
ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি, কলকাতায় অমিত শাহ। বিজেপির শীর্ষ নেতারা ২০২৬ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক এক বছর আগে বঙ্গবিজয় অভিযানে নেমে পড়েছেন। নানা কারণে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গ এবং তামিলনাড়ু হচ্ছে বিজেপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বাংলার মাটি কি বিজেপিকে জায়গা দেবে? এটাই হলো বড় প্রশ্ন। কারণ বিজেপির কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতারা মুখে যাই বলুন না কেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর পাশে আছেন খোদ আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত। একাধিকবার তিনি মন্তব্য করেছেন- পশ্চিমবঙ্গে কোনো মুখ্যমন্ত্রীর আমলেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের এত বাড়বাড়ন্ত ছিল না। সে কারণে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি তার কৃতজ্ঞতা গোপন করেননি।
বঙ্গ সফরে এসে তৃণমূলকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন অমিত শাহ। দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার বার্তাও দেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানায় এনে শাহ বলেন, ‘রিগিং ছাড়া বাংলায় ভোট করালে জামানত জব্দ হবে।’ কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে বিজেপির সাংগঠনিক সভা থেকে অমিত শাহ বলেছেন, মা-মাটি-মানুষের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তার শাসনে বাংলায় দুর্নীতি, অনুপ্রবেশ, নারী নির্যাতন, বোমা বিস্ফোরণ, হিন্দুদের ওপর অত্যাচার বেড়েছে।
কদিন আগে বাংলায় সভা করতে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেদিন অপারেশন সিঁদুর নিয়ে মোদিকে চরম কটাক্ষ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তীব্র শ্লেষের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘বাংলায় সিঁদুর বেচতে এসেছেন... আগে নিজের স্ত্রীকে গিয়ে সিঁদুর পরান।’ দিদির সেই কথা যেন শলার মতো বিঁধেছিল বিজেপিকে। বাংলায় এসে তারই জবাব দিতে চাইলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। নেতাজি ইনডোরে বিজেপির সংকল্প সভা ছিল। সেই সভামঞ্চে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে অমিত শাহ বলেছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে আপনি প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে ‘জঘন্য’ কথা বলেছেন। সিঁদুরের অপমান করেছেন। মা-বোনেরা এর জবাব আপনাকে দেবে।
সিঁদুরের প্রশ্নেই অমিত শাহ বলেছেন, পাহালগামে নিরীহ পর্যটকদের সন্ত্রাসবাদীরা গুলি করে মেরেছিল। তার জবাবে পাকিস্তানে কয়েক শ জঙ্গিকে খতম করেছে ভারত। কিন্তু জঙ্গিরা মারা গেলে তো দিদির পেটে ব্যথা করে। আর বাঙালি পর্যটককে যখন জঙ্গিরা হত্যা করে তখন উনি কিছুই বলেন না। সংখ্যালঘু তোষণের প্রশ্নেও তৃণমূলের তীব্র সমালোচনা করেছেন অমিত শাহ। তার বক্তৃতার অধিকাংশ সময়জুড়েই ছিল ‘তৃণমূল সরকারের তোষণনীতি’ নিয়ে সওয়াল-জবাব। অমিত শাহ অভিযোগ করেন, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারই দায়ী। তার কথায়, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জন্য জমি লাগবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ইচ্ছে করে জমি দিচ্ছে না। যাতে বাংলাদেশ থেকে লাগাতার অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে এবং তৃণমূলের ভোটব্যাংকের রাজনীতি চলতে থাকে।
ঠিক সময়ে বিধানসভা নির্বাচন হলে আর ১০ মাসও বাকি নেই। তার আগে নেতাজি ইনডোরে বিজেপির সংকল্প সভা থেকে দলের কর্মীদের কিছুটা ভোকাল টনিক দিয়ে গেছেন কেন্দ্রীয় অমিত শাহ। তার কথায়, বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির আর বিশেষ ফারাক নেই। মাত্র কয়েক শতাংশ ফারাক রয়েছে ভোটের। যে ফারাক ছাব্বিশেই মুছে যাবে। অমিত শাহর নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় এও স্পষ্ট হয়েছে যে, তৃণমূলের সঙ্গে সেই ফারাক মুছতে উগ্র মেরুকরণের পথেই হাঁটবে বিজেপি। বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বিষয়-আশয়, তথা দুর্নীতি, অরাজকতার মতো বিষয় তাদের প্রচারে থাকবে ঠিকই। কিন্তু কেকের ওপর টপিংয়ের মতোই থাকবে উগ্র মেরুকরণের রাজনীতি, সংখ্যালঘু তোষণ, অনুপ্রবেশ, হিন্দুদের ওপর হামলা ইত্যাদির প্রশ্নে তীব্র তৃণমূলবিরোধিতা।
কদিন আগে উত্তরবঙ্গে জনসভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেদিন প্রধানমন্ত্রী একবারের জন্যও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম মুখে আনেননি। কিন্তু অমিত শাহর কৌশল ছিল বিপরীত। তিনি সরাসরি নিশানা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নেতাজি ইনডোরের সভায় দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দিদি আমার গুনে নিন, আপনার সময় ঘনিয়ে এসেছে, ছাব্বিশেই বিদায়।’ সেই সঙ্গে শাহ বলেন, টিএন সেশন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর থেকে সর্বভারতীয় স্তরে ভোগ হিংসা বন্ধ হয়ে গেছে। একমাত্র বাংলাতেই তা বন্ধ হয়নি। ‘দিদি হিম্মত থাকলে হিংসা, রিগিং বাদ দিয়ে ভোট করে দেখুন আপনারও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে’। বাংলায় বুথ স্তরে বিজেপির সংগঠন এখনো তৃণমূলের চেয়ে অনেক দুর্বল।
বিজেপি অভিযোগ করে, নিচুতলায় তৃণমূলের হিংসা ও পুলিশের অত্যাচারে বুথস্তরে রাজনৈতিক কর্মসূচি নেওয়াই দুষ্কর। ভোটের দিন বড় ব্যবধান গড়ে দেয় এসব বিষয়। সম্ভবত সে কারণেই এদিন অমিত শাহ ভোটে হিংসা ও রিগিংয়ের প্রসঙ্গ তোলেন। সেই সঙ্গে দলের কর্মীদের অভয় দিয়ে বলেন, চিন্তা করবেন না, আমি কথা দিচ্ছি, বিজেপি ক্ষমতায় এলে তৃণমূলের এ গুণ্ডাদের দরকার হলে কবর খুঁড়ে তুলে এনে শাস্তি দেবে।
চার বছর পর বাংলায় ফের বিধানসভা ভোট আসন্ন। সময়ে নির্বাচন হলে ছাব্বিশ সালের এপ্রিল মাস নাগাদ শুরু হয়ে যাবে গণতন্ত্রের সেই উৎসব। তার আগে বাংলায় রাজনৈতিক সভা করতে এসে প্রধানমন্ত্রী মোদি আর সেই পুরোনো পথে হাঁটেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা দিদির নাম একবারের জন্য মুখেও আনেননি। তবে রাজ্যে তৃণমূল সরকারকে নির্মাণ আখ্যা দিয়ে বাংলায় পাঁচ সংকটের কথা ব্যাখ্যা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে তার আশ্বাস, বিজেপি বাংলায় ক্ষমতায় এলে বিকশিত ভারতের মতো এ রাজ্যও বিকশিত হবে। সুশাসন ও সমৃদ্ধির গ্যারান্টি দেবে বিজেপি সরকার।
আলিপুরদুয়ারের ওই সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বর্তমান সময় বাংলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বহু রকমের সংকট এখন বাংলাকে ঘিরে রেখেছে। প্রথম সংকট হলো- সমাজে হিংসা ও অরাজকতা। দ্বিতীয় সংকট হলো- মা-বোনেদের নিরাপত্তাহীনতা ও তাদের ওপর অত্যাচার। তিন নম্বর উদ্বেগ হলো- নতুন প্রজন্মের মধ্যে হতাশা ও কর্মসংস্থার তথা জীবিকার অভাব। চতুর্থ সংকট- বেলাগাম দুর্নীতি। তার ফলে সরকারি ব্যবস্থার ওপর থেকে মানুষের বিশ্বাসই উঠে যাচ্ছে। আর পঞ্চম সংকট হলো- গরিবের অধিকার ছিনিয়ে নিতে তৃণমূলের স্বার্থপর রাজনীতি’।
অনেকের ধারণা ছিল, আলিপুরদুয়ারের সভা থেকে বাংলাদেশের প্রতিও কিছুটা আক্রমণাত্মক হবেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলায় দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকের এই প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে নিশানা করেননি মোদি। বরং গত কয়েকদিন ধরে অপারেশন সিঁদুরের প্রশ্নে যেভাবে পাকিস্তানের উদ্দেশে কড়া কথা শোনাচ্ছেন, তাই অব্যাহত রেখেছেন। তার কথায়, এই বাংলা হলো সিঁদুর খেলার মাটি, এখানে দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর কথা তো বলতেই হবে। তবে পাক প্রসঙ্গের তুলনায় বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা করতেই অধিক সময় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘এখানে এই যে গরিব মানুষের ওপর রোজ অত্যাচার হচ্ছে, তাতে বাংলার সরকারের কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। সব ব্যাপারে আদালতকে মাথা গলাতে হয়। আদালতের হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনো কিছুতেই সুরাহা পাওয়া যায় না’। এর পরই স্লোগান তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাই ‘বাংলার চিৎকার, লাগবে না নির্মম সরকার।’
অনিবার্যভাবেই শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির প্রসঙ্গও তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘দুর্নীতির সব থেকে খারাপ প্রভাব যুব সম্প্রদায়ের ওপর পড়ে। দুর্নীতি কীরকম বিপর্যয় ডেকে আনে তা শিক্ষক নিয়োগদুর্নীতিকাণ্ডে দেখেছি। তৃণমূল সরকার হাজার হাজার শিক্ষকের পরিবারকে বরবাদ করে দিয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েকে অসহায় করে দিয়েছে, অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। এ শুধু কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা নয়, গোটা বাংলায় শিক্ষাব্যবস্থা ওরা তছনছ করে দিয়েছে। এ হলো মহা পাপ।’
প্রধানমন্ত্রীর অতীতের সব রাজনৈতিক বক্তৃতার সঙ্গে এদিনের বক্তৃতায় তেজ ও শ্লেষ তুলনায় অনেকেরই কম ঠেকেছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকের মতে, ভোটের এখন মেলা বাকি। তাই হয়তো আগে থেকেই সুর সপ্তমে না চড়িয়ে মেপে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভোট যত এগোবে ততই তার কথার ধার হয়তো বাড়তে বাড়তে যাবে। বক্তৃতার শেষে দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে মোদি বলেছেন, এবার দায়িত্ব অনেক। একমাত্র বিজেপিই যে সুশাসন ও সমৃদ্ধির গ্যারান্টি দিতে পারে এবং এই নির্মম সরকারের থেকে মুক্তি দিতে পারে তা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাতে হবে। তাই আরও জোরদারভাবেই কাজে লাগতে হবে। সময় নষ্ট করার সময় আর নেই।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক