
একটি জাতির উন্নয়নের মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা। আর এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী, মানসম্মত ও সমন্বিত করতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, যা বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন সম্ভব। উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘ সময় ধরে শিক্ষা খাতে অর্থায়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। ফলে তারা শুধু মানবসম্পদ উন্নয়নে নয়, প্রযুক্তি, গবেষণা এবং উদ্ভাবনেও বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষায় পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের মধ্য দিয়ে মানসম্মত শিক্ষা এবং যোগ্য ও দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর অভিমত, শিক্ষায় জিডিপির ৫-৬ শতাংশ বা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া দরকার। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব স্তরে বাজেট বরাদ্দের সঙ্গে যোগ্য ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির প্রসঙ্গটিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়।
ফিনল্যান্ড বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সফল শিক্ষাব্যবস্থার অধিকারী। তাদের শিক্ষা বাজেট মোট জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ পায়, যা ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই অর্থে তারা শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করে, শিক্ষকদের উচ্চ বেতন নিশ্চিত করে এবং প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের হাতে আধুনিক প্রযুক্তি তুলে দেয়। শিক্ষাকে তারা কোনোভাবেই বাণিজ্য হিসেবে দেখে না, বরং এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার বলে বিবেচনা করে। ফিনল্যান্ডে কোনো পাবলিক স্কুলে বেতন নেই, আর সরকারি বাজেট থেকেই বই, খাতা, খাবার এমনকি বাসসেবাও দেওয়া হয়।
জার্মানি শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের প্রায় ১১ শতাংশ ব্যয় করে, যার একটি বড় অংশ ব্যয় হয় ‘ডুয়াল এডুকেশন সিস্টেম’-এর ওপর। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা একযোগে স্কুল ও কাজ শেখার সুযোগ পায় একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, অন্যদিকে ব্যবহারিক জ্ঞান। সরকারি বাজেটের মাধ্যমে শত শত প্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়, যেখানে প্রশিক্ষণরত শিক্ষার্থীদের ভাতা দেওয়া হয় এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পার্টনারশিপ তৈরি করা হয়। ফলে বেকারত্বের হার অনেক কম এবং উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি।
কানাডায় শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হলো ‘সামাজিক সাম্য’। স্থানীয় সরকারগুলোও বাজেট নির্ধারণে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চল, আদিবাসী সম্প্রদায় কিংবা অভিবাসী পরিবারগুলোর শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, কানাডার বাজেটে প্রতি বছর প্রায় ৩ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার বরাদ্দ দেওয়া হয় আদিবাসী শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে।
জাপান বরাবরই শিক্ষার মান ও শৃঙ্খলার দিক দিয়ে পরিচিত। বাজেটে তারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বেশি গুরুত্ব দেয়। জাপানে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, স্কুল অবকাঠামো এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা হয়।
বাংলাদেশে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের প্রায় ১১ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকলেও, তা জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের নিচে, যা UNESCO-এর প্রস্তাবিত ৪-৬ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। আমাদের দরকার বাজেট বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার, দুর্নীতি রোধ এবং গবেষণা ও প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়া।
গত ২৯ মে খবরের কাগজে প্রকাশিত ‘শিক্ষায় কমছে বরাদ্দ: মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত নিয়ে প্রশ্ন’ শিরোনামের প্রতিবেদন সূত্রে জানতে পারলাম যে আসন্ন বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব করা হচ্ছে চলতি অর্থবছরের তুলনায়। উক্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আমরা লক্ষ করেছি যে, প্রায় প্রতি বছরই শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের আলোচনা, সংলাপ, সেমিনার চলে।
কিন্তু সেসব আমলে নেওয়া হয় না। অথচ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭টি বিষয়ের মধ্যে একটি মানসম্মত শিক্ষা। যেখানে ২০৩০ সালের মধ্যে গুণগত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত না হওয়ায় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই নিম্নমুখী বা অবস্থান তলানিতে। ২০২৪ সালে গ্লোবাল এডুকেশন ইনডেক্সের করা তালিকায় ১৪১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১১৩তম। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার, তার অনেকটাই অনুপস্থিত দেশের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। নেই পর্যাপ্ত গবেষণাগার আর ল্যাব সুবিধা। এমনকি শিক্ষকদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই।
বাংলাদেশ যদি উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে চায়, তাহলে শিক্ষাকে শুধু রাজনৈতিক অঙ্গীকার নয়, বরং বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট কাঠামোর মাধ্যমে শক্ত ভিত্তি দেওয়া উচিত। তাহলেই গড়ে উঠবে এক নতুন, শিক্ষিত এবং সচেতন বাংলাদেশ।
লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]