
বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখন খুবই প্রতিযোগিতামূলক। শ্রমবাজার থেকে শুরু করে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংকিংব্যবস্থা সবকিছুই প্রতিযোগিতামূলক। আমরা যদি মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই, তাহলে বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং বিশ্ব নাগরিক হওয়ার যে বিষয়গুলো আছে- সেগুলো শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হওয়ার জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা থাকা দরকার। শিক্ষা কমিটি বা কমিশন যাই হোক না কেন- সবাই শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থার ভালোর জন্য, উন্নতির জন্য সুপারিশ করার পরও সেগুলো বাস্তবায়িত না হওয়ার একটি বড় কারণ হলো, আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে সরকার ওলট-পালট হয়েছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, ভালোমন্দ না দেখে পূববর্তী সরকারের সব বিষয়কে মোটামুটি অকার্যকর করে ফেলেছে। পরবর্তী সরকার এসে আবার নতুন করে সবকিছু করেছে। তাছাড়া বিগত সময়ে বাংলাদেশ অনেক বেশি বৈদেশিক অনুদাননির্ভর ছিল। ফলে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় একটি প্রতিবন্ধকতা ছিল। অনেক সময় দাতা দেশগুলোর কথা ও ইচ্ছায় তাদের কথা মতো চলতে হয়েছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে আমি বলব, একটি অগ্রসরমুখী চিন্তাভাবনাসহ আরও অনেক কিছু করা দরকার। শিক্ষাক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা ও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা যদি স্বপ্ন দেখি উন্নত বিশ্বের দিকে যাওয়ার, তাহলে শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে। মান নির্ধারণের বড় একটি জায়গা হলো মূল্যায়ন পদ্ধতি। আমাদের যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেটি হলো লেখাপড়া নোটবইভিত্তিক অথবা শিক্ষকরা নোট দেবেন; শিক্ষার্থীরা সেগুলো পড়ে সমাপনী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। শিক্ষাক্ষেত্রে যথার্থ বিনিয়োগ প্রয়োজন। শিক্ষায় বিনিয়োগের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এমনিতেই শিক্ষা সরঞ্জামের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি। এর ফলে শিক্ষার্থীদের নানারকম বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। পরিবারকে শিক্ষা সরঞ্জামগুলোর ব্যয়ভার বহনে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। বিশ্বব্যাপী নারীরা এ প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে আছে। ইউনেস্কোর রিপোর্টেও একই তথ্য উঠে এসেছে। যেখানে ছেলেদের অংশগ্রহণ ৬০ শতাংশের ওপর, সেখানে নারীদের অংশগ্রহণ ৩০ শতাংশেরও কম। নারী-পুরুষ ও ধনী-দরিদ্রের একটা বৈষম্য আমরা দেখেছি। তরুণ প্রজন্মকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তাদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে বৈষম্য দূর করে দিতে হবে।
শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। শিক্ষা খাতে বরাদ্দকৃত বাজেট দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নিম্নতম। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলো সেদিক থেকে অনেক বেশি অগ্রগামী, বিশেষ করে ভারতের কথা বলা যায়। এখন পর্যন্ত শিক্ষায় আমাদের বিনিয়োগ জাতীয় আয়ের খুবই সামান্য অংশ, যা অবশ্যই কয়েক গুণ বাড়ানো দরকার। আমি মনে করি, আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাস্তব বিষয়গুলো আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থাপনায় আমাদের বড় বড় মেগা প্রকল্প দরকার। কারিগরি শিক্ষায় কর্মসংস্থান বাড়াতে বৈষম্য কমানোর জন্য প্রযুক্তি এবং কারিগরি শিক্ষাকে আরও এগিয়ে নিয়ে আসা দরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা বিশেষ প্রকল্পই আছে এটার জন্য। বিশেষ করে শিক্ষা গবেষণা উন্নয়নে আমরা সঠিক মাত্রায় বিনিয়োগ দেখি না। বিগত সময়ে বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা না করে ঠিকাদারদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব প্রজেক্ট বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা মতানৈক্য আগে প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশ কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ করে কত বড় সাফল্য দেখিয়েছে। একইভাবে শিক্ষা গবেষণায় বিনিয়োগটা খুব দরকার।
সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন-পরিমার্জন হচ্ছে এবং অবশ্যই তা হতে হবে। দেশে যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, নীতিনির্ধারক যারা আছেন, তারা প্রতিনিয়তই চেষ্টা করছেন। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি এত সহজ কাজ নয় যে, চাওয়া মাত্রই সেটি দ্রুত বাস্তবায়িত করে ফেলা সম্ভব। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার অংশ । সে লক্ষ্যে আমাদের কাজ করে যেতে হবে এবং সুফল পেতে সময় দিতে হবে।
দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় অনেকদিন কোনো সংস্কার হয়নি। দিনের পর দিন একইভাবে চলতে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। ক্রমপরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে আমরা বদলাইনি। ছাত্রছাত্রীদের শ্রেণিকক্ষে সঠিক পাঠ না দিয়ে, পরীক্ষার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোচিংবাণিজ্যের মাধ্যমে গাইড বইনির্ভর একটি সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে। যেটি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে দেখা যায় না। পৃথিবীর বহু উন্নত দেশ আছে যেখানে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীর মান নির্ধারণ হয় না কিংবা দক্ষতা যাচাই হয় না। শ্রেণিকক্ষভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়নের মধ্যদিয়ে অর্থাৎ নিয়মিত মূল্যায়নপ্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে দক্ষতা যাচাই হয়। শিক্ষার ভিত্তিটুকু শক্ত করতে হলে আমাদের প্রধানত তিনটি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। দক্ষ শিক্ষক, সক্ষম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নিয়মিত মনিটরিং ইত্যাদি।
শিক্ষাব্যবস্থা সময়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। মানুষের চাহিদা এবং যুগের প্রয়োজনে এটি পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা উচিত। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ন্যূনতম কতগুলো বিষয়ে অবশ্যই জ্ঞান অর্জন করতে হবে। একই সঙ্গে প্রত্যেক শ্রেণির ক্ষেত্রে পড়ালেখার পাশাপাশি দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাক্রম বিশ্বব্যাপী চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। বলাবাহুল্য শিক্ষাক্রমে কোনো বিভাজন থাকা উচিত নয়। বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভাজন করেই শিক্ষার্থীদের আমরা আরেকটি ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিয়েছি। আমি মনে করি, শিক্ষাক্ষেত্রে বিভাজনের কোনো দরকার নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো পরিবার থেকে শিক্ষার্থীদের বিকাশ শুরু করতে হবে। মা-বাবাকে তার সন্তানদের দিকে নজর দিতে হবে। সেই নজর দেওয়া বলতে তাদের মেধা সুস্থভাবে বিকাশ হচ্ছে কি না প্রথমেই সেদিকটা দেখতে হবে। তার পরের দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। আমাদের দেশে শিক্ষকরা শিক্ষাদানে যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষ নয়। বিশ্বমানের শিক্ষার্থী তৈরি করতে শিক্ষকদের দক্ষ করে তৈরি করা দরকার। তাছাড়া পুঁথিগত বিদ্যা ও মুখস্থবিদ্যা থেকে শিক্ষার্থীদের সরে আসতে হবে। আমরা যদি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারি, পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সাথে না বদলাই, তাহলে বিশ্বায়নের যুগে আমাদের শিক্ষার্থীরা আরও পিছিয়ে যাবে।
লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা