
একদা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের নয়নমণি, দিগন্তজোড়া সোনালি বালুতট আর সারি সারি নারকেল গাছের শ্যামল শোভায় মুখরিত কক্সবাজার আজ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এক বিপর্যস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। ভ্রমণপিপাসুদের চোখে ঝলমলে অবকাশ যাপনের স্থান হলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে এই সমুদ্রতীরবর্তী শহর ক্রমশঃ বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে; যেখানে নেই কোনো সুসংহত বর্জ্যব্যবস্থাপনা, কার্যকর পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, মসৃণ সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা, উপরন্তু যুক্ত হয়েছে মাদক সমস্যা, অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, অপহরণ ও খুন, ছিনতাই, ডাকাতির মতো ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি।
প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি দেশি-বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে এ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা শহরে। এ জনবহুল গন্তব্য প্রায় আড়াই লাখ স্থানীয় মানুষের স্থায়ী আবাসস্থল। এ ছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে কর্মরত কয়েক হাজার দেশি-বিদেশি সাহায্যকর্মী এখানে বসবাস করেন। পর্যটনশিল্পের অভাবিত বৃদ্ধি, যদিও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কক্সবাজারে অপরিকল্পিত নগরায়ণকে ত্বরান্বিত করেছে, যা এক সময়ের শান্ত সৈকত শহরটিকে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত এক ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর এলাকায় রূপান্তরিত করেছে। যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকা গৃহস্থালির আবর্জনা, রাস্তায় উপচে পড়া দূষিত পানি, আর নদীতে ফেলা অপরিশোধিত পয়োপ্রণালি অপরিকল্পিত পর্যটনের জোয়ারে এ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় স্বর্গভূমির পরিবেশ ও প্রতিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে।
কক্সবাজার শহর ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা, বিশেষত কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিতে ভয়াবহ যানজট এখানকার ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দৃষ্টিনন্দন উপকূলীয় পথটি বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের- ব্যক্তিগত গাড়ি, যাত্রীবাহী বাস, ধীরগতির রিকশা, দ্রুতগামী মোটরসাইকেল এবং নির্মাণশিল্পের মালবাহী ট্রাকের এক বিশৃঙ্খল মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দুর্বল ট্র্যাফিকব্যবস্থা, সরু ও জরাজীর্ণ রাস্তা এবং বিশেষ করে পর্যটন মৌসুম ও বাজার সময়ে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে প্রায়শই অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হয়। এক সময়ের মনোরম পারি পথ আজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থবির হয়ে থাকে, যা পর্যটকদের ভ্রমণকে তিক্ত করে তোলে এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তোলে।
এই দ্রুত ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের পরিবেশগত পরিণতিও অত্যন্ত উদ্বেগজনক। গৃহস্থালির আবর্জনা রাস্তাঘাট ও উন্মুক্ত স্থানে স্তূপীকৃত হয়ে থাকে, যা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করে। দূষিত পানি নর্দমা উপচে রাস্তায় বন্যার সৃষ্টি করে, এবং অপরিশোধিত পয়োপ্রণালি সরাসরি নদী ও সাগরে ফেলা হয়, যা এক সময়ের স্বচ্ছ পানিকে দূষিত জলাধারে পরিণত করে। বর্জ্যব্যবস্থাপনা ও স্যানিটেশনের প্রতি এই চরম অবহেলা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এ স্বর্গভূমির পরিবেশ ও প্রতিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যে সৈকত পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ, তা ক্রমশ আবর্জনায় ভরে উঠছে, যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কমিয়ে সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। প্রাকৃতিক নিষ্কাশন নালা ধ্বংসের কারণে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা বাড়িয়ে তোলে এবং অঞ্চলের সূক্ষ্ম পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করে।
মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণ নিঃসন্দেহে যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে, তবে মনোরম উপকূলীয় দৃশ্য উপভোগের সুযোগ বাধাগ্রস্ত করেছে। এর উন্নয়নের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাবের বিষয়টি যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে, এ সড়ক নির্মাণের জন্য পাহাড় কাটা হয়েছে, বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে, যা স্থানীয় প্রতিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। সমুদ্রতীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে যথাযথ পরিকল্পনা ও নজরদারির অভাব পরিলক্ষিত হয়।
কক্সবাজারের ক্রমবর্ধমান সমস্যাগুলোর মধ্যে মাদক সমস্যা একটি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সহজলভ্য মাদকদ্রব্য বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। পর্যটন এলাকা এবং এর আশপাশে মাদকের চোরাচালান ও বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা শুধু সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে না, বরং অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যকলাপকেও উৎসাহিত করছে।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ। মাদকের কারবার এবং অন্যান্য অবৈধ ব্যবসার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অবৈধ অস্ত্রের আনাগোনা বেড়েছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে, যা স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে এবং পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
অপহরণ ও খুন কক্সবাজারের সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম উদ্বেগের কারণ। বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়ের মতো ঘৃণ্য অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। তুচ্ছ ঘটনা থেকেও খুনের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, যা আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি নির্দেশ করে। পর্যটন এলাকায়ও অপহরণের ঘটনা শোনা যায়, যা এই অঞ্চলের ভাবমূর্তিকে কলুষিত করছে।
দৈনন্দিন জীবনে ছিনতাই ও ডাকাতি এখানকার সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাতে তো বটেই, দিনের বেলায়ও ছিনতাইকারীরা পথচারীদের সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকায় ডাকাতির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকাকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। পর্যটকরাও প্রায়শই ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছেন, যা তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে তিক্ত করে তোলে এবং নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
দ্রুত অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কক্সবাজারের সামাজিক রূপান্তর ঘটছে। বহিরাগতদের আগমন এবং পর্যটন অর্থনীতির প্রভাব স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে দুর্বল করে দিচ্ছে। মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং অপরাধ প্রবণতার বৃদ্ধি সামাজিক অস্থিরতা বাড়াচ্ছে। অর্থনৈতিক রূপান্তর সত্ত্বেও স্থানীয় জনগণের একটি বড় অংশ উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা অসন্তোষ ও বৈষম্য সৃষ্টি করছে।
নারীর নিরাপত্তা ও অধিকারের ক্ষেত্রে কক্সবাজার এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। নারী নিপীড়ন এখানকার একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায় এমনকি নিজ গৃহেও নারীরা বিভিন্ন ধরনের হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। পর্যটন এলাকায় নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও শোষণের ঘটনাও উদ্বেগজনক।
রোহিঙ্গা শরণার্থীসংকটের কারণে কক্সবাজারের পরিবেশ ও অর্থনীতির ওপর যে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা এখানকার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর উপস্থিতি এবং ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার ফলে শহরের সীমিত সম্পদ ও অবকাঠামোর ওপর চরম চাপ পড়েছে।
কক্সবাজারের এ ক্রমবর্ধমান বিশৃঙ্খলা রোধে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য নীতি-নির্ধারকদের অবিলম্বে একটি সুদূরপ্রসারী ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণ, টেকসই পর্যটননীতি প্রণয়ন, কঠোর ট্র্যাফিকব্যবস্থাপনা, কার্যকর বর্জ্যব্যবস্থাপনা, পরিবেশ সুরক্ষা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি- এসব বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া অপরিহার্য। মাদকব্যবসা, অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, অপহরণ, খুন, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ভয়াবহ অপরাধ দমনে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। নারী নিপীড়ন বন্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পর্যটন সম্ভাবনাকে টিকিয়ে রাখতে হলে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে। টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ, বর্জ্যব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। পর্যটকদের জন্য উন্নতমানের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা, নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা এবং একটি বহুমুখী পর্যটন আকর্ষণকেন্দ্র হিসেবে কক্সবাজারকে গড়ে তোলার জন্য আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বলা যায়, কক্সবাজারের পর্যটনশিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সঠিক পরিকল্পনা, পরিবেশের সুরক্ষা, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি এবং স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদের সহযোগিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এ শিল্প শুধু জাতীয় অর্থনীতিতেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে না, বরং একটি শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে তার স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হবে। প্রয়োজন শুধু সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং একটি টেকসই ও দায়িত্বশীল পর্যটননীতি বাস্তবায়ন। অন্যথায়, এক সময়ের সম্ভাবনাময় এ পর্যটন নগরী ক্রমশঃ বিশৃঙ্খলার আবর্তে হারিয়ে যাবে।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী