
উদারনীতিকরা সংস্কারের কথা বলেন, কিন্তু সংস্কারে যে কুলাবে না তা অত্যন্ত স্পষ্ট। নাট্যকার হেনরিক ইবসেন ‘বুনো হাঁস’ নামে একটি নাটক লিখেছিলেন সেই ১৮৮৪ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১৪১ বছর আগে। নাটকটিতে ওই সময়েই পুঁজিবাদ কীভাবে কাজ করে সেটা তিনি দেখিয়েছেন। নাটকে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী প্রতারণাব্যবস্থার শিকার হচ্ছে একডাল পরিবার। বৃদ্ধ একডাল ব্যবসা করতেন তার বন্ধু ওয়ারলের সঙ্গে। ওয়ারল খাঁটি পুঁজিবাদী। সে নেমেছিল কাঠকাটার অবৈধ ব্যবসায়; কাজটা ধরা পড়ে যায়। মামলা হয়। ওয়ারলের ছিল প্রচুর টাকা; টাকার জোরে সে খালাস পেয়ে যায়, কিন্তু ১০ বছরের জেল হয় একডালের। একডালরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, টাকাওয়ালা ওয়ারল লোকটা ছিল ভীষণ ভোগবাদী; সে তার গৃহপরিচারিকা জীনার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। জীনা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে তড়িঘড়ি তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় একডালেরই ছেলে হেলমারের সঙ্গে। জীনা একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। জীনার স্বামী হেলমার একডাল যে কন্যাটির জৈব-বাবা নয়, এটা সে খোঁজ নিলেই জানতে পারত। কিন্তু খোঁজ হেলমার নেয়নি। তার বসবাস ছিল স্বপ্নের জগতে। জীনা এবং কন্যাটিকে নিয়ে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। পেশা ছিল ফটোগ্রাফারের। স্বপ্ন ছিল একটি ফটোগ্রাফির যন্ত্র উদ্ভাবনের, যাতে তাদের সংসারে প্রচুর টাকা আসবে, পরিবারের জন্য আসবে সম্মান ও সুখ। কিন্তু হেলমারের বাল্যবন্ধু ওয়ারলের একমাত্র সন্তান গ্রেগারস বাবার কীর্তিগুলো ধরে ফেলেছিল।
এই ছেলে বাবাকে ভীষণ ঘৃণা করে, বন্ধু হেলমারকে সে গভীরভাবে ভালোবাসে। সে আদর্শবাদী এবং সংস্কারপন্থি। সে চাইল অন্তরের বন্ধু হেলমারকে মিথ্যার জাল থেকে উদ্ধার করবে, সত্য ধরিয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ বোঝাবুঝির ওপর বন্ধুর দাম্পত্যজীবনের প্রতিষ্ঠা ঘটাবে। তাই একদিন সে তার বন্ধু হেলমারকে ডেকে নিয়ে জীনার সন্তান সম্পর্কে ‘সত্য’টা জানিয়ে দিল। ফল দাঁড়াল এই যে, হেলমারের কষ্ট-করে-সাজানো সংসারটা গেল ভেঙে, হেলমারের অবস্থাটা দাঁড়াল অর্ধউন্মাদের; সে তার অত্যন্ত আদরের কন্যাটিকে ঘৃণাভরে দূরে সরিয়ে দিল। স্ত্রীকে অসৎ বলে ঘোষণা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে ঠিক করল। ১৪ বছর বয়সের কন্যাটি বুঝতে পারল না কী ঘটেছে, কেন ঘটছে, কিন্তু টের পেল যে তার বাবা তাকে আর ভালোবাসে না, সহ্যই করতে পারে না। মেয়েটির সন্দেহ হলো হয়তো সে তার বাবা-মায়ের সন্তান নয়, মা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছে। হঠাৎ-জাগা উপলব্ধিতে অসহায় মেয়েটি আত্মহত্যা করে বসল। বাবার অকৃত্রিম বন্ধুর সংস্কারচেষ্টার সবটা ভার গিয়ে পড়েছিল নিরুপায় কন্যাটির ওপর, যেটা বহন করার ক্ষমতা তার ছিল না। নষ্ট বাবা ওয়ারল টাকার জোরে যে পরিবারটিকে পথে বসিয়ে দিয়েছে, উপকার করতে গিয়ে আদর্শবাদী ছেলে তাদেরই দিল ছিন্নভিন্ন করে।
বিখ্যাত এ নাটকটির নানা রকমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে; কিন্তু এর বক্তব্যটা খুবই সুস্পষ্ট যে, নষ্ট বাবার আদর্শবাদী ছেলে গ্রেগারস বন্ধুর পরিবারে সংস্কার ঘটাতে গিয়ে যা ডেকে আনল তা ভয়াবহ বিপর্যয় ভিন্ন অন্যকিছু নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে গেলে পরিণতিটা এর চেয়ে ভালো হওয়ার নয়। গ্রেগারস তার বন্ধু হেলমারের উপকার করতে পারত সংস্কারের পথে না গিয়ে, আর্থিকভাবে সাহায্য করে, সে সামর্থ্য তার ছিল। বিজ্ঞানী ডারউইন প্রাকৃতিক জগৎকে পরিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার করার পরে মানবজাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন প্রকৃতিকে নিজের মতো থাকতে দিতে, হস্তক্ষেপ না ঘটাতে; পুঁজিবাদীরা সে পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়নি, তারা প্রকৃতিকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করেছে, যার পরিণতি হচ্ছে বর্তমান দুরবস্থা। বিপদ বহুবিধ। সমুদ্রের পানির উচ্চতা নিয়েও। খবরে জানা যাচ্ছে যে, বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ওই বৃদ্ধি গড়পড়তা বৃদ্ধির তুলনায় অধিক।
মেডিকেল পড়ার জন্য বিদেশি ছাত্ররা আসত; কিন্তু তাদের সংখ্যা বর্তমানে ব্যাপকহারে নেমে এসেছে। ফলে ২ হাজার কোটি টাকার বিদেশি মুদ্রা আয় হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গণপিটুনিতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গত ১০ মাসে গণপিটুনিতে মব ভায়োলেন্সে মৃত্যু ঘটেছে অসংখ্য মানুষের। বজ্রপাতে মৃত্যু তো আছেই; বাড়ছেই; তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিটস্ট্রোকে মৃত্যু। কবরের কংকালরা পর্যন্ত নিরাপদে নেই, বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। সশরীরে উপস্থিত না থেকে কাজ করা উপার্জনের একটি উপায় ফ্রিল্যান্সিং। বাংলাদেশিরাও ওই ফ্রিলান্সিংয়ে আগ্রহী। কিন্তু সুবিধা করতে পারছে না। জানা গেছে, ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান এখন ২৯তম। লজ্জা ও হতাশার খবর হয়ে দাঁড়ায় যখন জানা যায় যে, বিগত সরকারের তিনবার নির্বাচিত একজন এমপি কলকাতায় গিয়ে খুন হয়েছেন তারই ঘনিষ্ঠতম ব্যবসায়ী বন্ধুর ব্যবস্থাপনায় এবং ব্যবসাটা ছিল হুন্ডির এবং স্বর্ণ চোরাচালানের। আমাদের একজন সাবেক সেনাপ্রধান দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হবেন এবং পুলিশের একজন সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা করতে বাধ্য হবে এ খবরও উৎসাহব্যঞ্জক নয়।
অধিকাংশ মানুষেরই আয় যে কমেছে, এ বাস্তবতাও বিষণ্নতার সৃষ্টি করে; বিশেষ করে এ কারণে যে, উন্নতি হচ্ছে কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এ নিয়ে অভিযোগ তো আমরা করেই আসছি। স্বাধীনতার পরে দেশের শিল্পকারখানাগুলোর রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছিল। ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, রাষ্ট্রীয় খাতটাই প্রধান হবে। পরে সে নীতিতে পরিবর্তন ঘটেছে, ব্যক্তিমালিকানাই প্রধান হয়ে উঠেছে। ব্যক্তি মালিকানার তৎপরতার ক্ষেত্রে বড় জায়গাটা হওয়ার কথা ব্যবসা। ব্যবসা এখন চলে গেছে সিন্ডিকেটের হাতে। ছোট ব্যবসায়ীরা সুবিধা করতে পারছেন না। কেউ কেউ ভীষণ বিপদে পড়েছেন।
এমন একজনের কথা বের হয়েছে পত্রিকায়। নাম তার আরিফুল। বয়স বেশি নয়। অল্পবয়সেই সে উপার্জনে বের হয়েছিল। প্রথমে সে বাসাবাড়িতে আসবাবপত্র পরিবহনের কাজ করত। এর পরে এক বন্ধুর পরামর্শে ইট-বালু-পাথর সরবরাহের ব্যবসা শুরু করল। বিপদটা ঘটল তখনই। পুঁজি ছাড়া চলে না, তাই সে ঋণ করল। কিন্তু ব্যবসাটা জমল না। এক সময়ে দেখল সে ১৪-১৫ লাখ টাকা ঋণ করে ফেলেছে। পাওনাদারদের তাগাদায় সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাধ্য হলো আত্মগোপন করতে। নিরুপায় আরিফুল একপর্যায়ে ভেবেছিল দুটি কিডনির একটি বিক্রি করে ঋণ শোধ করবে। কিন্তু গ্রাহক খুঁজে পায়নি। শেষমেশ ঠিক করল ব্যাংকের এটিএম বুথ ভেঙে টাকা সরাবে। ইউটিউবে সে ছবি দেখেছে, ধারণা পেয়েছে কাজটা কীভাবে করা যায়। উদ্ভ্রান্ত আরিফুল যন্ত্রপাতি কিনল। বুদ্ধি খাটিয়ে নির্জন এলাকায় একটি এটিএম বুথকে সে চিহ্নিত করল এবং ঈদের আগের রাতে কাজটায় ব্রতী হলো। কিন্তু নিরাপত্তা প্রহরী তো ছিলেন। তিনি বাধা দিলেন। আরিফুল তার হাতের ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিরাপত্তা প্রহরীকে আঘাত করল। তিনি মারা গেলেন। আরিফুল তখন কী করবে? ভোর হয়ে এসেছে; বাস চলাচল শুরু হয়েছে, চলমান একটি বাসে উঠে সরে পড়ল। কিন্তু সে তো ধরা পড়বেই। ধরা পড়েছেও। আরিফুল সেই কাজই করতে গিয়েছিল ঋণের নাম করে বড় বড় ব্যাংক-ডাকাতরা যা হামেশাই করে থাকে এবং নির্বিঘ্নে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার একটা দিক। এটিও কোনো ছোট বিপদ নয় যে, কোটিপতির সংখ্যা যদিও অবিশ্বাস্য রকমে বেড়েছে কিন্তু লোকে বিনিয়োগে উৎসাহিত হচ্ছে না। শেয়ার মার্কেট প্রাণহীন। লোকে সঞ্চয়পত্র যত কেনে, ভাঙায় তার চেয়ে অধিক সংখ্যায়। একটি দৈনিক সংবাদ-শিরোনাম করেছে ‘বিনিয়োগকারীদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে’।
সরকারি চাকরি হচ্ছে সবচেয়ে লোভনীয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো এখন মনে হচ্ছে যে, পরিণত হয়েছে চাকরির জন্য প্রস্তুতির কর্মশালায়। ওদিকে আবার এমন খবরও পাওয়া যায় যে, চাকরি আছে, কিন্তু প্রার্থী নেই। যেমন এই খবরটি: ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্য পদ ৯৬ হাজার, আবেদন মাত্র ৬৪ হাজার’। আবেদন করার মতো আগ্রহী মানুষ কী দেশে নেই? সেটা তো অবিশ্বাস্য। দেশে শোনা যাচ্ছে জটিলতা এমন যে আবেদন করাই কঠিন। সে জন্য ওই শূন্যতা।
সব মিলিয়ে ছবিটা বিষণ্নতার। জগৎজুড়েই এখন বিষণ্নতা। এর প্রধান কারণ পুঁজিবাদী উন্নয়ন ব্যবস্থাটা বদলাবার চেষ্টা নেই। অথচ পুঁজিবাদের দুর্বৃত্তপনা লম্ফঝম্প দিয়ে বাড়ছে। তাই হতাশা এবং হতাশা থেকে বিষণ্নতা। ব্যবস্থাটা বদলাবার জন্য প্রথম প্রয়োজন ব্যবস্থাটাকে ঘৃণা করা। ব্যক্তিগতভাবে তো বটেই, সমষ্টিগতভাবেও। ঘৃণা দরকার ভালোবাসার প্রয়োজনে। ভালো ব্যবস্থার প্রতি ভালোবাসার কারণেই নষ্ট ব্যবস্থাটাকে প্রত্যাখ্যান করা চাই। সে জন্যই প্রশ্নটা থাকে: মানুষ কী এ ব্যবস্থাকে ক্ষমা করে দিয়েছে; যে প্রশ্নটা রবীন্দ্রনাথ একদা করেছিলেন। ক্ষমা করে দিলে আর যা-ই ঘটুক, মুক্তি আসবে না; এবং ব্যবস্থা ও অবস্থা দুটোই আরও খারাপ হতে থাকবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়