তন হয় না। স্যাটেলাইট কিনে গত সরকার বাহাদুরি করল। এর জন্য সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়, এসব বাহাদুরি দেখিয়ে দেশ কখনো অগ্রসর হতে পারে না। এর বদলে এর একাংশ টাকা তারা যদি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিজ্ঞানী, গবেষকদের গবেষণা করতে দিত তাহলে বিজ্ঞান গবেষণার একটা স্থায়ী ভিত্তি তৈরি হতে পারত। সেই জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টাই গুরুত্বপূর্ণ। 

চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার কথা প্রধান উপদেষ্টা এমনভাবে ঘোষণা করলেন যে, এটা দিতেই হবে। যেকোনো মূল্যে দিতে হবে। কিংবা করিডর তৈরি করতে হবে। স্টার লিংকের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। এসবই জাতীয় সক্ষমতার বিকল্প হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। এখানে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষেত্রে সরকারের কী করণীয় ছিল, কী করতে পারত? বিদেশি কোম্পানি আনতেই হবে- এরকম দৃঢ়তা না দেখিয়ে তারা যদি দৃঢ়তা দেখাতেন চট্টগ্রাম 
বন্দরে যেসব দুর্বলতা আছে, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব আছে, এগুলো দূর করার জন্য জাতীয় দক্ষতা বাড়ানো। প্রয়োজনে যদি দরকার হয় 
প্রশিক্ষণে পাঠানো বা প্রশিক্ষক নিয়ে আসা- এগুলো করতে পারতেন। 

আমাদের দরকার গ্যাস উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো। সেটার জন্য গত ৯ মাসে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সামনে বাজেটে এ বিষয়গুলো থাকতে হবে। জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিগত অবস্থানের একটা পরিবর্তন করতে হবে। শতভাগ মালিকানায় দেশের সম্পদ দেশেই ব্যবহার সম্ভব হলে নিরাপত্তা থাকবে, সুলভে গ্যাস পাওয়া যাবে, সুলভে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। তার ওপর আমরা নির্ভর করতে পারব। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যে বিশাল ভর্তুকি দেখা যাচ্ছে, তা একেবারে কমে আসবে যদি নিজেদের জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করি। সরকারের একটা সুযোগ ছিল এ কাজগুলো করে পরিবর্তন দৃশ্যমান করার।  

আমরা আগের সরকারগুলোর সময় দেখেছি যে, রেলওয়ের সৈয়দপুর, চট্টগ্রামে যেসব ওয়ার্কশপ ছিল তার জনবল কমানো হয়েছে, বহু বছরে তৈরি দক্ষ জনশক্তিকে বেকার বানানো হয়েছে। ইঞ্জিন, ওয়াগন, বগি সবকিছু আমদানি করা হচ্ছে। অথচ ওয়ার্কশপ যদি শক্তিশালী করা হতো তাহলে বাংলাদেশেই রেলের বগি, ইঞ্জিন নির্মাণ করা সম্ভব হতো। রেলওয়ে-নির্ভর একটা যোগাযোগব্যবস্থা যদি আরও বিস্তৃত হতো তাহলে অনেক অপচয়, পরিবেশদূষণ, দুর্ঘটনা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারতাম।

প্রধান উপদেষ্টার মুখে আমরা থ্রি-জিরোর কথা শুনি। তার থ্রি-জিরোর মধ্যে একটা হলো কার্বন কমানো। কিন্তু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেই যাচ্ছে। দ্বিতীয় হলো বেকারত্ব শূন্য করা। গত নয় মাসে নতুন বেকার হয়েছে লাখেরও বেশি। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। তৃতীয় হলো শূন্য দারিদ্র্য, গত ৯ মাসে ২০ লাখের বেশি দারিদ্র্য বেড়েছে। তার মানে আমরা কথা শুনছি একরকম, কাজ দেখছি আরেক রকম। 

সর্বশেষ বলতে চাই, সরকারের কাজ ছিল বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশ নির্মাণের গতিমুখ ঠিক করা। এ সরকার অস্থায়ী সরকার, এর স্থায়ী কোনো ম্যান্ডেট নেই। সুতরাং তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব নয়। সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট হয়েছে, কিছু সংস্কারের প্রত্যাশা রয়েছে এবং কিছু করণীয় আছে, যেগুলো তারা খুব সহজেই শুরু করতে পারতেন, যাতে জাতীয় সক্ষমতার ভিত্তিতে দেশ অগ্রসর হতে পারে।

লেখক: শিক্ষাবিদ

রপ্তানি বড় ধরনের চাপে পড়বে

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৮ এএম
রপ্তানি বড় ধরনের চাপে পড়বে
সেলিম রহমান

বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপের যুক্তরাষ্ট্রের একক সিদ্ধান্ত আরোপিত হলে তা হবে আমাদের জন্য চরম অর্থনৈতিক ধাক্কা। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। এর ফলে আগে যেখানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো, সেখানে এখন দ্বিগুণেরও বেশি দিতে হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিষয়টি বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।

এই পারস্পরিক শুল্ক আরোপের যৌক্তিকতাও স্পষ্ট নয়, যা উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। এখনো জানা যায়নি বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ- যেমন ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ওপর কত শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। 

যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দফায় ১৪টি দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত হারই সর্বোচ্চগুলোর একটি। অন্যদের ক্ষেত্রে হার কম হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের প্রতিযোগিতামূলক অসুবিধায় পড়বে। এতে ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি সরবরাহ চেইন-পরিকল্পনাও জটিল হয়ে উঠবে।

পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও গভীর। বাড়তি খরচের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা তুলনামূলকভাবে কম শুল্কের দেশে অর্ডার স্থানান্তর করতে পারেন। তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ, যা মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশ তাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শুল্ক আলোচনা যেভাবে হয়েছে তাতে বাংলাদেশ কোনো সুবিধাজনক অবস্থান আদায় করতে পারেনি। ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিবর্তনশীল পরিবেশে আরও দুর্বল করে তুলবে। তার পরও আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। 

পাশাপাশি বহুমুখী ও কৌশলগত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানি বৈচিত্র্য এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পোশাক খাতের বাইরের শিল্প গড়ে তোলা এখন অত্যাবশ্যক। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। এই বিষয়গুলো অনেক দিন থেকে বলা হলেও কাজ হচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতির মতো অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের মতো দেশের ভালো প্রস্তুতি না থাকলে বড় ধরনের চাপে পড়তে হবে। 

লেখক: সানেমের নির্বাহী পরিচালক

দর-কষাকষি করতে হবে

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৩ এএম
দর-কষাকষি করতে হবে
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারপ্রধান যেহেতু বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, তাই এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে আলোচনা করতে হবে। ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। কাজেই সেই পর্যন্ত দর-কষাকষি করতে হবে। যাতে ভিয়েতনামের কাছাকাছি যাওয়া যায়। ভিয়েতনামও হয়তো দর-কষাকষি করে এই পর্যায়ে এসেছে। তাই আমাদের সরকারকেও সেভাবে এগোতে হবে। তা না হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় ঝুঁকিতে পড়বে দেশ। 

বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ মোট ১৪টি দেশের ওপর নতুন করে শুল্কহার নির্ধারণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। 

হোয়াইট হাউসের ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির সময়সীমা শেষ হতে চলায় ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন। 

এর আগে ৯ জুলাই থেকে শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সেটি পিছিয়ে ১ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজেই এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে।

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো

কতটুকু গিলতে পারব তা দেখার বিষয়

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:২৫ এএম
কতটুকু গিলতে পারব তা দেখার বিষয়
ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক

ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ ঘোষণা করেছেন। কাজেই সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে জোরালোভাবে দর-কষাকষি করতে হবে। তবে দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র কী চায়। তারা এমন জটিল ও কঠিন শর্ত দিল, যা পূরণ করা সম্ভব নয়। যেটা ভিয়েতনামে দেওয়া হয়েছিল। তারা পূরণ করতে পারলেও আমরা সেই কঠিন শর্ত পূরণ করতে পারব না। 

এ ছাড়া চীন, পাকিস্তানসহ যারা প্রতিযোগিতামূলক বাজার দখল করে আছে, তাদেরও দেখতে হবে। অনেক দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বসিয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। প্রতিযোগিতার বাজার স্লো হয়ে যাবে। তারা কী শর্ত উল্লেখ করেছে, সেটাও দেখার বিষয়। এটা যেহেতু জানা যায়নি। তাই বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা কতটুকু গিলতে পারব তা দেখার বিষয়। 

তারা গ্লোবালি (সারা বিশ্বে) শুল্ক আরোপের কথা বলেছে। এতে সবাই চাপে পড়বে। বিভিন্ন দেশে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে ৩৫ শতাংশ। যা ২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। এখনো মাঝে কিছুদিন সময় আছে। এই সময় কাজে লাগাতে হবে। 

ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান      

ক্ষমতার বলয়ে বাংলার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৬:৩৬ পিএম
ক্ষমতার বলয়ে বাংলার প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ

মানুষকে ভাষা দিয়ে চেনা যায়, চেনা যায় ক্ষমতা দিয়েও। ভাষা বরঞ্চ অধিক বাঙ্ময়, ক্ষমতার চেয়ে। মুখ খুললেই বক্তার পরিচয় হেসে-খেলে কিংবা রেগে-মেগে বের হয়ে আসে। ভাষা পারে চুম্বকের মতো কাছে টেনে নিতে এবং যন্ত্রের মতো ঠেলে দিতে পারে দূরে। কাছে টেনে নেওয়াটা বিশেষভাবে ঘটে প্রবাসে; প্রবাসে বাঙালি মাত্রই বাঙালির মিত্র, শত্রুতে পরিণত হওয়ার আগে। এ বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনেকেরই রয়েছে, আমারও আছে বলে দাবি করতে পারি। আজ থেকে ৬৭ট্টি বছর আগে আমি বিদেশে গিয়েছিলাম পড়তে। তখন আমরা পাকিস্তানি। সেই পরিচয়েই গিয়েছি ব্রিটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি নিয়ে। উর্দুভাষী যে পাকিস্তানিরা সহযাত্রী ছিল আমার, তাদের কারও কারও সঙ্গে যে বন্ধুত্ব হয়নি তা নয়, হয়েছে। কিন্তু বিদেশে পা দিয়ে বাঙালি মাত্রকেই বন্ধু মনে হয়েছে, সে বাঙালি যে রাষ্ট্রেরই নাগরিক হোক; ভারত-পাকিস্তান তখন শত্রুর সম্পর্ক, কিন্তু সেই শত্রুতা ভারতীয় বাঙালিদের আপনজন ভাবার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়নি।

 পরে, একাত্তর সালে, ভাষার টানের আত্মীয়তাটা আবার দেখেছি, হিন্দু ধর্মের মানুষ মাত্রই কাফের ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের কাছে; তবে এমন ঘটনা গল্পে নয় বাস্তবেই ঘটেছে, বিমানবিহারীকে তার নাম শুনে তারা ছেড়ে দিয়েছে, বিহারি ভেবে, কিন্তু তাজুল ইসলামকে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখেছে লোকটা জয় বাংলার মানুষ কি না সেটা জানার জন্য। ১৬ ডিসেম্বরের পরে নিজের চোখে দেখেছি কাপ্তানবাজারের কসাইপাড়ার যে বিহারিরা কসমখাওয়া পাকিস্তানি ছিল, বাঙালি নিধন যাদের ধর্মীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিহারি এবং অবশ্যই হিন্দিভাষী হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যদের কী অসামান্য দোস্তালি। জড়িয়ে ধরছে, গলাগলি করছে, টেনে নিয়ে চা খাওয়াচ্ছে, পাটনা ও মুঙ্গেরের খবর আদান-প্রদান করছে। ধর্ম ও রাষ্ট্র মিথ্যা হয়ে গেছে ভাষার হাতে পড়ে। হ্যাঁ, ভাষা এ ক্ষমতা রাখে বৈকি। রাখতে থাকবে।

তবু অনেক ক্ষেত্রেই ভাষার চেয়ে বেশি জোরদার হয় রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থের শক্তি। সেই শক্তি ক্ষমতা রাখে ভাষাকে জব্দ করার। বাঙালিরা যে দুটি রাষ্ট্রে ভাগ হয়েছে সেটা ভাষার কারণে নয়, ক্ষমতার কারণে। ক্ষমতা ছিল রাষ্ট্র ও রাজনীতির হাতে, সেই ক্ষমতার বলীয়ান যারা ভূখণ্ডকে তারা দুই টুকরা করে ছেড়েছে। আর বাংলাদেশেও বাঙালিরা যে এক নয়, তার কারণ কারও হাতে ক্ষমতা আছে, কারও হাতে ক্ষমতা নেই। ক্ষমতাবানরা আগে ছিল অবাঙালি, এখন যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা বাঙালি পরিচয়েই এসেছিল বটে, কিন্তু ক্ষমতা পেয়ে বাংলাভাষা ব্যবহার করছে কম, কথাবার্তায় বাংলা বলে ইংরেজি মিশিয়ে। যার কথায় যত বেশি ইংরেজি শব্দ, বুঝতে হবে সে ব্যক্তি তত অধিক ক্ষমতাবান। অন্য প্রমাণের দরকার পড়ে না, ওই একটি প্রমাণই যথেষ্ট, এ সত্য প্রমাণের জন্য যে ক্ষমতাবানরা বাঙালি থাকছে না, থাকতে চাইছে না, যতই উঠছে ততই বিচ্যুত হচ্ছে তাদের আদি বাঙালিত্ব থেকে। এ ভূখণ্ডের আদিবাসীরা আগের কালে ক্ষমতাবঞ্চিত ছিল, এখনো তাই। বাংলা ভাষা যখন রাষ্ট্রভাষা হয় তখনো তা রাষ্ট্রের ভাষা হয় না। কেননা রাষ্ট্র ও ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। রয়েছে তাদের হাতে, যারা বাংলা বলতে অনাগ্রহী।

ক্ষমতা যে ভাষার চেয়ে জোরদার, সে অভিজ্ঞতা লাভ ওই আমার প্রথম প্রবাসকালেই ঘটেছিল, ঢাকায় ফেরার পথে বাঙালির শহর কলকাতায় থেমে। কলকাতায় এসেছিলাম জল ও স্থলপথে। জাহাজে যে কয়জন বাঙালি ছিল সবার সঙ্গেই খাতির জমেছিল, আমরা তিন বাঙালি তো একই কেবিনে থেকেছি, ২০ দিন। করাচিতে একজন নেমে গেছে, সে জাহাজ ধরবে অস্ট্রেলিয়ার, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দেবব্রত আর আমি বম্বে (মুম্বাই) হয়ে এসেছি কলকাতায়। হাওড়া রেল স্টেশনে পা দিয়েই মনে হলো দেশে ফিরেছি। আমার ছেলেবেলার একটা অংশ কলকাতায় কেটেছে, ১৩ বছর পরে সেখানে এসে আপনজনদের দেখতে পেলাম, যদিও কাউকেই আমি চিনি না, এক দেবব্রতকে ছাড়া।

 বিকেলে পরিচিত রাস্তাঘাটে হাঁটাহাঁটি করেছি, চৌরঙ্গী এলাকায় কোনো সিনেমা হলে পাওয়া না যাওয়ায় ভবানীপুরে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখেছি। সন্ধ্যার পরে দেবব্রতের সঙ্গে ধর্মতলা, গড়ের মাঠ, পদ্মার ধার, এসব জায়গায় পায়চারি করেছি। অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটল পরের দিন সকালে। অতিপ্রত্যুষে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের লোক আমাকে জমা রেখে গেছে গ্র্যান্ড হোটেলে, পরদিন সকালে তাদের ড্রাইভার এসে নিয়ে যাবে দমদম বিমানবন্দরে। বাক্সপেঁটরা নিয়ে নিচে নেমে দেখি হোটেলের কাউন্টারে কাজ করছেন এক বাঙালি ভদ্রলোক। আমি উৎফুল্ল হয়ে তার কাছ থেকে বিদায় চেয়েছি, যেন আপনজন। তিনি বললেন, ‘বিলের টাকা দিন’। আমি বললাম, ‘সে তো দেবে ব্রিটিশ কাউন্সিল।’ তিনি কাগজপত্র নাড়াচাড়া করে বলেন, ‘না, তেমন কোনো চিঠি তার টেবিলে নেই।’

গোলমাল আঁচ করে অপেক্ষমাণ ড্রাইভারটি এগিয়ে এসে জানতে চাইল ঘটনা। সে লোক কলকাতার আদিবাসী, কথা বলে বাংলার সঙ্গে উর্দু মিশিয়ে; কাউন্টারের ভদ্রলোককে সে বলল, ‘কোনো অসুবিধা নেই, আমার সত্যবাদিতার বিষয়ে সন্দেহ দেখা দিয়ে থাকলে ফোন করে আমার সাহেবের সঙ্গে কথা বললেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’ বলে ফোন নম্বর দিল এবং আশ্বস্ত করল যে, তার সাহেবকে অবশ্যই বাসায় পাওয়া যাবে; এত সকালে যাবেন আর কোথায়, নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছেন। ঘুমন্ত ইংরেজ সাহেবকে জাগানো ঠিক হবে কি না, এ ব্যাপারে হোটেলের বাঙালি কর্মচারীটিকে দ্বিধান্বিত দেখে লোকটি পকেট থেকে তার সচিত্র পরিচয়পত্র বের করে বলল, ‘এই যে আমার নাম-ঠিকানা, সব লিখে নিন, দরকার হলে আমি সই করে দিচ্ছি। কিন্তু আর বিলম্ব করবেন না। করলে প্লেন ধরা যাবে না।’ এতে কাজ হলো। ড্রাইভারটি সই করল, আমি মুক্ত হলাম।

পথিমধ্যে সে তার মিশ্রিত ভাষায় আমাকে জ্ঞানসমৃদ্ধ করল। পার্টিশনের পরে সে ঢাকায় গিয়েছিল, কিন্তু নকরির সুবিধা না দেখে অল্পদিন পরে ওয়াপস চলে এসেছে। সে মুসলমান, সেই হিসেবে আমার নিকটজন, তাই বলেছে কথাটা। কথাটা হলো, আমি মস্তবড় ভুল করেছি কাউন্টারে বাংলা বলে। আমি হচ্ছি ব্রিটিশ কাউন্সিলের গেস্ট, ফিরছি লন্ডন থেকে কিন্তু সেটা বোঝা যাবে কী করে, বাংলা বললে? যদি বাংলায় কথা না বলে ইংরেজিতে দাপট দিতাম, তাহলে দেখা যেত কত সহজে কাজ হচ্ছে। কাউন্টারের ভদ্রলোক এতসব কথা বলতেন না, চোখ তুলে তাকাতেনও না, ঘাড় গুঁজে কুইকুই করে আমাকে বিদায় দিতেন।

 এ আলোচনা আর যাতে না এগোয় সেই লক্ষ্যে আমি ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করি, জানতে চাই ঢাকা তার কাছে কেমন লেগেছে। বলল, না, ঢাকা তার মোটেই ভালো লাগেনি, খুবই গরিব শহর। দেখি বেশ দাপটের সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে, একে তো কলকাতার বাসিন্দা, তদুপরি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। শহর ছেড়ে শহরতলির ভেতর দিয়ে চলছে গাড়ি, চারপাশে মানুষ জেগে উঠছে, তাদের ভাষা বাংলা, কিন্তু তাদের হাতে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা অবাঙালির হাতে। গ্র্যান্ড হোটেলের নিম্নপদস্থ কর্মচারীটিই শুধুই বাঙালি, তার ওপরের সবাই উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয়। ওই অবস্থানে থাকলে আমিও হয়তো অমন আচরণই করতাম, কাউন্টারে বাঙালি ভদ্রলোক যেমনটা করেছেন আমার সঙ্গে।

এটা ১৯৬০ সালের কথা। তার পর অবস্থার যে বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। পশ্চিমবঙ্গে এখন একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়, আরও বড় খবর এই যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ঠিক করেছে অফিস-আদালতে এখন থেকে বাংলা ব্যবহার করা হবে, ইংরেজির পরিবর্তে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তো স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, সে ভারতের একটি প্রদেশ মাত্র, সীমানা পার হলেই বাংলাভাষা হারিয়ে যায়, রবীন্দ্রনাথ পরিণত হন একজন প্রাদেশিক কবিতে। একদিন তার গান ভারতের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছিল, কিন্তু সেটা অতীতের ব্যাপার, একালে হলে পেত না। একালে অন্য ক্ষমতা তো বটেই, সাংস্কৃতিক ক্ষমতাও চলে গেছে অন্যদের হাতে। আগের দিনে বাঙালি লেখকরা ইংরেজি ছেড়ে বাংলায় লিখতেন। কেননা, দেশ তখন প্রত্যক্ষরূপে পরাধীন ছিল এবং পরাধীনতাকে তারা পরাধীনতা বলেই জানতেন। আজকের দিনের পরাধীনতাটা অপ্রত্যক্ষ, যে জন্য পরাধীনতাকে স্বাধীনতা বলে মনে করা সম্ভব হচ্ছে। 

মাইকেল মধুসূদন দত্ত তার মাইকেল পরিচয় ফেলে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মধুসূদন হতে চেয়েছিলেন, আজকের দিনের কোনো মাইকেল অমনটি করবেন না। তিনি বরঞ্চ তার মধুসূদনত্বকেই বর্জন করতে চাইবেন। মাইকেল সত্তাকে উচ্চে তুলে ধরবেন; লিখবেন ইংরেজিতেই কেননা, ওই ভাষার ক্ষমতা বেশি, বাজারের কারণে। কোনো গ্লানি নেই।
বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গে প্রাদেশিক ভাষাই থাকবে, যতই উচ্চে উঠুক না কেন। প্রাদেশিক ভাষা হবে, সরকারি হবে না। 

তাছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষমতাও তো বাঙালির হাতে নেই, যে হোটেলের মালিক অবাঙালি, তার বাঙালি কর্মচারীটির সাধ্য কি সেই মালিকানায় পরিবর্তন আনে, সে বেচারা বাঙালি গ্রাহক দেখলে বরঞ্চ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, ভাবে ঠকাবে, নয়তো পালাবে বিল বাকি রেখে। বড় দোকানেও এমনই ঘটনা। কর্মচারীটি বাঙালি, ক্যাশবাক্স নিয়ে বসে রয়েছে অবাঙালি। বাঙালি কর্মচারী অবাঙালি ক্রেতা পেলে খুশি হয়, বাঙালি আগন্তুক দেখলে ধরে নেয় নাড়াচাড়া করবে, কিনবে না। সব মিলিয়ে সত্যটা এই যে, দপ্তরে যাই হোক, ক্ষমতার বলয়ে বাংলার প্রবেশাধিকার মোটামুটি নিষিদ্ধ।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটারদের পক্ষে টানতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার

প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ০৬:৩২ পিএম
ভোটারদের পক্ষে টানতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দরকার

গণতন্ত্রে রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একমাত্র পদ্ধতি। বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য মাঝে-মধ্যে এ ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে। গত ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর দেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এ অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হলো দেশে একটি সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা। এ জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে সেই পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। কবে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন- এ প্রশ্নের এখনো স্পষ্ট কোনো উত্তর নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় নিয়ে এখনো পুরোপুরি ঐকমত্য নেই। একাংশের মধ্যে দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিও যেমন রয়েছে, তেমনি অন্য অংশের নেতারা এ বিষয়ে সংস্কার এবং বিচারের প্রসঙ্গে যৌক্তিক সময় নিতে বলছেন।

নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে- এ বিষয়ে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতামত এবং অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রাজনীতিতে তারা এখন বিশেষ ফ্যাক্টর। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র-তরুণদের এ দলটি আলাদা ধরনের গুরুত্ব বহন করছে বলে পরিষ্কার ধারণা করা যায়। সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলন এখন এ দলটির মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। তারা কখন কীভাবে নির্বাচন চাইবে, কোন সময় চাইবে, কোন শর্তে চাইবে, সংস্কার এবং বিচারের আগে না পরে- এ ধরনের অনেক বিষয়ের সঙ্গেও সরকারের সদিচ্ছার প্রসঙ্গটি জড়িত বলে অনেকেই মনে করেন। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়।

ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ১১ মাস অতিবাহিত হয়েছে। এখন পর্যন্ত নির্বাচনের যেমন সুস্পষ্ট রোডম্যাপ সরকারের পক্ষ থেকে আসেনি, ঠিক তেমনি কোনো রাজনৈতিক দলও তাদের জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক রোডম্যাপ যথাযথভাবে ঘোষণা করেনি। আবার  নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি থাকলেও তারা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সিগন্যাল পায়নি বলে বিভিন্ন বক্তব্য থেকে আমরা জেনেছি। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করতে কিংবা নির্বাচনের লক্ষ্যে ভোটারদের নিজেদের পক্ষে টানতে কোনো ধরনের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। চোখে পড়ার মতো কোনো রাজনৈতিক রোডম্যাপ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে জনগণ পাচ্ছে না। জনগণের কাছেও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বার্তা পৌঁছাচ্ছে না। 

যেকোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ সাধন করা। এ ক্ষেত্রে জনগণ যেভাবে চান ঠিক সেভাবেই তাদের কাজ করতে হয়। নির্বাচনের দিন-তারিখ ঠিক হলেই যেসব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তাও কিন্তু নয়। রাজনীতিতে টানাপোড়েন বাড়তে থাকলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়তে থাকবে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে সব পক্ষকে একটি যথাযথ এবং ন্যায্য দিকে হাঁটতে হবে। কারণ যথাযথ রাস্তায় হাঁটতে না পারলে কোনোভাবেই দেশে ইতিবাচক রাজনীতির সূত্রপাত হবে না। এ কারণে প্রয়োজন একটি উইন উইন পরিস্থিতির। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক পক্ষকেই বিশেষ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকতে হবে। সব পক্ষ থেকে ছাড় দিতে না পারলে কোনোভাবেই উইন উইন পরিস্থিতি আশা করা যায় না। 

বাংলাদেশে এ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি শতাধিক নিবন্ধনহীন এবং ব্যক্তিনির্ভর দল রয়েছে। ইতোমধ্যেই নতুন ১৪৭টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দিয়েছে। সেসব দলের অধিকাংশেরই কোনো অফিস নেই, আবার অফিস থাকলেও সভাপতির নিজের বাসার ড্রয়িংরুম অফিসের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমসূত্রে জানতে পেরেছি। অনেক দল রয়েছে যেগুলোর সভাপতির নাম পাওয়া যায় কিন্তু সাধারণ সম্পাদকের নাম পাওয়া যায় না। এ ছাড়া বিদ্যমান নিবন্ধিত অনেক দলই সাইনবোর্ড সর্বস্ব রাজনৈতিক দল। নিবন্ধিত দলগুলোর মধ্যে কয়েকটি ছাড়া আর কারও তেমন জনসমর্থন নেই। বাকি দলগুলোর তেমন একটা জনসমর্থন না থাকলেও দলের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিশাল বিশাল সাইনবোর্ড রয়েছে। এদের তৎপরতা দেখা যায় শুধু নির্বাচন মৌসুম এলেই। নির্বাচনের আগে এ দলগুলোর কদর বেড়ে যায়। বড় দলগুলোর সঙ্গে জোটভুক্ত হওয়া, নির্বাচনে মনোনয়ন এবং ক্ষমতা ভাগাভাগির দর কষাকষি চলে। 

যেকোনো রাজনৈতিক দল বৈধ এবং সাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক দলগুলো জোট গঠন করেও ক্ষমতায় আসে এবং আসার চেষ্টা করে। আমাদের দেশে বিদ্যমান নামসর্বস্ব দলগুলোর কোনো জনসমর্থন নেই। 
আমরা আশা করব, বাংলাদেশের বিদ্যমান এবং নবগঠিত রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকার অর্থেই জনগণের জন্য কাজ করবে। 

এমনকি সব দল এবং দলের নেতারা সহনশীল হবেন, সংযত হবেন। অতীত বা বিগত দিনগুলোর অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগিয়ে দেশবাসীর কল্যাণের রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবেন, যাতে দেশ স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক ধারায় চলতে পারে, যাতে দেশে কোনো অপশক্তি মাথাচাড়া দেওয়ার মতো অবস্থা ভবিষ্যতে সৃষ্টি না হয়। রাজনীতিতে টানাপোড়েন বাড়তে থাকলে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাও বাড়তে থাকবে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে সব পক্ষকে একটি যথাযথ এবং ন্যায্য দিকে হাঁটতে হবে। কারণ যথাযথ রাস্তায় হাঁটতে না পারলে কোনোভাবেই দেশে ইতিবাচক রাজনীতির সূত্রপাত হবে না। এ কারণে প্রয়োজন একটি উইন উইন পরিস্থিতি। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক পক্ষকেই বিশেষ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতির মাঠে থাকতে হবে। সব পক্ষ থেকে ছাড় দিতে না পারলে কোনোভাবেই উইন উইন পরিস্থিতি আশা করা যায় না। 

ভোটের রাজনীতিতে বিজয়ী হওয়ার একমাত্র হাতিয়ার হলো সাংগঠনিক ভিত্তি এবং জনসমর্থন। দলের সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত না হলে এবং জনসমর্থন না থাকলে সেই দল নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে না। উল্লেখ্য, নতুন দলগুলোর উচিত সাধারণ মানুষের জন্য ব্যতিক্রম চিন্তা বা জনমুখী কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বাস্তবতাবিবর্জিত রাজনৈতিক দর্শনের কারণেও অনেক দল মানুষের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে না। ফলে জনসমর্থনও বাড়ে না। এতে নির্বাচনের ফলও নেতিবাচক হয়। 

কাজেই নতুন নতুন রাজনৈতিক ভাবাদর্শ সৃষ্টির যে প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ করছি, সেটি সত্যিকার অর্থে কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করবে কি না- তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। জনসমর্থন বাড়ানোর রাজনৈতিক কর্মসূচি গঠনই রাজনৈতিক দলগুলোর মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভুল সিদ্ধান্ত এবং ভুল কার্যক্রমের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোকে মাশুল দিতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবেই চিন্তা করুক না কেন, দিনশেষে তাদের জনগণের কাছে পৌঁছাতে হবেই। 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]