ঢাকা ২৬ আষাঢ় ১৪৩২, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
English
বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫, ২৬ আষাঢ় ১৪৩২

বাজেটে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমন্বয় জরুরি

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০২:৪৫ পিএম
বাজেটে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সমন্বয় জরুরি

বাংলাদেশে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এ খাতের অগ্রগতিকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষায় বিনিয়োগ মানেই ভবিষ্যতে সুদে-আসলে লাভ। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো মানেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধির টেকসই ভিত্তি গড়া।...

বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নানা সংকটে জর্জরিত। নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে কিছুটা কমেছে। বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দকে ‘হতাশার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন অনেকেই। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার যে বাজেট উত্থাপন করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৭ শতাংশ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শিক্ষা খাতে মূল বাজেটের আকার ছিল ১ লাখ ১১ হাজার ১৫৮ কোটি টাকা, যা সংশোধনে ৯৯ হাজার ১১৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়। খরচ করা ওই টাকার পরিমাণ ছিল সংশোধিত বাজেটের ১৩.৩২ শতাংশ এবং জিডিপির ১.৭৮ শতাংশ। অথচ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। শিক্ষামানের দিকে যখন সবাই জোর দিচ্ছে, তখন জিডিপির অনুপাতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমার বিষয়টি কিছুটা হতাশার। কারণ যেকোনো উদ্যোগের মেরুদণ্ড হলো ফাইন্যান্স। বরাদ্দ না থাকলে শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ আমরা কীভাবে আশা করব?

শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে শুধু ভবিষ্যতের মানবসম্পদই গড়ে তোলা হয় না; একই সঙ্গে জাতির উন্নয়ন কাঠামোর ভিত্তিও নির্মিত হয়। আজকের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে জনশক্তিকে দক্ষ ও উপযোগী করে তুলতে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে উন্নত বিশ্ব এই বিনিয়োগ শুধু জ্ঞান অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ও অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। উন্নত দেশগুলো কীভাবে শিক্ষায় বাজেট বাড়িয়ে জাতীয় উন্নয়নে ব্যবহার করছে, তা বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, এ নীতি কেবল একটি খাত নয়, বরং পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গতিশীল করার মূল হাতিয়ার। 

জার্মানি পৃথিবীর অন্যতম উদাহরণ, যারা ডুয়াল এডুকেশন সিস্টেম’-এর মাধ্যমে শিক্ষাকে সরাসরি কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এখানে শিক্ষার্থীরা স্কুলে পাঠ গ্রহণের পাশাপাশি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে থাকে। রাষ্ট্রের বাজেটে বিশাল অংশ বরাদ্দ থাকে এ কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার জন্য। জার্মান সরকার প্রতি বছর শিক্ষা খাতে প্রায় ১৩০ বিলিয়ন ইউরো ব্যয় করে, যার বড় অংশ পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষায়। ফলে জার্মানির যুব বেকারত্বের হার ইউরোপের মধ্যে সর্বনিম্ন ২০২৪ সালে যা ছিল মাত্র ৫.৭ শতাংশ। এখানকার শিক্ষার্থী মাত্র ১৮ বা ১৯ বছর বয়সেই চাকরির জন্য প্রস্তুত হয়ে যায় এবং শিল্পক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলে।

ফিনল্যান্ড সরকার বিশ্বাস করে, শক্তিশালী জনশক্তি গড়ে তোলার পূর্বশর্ত হলো মানসম্পন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা। ফলে ফিনল্যান্ডে ১৫-২৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগণের মধ্যে ৯৮ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুক্ত। এ ধারাবাহিকতা দেশের অর্থনীতিকে টেকসই করেছে এবং উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর পেশায় ফিনিশ যুবসমাজের অংশগ্রহণ অনেক বাড়িয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুরোপুরি বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার উঠে আসার অন্যতম রহস্য শিক্ষায় অগ্রাধিকার। ১৯৬০ সালে যেখানে দেশটির সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ২২ শতাংশ, সেখানে ২০২৩ সালে তা দাঁড়ায় ৯৯ শতাংশে। বর্তমান বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়। সরকার শিক্ষা খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করে প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায়। এ বিনিয়োগ সরাসরি ফল দিয়েছে: স্যামসাং, এলজি, হুন্দাই-এর মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে দক্ষ কোরিয়ান কর্মীর মাধ্যমে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও কোরিয়ান শিক্ষিত তরুণদের জন্য চাহিদা ক্রমবর্ধমান।

কানাডা শিক্ষা খাতে প্রতি বছর গড়পড়তা ৪০ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার বরাদ্দ দেয়। দেশটির বিশেষত্ব হলো- শিক্ষাকে তারা শুধু জাতীয় উন্নয়নের অংশ হিসেবে দেখেই না, বরং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী, অভিবাসী- সবার জন্য উচ্চশিক্ষায় সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করেছে।

ফলস্বরূপ, কানাডায় বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণির মানুষ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণ। এখন কানাডার অর্থনীতির একটি বড় চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী ও প্রযুক্তিনির্ভর কর্মী।

বাংলাদেশে নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনা এ খাতের অগ্রগতিকে প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও অনেক তরুণ-তরুণী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে না। শিক্ষায় বিনিয়োগ মানেই ভবিষ্যতে সুদে-আসলে লাভ। উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা বলে দেয় শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানো মানেই কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং জাতীয় প্রবৃদ্ধির টেকসই ভিত্তি গড়া। বাংলাদেশ যদি এ দিকগুলো মাথায় রেখে নীতি প্রণয়ন করে, তাহলে কর্মসংস্থানের সংকটও কমবে এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম প্রস্তুত হবে দৃঢ়ভাবে।

প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দের প্রসঙ্গটি কীভাবে আরও কর্মসংস্থানবান্ধব হবে তা খুঁজে দেখার ন্যায্যতা অনেক বেশি। বেকারদের আগামীর জীবন অনিশ্চয়তা থেকে কাটিয়ে তুলতে কর্মসংস্থানকেন্দ্রিক ভাবনা অধিকভাবে বাড়ানোর ন্যায্যতা অতিমাত্রায় অনুভূত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আশার বাণী হলো, দেশের উন্নয়নে তরুণদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে আগামী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) ‘তারুণ্যের উৎসব’ উদ্যাপনের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। 

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় এ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এমন তহবিল এবারই প্রথম।’ আমরা জানি, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশই তরুণ। যারা দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশাল এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন নীতি থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি।

শুধু তরুণ উদ্যেক্তাদের জন্য নয়, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কীভাবে শিক্ষা কাঠামোকে কর্মসংস্থানমুখী করে তোলা যায়- সে বিষয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দাঁড় করানোর বিষয়টি এখন গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্য বাজেটের প্রসঙ্গ নিয়ে পুনরায় ভেবে দেখার যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যমান শ্রমবাজারের সংকট কাটিয়ে উঠতে কীভাবে শিক্ষাব্যস্থাকে আরও কর্মসংস্থানবান্ধব করে তোলা যায়- সে বিষয়ে একটি কমিশন গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বরাদ্দের বিষয়টি বিশেষভাবে ভেবে দেখা যেতে পারে। 

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]



অর্থনীতি সংস্কারে আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ০৬:৪১ পিএম
অর্থনীতি সংস্কারে আরও গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন

দেশের অর্থনীতির সংস্কারের দিকে আমাদের আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে হবে। দেশের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে ভালো কিছু আশা করা যায় না। আগের সরকার নির্বাচনের নামে নানারকম প্রহসন করেছে। ফলে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কাজেই গণতন্ত্রের নামে আমরা এখনো যদি বিভাজন করি, তাহলে কোনোভাবেই সামনে এগোনো সম্ভব নয়। সবারই নজর আগামী নির্বাচনের দিকে। কাজেই সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন হলেই দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। 

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পাবেন। বর্তমানে অর্থনীতিতে এক ধরনের গতি সঞ্চার হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে এখনো বহুমুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রিজার্ভ-রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয় বাড়ানো কঠিন। একই সঙ্গে রাজস্ব ও ব্যাংক খাত নিয়ে যে উদ্বেগজনক  পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সহজ হবে না। এমতাবস্থায় অর্থনীতিকে স্থিতিশীল অবস্থায় আনাই হবে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। এ লক্ষ্যে কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।

 অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ব্যাংক বা অন্য কোনো খাতে যেন কাঠামোগত সংকট দেখা না দেয়। বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রেও যেন কোনো সমস্যা তৈরি না হয়। কোনো কোম্পানি যখন কোনো লাভ করতে পারবে না, সেটাকে ভর্তুকি দিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। কৃষকের জন্য কিছু ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু একটি লোকসানি শিল্পকে কেন সরকারের মধ্যে রাখতে হবে? 

আমাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছি। যতদিন এ ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারব, ততদিন আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য থেকেই যাবে। আর এসব কারণে আমরা কর সংগ্রহ যতটুকুই করি, যতটা অপব্যয় হচ্ছে তা আমাদের রোধ করতে হবে। দেশে ডলারসংকটের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সুদের হার, পণ্য আমদানি-রপ্তানি, রাজস্বসহ কোনো সূচকেই সন্তোষজনক অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মুদ্রাবাজারেও অস্থিরতা বিদ্যমান। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। বর্তমানে নানামুখী সমস্যায় বৈশ্বিক আর্থসামাজিক অবস্থা সংকটজনক। এ সংকট শিগগিরই দূর হওয়ার নয়।

 এমতাবস্থায় বিরাজমান বিশ্বমন্দা ও সংকট কেটে যাওয়ার আশা থাকলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। রাজস্ব আদায় বাড়াতে যে ক্ষেত্রগুলো করহারের অধীনে আসেনি সেগুলোকে করহারের আওতায় আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে অটোমেশনে যেতে হবে। যাদের ঢাকা শহরে অনেক বাড়ি আছে, অথচ তারা সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এ রকম উদাহরণ বহু আছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু আয়কর রিটার্ন দিচ্ছে না। ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার করছে, অথচ কর দিচ্ছে না, কোম্পানির ডিভিডেন্ট দেয় না, অথচ ওই কোম্পানির এমডি পাজেরো গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ান, তাদের জরিমানাসহ করের আওতায় আনতে হবে। অর্থনীতি যদি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ করে তাহলে এর রাজস্ব আয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। বাজেটঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।

বিগত সরকারের আমলে পুঁজিবাজার নিয়ে যথেষ্ট অবহেলা করা হয়েছে। বড় সব জুয়াড়ি সরকারের পৃষ্ঠপোষতায় স্টকমার্কেট থেকে টাকা নিয়ে গেছে। কোম্পানির লাভ নেই, কিন্তু সেগুলো বাজারে রেখে দেওয়া হয়েছে। কোম্পানি যখন কোনো লাভ করতে পারছে না, সেটাকে ভর্তুকি দিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। কৃষকের জন্য কোনো কিছুর ভর্তুকি দেওয়া- সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু আমি কেন একটি লোকসানি শিল্পকে, যেটা দিয়ে কিছু হবে না সেটাকে কেন সরকারের মধ্যে রেখে দিয়েছি।

 আমাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছি। যতদিন এ ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারব, ততদিন আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য থেকেই যাবে। আর এসব কারণেই আমরা কর সংগ্রহ যা কিছুই করি, খরচটা অপব্যয় হচ্ছে আমাদের এবং সেটা রোধ করতে হবে। পুঁজিবাজারকে দুর্নীতিমুক্ত করা, ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা, কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার পাশাপাশি কেউ হিসাব গোপন করে কি না, এগুলো যাচাই করে দেখা ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। 

এসব উদ্যোগ নেওয়া হলে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং পুনরায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে। 
নানা ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখতে হলে সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সুশাসন দরকার। যেকোনো সমস্যা সমাধানে যৌক্তিক আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতায় দল-মতনির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিককে নিজের অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতার পাশাপাশি জনমত গঠন জরুরি। প্রসঙ্গক্রমে বলা প্রয়োজন, দেশের অর্থনীতিকে মোটামুটি সচল রাখছে আমাদের পোশাকশিল্প। অথচ এ খাতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে।

 সুযোগসন্ধানীরা নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। এমনিতেই দেশে রাজনৈতিক সংকট চলমান। তার ওপর সুযোগসন্ধানীদের অপতৎপরতা মোকাবিলা করা সরকারের কঠিন কাজ। তার পরও সরকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। বারবার এ ধরনের সংকট আমরা ঠেকাতে পারব না। দেশজুড়ে আমরা আর কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা চাই না। কাজেই দেশের স্বার্থে, শিল্পের স্বার্থে সংকটগুলো সমাধানে জনমত গঠনের পাশাপাশি সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সব অপতৎপরতা বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দেশ গঠনে মনোযোগ দিতে হবে এবং সে লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে হবে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ ও চেয়ারম্যান আইসি

বদলে যাচ্ছে সফলতার ধারণা

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ০৬:০৬ পিএম
বদলে যাচ্ছে সফলতার ধারণা

সাফল্য মানেই কি শুধু অনেক টাকা আর বড় চাকরি? আগে হয়তো এমনটাই ভাবা হতো। কিন্তু এখন দুনিয়া বদলাচ্ছে, আর তাই বদলাচ্ছে সফলতার মানেও। বিশ্বায়নের এ যুগে দেশগুলো কাছাকাছি আসছে, ইন্টারনেট সবকিছু সহজ করে দিয়েছে, আর আমাদের পুরোনো ধ্যানধারণাগুলোও পাল্টাচ্ছে। সমাজই আসলে ঠিক করে দেয় কোনটা সাফল্য, কোনটা নয়। আর এ ভাবনাটা একেক জায়গায় একেকরকম। আমাদের বাংলাদেশও এখন অনেক বদলাচ্ছে- অর্থনীতি, মানুষজন, সংস্কৃতি- তাই এখানেও সফলতার ধারণাটা বদলে যাচ্ছে।

আমাদের দেশে বা আরও অনেক জায়গায় আগে সাফল্য বলতে বোঝাত সংসার চালানো, পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়া আর সমাজে একটু মাথা উঁচু করে বাঁচা। যাদের জমি ছিল, গবাদি পশু ছিল বা সরকারি চাকরি ছিল, তাদেরই লোকে সফল বলত। এগুলো ছিল চোখে দেখা জিনিস, যা দিয়ে জীবন চালানো যেত। পরিবারের বড়দের কথা, ধর্মের নিয়ম আর ছেলেদের বেশি গুরুত্ব দেওয়ার চল- এসবই ঠিক করে দিত কী অর্জন করলে লোকে বাহবা দেবে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা সরকারি বড় কর্তা হওয়াটা শুধু টাকার জন্যই নয়, সম্মানের জন্যও খুব দরকারি ছিল।

কিন্তু বিশ্বায়ন সবকিছুকে অনেক বড় করে দিয়েছে। এখন টিভি, ইন্টারনেট, ফেসবুক আর বিদেশে যাওয়া-আসা মানুষের সামনে নতুন নতুন রাস্তা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের তরুণরা এখন দুনিয়ার খবর রাখছে, আর তারা দেখছে শুধু টাকা থাকলেই সফল হওয়া যায় না। এখন অনেকেই নিজের শখ পূরণ করা, সমাজে কিছু করা, সবার কাছে পরিচিত হওয়া আর নিজের মতো করে বাঁচার মধ্যেই সফলতা খুঁজে নিচ্ছে।
ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটক- এসব প্ল্যাটফর্ম সাফল্যের ধারণা পাল্টে দিয়েছে। এখন অনেকেই অনলাইনে জনপ্রিয় হয়ে, ইনফ্লুয়েন্সার হয়ে বা নতুন টেক কোম্পানি বানিয়ে সফল হচ্ছে। আগে যারা হয়তো সুযোগ পেত না, তারাও এখন এ প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে টাকা কামাচ্ছে আর পরিচিতি পাচ্ছে। তবে এখানেও সমস্যা আছে, অনেক সময় শুধু দেখানোর জন্যই লোকে সফল সাজার চেষ্টা করে, আর রাতারাতি বিখ্যাত হওয়াটা সবসময় টিকে থাকে না।

বাংলাদেশের অর্থনীতিও অনেক বদলেছে। পোশাক কারখানা হয়েছে, বিদেশ থেকে আমাদের লোকেরা টাকা পাঠাচ্ছে, আর অনেকেই ছোটখাটো ব্যবসা বা এনজিওর সাহায্যে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। নারীরা এখন কারখানায় কাজ করছে, গ্রামের অনেক মেয়ে এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে সংসারে সাহায্য করছে। এতে তাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বাড়ছে, আর সাফল্য মানে যে শুধু ঘর সামলানো নয়, এটাও সবাই বুঝতে পারছে।

তবে সবকিছুর পরও বৈষম্য কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, বরং নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে। নতুন ধরনের সাফল্য পাওয়ার সুযোগ সবার জন্য সমান নয়। এটা নির্ভর করে কে কোন পরিবারে জন্মেছে, কোথায় থাকে, ছেলে না মেয়ে এবং কে কতটুকু পড়াশোনা করেছে তার ওপর। গ্রামের ছেলে হয়তো বিদেশে গিয়ে টাকা পাঠানোকেই বড় সাফল্য মনে করে। আবার শহরের ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা হয়তো বিদেশ থেকে পড়ে এসে বড় কোম্পানিতে যোগ দেওয়া বা নতুন ব্যবসা শুরু করাকে সাফল্য ভাবে। তাই একেকজনের কাছে সাফল্যের মানে একেকরকম, আর এর ঝুঁকিও আলাদা।

পড়াশোনাকে এখনো অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু এর মানেও আগের মতো নেই। এখন অনেক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি হয়েছে, কোচিং সেন্টার আর নতুন নতুন কারিকুলাম এসেছে। ভালো রেজাল্ট করার চাপ অনেক বেশি, কিন্তু অনেকেই ভাবছে এত পড়াশোনা করেও ভালো চাকরি পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক শিক্ষিত তরুণ বেকার থাকছে, আর তাই লোকে ভাবছে শুধু ভালো ডিগ্রি থাকলেই লাভ নেই, দরকারি কিছু শিখতে হবে।

এ পরিবর্তনের কারণে পরিবারেও সমস্যা হচ্ছে। বাবা-মা হয়তো এখনো চান ছেলেমেয়ে সরকারি চাকরি করুক বা তাড়াতাড়ি বিয়ে করুক। কিন্তু নতুন প্রজন্ম হয়তো শিল্পী হতে চায়, অনলাইনে বিখ্যাত হতে চায় বা সমাজের জন্য কিছু করতে চায়। আগের আর এখনকার প্রজন্মের চিন্তাভাবনার এ পার্থক্য সমাজে একটা টানাপোড়েন তৈরি করছে।

ধর্ম আর নীতিবোধ এখনো আমাদের সমাজে সফলতার সংজ্ঞায় প্রভাব ফেলে। কেউ কেউ মনে করে টাকা থাকলেই বুঝি আল্লাহ খুশি থাকেন বা সে খুব ভালো লোক। আবার অনেকে মনে করে শুধু টাকা আর নাম কামানোর পেছনে ছোটাটা ঠিক নয়। ইসলাম ধর্মে বিনয়, সমাজের প্রতি দায়িত্ব আর মনের শান্তিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যা পশ্চিমা দেশের শুধু নিজের জন্য সফল হওয়ার ধারণার চেয়ে আলাদা। ধর্মের গুরুরাও এসব নিয়ে কথা বলেন এবং কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, সে বিষয়ে মানুষের ধারণা গড়ে তোলেন।

টিভি, সিনেমা, বিজ্ঞাপন- এগুলোও সাফল্যের গল্প শোনায়। গ্রামের ছেলে শহরে এসে বড় চাকরি পেল, গ্রামের মেয়ে বড় শিল্পী হলো, বা রিকশাওয়ালার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হলো- এমন গল্পগুলো আমাদের দেখায় যে, চেষ্টা করলে আর প্রতিভা থাকলে যে কেউ জীবনে উন্নতি করতে পারে। কিন্তু এর আড়ালে যে কত বাধা আছে, সেটা অনেক সময় দেখানো হয় না।

এখন অনেকেই বিদেশে থাকছে বা দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। তারা শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরেও নিজেদের প্রমাণ করতে চায়। যারা বিদেশে থাকে, তারা একদিকে দেশের সংস্কৃতি ধরে রাখতে চায়, আবার অন্যদিকে নতুন দেশের সঙ্গেও মানিয়ে নিতে চায়। যারা কাজের জন্য বিদেশে যায়, তাদের জন্য সাফল্য মানে পরিবারকে টাকা পাঠানো আর নতুন জায়গায় টিকে থাকা।

সরকার আর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও সফলতার নতুন নতুন ধারণা তৈরি করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, তরুণদের ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া বা নারীদের স্বাবলম্বী করার প্রকল্পগুলো আসলে সাফল্যের নতুন পথ খুলে দিচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও ক্ষমতায়ন বা উন্নয়নের কথা বলে আমাদের সমাজের লক্ষ্য ঠিক করে দিতে সাহায্য করছে।

যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে, পরিবেশ বাঁচানোর চেষ্টা করছে বা নারী-পুরুষের সমতার জন্য লড়ছে- তারাও নতুন এক ধরনের সাফল্য দেখাচ্ছে। তারা হয়তো অনেক টাকা কামাচ্ছে না, কিন্তু সমাজের ভালোর জন্য তাদের কাজকে লোকে এখন সম্মান জানাচ্ছে। এখানে সাফল্য মাপা হচ্ছে কে কতটা সমাজকে দিতে পারল, পরিবেশের জন্য কী করল বা কতটুকু সৎ থাকতে পারল, তার ওপর ভিত্তি করে।
তবে দামি জিনিস কেনার আর লোক দেখানোর চল এখনো কমেনি। পুঁজিবাদী সমাজে বাজারই সবকিছুর নিয়ম ঠিক করে দেয়, আর সাফল্য মানে অনেক সময় ভালো পোশাক পরা, দামি গাড়ি কেনা বা বড় বাড়িতে থাকা। এতে অনেকেই চাপে পড়ে যায়, অনেক কষ্ট করে হলেও লোকজনকে দেখাতে চায় যে, সে সফল।

সাফল্যের এই বদলে যাওয়া ধারণাগুলো আমাদের মনেও প্রভাব ফেলছে। যখন সমাজ বারবার সফলতার মানদণ্ড বদলায়, তখন সফল হওয়ার চাপও বাড়ে। ব্যর্থ হওয়ার ভয়, পিছিয়ে পড়ার চিন্তা আর অন্যদের কাছে ভালো সাজার আকাঙ্ক্ষা আমাদের অস্থির করে তোলে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ বাড়ছে, যা প্রমাণ করে সফলতার পেছনে ছুটতে গিয়ে আমাদের কতটা মানসিক ধকল পোহাতে হচ্ছে।

মোটকথা, বিশ্বায়নের যুগে সাফল্যের সামাজিক সংজ্ঞাটা সবসময় বদলাচ্ছে এবং এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। এটা একদিকে আমাদের ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মধ্যেকার টানাপোড়েন, অন্যদিকে নিজের ভালো চাওয়া আর সবার ভালোর কথা ভাবার মধ্যেকার পার্থক্য এবং স্থানীয় জীবন আর বিশ্ব দুনিয়ার স্বপ্নের প্রতিফলন। বাংলাদেশে এ সবকিছু ঘটছে এক নতুন শক্তি, সৃষ্টিশীলতা আর আকাঙ্ক্ষার মধ্যদিয়ে। সাফল্য এখন আর একটা নির্দিষ্ট পথ নয়, এটা অনেক সম্ভাবনার সমষ্টি- যা নির্ভর করে কে কোথায় আছে, তার চারপাশের মানুষজন কেমন এবং সে নিজে কী ভাবছে তার ওপর।
সমাজ যত এগোবে, সাফল্যের ধারণাও তত বদলাবে। 

আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে এ ধারণাগুলো সবার জন্য ভালো হয়, মানুষ হিসেবে আমাদের মূল্য দেয় এবং ন্যায্যতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। সবার জন্য একই রকম সফলতার সংজ্ঞা ঠিক না করে, বরং যার যার পথকে সম্মান জানানো উচিত, বিভিন্ন ধরনের অবদানকে মূল্য দেওয়া উচিত এবং এমন পরিবেশ তৈরি করা উচিত যেখানে সবাই নিজের মতো করে, নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। এভাবেই বাংলাদেশ এবং পুরো পৃথিবী সফল হওয়ার আরও মানবিক আরও সুন্দর মানে খুঁজে পাবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
[email protected]

রপ্তানি বড় ধরনের চাপে পড়বে

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৮ এএম
রপ্তানি বড় ধরনের চাপে পড়বে
সেলিম রহমান

বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক আরোপের যুক্তরাষ্ট্রের একক সিদ্ধান্ত আরোপিত হলে তা হবে আমাদের জন্য চরম অর্থনৈতিক ধাক্কা। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। এর ফলে আগে যেখানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো, সেখানে এখন দ্বিগুণেরও বেশি দিতে হবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার বিষয়টি বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।

এই পারস্পরিক শুল্ক আরোপের যৌক্তিকতাও স্পষ্ট নয়, যা উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। এখনো জানা যায়নি বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ- যেমন ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ওপর কত শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। 

যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দফায় ১৪টি দেশের ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত হারই সর্বোচ্চগুলোর একটি। অন্যদের ক্ষেত্রে হার কম হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের প্রতিযোগিতামূলক অসুবিধায় পড়বে। এতে ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি সরবরাহ চেইন-পরিকল্পনাও জটিল হয়ে উঠবে।

পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও গভীর। বাড়তি খরচের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা তুলনামূলকভাবে কম শুল্কের দেশে অর্ডার স্থানান্তর করতে পারেন। তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ, যা মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশ তাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শুল্ক আলোচনা যেভাবে হয়েছে তাতে বাংলাদেশ কোনো সুবিধাজনক অবস্থান আদায় করতে পারেনি। ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিবর্তনশীল পরিবেশে আরও দুর্বল করে তুলবে। তার পরও আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। 

পাশাপাশি বহুমুখী ও কৌশলগত কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। রপ্তানি বৈচিত্র্য এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পোশাক খাতের বাইরের শিল্প গড়ে তোলা এখন অত্যাবশ্যক। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। এই বিষয়গুলো অনেক দিন থেকে বলা হলেও কাজ হচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতির মতো অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের মতো দেশের ভালো প্রস্তুতি না থাকলে বড় ধরনের চাপে পড়তে হবে। 

লেখক: সানেমের নির্বাহী পরিচালক

দর-কষাকষি করতে হবে

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:৩৩ এএম
দর-কষাকষি করতে হবে
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারপ্রধান যেহেতু বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন, তাই এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারকে আলোচনা করতে হবে। ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। কাজেই সেই পর্যন্ত দর-কষাকষি করতে হবে। যাতে ভিয়েতনামের কাছাকাছি যাওয়া যায়। ভিয়েতনামও হয়তো দর-কষাকষি করে এই পর্যায়ে এসেছে। তাই আমাদের সরকারকেও সেভাবে এগোতে হবে। তা না হলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় ঝুঁকিতে পড়বে দেশ। 

বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ মোট ১৪টি দেশের ওপর নতুন করে শুল্কহার নির্ধারণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। 

হোয়াইট হাউসের ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির সময়সীমা শেষ হতে চলায় ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন। 

এর আগে ৯ জুলাই থেকে শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সেটি পিছিয়ে ১ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজেই এই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে।

অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো

কতটুকু গিলতে পারব তা দেখার বিষয়

প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১০:২৫ এএম
কতটুকু গিলতে পারব তা দেখার বিষয়
ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক

ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ ঘোষণা করেছেন। কাজেই সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে জোরালোভাবে দর-কষাকষি করতে হবে। তবে দেখার বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র কী চায়। তারা এমন জটিল ও কঠিন শর্ত দিল, যা পূরণ করা সম্ভব নয়। যেটা ভিয়েতনামে দেওয়া হয়েছিল। তারা পূরণ করতে পারলেও আমরা সেই কঠিন শর্ত পূরণ করতে পারব না। 

এ ছাড়া চীন, পাকিস্তানসহ যারা প্রতিযোগিতামূলক বাজার দখল করে আছে, তাদেরও দেখতে হবে। অনেক দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বসিয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। প্রতিযোগিতার বাজার স্লো হয়ে যাবে। তারা কী শর্ত উল্লেখ করেছে, সেটাও দেখার বিষয়। এটা যেহেতু জানা যায়নি। তাই বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা কতটুকু গিলতে পারব তা দেখার বিষয়। 

তারা গ্লোবালি (সারা বিশ্বে) শুল্ক আরোপের কথা বলেছে। এতে সবাই চাপে পড়বে। বিভিন্ন দেশে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে ৩৫ শতাংশ। যা ২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। এখনো মাঝে কিছুদিন সময় আছে। এই সময় কাজে লাগাতে হবে। 

ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) চেয়ারম্যান