
রাজস্ব আদায় বাড়াতে যে ক্ষেত্রগুলো করহারের অধীনে আসেনি সেগুলোকে করহারের আওতায় আনতে হবে। আমাদের সে ক্ষেত্রে অটোমেশনে যেতে হবে। যাদের ঢাকা শহরে অনেক বাড়ি আছে, অথচ তারা সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এ রকম উদাহরণ বহু আছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু আয়কর রিটার্ন দিচ্ছে না, ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার করছে, অথচ কর দিচ্ছে না, কোম্পানির ডিভিডেন্ট দেয় না, অথচ ওই কোম্পানির এমডি পাজেরো গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ান, তাদের জরিমানাসহ করের আওতায় আনতে হবে। অর্থনীতি যদি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ করে তাহলে এর রাজস্ব আয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। বাজেটঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে ব্যয় সংকোচন করতে হবে।…
২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট তুলনামূলক ভালো হয়েছে। রাজস্ব বাজেটের আকার বেড়েছে; যা এডিপির তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। রাজস্ব নিয়ে আমাদের আগে থেকেই আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত ছিল। দেশের অর্থনীতির সংস্কারের দিকে আমাদের আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে ভালো কিছু আশা করা যায় না। আগের সরকার নির্বাচনের নামে নানারকম প্রহসন করেছে।
ফলে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কাজেই গণতন্ত্রের নামে আমরা এখনো যদি বিভাজন করি, তাহলে কোনোভাবেই সামনে এগোনো সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, সবারই নজর আগামী নির্বাচনের দিকে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করার ব্যাপারে সবার মধ্যেই একটা মতানৈক্য হয়েছে। কাজেই সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন হলেই দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। ব্যবসা ও বিনিয়োগ সৃষ্টিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা ফিরে পাবেন।
আমরা জানি, বিগত সময়ে আর্থিক খাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। নজিরবিহীন অপশাসনের মাধ্যমে ব্যাংক খাতকে প্রায় ধ্বংসের মধ্যে ফেলে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। ব্যাংকগুলো লুটপাটের কারণেই আর্থিক খাতের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারেও। দেশ থেকে প্রচুর টাকা পাচার হয়েছে। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র এখন সামনে আসতে শুরু করেছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে খেলাপি ঋণের হার ছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২০ শতাংশে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘদিনের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সরকার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে।
ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি, তারল্যসংকট, দেউলিয়া বা অস্তিত্বের জন্য হুমকি- এমন সব ঝুঁকির সময়োপযোগী সমাধান এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ব্যাংকগুলোকে প্রায় শেষ করে দিয়েছে মাফিয়া গ্রুপ। এ সরকারের সময় আর সে সুযোগ নেই। এদের বিচারের আওতায় আনতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।
এবারের বাজেটে শেয়ারবাজারকে পুনরায় চাঙা করে তুলতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির মধ্যকার করপোরেট করহারের ব্যবধান বৃদ্ধি এবং ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেনের ওপর ধার্য কর কমানো। এসব প্রণোদনার সুবিধাভোগী শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সরাসরি বিনিয়োগকারীরা কোনো সুবিধা পাবেন না।
যদিও বাজেটের আগে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ আয় থেকে শুরু করে মূলধন মুনাফার ওপর থেকে কর প্রত্যাহারের জন্য দাবি জানানো হয়েছিল। আমরা যে বাজেট প্রণয়ন করি, তার ৭০ শতাংশই রাজস্ব বাজেট। এর কারণ হলো, আমাদের অর্থনীতির তুলনায় বিশাল আকারের সরকার নিয়ে আমরা বসে আছি। এখন এ বিশাল আকারের সরকারকে চালাতে হলে জনগণকে কর দিতে হবে। সরকার দক্ষ না হলে দেশের অর্থনীতিকেও দক্ষ মাত্রায় আনা যাবে না। বড় অর্থনীতির দেশ অথচ সরকারের পরিধি অনেক ছোট, এমন অনেক দেশ আছে। তারা পারছে। কাজেই আমাদেরও সেটা পারতে হবে। বাজারে কোম্পানি যখন কোনো লাভ করতে পারছে না, সেটাকে ভর্তুকি দিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। কৃষকের জন্য কোনো কিছুর ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু একটি লোকসানি শিল্পকে কেন সরকারের মধ্যে রাখতে হবে? আমাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছি। যতদিন এ ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বের হতো না পারব, ততদিন আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য থেকেই যাবে। আর এসব কারণেই আমরা কর সংগ্রহ যতটুকুই করি, খরচটা অপব্যয় হচ্ছে এবং সেটা রোধ করতে হবে।
রাজস্ব আদায় বাড়াতে যে ক্ষেত্রগুলো করহারের অধীনে আসেনি সেগুলোকে করহারের আওতায় আনতে হবে। আমাদের সে ক্ষেত্রে অটোমেশনে যেতে হবে। যাদের ঢাকা শহরে অনেক বাড়ি আছে, অথচ তারা সরকারকে কর ফাঁকি দিচ্ছে। এ রকম উদাহরণ বহু আছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু আয়কর রিটার্ন দিচ্ছে না, ফাইভ স্টার হোটেলে ডিনার করছে, অথচ কর দিচ্ছে না, কোম্পানির ডিভিডেন্ট দেয় না, অথচ ওই কোম্পানির এমডি পাজেরো গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ান, তাদের জরিমানাসহ করের আওতায় আনতে হবে। অর্থনীতি যদি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে থাকে সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ করে তাহলে এর রাজস্ব আয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। বাজেটঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে ব্যয় সংকোচন করতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প এই মুহূর্তে আমরা দেখছি না। সরকারের পরিধি বা আয়তনটা ছোট করতে পারলে, সেটা সবচেয়ে বড় কাজ হয়। কিন্তু আমাদের দেশে একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে যে, সরকারের আকার ছোট করা যাবে না। সুতরাং সরকারের আয়-ব্যয়ের সমন্বয়হীন অসম আকার অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবেই।
বিগত সরকারের আমলে পুঁজিবাজার নিয়ে যথেষ্ট অবহেলা করা হয়েছে। বড় সব জুয়াড়ি সরকারের পৃষ্ঠপোষতায় স্টক মার্কেট থেকে টাকা নিয়ে গেছে। কোম্পানির লাভ নেই, কিন্তু সেগুলো বাজারে রেখে দেওয়া হয়েছে। কোম্পানি যখন কোনো লাভ করতে পারছে না, সেটাকে ভর্তুকি দিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। কৃষকের জন্য কোনো কিছুর ভর্তুকি দেওয়া- সেটা হয়তো ঠিক আছে। কিন্তু আমি কেন একটি লোকসানি শিল্পকে, যেটা দিয়ে কিছু হবে না সেটাকে কেন সরকারের মধ্যে রেখে দিয়েছি। আমাদের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে আমরা বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে যাচ্ছি। যতদিন এ ভর্তুকির সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারব, ততদিন আমাদের অর্থনৈতিক দৈন্য থেকেই যাবে।
আর এসব কারণেই আমরা কর সংগ্রহ যা কিছুই করি, খরচটা অপব্যয় হচ্ছে আমাদের এবং সেটা রোধ করতে হবে। পুঁজিবাজারকে দুর্নীতিমুক্ত করা, ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা, কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার পাশাপাশি কেউ হিসাব গোপন করে কি না, এগুলো যাচাই করে দেখা ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। এসব উদ্যোগ নেওয়া হলে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং পুনরায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা সম্ভব হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ